যিনা (ব্যাভিচার) কি?
Table of Contents
যিনা বা ব্যভিচার কি?
যিনা বলতে বুঝায় ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক বিবাহ বন্ধন ছাড়া অবৈধ পন্থায় যৌন তৃপ্তি লাভ করাকে। যিনাʾ (زِنَاء) বা জিনা (زِنًى বা زِنًا) হল অবিবাহিত দুইজন মানুষের মধ্যে যৌনক্রিয়া।
ব্যুৎপত্তিগতভাবে : যিনা হল ইসলামী বৈবাহিক নিয়ম অনুযায়ী পরস্পর অবিবাহিত একাধিক মুসলিমের মাঝে অবৈধ যৌন সম্পর্ক বিষয়ক একটি ইসলামী নিষেধাজ্ঞা। বিবাহোত্তর যৌনতা এবং বিবাহপূর্ব যৌনতা।
যেমনঃ পরকীয়া (পারস্পারিক সম্মতিতে বিবাহিতের অবৈবাহিক যৌন সম্পর্ক), ব্যভিচার (দুজন অবিবাহিতের পারস্পারিক সম্মতিতে যৌনসঙ্গম), পতিতাবৃত্তি (অর্থের বিনিময়ে যৌনসঙ্গম), সমকামিতা (সমলিঙ্গীয় ব্যক্তিদ্বয়ের পারস্পারিক সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক), অজাচার (পরিবারের সদস্য বা অবিবাহযোগ্য রক্তসম্পর্কের ব্যক্তির সঙ্গে যৌনসঙ্গম), পশুকামিতা (অমানব পশুর সঙ্গে যৌনসঙ্গম) এবং ধর্ষণ (জোরপূর্বক অবৈবাহিক যৌনসঙ্গম) এর অন্তর্ভুক্ত।
যিনা কবিরা গুনাহ যা তাওবাহ ব্যাতিরেকে মাফ হয় না। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ”লা তাকরাবাল যিনা” যার অর্থ “তোমরা যিনার ধারে-কাছেও যেও না।”
ইসলামী শরীয়াতে অবৈধ পন্থায় যৌন সম্ভোগ সম্পূর্ণ হারাম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে বাঁচতে চাইলে এখনি নিজেকে ফিরাও।
নিজের আবেগ আর মনগড়া যুক্তি দিয়ে জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচা যাবেনা।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন “হাতের যিনা হলো গায়রে মাহরামকে (যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ) স্পর্শ করা”।
[বুখারী, মুসলিম, রিয়াদুস সালেহীন ৪র্থ খন্ড হাদীস নং – ১৬২১।]
আজকাল অবৈধ প্রেম ও সহশিক্ষার কারণে কিংবা অভিনয় জগতে কাজ করার কারণে কিংবা পর্দা সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষ একে অন্যের হাত ধরা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বোনেরা একটু চিন্তা করে দেখুন উপরের হাদীসের আলোকে তাহলে অহরহ আমরা কোন ধরনের গুনাহের মধ্যে ডুবে আছি…
যিনা কি শুধুই অবৈধ ভাবে মেলা-মেশা করাকে বলা হয়
-আচ্ছা যিনা কি শুধুই অবৈধ ভাবে মেলা-মেশা করাকে বলা হয়?
-না!
যিনা অনেক প্রকারের হয়ঃ
- কোন বেগানা নারী অথবা পুরুষের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া চোখের জিনা।
- যৌনতা সম্পর্কিত অশ্লীল কথাবার্তা বলা জিহ্বার জিনা।
- বিবাহ সম্পর্ক ছাড়া অবৈধভাবে কাউকে স্পর্শ করা হাতের যিনা।
- ব্যাভিচারের উদ্দেশ্যে হেঁটে যাওয়া পায়ের যিনা।
- সে সম্পর্কিত খারাপ কথা শোনা কানের জিনা।
- যিনার কল্পণা করা ও আকাংখা করা মনের জিনা।
- অতঃপর লজ্জাস্থান একে পূর্ণতা দেয় অথবা অসম্পূর্ণ রেখে দেয়। [বুখারী,মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে আন-নাসাঈ]
অথচ আমরা কেবল সর্বশেষ ধাপটিকেই যিনা মনে করে থাকি!!
বোন এইবার ভেবে দেখুন আপনি এইসব এর কোনো একটির সাথে জড়িত নয়তো?
যিনা হারাম ও কবিরা গুনা
যিনা হারাম ও কবিরা গুনাহঃ
আল্লাহ তায়ালা জিনাকে হারাম ঘোষণা করে বলেনঃ
তোমরা যিনার ধারে কাছেও যাবে না। কেননা তা অত্যন্ত নির্লজ্জ এবং খারাপ কাজ।
[বনী-ইসরাঈল: ৩২]
وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً
আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।
[সূরা বনী ইসরাঈলঃ৩২]
যিনার শাস্তি কি ?
যিনার শাস্তিঃ
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
আমি স্বপ্নে একটি চুলা দেখতে পেলাম যার উপরের অংশ ছিল চাপা আর নিচের অংশ ছিল প্রশস্ত আর সেখানে আগুন উত্তপ্ত হচ্ছিল, ভিতরে নারী পুরুষরা চিল্লাচিল্লি করছিলো।
আগুনের শিখা উপরে আসলে তারা উপরে উঠছে, আবার আগুন স্তিমিত হলে তারা নিচে যাচ্ছিলো, সর্বদা তাদের এ অবস্থা চলছিলো।
আমি জিবরাঈল (আঃ) কে জিজ্ঞেস করলামঃ এরা কারা?
জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ
তারা হলো অবৈধ যৌনচারকারী নারী ও পুরুষ। (বুখারী)
যিনাকারীর লজ্জাস্থানের দূর্গন্ধে জাহান্নামবাসী অস্থির হয়ে উঠবে। সেদিন জিনাকারীকে পিপাসা মেটানোর জন্য এই পঁচা পানি দেওয়া হবে।
তাই সবারই উচিত প্রেমিক-প্রেমিকা নামের এই শয়তানি সম্পর্ক চিহ্নিত করা এবং কৃত গোনাহ থেকে তাওবা করে ফিরে আসা।
কারণ, হাশরের ময়দানে এইসব শয়তানী সম্পর্ক থাকবেনা, থাকবে শুধুই আগুন। সেদিন কেউ কাউকে চিনবেও না, আর বলবে…
হায় আফসোস! আমি যদি রাসূলের দেখানো পথে চলতাম, অমুক বন্ধুর ডাকে সাড়া না দিতাম তাহলে আজ আমার এ দশা হতো না।”
[সূরা ফুরকান: ২৭-২৮]
যদি কেও না জেনে এই অপরাধ করে থাকে এবং খাস দিলে আল্লাহর কাছে তাওবা করে তবে আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দেবেন, ইনশা-আল্লাহ।
[সূরা ফুরকান :৬৮-৭০]
অতএব,
হে মুসলিম ভাই ও বোনেরা!
সাবধান হও অবাধ যৌনচার থেকে।
কারণ কিয়ামতের দিন নিজেদের বোঝা নিদেরকেই উঠাতে হবে, কেউ কারো গুনাহের বোঝা উঠাবে না।
হাদিসের আলোকে যিনা কি?
হাদিসে যিনাকে সঙ্গায়িত করা হয়েছে সকল প্রকারের বিবাহবহির্ভূত যৌনসঙ্গম হিসেবে।
আবূ হুরায়রা সুত্রে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেছেনঃ আদম সন্তানের উপর যিনার যে অংশ লিপিবদ্ধ আছে তা অবশ্যই সে প্রাপ্ত হবে। দু-চোখের জিনা হল (নিষিদ্ধ যৌনতার প্রতি) দৃষ্টিপাত করা, দু’কানের যিনা হল শ্রবণ করা, রসনার যিনা হল কথোপকথন করা, হাতের জিনা হল স্পর্শ করা, পায়ের যিনা হল হেঁটে যাওযা, অন্তরের যিনা হচ্ছে আকাংখা ও কামনা করা। আর যৌনাঙ্গ অবশেষে তা বাস্তবায়িত করে অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।—
সহীহ বুখারী, ৮:৭৭:৬০৯ (ইংরেজি), সহীহ মুসলিম, ৩৩:৬৪২১ (ইংরেজি)
হাদিসে জিনার শাস্তির বর্ণনা এসেছে জনসম্মুখে বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড হিসেবে, এটি পাওয়া যায় মূলত হাদিসের “কিতাব-আল হুদুদ” নামক সংকলিত খণ্ডাংশে।
‘উবাদা বিন আস-সামিত বর্ণনা করেন: আমি আল্লাহর রাসূলকে বলতে শুনেছি: আমার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর। আল্লাহ সেসব মহিলাদের জন্য আদেশ জারি করেছেন। যখন একজন অবিবাহিত পুরুষ একজন অবিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচার করে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন পেতে হবে। আর বিবাহিত পুরুষের সাথে বিবাহিত নারীর ব্যভিচারের ক্ষেত্রে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে।—
সহীহ মুসলিম, ১৭:৪১৯১ (ইংরেজি)
আল্লাহর রাসূল বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করতেন এবং, তাঁর পরে, আমরাও পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করতাম, আমি ভয় করি যে কালের অতিক্রমের সাথে সাথে, মানুষ হয়তবা এটি ভুলে যাবে এবং হয়তো বলবে: আমরা আল্লাহর কিতাবে পাথর নিক্ষেপের শাস্তি খুঁজে পাই নি, এবং আল্লাহর নির্দেশিত এই কর্তব্য পরিত্যাগ করে বিপথে যাবে। পাথর নিক্ষেপ হল আল্লাহর কিতাবে দেয়া ব্যভিচারী বিবাহিত পুরুষ ও নারীদের জন্য ধার্যকৃত একটি দায়িত্ব যখন তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়, অথবা যদি গর্ভধারণ ঘটে, অথবা যদি দোষ স্বীকার করা হয়।—
সহীহ মুসলিম, ১৭:৪১৯৪ (ইংরেজি)
মা’য়িয নবীর কাছে এলো এবং তাঁর উপস্থিতিতে নিজের ব্যভিচার করার কথা চারবার স্বীকার করল, তাই নবী তাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার আদেশ দিলেন। কিন্তু হুজ্জালকে বললেন: “তুমি যদি তাকে তোমার কাপড় দ্বারা ঢেকে দিতে, তাহলে তা তোমার জন্য ভাল হত।”—
সুনান আবু দাউদ, ৩৮:৪৩৬৪ (ইংরেজি)
আরেক বিশুদ্ধ নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থ সহিহ বুখারীতে কয়েকটি ঘটনা পাওয়া যায় যেখানে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার কথা উল্লেখ রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ,আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত: ‘উতবা বিন আবি ওয়াক্কাস তাঁর ভাই সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসকে বললেন, “জা’মার দাসীর পুত্রটি আমার থেকে আগত, তাই একে তোমার তত্ত্বাবধানে রাখো।” তাই মক্কা বিজয়ের বছরে, সা’দ তাকে নিয়ে নিলেন এবং বললেন, “(এ হল) আমার ভাইয়ের পুত্র যাকে আমার ভাই আমার তত্ত্বাবধানে রাখতে বলেছেন।”
‘আব্দ বিন জা’মা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গেলো এবং বললো,
“(সে) আমার ভাই, আমার বাবার দাসীর পুত্র এবং আমার পিতার বিছানায় তাঁর জন্ম হয়েছিল।”
তাই তারা উভয়েই আল্লাহর রাসূলের সামনে তাদের মোকাদ্দমা পেশ করলেন। সা’দ বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! এই বালক আমার ভাইয়ের পুত্র আর তিনি একে আমার দায়িত্বে অর্পণ করেছেন।” ‘আব্দ বিন জা’মা বলল, “এই বালক আমার ভাই এবং আমার পিতার দাসীর ছেলে, এবং আমার পিতার বিছানায় তাঁর জন্ম হয়েছিল।” আল্লাহর রাসূল বললেন, “এই বালকটি তোমার, হে ‘আব্দ বিন জা’মা!” এরপর আল্লাহর রাসূল আরও বললেন, “উক্ত সন্তানটি বিছানার মালিকের, এবং উক্ত ব্যভিচারকারীকে পাথর নিক্ষেপ করা হোক।” যখন তিনি উতবার সাথে বাচ্চাটির সাদৃশ্য দেখলেন, তখন সাওদা বিন জা’মাকে বললেন, “তোমার পর্দা তাঁর সামনে নামিয়ে দাও।” বালকটি মৃত্যুর পূর্বে আর কখনই ওই মহিলাকে দেখতে পায় নি।—
সহীহ বুখারী, ৯:৮৯:২৯৩ (ইংরেজি)
পুরুষ ও নারীর মধ্যে জিনা সম্পর্কিত আরও যে সকল হাদিস রয়েছে সেগুলো হল:অবৈধ যৌন কর্মে লিপ্ত হওয়ার জন্য এক ইহুদি মহিলাকে পাথর নিক্ষেপ(রজম)।[২২]আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন যে নবীজি একজন যুবক এবং একজন বিবাহিত মহিলার দৈহিক মিলনের অভিযোগে মহিলাটিকে পাথর নিক্ষেপ করার আদেশ দিলেন[২৩] এবং যুবকটিকে চাবুক মারতে ও এক বছরের জন্য নির্বাসন দিতে নির্দেশ দিলেন;ওমর ইবন আল-খাত্তাব নিশ্চিত করেন যে, একটি নির্দেশ নাযিল হয়েছিল এই বিষয়ে যে, কোন মুহসান ব্যক্তি (একজন প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন, মুসলিম যে পূর্বে বৈধভাবে বৈবাহিক যৌন সম্পর্কে অংশ নিয়েছে, এবং তাঁর বিবাহ এখনো নিশ্চিতভাবে বহাল রয়েছে) যদি অবৈধ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয় তবে তাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে।
ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে অভিশপ্ত যিনার হাত থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদেরকে সহী বুঝ দান করুন, আমীন!
সংগৃহীত ও পরিমার্জিত।