উম্মুল মুমিনীন যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) : যে মহিয়সী নারীর বিয়ের সিদ্ধান্ত হয় সাত আসমানে।
Table of Contents
ইসলামের প্রাথমিক যুগ,
নারী পুরুষ সকলে দ্বিধা দ্বন্দের আবর্তে দন্ডায়মান, ঠিক সেই সময় নিরদ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এবং তাঁর পরিবার। পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠলেন অসম্ভব আল্লাহভীরু, বিনয়ী এবং আবিদা এক মহিয়সী রমণী।
আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন,
“আমি যায়নাব এর চেয়ে কোনো মহিলাকে বেশি দ্বীনদার, বেশি পরহেজগার, বেশি সত্যভাষী, বেশি উদার, দানশীল, সৎকর্মশীল এবং আল্লাহ-র সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে বেশি তৎপর হতে দেখিনি। শুধু তাঁর মেজাজে একটু রুক্ষতা ছিলো। তবে তাঁর জন্য তিনি খুব দ্রুত লজ্জিত হতেন।1
সুবহানআল্লাহ।
বৈবাহিক জীবনঃ
যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ছিলেন অভিজাত পরিবারের কন্যা। শৈশব থেকে তিনি পারিবারিক ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের মধ্যে লালিত পালিত হোন। সে সময় বংশ মর্যাদা এবং আভিজাত্য নিয়ে কুরাইশদের মাঝে এক প্রকার অহংবোধ কাজ করতো।
অন্যদিকে, যায়িদ ইবন হারিসা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্বীয় আযাদকৃত দাস। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তত্ত্বাবধানে পালিত হোন। তাঁর প্রখর ইলম দ্বারা ইসলাম অত্যঅধিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এবং যায়িদ ইবনে হারিসা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) -কে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলেন।
মূলত, এ বিয়ের উদ্দেশ্য ছিলো সাম্য ও সমতার বাস্তব প্রতিফলন। যা ইসলামের সূচনালগ্নে ছিলো এক নতুন মাইলফলক।
কিন্তু বিয়ের পর যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ও যায়িদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) উভয়ের মধ্যে দাম্পত্য কলহ এবং মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং ক্রমান্বয়ে তা বাড়তে থাকে।
অবশেষে যায়িদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) – কে ত্বালাক দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়িদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে ত্বালাক প্রদান থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁর শত চেষ্টা সত্ত্বেও বিয়েটি টিকল না এবং উভয়ের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেলো।
উম্মুল মুমিনীনের মর্যাদা লাভঃ
উল্লেখ্য, যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-র ত্বালাক এবং পরবর্তীতে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্ত্রী হবেন – এ ব্যাপারে আল্লাহ পাক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে পূর্বে অবহিত করেছিলেন।
কিন্তু যায়িদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হোন। সকলের কাছে তিনি যায়িদ ইবন মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর জাহিলী সমাজে ঔরসজাত এবং পালকপুত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলোনা। পালকপুত্রকে তাঁরা নিজ পুত্রসম মনে করতো।
এমতাবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতির কথা ভেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরব রইলেন এবং বিষয়টি গোপন রাখলেন।
অতঃপর আল্লাহ পাক কুরআনের আয়াত নাযিলের মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ্যে আনলেন এবং পোষ্যপুত্রের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিবাহের নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে এ প্রথা বিলুপ্ত করে ইরশাদ করলেনঃ
“আল্লাহ যাকে (যায়িদ) অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ পাক প্রকাশ করে দেবেন আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়িদ যখন যায়নাবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।”2
অতঃপর ত্বালাকের পর যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) -র ইদ্দত শেষ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) কে বিয়ে করলেন। আর এভাবেই তিনি উম্মুল মুমিনীনের মর্যাদায় অভিষিক্ত হোন।
পরবর্তীতে যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্য স্ত্রীগণ কে গর্ব করে বলতেন, আল্লাহ তা’আলা সাত আসমানে তাঁর বিয়ের সিদ্ধান্ত করেছেন এবং জিব্রাঈল (আলাইহিস সালাম) ছিলেন এ ঘোষণার বার্তাবাহক।
আল্লাহু আকবার।
দুনিয়াবিমুখতা ও দানশীলতাঃ
উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) -র খিলাফতকাল,
তিনি যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) -র জন্য বাৎসরিক ১২ হাজার দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করেন; কিন্তু তিনি কখনো তা গ্রহণ করেননি।
একবার উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-র জন্য এক বছরের ভাতা একত্রে পাঠালেন। যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তৎক্ষনাৎ দিরহামগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর বাযরাহ ইবনে রাফে’কে নিরদেশ দেন দিরহামগুলো আত্মীয়-স্বজন ও গরীব মিসকীনদের মাঝে বন্টন করার জন্য।
সব দিরহাম বন্টন করার পর তিনি দু’আ করেন এই বলে, “হে আল্লাহ, আগামীতে এই অর্থ যেন আমাকে আর না পায়। কারণ, এ এক পরীক্ষা।”
সুবহানআল্লাহ।
আর এ ব্যাপারে উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) অবগত হয়ে মন্তব্য করেনঃ “এ এমন এক নারী যার থেকে শুধু ভালো আশা করা যায়।”
পরবর্তীতে উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আরও এক হাজার দিরহাম তাঁর খরচের জন্য পাঠান। কিন্তু সেসবও তিনি পূর্বের ন্যায় দান করে দিলেন।
ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেন, যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এর সেই দু’আ কবুল হয় এবং তিনি সে বছরই ইন্তিকাল করেন।3
যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-র মৃত্যুতে আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) শোকাভিভূত হয়ে স্মরণ করলেনঃ “তিনি প্রশংসনীয় ও অতুলনীয় অবস্থায় চলে গেলেন। ইয়াতীম ও বিধবাদের অস্থির করে রেখে গেলেন।”4
যায়নাব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) যেদিন মারা যান সেদিন মদীনায় গরীব-মিসকীন ও অভাবী মানুষরা শোকে আহাজারি শুরু করে দেয়।
যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) -র মাঝে সমন্বয় ঘটেছিলো আল্লাহ তা’আলা-র পছন্দনীয় সব গুণাবলীর। আল্লাহভীরুতা, পরহেজগারিতা, দানশীলতা সহ যাবতীয় সৎ কর্মের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অতুলনীয় একজন। আর সে আদর্শ গ্রহণ করে আমরাও যেন হয়ে উঠতে পারি তাঁর মতো, আমীন।