জুম’আর খুতবা-৪০
০২/০৪/২০২১
ড. মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন
খতিব, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা জামে মসজিদ
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
وَيْلٌ لِّـكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةِ ۙ
দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে
اۨلَّذِىْ جَمَعَ مَالًا وَّعَدَّدَهٗ ۙ
যে অর্থ জমায় ও উহা বারবার গণনা করে;
(সূরা হুমাযাহ: ১-২)
সম্মানিত মুসল্লিয়ান,
শাবান মাসের মধ্যভাগে আল্লাহ তায়া’লার ইবাদত বন্দেগিতে শামিল হতে পেরে আমরা শুকরিয়া জানায় আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তায়া’লার কাছে ক্ষমা চাই, প্রত্যাবর্তন করছি, সকল জানা অজানা, গোপন প্রকাশ্য গুনাহর ব্যাপারে। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুক, আমীন। আল্লাহ তায়া’লা দয়াময়, ক্ষমাশীল যিনি এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আমাদেরকে হায়াত দিয়েছেন, সুস্থতা দিয়েছেন, আমাদের নাফরমানি অফুরন্ত তারপরও বি-ব্লকের এই মসজিদের বাসিন্দা করেছেন এই নেয়ামতের শুকরিয়া ভাষায় প্রকাশ করা যায় আমাদের জানা নেই, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। পবিত্র রমজানের প্রস্তুতি গ্রহনের বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।
সম্মানিত হাজেরীন,
বারবার আমাদেরকে স্মরণ করতে হয় সেই কথা وَّمَا تَدْرِىْ نَـفْسٌۢ بِاَىِّ اَرْضٍ تَمُوْتُ (সূরা লোকমান-৩৪) কোন প্রাণীই জানেনা কোন জমিনে, কোন বাসস্থানে, কোন হাসপাতালে তার সমাপনী হবে। وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ اَنْ تَمُوْتَ اِلَّا بِاِذْنِ اللّٰهِ كِتٰبًا مُّؤَجَّلًا (সূরা আল ইমরান-১৪৫) রাজা মহারাজা অনেক হতে পারে কিন্তু এক সেকেন্ড পরে যাওয়ার ক্ষমতা কি কারো আছে? কোন দেশের হাসপাতালে মৃত্যু হবে তা কি কেউ বলতে পারবে?
যে দেশেই যায় না কেন এই ক্ষণস্থায়ী চিত্তাকর্ষক জীবন ছেড়ে যেতেই হবে। রমজান মাস আসছে একথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, অনেক সুযোগ অবকাশ আল্লাহ পাক আমাদের দিয়েছেন। কিন্তু আনুগত্য কি পরিমাণের, কৃতজ্ঞতা কি পরিমাণের চিন্তা করা উচিত। প্রতি মুহুর্তে, প্রতি দিবসে অনুধাবন করা উচিত, হতে পারে এই দিবস শেষ সময়, হতে পারে জীবনের শেষ জুম’আহ।
আল্লাহ আমাদের সতর্ক করছেন… لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُوْنَ (সূরা সেজদাহ-২১) বান্দারে একটু সতর্ক হবে! একটু বিবেককে শাণিত করবে! কুপ্রবৃত্তিকে একটু দমন করে বিবেককে কি একটু জাগ্রত করবে না?
কেন বান্দারা এগিয়ে আসবে না?
وَتُوْبُوْۤا اِلَى اللّٰهِ جَمِيْعًا اَيُّهَ الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ (সূরা নূর-৩১) বান্দারে সফলতা চাও, দীর্ঘ হায়াত চাও, তওবা কর প্রত্যাবর্তন কর। আমার দিকে ফিরে আস। প্রত্যেকটা ক্ষণকে জীবনের সর্বশেষ সময় মনে কর। وَالْعَصْرِۙ اِنَّ الْاِنْسَانَ لَفِىْ خُسْرٍۙ (সূরা আসর:১-২) প্রত্যেকটা ক্ষণের শপথ, প্রত্যেকটা মুহুর্তের শপথ, হে বনি আদম, হাজার কোটি কোটি বছরের সফলতা ব্যর্থতার জন্য যে সীমিত সময় তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। মহা ক্ষতিতে নিমজ্জিত আছো।
তাই একটু আমরা প্রত্যাবর্তন করি, রমজান মোবারকের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই। পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, শারিরীক সুস্থতা আল্লাহর কাছে কামনা করি। রহমতের নবী সঃ দয়াপরবশ হয়ে উপদেশ দিচ্ছেন, যখন শাবানের প্রথমার্ধ শেষ হয়ে যায় দ্বিতীয়ার্ধ এসে যায় তখন তোমরা রোজা রেখো না। কেন?
রমজান মাসে সুস্থতা দরকার, যাতে ফরজ ছুটে না যায়। সারারাত ওয়াইজ করলাম, নফল আদায় করলাম হাজার রাকাত কিন্তু ফরজ ছুটে যায় বড়ই ব্যর্থ, বড়ই মুর্খতায় নিমজ্জিত, বড়ই দুর্ভাগ্য। তবে হা, শারিরীক সুস্থতা আছে, সামর্থ্য আছে, ফরজ ছুটবে না এই আত্মবিশ্বাস আছে তার জন্য অসুবিধা নাই। সুস্থতার জন্য সতর্ক থাকবেন, চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। রাসুল সঃ এই শিক্ষা দিচ্ছেন, রমজানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
রমজানের জন্য বাহ্যিক অভ্যন্তরীন মনের পরিচ্ছন্নতা, রুহের আত্মিক শক্তি অর্জনের জন্য চেষ্টা করা উচিত। সে আত্মিক শক্তি অর্জনের জন্য বড় উপায় হচ্ছে, সম্পদের আকর্ষণ কমানো, অধিক দান সদকা করা। وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَـفْسِهٖ فَاُولٰٓٮِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَۚ (সূরা হাশর-৯) ধন সম্পদ বের করতে চাই না, মনে হয় যেন মসজিদে ৫০ টাকা দিলে ১ লক্ষটাকা ক্ষতি হয়ে যাবে, নানান ভয় ভীতি হতে মনকে বিরত রাখতে পারে দান সদকা। অধিক দান সদকা দিয়ে মনকে পবিত্র করে যারা, আল্লাহ বলেন, তারাই সফলকাম।
বারবার প্রতারণায় পরে থাকি, সম্পদের আকর্ষণ, আগামীকালের আকর্ষণ কিন্তু আগামীকাল আমার ঠিকানা অন্ধকার প্রকোষ্ঠে হতে পারে। এজন্য আল্লাহ বলেন, اِنَّمَاۤ اَمْوَالُـكُمْ وَاَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ ؕ وَاللّٰهُ عِنْدَهٗۤ اَجْرٌ عَظِيْمٌ (সূরা তাগাবুন-১৫) এ কথা অন্তরে গেঁথে রাখো, জেনে রাখো, তোমার ধনবল জনবল বাহ্যিক চাকচিক্য সবকিছুই প্রতারণার হাতিয়ার, হাজার বছরের আগুনের জ্বালানি আসল সফলতা তো তোমার প্রভুর কাছে।
রাসুল সঃ বলেন, আমার উম্মতের যতো নর নারী ধরাশায়ী হয়েছে হবে তার প্রধান কারণ সম্পদের আকর্ষণ। দান সদকা করে না, হিসাব করে যাকাত দেয় না, আল্লাহর ওয়াস্তে খরচ করে না। লোক দেখানো ভাব নিয়ে দেয়, পার্থিব স্বার্থের উদ্দেশ্যে দেয়। বারবার ধোঁকায় পরে, এ সম্পদ অনেক দিন থাকবে, অথর্ব। আল্লাহ বলেন, وَيْلٌ لِّـكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةِ ۙاۨلَّذِىْ جَمَعَ مَالًا وَّعَدَّدَهٗ ۙ يَحْسَبُ اَنَّ مَالَهٗۤ اَخْلَدَهٗ (সূরা হুমাযাহ: ১-২) ধ্বংস অনিবার্য, চড়ম ভোগবাদী, হাজার কোটি বছরের আগুনের সেই ভয়াবহ চিত্র, সে ব্যাক্তির জন্য যে পিছনে গীবত করে সামনাসামনি লাঞ্ছিত করে আর এই স্বার্থান্বেষীদের একটি পরিচয় হচ্ছে اۨلَّذِىْ جَمَعَ مَالًا وَّعَدَّدَ সম্পদের মোহ, লাখপতি হতে কোটিপতি হবো, বাড়তে থাকবে কমতে পারবে না! কেন?
يَحْسَبُ اَنَّ مَالَهٗۤ اَخْلَدَهٗ সারাবিশ্ব সব চিকিৎসক একত্রিত হয়ে চিকিৎসা করে হায়াত বাড়াবে। চড়ম মূর্খতার পরিচয়, চড়ম বোকামি এই ভাবনা। পরিণাম কি?
كَلَّا لَيُنْۢبَذَنَّ فِى الْحُطَمَةِ (সূরা হুমাযাহ-৪) সুদেআসলে তার জীবনের চিত্র ফুটে উঠবে, ভয়াবহ অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত করা হবে তারপর বুঝবে কি ফজিলত তার এই সম্পদের।
এই সব জাহান্নামবাসীদের আবাসস্থলে আসার তিনটি কারন…
প্রথমত, রাতভর ইবাদত করে, কত নফল বন্দেগি কিন্তু নামাজের পাহারাদারীতে নাই। ফজরের নামাজে হাজিরা নাই। দ্বিতীয়ত, দান সদকা করে মিসকীনদেরকে লোক দেখানোর জন্য। কত শিক্ষিত লোক হাত পাততে পারছে না। অভাবী, এক বেলা খায় এক বেলা খায় না, আহা কাউকে বলতে পারেনা। ভদ্রতার খাতিরে পরিস্কার জামা কাপড় পরে, কিন্তু বাসা ভাড়া চালাতে পারে না বড়ই অভাব তাদের খোঁজখবর নাই। নিকট আত্মীয়দের কোন খোঁজখবর নাই, কিভাবে কাটছে তাদের দিন এই মহামারিতে তার কোন খোঁজ নাই। সর্বশেষ, দুনিয়ার উপর মহামারি চলছে, প্রতিদিন মানুষ মরছে লাখো লাখো সে আড্ডাবাজিতে আছে ফুর্তিতে আছে। ডিশের সংযোগ নিয়ে, জাহান্নামীদের অনুষ্ঠান নিয়ে আনন্দ উপভোগ করছে। এমন হিতাহিত জ্ঞানহীন, বিবেকহীন।
এমন ভয়াবহ আগুন এই জাহান্নামে, মুখ ঝলসে দিবে শরীর ঝলসে দিবে। সত্যকথা, পরকালীন কথা শুনে, জুম’আর আলোচনা শুনে একটু মুচকি হাসি দেয়, বাইরে গিয়ে অট্টহাসি দেয়, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়, খতিব সাহেবেরও মাথা পাগল আমাদেরকেও পাগল বানায়, নাউজুবিল্লাহ। كَلَّا لَيُنْۢبَذَنَّ فِى الْحُطَمَةِ আল্লাহ তায়া’লা বলেন এই শ্রেণির লোকদের আহবান করবে জাহান্নাম। আর ওই জাহান্নামের বাসিন্দা যখন হবে তখন বুঝবে।
অতএব, আসুন এই রমজানের প্রস্তুতির জন্য, ফরজ যাকাত আদায় করি, হিসাব করি। গরিবদের খবর রাখি আল্লাহর ঘরের খবর রাখি। মনে রাখবেন সঞ্চয় করার মাধ্যমে সম্পদশালী হবেন না, দান করার মাধ্যমে সম্পদশালী হবেন। আল্লাহর রাসুল সঃ বলেন, আমার আল্লাহ বলেন, হে বনি আদম তোমার হাত খুলো গরিবদের জন্য, আল্লাহর ঘরের জন্য আর আমি তা বাড়িয়ে দিব হাজার লক্ষগুণে। আল্লাহু আকবর। অভাবী মানুষের খবর নেয়, পত্রিকায় ছবি দেয় না। আল্লাহ বলেন তার কি অভাব দুনিয়া আখিরাতে আমি আল্লাহ তা পূরণ করবো। সুবহানাল্লাহ।
ইফতারির আয়োজন করে পেট ভরে খাওয়ায় সবাইকে চিৎ করে রাখে, না তার চেয়ে কাঁচা ইফতারি পাঠিয়ে দিন। খবর নেন, ইফতারি আয়োজন, সাহরীর আয়োজন করতে পারে না, চাকরী নাই, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ, অভাবে আছে তাদের জন্য গোপনে সহযোগিতা পাঠিয়ে দিন। যাকাতের হিসাব করে চাল ডাল কিনে পাঠিয়ে দেন যাকাত আদায় হয়ে যাবে। যে মসজিদে ইফতারির সংকট ওই মসজিদে দেন, যেখানে ইফতারি গড়াগড়ি খায় ওইখানে নামকেওয়াস্তে দিয়ে অপব্যয় করবেন না। যেই মসজিদ গুলোতে ইফতারির আয়োজন নাই সেগুলোর খবর নেন। সম্মানী মানুষ অভাবী তাদের খবর নিন। আল্লাহর রাসুল সঃ বলেন, ওইসব মিসকীন মসজিদে রাস্তাঘাটে ঘুরাফিরা করে এক আনা দুই আনা খেজুরের জন্য তার চেয়ে আসল মিসকীন হচ্ছে, প্রকৃত মুসলিম, আত্মসম্মানবোধের কারনে হাত টানতে পারে না, উপরে অভাব দেখাতে পারে না, পরিস্কার কাপড় পরে কিন্তু কিছুই নেই, অভাব দেখায় না কিন্তু একবেলা খায় আরেকবেলা খায় না, রাস্তায়ও দাঁড়ায় না, আল্লাহু আকবর, তাদের খবর নেন।
হাজার বছরের জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তির জন্য। দান সদকা করেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রামনে লোক দেখানো লক্ষটাকা সাহায্যের চেয়ে গোপনে মসজিদের বক্সে এক হাজার টাকা দেন আপনার লাখ টাকার চেয়ে বহুগুণে উত্তম এই দান। রাসুল সঃ বলেন, বিপদ মসিবত অনেক কিছু আছে সবকিছু মওকূফ করে দিবেন এই দান সদকার মাধ্যমে। সুবহানাল্লাহ। রাসুল সঃ বলেন, আর্থিক সহযোগিতা করে, দান সদকা করে, মসজিদের খবর নিয়ে আপনি চিকিৎসা নেন আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করবেন। কি সুন্দর আহবান আল্লাহর রাসুল সঃ এর, আল্লাহর রাগকে পানি করে দেন, জাহান্নামের আগুন হতে মুক্ত করে দেয় এই দান সদকা, আর্থিক কুরবানি। দুর্ঘটনার মৃত্যু, যন্ত্রনার মৃত্যু, আই সি ইউর মৃত্যু হতে আল্লাহ হেফাজত করেন।
আসুন দান সদকা করি রমজানের প্রস্তুতি গ্রহন করি। খোঁজখবর নিয়ে নিসাবের মালিক যারা নয় তাদেরকে যাকাত দিই, ধনীকে যাকাত দিলো আদায় হবে না। আর তওবা ইস্তিগফার করি, চোখের পানি ছাড়ি। মহামারিতে সতর্ক হই, শেফা দানের মালিক আল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে তওবা ইস্তিগফারের মাধ্যমে, বেশি বেশি দান সদকার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন হতে মুক্ত হওয়ার তৌফিক দিক, আমীন।
বি.দ্রঃ খুতবার বাংলা বয়ান হতে সংকলিত। কেবল মাত্র খুতবার বাংলা বয়ান শুনার উপর ভিত্তি করে লিখার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদও পড়তে পারে, এছাড়া জ্ঞানের অভাবহেতু কুরআন হাদীসের সবগুলো দলিলও বলা হয়নি। প্রতিটা কথার দলিল রূপে পেশ করা সুললিত কন্ঠের কুরআন হাদীসের স্বাদ দিতে না পারায় ক্ষমাপ্রার্থী । আল্লাহ এই পাপীকে ক্ষমা করুক।