যিনি ছিলেন নারী সাহাবীদের মুখপাত্র

আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী। তিনি ছিলেন বিখ্যাত ফক্বীহ সাহাবী মুয়ায ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর চাচাতো/ফুফাতো বোন।

মদীনার নারীদের যতো প্রশ্ন ছিলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাঁদের যেসব পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিলো, সেগুলো সরাসরি রাসূলকে গিয়ে বলতে অনেক নারী সঙ্কোচবোধ করতেন। তখন নারীদের প্রতিনিধি হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রশ্ন করতে যেতেন আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা। যার কারণে তাঁকে বলা হতো ‘মহিলাদের মুখপাত্রী’
[ড. মুহাম্মদ আব্দুল মা’বুদ, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা: ৬/২৩০।]

একবার তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে একটি ছোটোখাটো ভাষণ দেন। তিনি বলেন:

“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একদল মুসলিম নারীর পক্ষ থেকে তাদের কিছু কথা বলার জন্য এসেছি। আল্লাহ আপনাকে নারী-পুরুষ উভয় জাতির জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আমরা নারীরা আপনার ওপর ঈমান এনে আপনার অনুসারী হয়েছি। কিন্তু, নারী-পুরুষের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করেছি। আমরা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকি, পুরুষেরা তৃপ্তি ভোগ করে এবং আমরা তাদের সন্তানদের ধারণ করি। আর পুরুষরা জুমুআর নামাজ জামাতে ও জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। তারা হজ্জে যেতে পারে। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয়, পুরুষরা আল্লাহর পথে যুদ্ধে যেতে পারে। আর আমরা তখন তাদের সন্তানদের লালনপালন করি, ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করি, কাপড় তৈরির জন্য চরকার সূতা কাটি।

আমাদের প্রশ্ন হলো, আমরা কি আপনাদের (পুরুষ) মতো সওয়াবের অংশীদার হবো? আমার পেছনে যতো নারী আছে, তাদের এবং আমার একই প্রশ্ন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তখন অন্যান্য সাহাবীরা ছিলেন। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহার এমন প্রশ্ন শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পুরুষ সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন-
“তোমরা কি দ্বীন সম্পর্কে কোনো নারীর কাছ থেকে এরচেয়ে সুন্দর প্রশ্ন শুনেছো?”

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহার এমন প্রশ্ন শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্ত হননি, রাগ করেননি; তিনি বরং তাঁর প্রশ্ন করার প্রশংসা করেন।

সাহাবীরা জবাব দিলেন-

“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের তো ধারণাই ছিলো একজন নারী এমন প্রশ্ন করতে পারে!”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহার প্রশ্নের জবাব দিলেন-

“নারী যদি তার স্বামীর সাথে সদাচরণ করে, তার স্বামীর মন যুগিয়ে চলে, তার আনুগত্য করে এবং দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তাহলে সেও পুরুষের সমান প্রতিদান লাভ করবে। যাও, তুমি এই কথা তোমার পেছনে রেখে আসা নারীদের বলে দাও।”

আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলের জবাব শুনে খুশি হন এবং ‘আল্লাহু আকবর’ তাকবির দিতে দিতে নারীদের কাছে চলে যান।
[ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান: ৮৩৬৯, আল্লামা ইবনে আসির, উসুদুল গাবা: ৫/৩৯৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বিয়ের সময় তাঁকে যারা নববধূর সাজে সাজিয়েছিলেন, আসমা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বিয়ের দিন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাতে দুধের পেয়ালা দিলেন। আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা দুধপানে লজ্জা পাচ্ছিলেন। তখন আসমা তাঁকে মৃদু ধমক দিয়ে দুধ খেতে বলেন।
[মুসনাদে আহমাদ: ৬/৪৫৮-৪৬১]

বিয়ের অনুষ্ঠানে পাত্র-পাত্রী একত্রিত হবার পর দুধপানের ঘটনা সাহাবীদের যুগে পাওয়া যায়।

উহুদ যুদ্ধে আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর পরিবারের সদস্যদের হারান। উহুদ যুদ্ধে তাঁর পিতা ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু, তাঁর ভাই আমির রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তাঁর চাচা যিয়াদ ইবনে আস-সাকান রাদিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল করেন।
[ড. মুহাম্মদ আব্দুল মা’বুদ, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা: ৬/২৩৩]

আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহার পরিবারের সদস্যগণ যেমন ছিলেন যোদ্ধা, তেমনি তিনি নিজেও ছিলেন যোদ্ধা।

ইয়ারমুকের যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁবুর খুটি দিয়ে পিটিয়ে একাই ৯ জন রোমান সৈন্যকে হত্যা করেন! 
[ইমাম আয-যাহাবী, সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা: ২/২৯৭, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, আল-ইসাবা: ৪/২২৯]

মদীনার আনসারী নারী সাহাবীদের মধ্যে যারা আলেমা ছিলেন, আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আনসারী নারীদের মধ্যে সর্বাধিক হাদীস বর্ণনা করেন।

একদিন আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা সহ আরো কয়েকজন নারী বসা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই পথ দিয়ে মসজিদে যাবার সময় নারীদেরকে সালাম দেন।
[সুনানে আবু দাউদ: ৫২০৪, জামে আত-তিরমিজি: ২৬৯৭]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা তালাকপ্রাপ্তা হন। তাঁকে কেন্দ্র করে তালাকপ্রাপ্তা নারীর জন্য ইদ্দতের আয়াত নাযিল হয়। 
[সুনানে আবু দাউদ: ২২৮১]

যেসব নারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দাওয়াত খাওয়ান, তাদের মধ্যে আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহাও ছিলেন। একবার তিনি রাসূলুল্লাহকে মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়াবস্থায় দেখেন। তিনি বাড়িতে গিয়ে রাসূলের জন্য গোশত ও রুটি নিয়ে আসেন।

গোশত ছিলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে পছন্দের খাবার। সাহাবীরা তাঁকে দাওয়াত দিলে সামর্থ্যানুযায়ী আপ্যায়ন করতেন। যাদের গোশত খাওয়ানোর সামর্থ্য ছিলো, তারা গোশত খাওয়াতেন।

আসমা বিনতে ইয়াযিদ শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাতের খাবারের জন্য গোশত আর রুটি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একা সব খাবার না খেয়ে তাঁর সাহাবীদেরকে ডাকলেন। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা অবাক হলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।

তিনি গুনে দেখলেন ৪০ জন সাহাবী তাঁর নিয়ে আসা রুটি-গোশত খেলেন, তারপরও রুটি-গোশত অবশিষ্ট রয়ে গেছে!

এটা ছিলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম মুজিযা। রাসূলুল্লাহ একটি মশকে পানি খেয়ে সেদিনের মতো বিদায় নেন। আসমা বিনতে ইয়াযিদ সেই পানির মশকটি সংরক্ষণ করেন। এই পানির মশক থেকে পরবর্তীতে দুটো উদ্দেশ্য সাহাবীরা পানি পান করতেন।

আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। তাঁর বাড়িতে কেউ আসলে তিনি তাকে যথেষ্ট আপ্যায়ন করতেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর তাঁর কয়েকজন সাহাবী মদীনা ছেড়ে চলে যান। আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মদীনা ছেড়ে দিমাস্কে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে ইন্তেকাল করেন।
[ইমাম আয-যাহাবী, সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা: ২/২২০, ২৯৬]

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Exit mobile version