যিনি হাদীস না চিনলে সে হাদীস হাদীসই নয়!
যিনি হাদীস না চিনলে সেই হাদীস হাদীসই নয় ইতিহাসে এমন বক্তব্য হাদীসের একাধিক ইমামের ব্যাপারে পাওয়া যায়। প্রাচীন মুহাদ্দিসদের মধ্যে এমন বক্তব্য পাওয়া যায় ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (১৫৮-২৩৩ হি) রহিমাহুল্লাহর ব্যাপারে। হাদীসশাস্ত্রের অন্যতম প্রাণপুরুষ তাঁর সমসাময়িক ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি) রহিমাহুল্লাহর মতো ব্যক্তি তাঁর ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছেন,
«كل حديث لا يعرفه يَحْيَى بْن معين فليس هُوَ بِحديث»
“প্রত্যেক ঐ হাদীস যা ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন চেনেন না তা হাদীসই নয়।”
[তারীখু বাগদাদ (বাশশার তাহকীককৃত), খতীব আল-বাগদাদী, ১৬/২৬৩]
আমরা আগেই আলোচনা করেছি তিনি এক হাদীস ৫০ এরও অধিকবার লিখতেন এবং তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি সবচেয়ে বেশি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। লিখতে লিখতেই তিনি এমন পরিপক্ব হয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখার সঙ্গে শেখার এই সম্পর্ক সেই আদিমকাল হতে। আল্লাহ রব্বুল ইযযত কুরআনুল কারীমে প্রথম যে আয়াতগুলো নাযিল করেছিলেন সেখানে ইরশাদ করেন,
ٱقۡرَأۡ وَرَبُّكَ ٱلۡأَكۡرَمُ ٣ ٱلَّذِي عَلَّمَ بِٱلۡقَلَمِ
“পড়ো আর তোমার রব মহাসম্মানিত। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন।”
[সূরাতুল আলাক্বঃ৩-৪]
মুহাম্মাদ ইবনু নাসর আত-ত্বাবারী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«دخلت على يحيى بن معين فعددت عنده كذا وكذا سفطا يعني دفاتر (1) وسمعته يقول قد كتبت بيدي ألف ألف حديث وسمعته يقول كل حديث لا يوجد ها هنا وأشار بيده إلى الأسفاط فهو كذب»
“আমি ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈনের নিকট প্রবেশ করলাম। তাঁর কাছে গণনা করে আমি এই এই (অনুল্লেখিত) পরিমাণ নোটখাতা পেলাম এবং তাঁকে বলতে শুনলাম, “আমি আমার হাত দিয়ে ১০ লক্ষ হাদীস লিপিবদ্ধ করেছি।”
আমি তাঁকে আরো বলতে শুনেছি-
“প্রত্যেক ঐ হাদীস যা এখানে পাওয়া যাবে না তা মিথ্যা।” এ বলে তিনি তাঁর হাত দিয়ে নোটখাতাগুলোর দিকে ইশারা করলেন।”
[তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/১২-১৩]
যুগে যুগে মিথ্যুকেরা জাল হাদীস রচনা করেছে এবং একদল মুহাদ্দিস তাদের এই জাল ছিন্ন করার কাজে নিজেদের জান-মাল বিলিয়ে দিয়েছেন। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসকে জাল হাদীস হতে আলাদা করতে এই প্রতারকদের চেনা অতীব জরূরী। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল রহিমাহুল্লাহ বলছেন,
«ههنا رجل خلقه اللَّه لهذا الشأن، يظهر الكذابين فقال: يحيى بن معين»
“এখানে একজন মানুষকে আল্লাহ এই দায়িত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, তিনি কাযযাবদের (মিথ্যুকদের) কথা প্রকাশ করে দিবেন।” (আহমাদ বলেন-) “ইনি হলেন ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ)।”
[আল-জামিউ লি উলূমিল ইমামি আহমাদ – আর রিজাল, খালিদ আর-রিবাত্ব ও সায়্যিদ ইযযাত ‘ঈদ, ১৯/৫১০]
হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবনী নিয়ে যে শাস্ত্রে আলোচনা হয় তাকে বলা হয় রিজালশাস্ত্র। হাদীসশাস্ত্রের দিকপাল ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল রহিমাহুল্লাহ বলছেন,
«أعلمنا بالرجال يحيى بن معين، وأحفظنا للأبواب سليمان الشاذكوني، وعلي أحفظنا للطوال»
“রিজালশাস্ত্রে ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (১৫৮-২৩৩ হি / রহিমাহুল্লাহ) সবচেয়ে জ্ঞানী, হাদীসের অধ্যায় সংরক্ষণে সুলাইমান আশ-শাযাকূনী (২৩৪ হি / রহিমাহুল্লাহ) সবচেয়ে এগিয়ে এবং আলী (ইবনুল মাদীনী রহিমাহুল্লাহ / ১৬১-২৩৪ হি) লম্বা মুখস্তকরণে এগিয়ে।”
[আল-জামিউ লি উলূমিল ইমামি আহমাদ – আর রিজাল, খালিদ আর-রিবাত্ব ও সায়্যিদ ইযযাত ‘ঈদ, ১৯/৫০৯]
বিখ্যাত পর্যালোচক ইমাম ‘আমর (২৩২ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«مَا كَانَ فِي أَصْحَابِنَا أَحْفَظُ لِلأَبْوَابِ مِنْ أَحْمَدَ، وَلَا أَسَرَدُ لِلْحَدِيْثِ مِنِ ابْنِ الشَّاذَكُوْنِيِّ، وَلَا أَعْلَمُ بِالإِسْنَادِ مِنْ يَحْيَى، مَا قَدِرَ أَحَدٌ يَقلِبَ عَلَيْهِ إِسْنَاداً قَطُّ»
“আমাদের সাথীদের মধ্যে হাদীসের অধ্যায় সংরক্ষণে আহমাদের চেয়ে বড় কেউ ছিলো না, হাদীস দ্রুত পঠনে ইবনুশ শাযাকূনীর চেয়ে কেউ এগিয়ে ছিলো না আর সনদের ব্যাপারে ইয়াহইয়ার চেয়ে জ্ঞানী কেউ ছিলো না, তার সামনে কখনোই কেউ সনদ উল্টে দিতে সমর্থ হতো না।”
[সিয়ারু আ’লামিন নুবালা (রিসালাহ), যাহাবী, ১১/৯২]
ইমাম হিলাল ইবনুল ‘আলা (১৮৪-২৮০ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«سمعت هلال بن العلاء يقول من الله على هذه الأمة بأربعة في زمانهم أحمد بن حنبل ويحيى بن معين والشافعي وأبو عبيد القاسم بن سلام فأما أحمد بن حنبل فثبت في دين الله ولولا ذلك لارتد الناس وأما يحيى بن معين فإنه نفى الكذب عن رسول الله (صلى الله عليه وسلم) وأما الشافعي ففقه الناس في دين الله وأما أبو عبيد ففسر الغريب من حديث رسول الله (صلى الله عليه وسلم)»
“আল্লাহ এই উম্মাহকে চার জন ব্যক্তির মাধ্যমে তাঁদের নিজ নিজ যামানায় অনুগ্রহ করেছেনঃ আহমাদ ইবনু হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি / রহিমাহুল্লাহ), ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (১৫৮-২৩৩ হি/ রহিমাহুল্লাহ), শাফিঈ (১৫০-২৩৪ হি/ রহিমাহুল্লাহ) এবং আবূ উবাইদুল কাসিম ইবনু সালাম (১৫৭-২২৪ হি/ রহিমাহুল্লাহ)। একদিকে আহমাদ ইবনু হাম্বাল দীনকে সুসাব্যস্ত করেছেন, এখানে তিনি না থাকলে মানুষ দীন পরিত্যাগ করতো। অন্যদিকে ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসকে মিথ্যা থেকে বাঁচিয়েছেন। আরেকদিকে শাফিঈ দীনের কল্যাণার্থে মানুষকে ফিক্হ শিখিয়েছেন। অপর দিকে আবূ উবাইদুল কাসিম ইবনু সালাম আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গরীব (দুর্লভ) হাদীসগুলোকে খুলে খুলে ব্যাখ্যা করেছেন।”
[তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/১৭]
হাদীসশাস্ত্রে ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহর অবদানের কথা উল্লেখ করে ইমাম আবূ উবাইদ আল-কাসিম ইবনু সালাম রহিমাহুল্লাহ বলেন,
ربانيو الحديث أربعة فأعلمهم بالحلال والحرام أحمد بن حنبل وأحسنهم سياقة للحديث وأداء له علي بن المديني وأحسنهم وضعا لكتاب ابن أبي شيبة وأعلمهم بصحيح الحديث وسقيمه يحيى بن معين»
“হাদীসের কাণ্ডারি মূলত চারজন: তাঁদের মধ্যে হালাল-হারাম বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জানেন আহমাদ ইবনু হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি / রহিমাহুল্লাহ), হাদীসকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে ব্যবহার করা এবং আমল করায় এগিয়ে আলী ইবনুল মাদীনী (১৬১-২৩৪ হি / রহিমাহুল্লাহ), সবচেয়ে সুন্দরভাবে কিতাব রচনা করেছেন ইবনু আবী শাইবাহ (১৫৯-২৩৫ হি / রহিমাহুল্লাহ) এবং হাদীস সহীহ হওয়া না হওয়ার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (১৫৮-২৩৩ হি / রহিমাহুল্লাহ)।”
[তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/১৮]
ইমাম আবূ বাক্র আল-ইসমাঈলী (২৭৭-৩৭০ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«سئل الفرهياني عن يحيى وعلي وأحمد وأبي خيثمة فقال أما علي فأعلمهم بالحديث والعلل ويحيى أعلمهم بالرجال واحمد بالفقه وأبو خيثمة من النبلاء»
“ফিরহিয়ানী (মৃত্যু ৩০০ হি. এর কিছু পরে / রহিমাহুল্লাহ)-কে ইয়াহইয়া (১৫৮-২৩৩ হি / রহিমাহুল্লাহ), আলী (ইবনুল মাদীনী / ১৬১-২৩৪ হি / রহিমাহুল্লাহ), আহমাদ (ইবনু হাম্বাল / ১৬৪-২৪১ হি / রহিমাহুল্লাহ) ও আবূ খাইসামাহ (১৬০-২৩৪ হি / রহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো।
জবাবে তিনি বললেন, “তাদের মধ্যে আলী হাদীস ও হাদীসের ‘ইলাল (সূক্ষ্ম ত্রুটি) সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখেন, ইয়াহইয়া রিজালশাস্ত্র সম্পর্কে বেশি জানেন, আহমাদ ভালো জানেন ফিক্হ আর আবূ খাইসামাহ মর্যাদাবানদের একজন।” [তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/২০]
আব্দুর রহমান রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«سمعت محمد بن مسلم بن وارة وسئل عن علي ابن المديني ويحيى بن معين أيهما كان أحفظ؟ قال: كان علي أسرد وأتقن، وكان يحيى بن معين أفهم بصحيح الحديث وسقيمه»
“আমি মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম ইবনু ওয়ারাহ (১৯০-২৭০ হি / রহিমাহুল্লাহ) হতে শুনেছি, তাঁকে আলী ইবনুল মাদীনী ও ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- এদের মধ্যে কে বড় হাফিয (মুখস্তকারী)?
জবাবে তিনি বললেন, “আলী দ্রুত পাঠকারী এবং সবচেয়ে নির্ভুল। আর ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন হাদীসের সহীহ হওয়া না হওয়া সবচেয়ে ভালো বুঝেন।”
[আল-জারহু ওয়াত তা’দীল, ইবনু আবী হাতিম, ১/৩১৪]
ইমাম আব্দুল মু’মিন ইবনু খলফ আন-নাসাফী (২৫৯-৩৬৪ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«سألتُ أَبَا علي صالِح بْن مُحَمَّد: من أعلمُ بالحديث يَحْيَى بْن معين أم أَحْمَد بْن حنبل؟ فقال: أما أَحْمَد فأعلمُ بالفقه والاختلاف، وأمّا يَحْيَى فأعلمُ بالرجال والْكُنى»
“আবূ আলী সলিহ ইবনু মুহাম্মাদ (২০৫-২৯৩ হি / রহিমাহুল্লাহ)-কে আমি জিজ্ঞেস করলাম- “হাদীস সম্পর্কে কে বেশি জানেন- ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ) নাকি আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহিমাহুল্লাহ)?”
জবাবে তিনি বললেন, “আহমাদ, তিনি ফিক্হ ও ইখতিলাফ (মতভেদ) সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখেন। বিপরীতে ইয়াহইয়া, তিনি রিজালশাস্ত্র ও কুনিয়াত (উপনাম) সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখেন।” [তারীখু বাগদাদ (বাশশার তাহকীককৃত), খতীব আল-বাগদাদী, ১৬/২৬৩]
ইমাম আবূ দাঊদ (২০২-২৭৫ হি) রহিমাহুল্লাহর শিষ্য আবূ উবাইদ মুহাম্মাদ ইবনু আলী আল-আজরী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
« قلت لأبي داود، أيُّما أعلم بالرجال يَحْيَى أو عَلِيّ بْن عَبْد الله؟ قال: يَحْيَى عالمٌ بالرجال، وليس عِنْدَ علي من خبر أهل الشام شيء»
“আবূ দাঊদ (রহিমাহুল্লাহ)-কে আমি বললাম, রিজালশাস্ত্র সম্পর্কে কে বেশি জানেন- ইয়াহইয়া নাকি আলী ইবনু আব্দিল্লাহ (আলী ইবনুল মাদীনী)?”
তিনি বললেন, “ইয়াহইয়াই রিজাল সম্পর্কে বেশি জানেন। আর আলীর নিকট শামবাসীর কোনো খবরই নেই।” [তারীখু বাগদাদ (বাশশার তাহকীককৃত), খতীব আল-বাগদাদী, ১৬/২৬৩]
ইমামদের উক্তিগুলোই প্রমাণ করে দিচ্ছে হাদীসশাস্ত্রে ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহর যোগ্যতার কথা। ইমাম আল-’আজলী (১৮২-২৬১ হি) রহিমাহুল্লাহ তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে বলেন,
«ما خلق اللَّه تعالى أحدًا كان أعرف بالحديث من يحيى بن معين، ولقد كان يجتمع مع أحمد بن حنبل، وعلي بن المديني، ونظرائهم، فكان هو الذي ينتخب لهم الأحاديث لا يتقدمه منهم أحد، ولقد كان يُؤتى بالأحاديث قد خلطت»
«وقلبت، فيقول: هذا الحديث كذا، وهذا كذا، فيكون كما قال وفي “تاريخ المنتجالي”: لما مات غلقت الحوانيت، وحضر النساء والرجال»
“মহান আল্লাহ এমন কাউকে সৃষ্টি করেননি যিনি ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈনের চেয়ে হাদীসশাস্ত্রের সঙ্গে অধিক পরিচিত। তিনি আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আলী ইবনুল মাদীনী এবং তাঁদের সমকক্ষদের সাথে মেলামেশা করতেন। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি তাদের জন্য হাদীস নির্বাচন করে দিতেন কিন্তু তারা কেউই তাঁর চেয়ে সামনে অগ্রসর হতে সক্ষম হতেন না। হাদীস নিয়ে আসা হতো এবং আমি সব একসাথে মিশিয়ে ফেলতাম এবং ওলট-পালট করে দিতাম। সাথে সাথে তিনি বলে দিতেন, “এই হাদীস এমন আর এটা এমন।”
সেভাবেই মিলে যেতো যেমনটি তিনি বলেছেন। (‘তারীখুল মুনতাজালী’-তে তিনি বলেছেন-) “তিনি যখন ইন্তেকাল করেন তখন দোকানপাটগুলো (এর আরেকটি অর্থ মদ্যশালাগুলো) তালাবদ্ধ করে দেয়া হয় এবং বহু নারী ও পুরুষের লোকসমাগম ঘটে।” [ইকমালু তাহযীবিল কামাল (আল-ইলমিয়্যাহ), ‘আলাউদ্দীন মুগলতা’ঈ, ৬/৬৪৯-৬৫০]
আব্দুল খালিক ইবনু মানসুর (২৪৬ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«قلت لابن الرومي وسمعت أبا سعيد الحداد يقول لولا يحيى بن معين ما كتبت الحديث فقال لي ابن الرومي وما تعجب فوالله لقد نفعنا الله به ولقد كان المحدث يحدثنا لكرامته ما لم يكن نحدث به أنفسنا قلت لابن الرومي فإن أبا سعيد الحداد حدثني قال إنا لنذهب إلى المحدث فننظر في كتبه فلا نرى فيها إلا كل حديث صحيح حتى يجئ أبو زكريا فأول شئ يقع في يده يقع الخطأ ولولا أنه عرفناه لم نعرفه فقال لي ابن الرومي وما تعجب لقد كنا في مجلس لبعض أصحابنا فقلت له يا أبا زكريا نفيدك حديثا من أحسن حديث يكون وفينا يومئذ علي وأحمد وقد سمعوه فقال وما هو فقلنا حديث كذا وكذا فقال هذا غلط فكان كما قال قال وسمعت ابن الرومي يقول كنت عند أحمد فجاءه رجل فقال يا أبا عبد الله انظر هذه الأحاديث فإن فيها خطأ قال عليك بأبي زكريا فإنه يعرف الخطأ وقال عبد الخالق قلت لابن الرومي حدثني أبو عمرو أنه سمع أحمد بن حنبل يقول السماع مع يحيى بن معين شفاء لما في الصدور فقال لي وما تعجب من هذا كنت أختلف أنا وأحمد إلى يعقوب بن إبراهيم في المغازي ويحيى بالبصرة فقال أحمد ليت أن يحيى ها هنا قلت له وما تصنع به قال يعرف الخطأ»
“আমি ইবনুর রূমি (২৩৬ হি / রহিমাহুল্লাহ)-কে বলেছিলাম- “আমি আবূ সাঈদ আল-হাদ্দাদ (২২১ বা ২২২ হি / রহিমাহুল্লাহ)-কে বলতে শুনেছি, “ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন না থাকলে আমি হাদীস লিখতে সক্ষম হতাম না।”
ইবনুর রূমি আমাকে বললেন, “তুমি এতেই আশ্চর্য হচ্ছো! আল্লাহর কসম, আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে আমাদের উপকৃত করেছেন এবং মুহাদ্দিসগণ আমাদেরকে তার এমন মর্যাদার ব্যাপারে বলেছেন যা আমরা নিজেদের মাঝে আলোচনাও করিনি।”
আমি ইবনুর রূমিকে বললাম, “আবু সাঈদ আল-হাদ্দাদ আমাকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, “অবশ্যই আমরা মুহাদ্দিসদের কাছে যাবো এবং তাঁদের বইপত্রগুলোও ঘেটে দেখবো, তবে আবু যাকারিয়া (ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন) না আসা অবধি সমস্ত সহীহ হাদীস অবলোকন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তার হাতে প্রথম যে জিনিসটি ধরা পড়ে তা হলো ত্রুটি৷ যদি তার পরিচয় না পেতাম তবে সহীহ হাদীসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটতো না।”
ইবনুর রূমি আমাকে বললেন, “তুমি এতেই আশ্চর্য হচ্ছো! আমরা আমাদের কয়েকজন সাথীর সাথে একটি সমাবেশে ছিলাম। আমি তাঁকে বললাম, “হে আবু যাকারিয়া, আমরা আপনাকে সর্বোত্তম হাদীস থেকে একটি হাদিসের ব্যাপারে সাহায্য করবো যেটি সেদিন আমাদের সাথে থাকা আলী (ইবনুল মাদীনী রহিমাহুল্লাহ) ও আহমদ (ইবনু হাম্বাল রহিমাহুল্লাহ) তাঁরাও শুনেছিলেন।”
তাই তিনি বললেন, “কী এটা?”
জবাবে আমরা বললাম, “অমুক অমুক হাদীস।”
তিনি বললেন, “এটা তো ভুল!” দেখা গেলো তিনি যা বলেছেন তাই।
(আব্দুল খালিক ইবনু মানসুর বললেন-) “আমি ইবনুর রূমিকে আরো বলতে শুনেছি যে, “আমি আহমাদের সাথে ছিলাম। এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বললো, ‘হে আবু আব্দুল্লাহ, এই হাদিসগুলো দেখুন তো, এগুলোর মধ্যে ভুল আছে।”
তিনি বললেন, “আপনার উপর আবশ্যক আবু যাকারিয়াকে ধরা। ভুল কাকে বলে তা তিনিই চেনেন।” (আব্দুল খালিক বলেন-) “আমি ইবনুর রূমিকে বললাম, আবু ‘আমর আমাকে বর্ণনা করেছেন, তিনি আহমাদ ইবনু হাম্বালকে বলতে শুনেছেন, “ইয়াহিয়া ইবনু মা’ঈনের সাথে একইসাথে (হাদীস) শ্রবণ করা অন্তরের ভেতরে যা আছে তার জন্য নিরাময়।”
তিনি আমাকে বললেন, “তুমি এতেই আশ্চর্য হচ্ছো!” ইয়াকুব ইবনু ইবরাহীম (২০৮ হি / রহিমাহুল্লাহ)-র সাথে আমি এবং আহমাদ মাগাযী (নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুদ্ধের ঘটনাবলী) বিষয়ে মতানৈক্য করেছিলাম। ইয়াহইয়া ছিলেন বসরায়। এমতাবস্থায় আহমাদ বললেন, “আহা, ইয়াহইয়া যদি এখানে থাকতো!”
আমি তাঁকে বললাম, “তাঁকে দিয়ে কী করবেন?”
তিনি বললেন, “হাদীসের ভুলচুক তিনি ভালো করেই চিনেন।” [তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/২৩]
আলী ইবনু সাহল (২৬১ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«سمعتُ أَحْمَد بْن حنبل فِي دهليز عفان يَقُولُ لعبد الله ابْن الرومي: ليت أَبَا زكريا قد قَدِمَ، يعني: ابن معين، فقال لَهُ اليمامي: ما تصنعُ بقدومه؟ يُعيد علينا ما قد سَمعنا، فقال لَهُ أَحْمَد: اسكت، هُوَ يعرفُ خطأ الحديث»
“একবার আফফানের বারান্দায় আমি আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহিমাহুল্লাহ)-কে আব্দুল্লাহ ইবনুর রূমী (রহিমাহুল্লাহ)-কে লক্ষ্য করে বলতে শুনলাম, “আহা, যদি আবূ যাকারিয়ার আগমন ঘটতো!” অর্থাৎ, ইবনু মাঈন।
(ইবনুর রূমী) আল-ইয়ামামী তাঁকে বললেন, “তাঁর আগমন দিয়ে কী করবেন?”
আমরা যা শুনলাম তিনি আমাদের সামনে তা আবারও পুনরাবৃত্তি করলেন।
এবার আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ) বললেন, “থামো! হাদীসের ভুলচুক তিনি ভালো করেই চিনেন।” [তারীখু বাগদাদ (বাশশার তাহকীককৃত), খতীব আল-বাগদাদী, ১৬/২৬৩]
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসরা এভাবেই তাঁকে একের পর এক প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। আব্দুল খালিক ইবনু মানসুর রহিমাহুল্লাহ বলছেন,
«قلت لابن الرومي سمعت أبا سعيد الحداد يقول الناس كلهم عيال على يحيى بن معين فقال صدق ما في الدنيا أحد مثله سبق الناس إلى هذا الباب الذي هو فيه لم يسبقه إليه أحد وأما من يجئ بعد فلا يدري كيف يكون قال وسمعت ابن الرومي يقول ما رأيت أحدا قط يقول الحق في المشايخ غير يحيى وغيره كان يتحامل بالقول»
“ইবনুর রূমি (রহিমাহুল্লাহ)-কে আমি বললাম, “আমি আবূ সাঈদ আল-হাদ্দাদ (রহিমাহুল্লাহ)-কে বলতে শুনেছি, “সকল মানুষ ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈনের পরিবারভুক্ত।”
ইবনুর রূমি বললেন, “তিনি সত্য বলেছেন! এই পৃথিবীতে তাঁর মতো আর একজনও নেই। মানুষেরা সেই দরজা অবধি এসে দাঁড়িয়েছিলো যেখানে এখন তিনি আছেন, কিন্তু কেউ তাঁকে টপকাতে পারেনি। তবে পরে যারা আসবে তারা কেমন হবে তা তার নিকট অজ্ঞাত।”
ইবনুর রূমিকে আমি আরো বলতে শুনেছি, “নিজের উস্তাদ-মাশায়েখদের ক্ষেত্রে আমি কখনোই কাউকে সত্য উচ্চারণ করতে দেখিনি, শুধুমাত্র ইয়াহইয়াই ব্যতিক্রম। বাকীরা কথাবার্তার ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন।” [তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/২১]
যিনি হাদীস না চিনলে সে হাদীস হাদীসই নয়- এমন খ্যাতিতে যিনি ভূষিত হন তাঁকে তো এমন স্পষ্টভাষীই হতে হয়। ইয়াহইয়াল আহওয়াল রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«لقينا يَحْيَى بْن معين قدومه من مكة، فسألناهُ عَن حُسين بْن حِبَّان، فقال: أحدثكم أَنَّهُ لَمَّا كَانَ بآخر رَمَقٍ، قَالَ لي: يا أَبَا زكريا، أترى ما مكتوبٌ عَلَى الخيمة؟ قلت: ما أرى شيئًا، قَالَ: بلى أرى مكتوبًا: يَحْيَى بْن معين يقضي أو يفصل بين الظالمين، قَالَ: ثُمَّ خرجت نفسه»
“আমি ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ)- সাথে তাঁর মক্কা আগমনকালে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাঁকে হুসাইন ইবনু হিব্বান (২৩২ হি / রহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। জবাবে তিনি বললেন, “তিনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমি আপনাদের সেই সময়ের কথা বর্ণনা করছি। তিনি আমাকে বললেন, “হে আবূ যাকারিয়া, তুমি কি তাবুর মধ্যে কোনো লেখা দেখতে পাচ্ছো?”
আমি বললাম, “আমি কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”
তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি তো লেখা দেখতে পাচ্ছি: ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন যালিমদের মধ্যে বিচার করে দেন কিংবা সুরাহা করেন।”
(ইবনু মা’ঈন) বললেন, “এরপর তাঁর আত্মা বের হয়ে যায়।” [তারীখু বাগদাদ (বাশশার তাহকীককৃত), খতীব আল-বাগদাদী, ১৬/২৬৩]
ইমাম আবূ যুরআ’ আর-রাযী (২০২-২৮৯ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
« كان أحمد بن حنبل لا يرى الكتابة عن أبي نصر التمار ولاعن يحيى بن معين ولا عن أحد ممن امتحن فأجاب»
“আহমাদ ইবনু হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি / রহিমাহুল্লাহ) আবূ নাসর আত-তামার (১৩৭-২২৮ হি / রহিমাহুল্লাহ), ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (১৫৮-২৩৩ হি / রহিমাহুল্লাহ) এবং যাকে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং জবাবও সে দিয়ে দিয়েছে তাঁদের কাছ থেকে হাদীস গ্রহণের সময় হাদীসের অনুলিপি বা লিখিত পাঠ দেখতেন না।” [তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/৩৫]
ইমামুস সুন্নাহ আহমাদ ইবনু হাম্বাল রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«وقد قال أحمد بن حنبل: أكره الكتابة عمن أجاب في المحنة، كيحيى، وأبي نصر التمار»
“ইয়াহইয়া ও আবূ নাসর আত-তামারের মতো যাদের পরীক্ষা নেয়া হলে জবাব দিতে পারেন তাদের থেকে হাদীস গ্রহণকালে লিখিত অনুলিপি দেখে নেয়া আমি অপছন্দ করি।” [মীযানুল ই’তিদাল, যাহাবী, ৪/৪১০]
হাদীসশাস্ত্রে ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন উচ্চ আসনে আসীন হওয়ার কারণেই ইমাম ইবনু কাসীর (৭০০-৭৭৪) হি রহিমাহুল্লাহ তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন,
«إمام أهل الحديث في زمانه والمشار إليه من بين أقرانه»
“হাদীসের ধারক-বাহকদের ইমাম এবং তাঁর সমকক্ষদের মাঝে তিনি ছিলেন এক সেতুবন্ধন।” [আত-তাকমীলু ফীল জারহি ওয়াত তা’দীল, ইবনু কাসীর, ২/২৮২]
হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর অপূরণীয় অবদানের ফলে মৃত্যুর পর গণমানুষের ভালোবাসা লাভ করেন। ইমাম ইসমাঈল আল-আসবাহানী (৪৫৭-৫৩৫ হি) রহিমাহুল্লাহ তাঁর কিতাবে ইমাম ইবনু মা’ঈনের মৃত্যুপরবর্তী ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেন-
«وَهُوَ حَاجٌّ فَحُمِلَ عَلَى سَرِيرِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَمُنَادٍ يُنَادِي بَيْنَ يَدَيْ جَنَازَتِهِ: يَا مَعْشَرَ الْمُسْلِمِينَ، هَذَا كَانَ يَذُبُّ الْكَذِبَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَذَا وَكَذَا عَامًا»
“তিনি হজ্বব্রত অবস্থায় ছিলেন। তাঁকে আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাটিয়ায় করে নিয়ে আসা হয়। একজন ঘোষক তাঁর জানাযার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিচ্ছিলো যে, “ওহে মুসলিম জাতি, ইনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি এতো এতো বছর ধরে আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ হওয়া থামিয়ে রেখেছেন।” [সিয়ারুস সালাফিস সলিহীন, ইসমাঈল আল-আসবাহানী, ৩/১১৯৯]
আব্দুর রহমান রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«سمعت أبي رضي الله عنه [يقول – 3] توفي يحيى بن معين بمدينة رسول الله صلى الله عليه وسلم ووضع على (1) سرير النبي صلى الله عليه وسلم وأجتمع في جنازته خلق كثير وإذا رجل يقول: هذه جنازة يحيى بن معين الذاب عن رسول الله صلى الله عليه وسلم الكذب – والناس يبكون»
“আমি আমার পিতা (আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন) হতে শুনেছি যে, ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ) আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শহরে (মদীনায়) ইন্তেকাল করেন। আর তাঁকে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাটিয়াতেই রাখা হয়। তাঁর জানাযায় অগুনতি মানুষ উপস্থিত হন।
একজন ব্যক্তি যখন বলেই উঠলো, “এই জানাযা হচ্ছে ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈনের- যিনি আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ হওয়া থামিয়েছেন”- লোকেরা তখন কেঁদে উঠলো।”
[আল-জারহু ওয়াত তা’দীল, ইবনু আবী হাতিম, ১/৩১৬-৩১৭]
তাঁর মৃত্যুপরবর্তী অবস্থা আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু গালিব রহিমাহুল্লাহ তুলে ধরেন এভাবে-
«لَمَّا مات يَحْيَى بْن معين نادى إِبْرَاهِيم بْن المنذر الحزامي: من أراد أن يشهد جنازة المأمون عَلَى حديث رسول الله، صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فليشهد»
“ইয়াইহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ) যখন ইন্তেকাল করলেন তখন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির আল-হাযামী (২৩৬ হি / রহিমাহুল্লাহ) ঘোষণা দিয়ে বলেন- “যে ব্যক্তি আকাঙ্খা করে যে আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য কারো জানাযায় উপস্থিত হবে সে যেন হাজির হয়।” [তারীখু বাগদাদ (বাশশার তাহকীককৃত), খতীব আল-বাগদাদী, ১৬/২৬৩]
হাদীসশাস্ত্রে ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহর যোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন নেককার ব্যক্তিগণ অনেক স্বপ্ন দেখেছেন। আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ رُؤْيَا الْمُؤْمِنِ جُزْءٌ مِنْ سِتَّةٍ وَأَرْبَعِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ
“নিশ্চয়ই মু’মিনের স্বপ্ন নবুওয়তের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ।”
[আস-সহীহ, মুসলিম, ২২৬৩]
ইয়াহইয়া ইবনু আইয়ুব আল-মাকদিসী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
رأيت كأن النبي (صلى الله عليه وسلم) نائم وعليه ثوب مغطى وأحمد ويحيى يذبان عنه»
“স্বপ্নে আমি যেন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেলাম। তিনি ঘুমিয়ে আছেন। উপরে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া। আহমাদ ও ইয়াহইয়া (রহিমাহুমাল্লাহ) তাঁর প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত।” [তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/৪২]
বাশার ইবনু মুবাশশির রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«رأيت يحيى بن معين في المنام فقال: زوجني ربي عز وجل أربع مئة حوراء بِرَدِّي الكذب عن رسول الله -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ»
“ঘুমের মধ্যে (স্বপ্নে) আমি ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহকে দেখলাম। তিনি বললেন, “আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে মিথ্যাকে ফিরিয়ে রাখার আমার এই পদক্ষেপের কারণে আমার মহাপরাক্রমশালী মহান রব আমাকে ৪০০ হুরের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছেন।” [আল-কামাল ফী আসমায়ির রিজাল, আব্দুল গনী আল-মাক্বদিসী, ৯/৩৬৮]
প্রখ্যাত ফকীহ হুবাইশ ইবনু মুবাশশির (২৫৮ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«رأيتُ يحيى بن معين تلكَ الليلة في النوم، وعلى رأسهِ تاجٌ، فقلت: ما فعل الله بك؟ فقال: أدخلني عليه في داره، وزوَّجني ثلاثَ مئة حورية؛ ثم قال: انظروا إلى عبدي، كيف تطرَّى وحَسُن (1)»
“এক রাতে আমি ঘুমের মধ্যে (স্বপ্নে) ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ)-কে দেখলাম। তিনি মাথায় টুপি পরিহিত ছিলেন। এ দেখে আমি বললাম, “আল্লাহ আপনার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন?” জবাবে তিনি বললেন, “আল্লাহ আমাকে জান্নাতে এই স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন এবং তিনি আমাকে ৩০০ হুরের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছেন।
এরপর তিনি বলেছেন, “আমার বান্দার দিকে লক্ষ্য করো- কেমন কোমল ও সুন্দরতর হয়েছে!” [মিরআতুয যামান ফী তাওয়ারীখিল আ’য়ান, সাবত ইবনুল জাওযী, ১৪/৪৬৮-৪৬৯]
ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহ ইল্মে হাদীসে এমন উচ্চ আসনে আসীন হয়েছিলেন এবং মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীদের তিনি এমনভাবে চিহ্নিত করেছিলেন যে হাফিয মুহাম্মাদ ইবনু হারুন আল-ফাল্লাস আল-মাখরামী (২৬৫ হি) রহিমাহুল্লাহ তাঁর বিষয়ে বলেন,
إذا رأيت الرجل يقع في يحيى بن معين فأعلم أنه كذاب يضع الحديث، وإنما يبغضه لما يبين أمر الكذابين»
“যখন তুমি দেখবে কোনো ব্যক্তি ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তখন জেনে রেখো সে এমন একজন কাযযাব (মিথ্যুক) যে হাদীস জাল করে এবং সে এজন্যই তাঁর প্রতি বিদ্ধেষ রাখে যে, তিনি কাযযাবদের অবস্থা প্রকাশ করে দেন।” [আল-জারহু ওয়াত তা’দীল, ইবনু আবী হাতিম, ১/৩১৬]
কী পরিমাণ মিথ্যুক বর্ণনাকারীদের মুখোশ উন্মোচন করলে কারো ব্যাপারে এমন বক্তব্য আশা করা যেতে পারে! ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহ মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীদের নিয়ে পরিহাস করে বলেন,
كَتَبنَا عَنِ الكَذَّابِينَ، وَسَجَرنَا بِهِ التَّنُّورُ، وَأَخرَجنَا بِهِ خُبْزاً نَضِيجاً
“কাযযাবদের (মিথ্যুকদের) কাছ থেকেও আমরা (জাল হাদীস) লিপিবদ্ধ করতাম, এরপর ওগুলো দিয়ে আমরা চুলা ধরাতাম এবং সবশেষ আমাদের জন্য সুন্দর সাইজমতো রুটিও বানিয়ে ফেলতাম।” [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা (রিসালাহ), যাহাবী, ১১/৮৩-৮৪]
হাদীস গ্রহণে ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহর নীতি ছিলো অত্যন্ত সুদৃঢ়, তিনি নিজেই বলেন,
«من لم يكن سمحا في الحديث كان كذابا قيل له وكيف يكون سمحا قال إذا شك في الحديث تركه»
“হাদীসের ক্ষেত্রে যারা নম্র হয় না তারা মিথ্যুক।”
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, “নম্র কিভাবে হবে?”
তিনি বললেন, “যখনই হাদীসের মাঝে সন্দেহ জাগে তখনই সে হাদীস সে ছেড়ে দেয়।” [তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/৩০]
ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহ নিজেও খুব সাবধানতা অবলম্বন করে হাদীস বর্ণনা করতেন, তিনি বলেন,
«قَالَ يَحْيَى: إني لأحدِّث بالحديث فأسهر لَهُ مخافة أن أكون قد أخطأت فِيهِ»
“আমি হাদীস বর্ণনা করি তবে অবশ্যই এই ভয়ে হুঁশিয়ার থাকি যে, হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে না জানি কোনো ভুল করে ফেলি।” [তারীখু বাগদাদ (বাশশার তাহকীককৃত), খতীব আল-বাগদাদী, ১৬/২৬৩]
হারুন ইবনু বাশীর আর-রাযী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«رأيت يحيى بن معين استقبل القبلة رافعًا يديه يقول: اللهم إن كنت تكلَّمْتُ في رجل ليس هو عندي كذابًا فلا تغفر لي»
“আমি ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ)-কে কিবলার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর দু’ হাত তুলে বলতে দেখেছি: হে আল্লাহ, আমি যদি আমার নিকটে কাযযাব (মিথ্যুক) নয় এমন কারো উপরে কথা তুলি তাহলে বিনিময়ে আপনি যেন আমাকে ক্ষমা না করেন।” [আল-কামাল ফী আসমায়ির রিজাল, আব্দুল গনী আল-মাক্বদিসী, ৯/৩৬৫]
একজন ব্যক্তির চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস থাকলেই পরে এভাবে দু’আ করা সম্ভব। তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাস ও বিনয়ের সংমিশ্রণে এক উন্নত চরিত্রের মানুষ। ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহ বলছেন,
«إنَّا لنطعن على أقوام لعلهم قد حَطوا رِحَالَهُم في الجنة منذ أكثر من مائتي سنة»
“আমরা হয়তো এমন লোকদের ব্যাপারেই আপীল/অভিযোগ করে যাচ্ছি যাঁরা কিনা দু’ইশো বছরেরও বেশি আগে জান্নাতে তাঁদের ঠিকানা গেড়ে বসে আছেন।” [আল-কামাল ফী আসমায়ির রিজাল, আব্দুল গনী আল-মাক্বদিসী, ৯/৩৬৬]
প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللهُ
“আর কেউ আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করলে আল্লাহ তাকে উপরে তুলেন।” [আস-সহীহ, মুসলিম, ২৫৮৮]
ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহ শুধু হাদীস প্রচারের দিকেই নজর দেননি, হাদীস আমল করার দিকেও তিনি মনোযোগী ছিলেন, তিনি বলেন,
«سمعت يحيى بن معين يقول أول بركة الحديث إفادته»
“হাদীসের প্রথম বারাকাহই হলো এর থেকে ফায়দা বা উপকারিতা লাভ করা।”
[তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/২৮]
ইমাম শাফিঈ (১৫০-২০৪ হি) রহিমাহুল্লাহ ছন্দসুরে বলেন,
شَكَوتُ إِلى وَكيعٍ سوءَ حِفظي
فَأَرشَدَني إِلى تَركِ المَعاصي
وَأَخبَرَني بِأَنَّ العِلمَ نورٌ
وَنورُ اللَهِ لا يُهدى لِعاصي
“‘ক্ষীণ আমার স্মৃতি’ বলি ওয়াকীকে দুঃখ করে।
পাপকে ছাড়ার কথা বলে তিনি পথ দেখালেন মোরে।
আমাকে তিনি জানিয়ে দিলেন ইল্ম যে হলো আলো।
আল্লাহর আলো দেখায় না পথ কোনো পাপীর তরে।” [দীওয়ানুশ শাফিঈ (মাকতাবাতুল কুল্লিয়াতিল আযহারিয়্যাহ), শাফিঈ, পৃঃ ৮৮]