Writing

যার আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই

একজন মুসলিমকে অবশ্যই আমানতদার হতে হবে। সে নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যে, মানুষজন যেন তাকে বিশ্বাস করে। সে যেন সবার বিশ্বাসের পাত্র হতে পারে। একজন মুসলিম হয়ে সে কিভাবে প্রতারণা করতে পারে?

বিশ্বস্ততার আরবি শব্দ হলো ‘আমানাহ’। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে একটি শক্তিশালী আয়াত নাযিল করেন। আল্লাহ বলেন:

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে।”
[সূরা আন-নিসা: ৫৮]

আল্লাহ পবিত্র কুরআনের ‘সূরা মুমিনূন’ –এ মুমিনের ১৫ টি গুণের কথা উল্লেখ করেন। সেইসব গুণের মধ্যে একটি হলো- আমানত রক্ষা। আল্লাহ বলেন:

“এবং যারা নিজেদের আমানতসমূহ ও অঙ্গীকারে যত্নবান।”
[সূরা মুমিনূন: ৮]

সূরা মায়িদার প্রথম আয়াতে উল্লেখ করেন:

“হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করো।”
[সূরা আল-মায়িদাহ: ১]

আল্লাহ সুবহানাহু ওতা’আলা সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে সম্মানিত ফেরেশতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে বলেন:

“বিশ্বস্ত আত্মা (জিবরাঈল) এটা নিয়ে অবতরণ করেছে।”
[সূরা আশ-শুআরা: ১৯৩]

জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ‘রুহুল আমিন’ বিশ্বস্ত আত্মা/ফেরেশতা বলে উল্লেখ করেছেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে প্রশংসা করার জন্য অনেকগুলো বিশেষণ ছিলো। কিন্তু, আল্লাহ তাঁর জন্য বেছে নেন বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতার গুণ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী হিশেবে আত্মপ্রকাশের পূর্বে মক্কার লোকজন তাঁকে ‘আল-আমিন’ বলে ডাকতো। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এই গুণের প্রশংসা করেন, মানুষজন এই গুণের প্রশংসা করে।

আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন খুতবা খুব কম দিতেন, যেসব খুতবায় তিনি এই কথাটি বলতেন না-

“যার মধ্যে আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই।”
[মুসনাদে আহমাদ: ১১৯৩৫]

আপনি যদি নিজেকে মুসলিম দাবি করেন, কিন্তু আমানত রক্ষা না করেন, তাহলে বুঝা গেলো আপনার মধ্যে ঈমান নেই। আপনার মধ্যে ঈমান থাকলে আপনি আমানত রক্ষা করতেন। ঈমান থাকার মানে হলো আপনি আল্লাহকে ভয় পান, আপনি জানেন আল্লাহ আপনাকে দেখছেন। ফলে, আপনি মানুষকে ঠকাতে পারবেন না, আমানতের খেয়ানত করতে পারবেন না।

আমানতের গুণ এতো প্রশংসিত যে, এই গুণ যদি অমুসলিমদের মধ্যেও পাওয়া যায়, আল্লাহ তার প্রশংসা করেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে কতিপয় ইহুদি ও খ্রিস্টানের এই গুণের প্রশংসা করে বলেন:

“আর কিতাবীদের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে, যদি তার নিকট তুমি অঢেল সম্পদ আমানত রাখো, তবুও সে তোমার কাছে ফেরত দিবে।”
[সূরা আলে-ইমরান: ৭৫]

আমানতের অনুপস্থিতিকে খেয়ানত বলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনাফিকের চারটি লক্ষণের কথা উল্লেখ করেন। তারমধ্যে একটি লক্ষণ হলো-

“যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে খেয়ানত করে।”
[সহীহ বুখারী: ৩৪]

আমানতের রক্ষা করা ঈমানের পরিচয়, আমানতের খেয়ানত করা মুনাফিকের পরিচয়।
অনেকধরণের আমানত আছে। যেমন:

দ্বীনের আমানত

দ্বীনের আমানত হলো আল্লাহর ইবাদাত করা, নামাজ পড়া, যাকাত আদায় করা, রোজা রাখা ইত্যাদি। এই ধরণের আমানতের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:

“নিশ্চয়ই আমি আসমান, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এ আমানত পেশ করেছি, অতঃপর তারা তা বহন করতে অস্বীকার করেছে এবং এতে ভীত হয়েছে। আর মানুষ তা বহন করেছে।”
[সূরা আল-আহযাব: ৭২]

দায়িত্বের আমানত

যখন আপনাকে কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়, সেটা একটি আমানত। সেই দায়িত্ব ঠিকমতো পালনের মাধ্যমে আপনি আমানত রক্ষা করতে পারেন। আপনার যতো বড়ো দায়িত্ব, আপনার আমানত ততো বেশি। যার কারণে, একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রশংসা করা হয়; কেননা, তিনি তার আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করেন।

আর্থিক আমানত

কেউ যদি আপনার কাছে টাকা জমা রাখে, সেটা আপনার কাছে আমনত। ব্যাংক ব্যবস্থার পূর্বে মানুষ মানুষের কাছে টাকা জমা রাখতো। কোথাও সফর করার পূর্বে সমস্ত টাকা বা সম্পদ তারা যাকে বিশ্বাস করতো, তার কাছে আমানত রাখতো। সেই আমানতের যথাযথ হেফাযত করা একজনের দায়িত্ব।

জিহ্বার আমানত

যখন্ন আপনি কাউকে কোনো কথা দিবেন, সেই কথা রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব; এটাও একপ্রকার আমানত।

কথার আমানত

কেউ যদি আমাদেরকে কোনো কথা বলে, সেটা গোপন করতে বলে, তাহলে সেটাও একপ্রকার আমানত। যদি তার গোপন কথাটি কাউকে বলে দিই, তাহলে সেটা আমানতের খেয়ানত হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“সকল মজলিশ আমানতস্বরূপ।”
[সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৬৯]

আড্ডায় অনেকসময় অনেক কথা বলা হয়। সেসব কথা ফেসবুকে পোস্ট করার আগে জিজ্ঞেস করে নিন, ‘কথাটি কি বলবো?’
এমনকি কেউ যদি গোপনে আপনাকে কিছু বলে, সেটাও গোপন রাখতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“কোনো ব্যক্তি কোনো কথা বলার পর মুখ ঘুরালে (কেউ শুনছে কিনা তা দেখলে) তা আমানতস্বরূপ।”
[সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৬৮]

কেউ কোনো কথা বলার পর ‘কথাটি গোপন রাখবেন’ বলতে হবে কেনো? আপনাকে সে বিশ্বাস করে কথাটি বলেছে, আপনি তার কথাটি অন্যকে বলবেন না; সে আপনাকে সতর্ক করুক বা না করুন। আপনি তার কথা বলার ধরণ দেখেই যদি বুঝেন, কথাটি গোপন কথা; তাহলে আপনি তা গোপন রাখুন।

মনে করুন, এক মজলিশে একজন আরেকজনের গীবত করলো। সে গীবত করে গুনাহ কামালো। আপনি যদি এখন যাকে নিয়ে গীবত করা হয়েছে, তার কাছে কথাটি পৌঁছে দেন সেটাও তখন গুনাহের কাজ। এটাকে বলা হয় ‘নামিমাহ’। গীবত যেমন হারাম, গীবতের কথা অন্যজনকে জানানোও হারাম

পরামর্শের ক্ষেত্রে আমানত

কেউ যদি আপনার কাছে পরামর্শ চায়, সেটাও আমানত। যেমন: একজন একটি ব্যবসার জন্য কিছু পরিকল্পনা আপনাকে বললো। তার পরিকল্পনামাফিক আপনি তাকে কিছু পরামর্শ দিলেন। অতঃপর আরেকজন ব্যবসায়ীকে যদি প্রথমজনের পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন, সেটা হবে আমানতের খেয়ানত।

হাফসা বিনতে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহা বিধবা হবার পর উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর জন্য পাত্র খুঁজেন। তিনি আবু বকর ও উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুমার কাছে যান। কিন্তু, তারা তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দেননি। তিনি খুব ব্যথিত হন। কারণ, তাঁর বন্ধুপ্রতীম দুজন তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ে করেন।

রাসূলুল্লাহর বিয়ের পর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণ বলেন। তিনি বলেন:

“আপনার প্রস্তাব গ্রহণ না করায় আপনি আমার ওপর ব্যথিত হয়েছেন। আপনি যখন প্রস্তাব দেন, আমি একটি কারণে তা প্রত্যাখ্যান করি। কারণ হলো- আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর (হাফসা) সম্পর্কে আলোচনা করতে শুনেছি। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোপন কথা প্রকাশ করতে চাইনি। যদি তিনি তাঁকে বাদ দিতেন, তবে আমি তাঁকে বিয়ে করতাম।”
[সুনানে আন-নাসাঈ: ৩২৪৮]

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলের সেই গোপন কথা সম্পর্কে এতো সচেতন ছিলেন যে, তিনি তা তাঁর বন্ধু উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেননি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাদেম হবার কারণে আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলের অনেক গোপন বিষয় জানতেন, কখনো বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বলতেন। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু একটি গোপন কথা বলেন। ছোট্ট বয়সেও তাঁর মধ্যে আমানতদারিতার পরিচয় পাওয়া যায়। রাসূলের এই গোপন বিষয় সম্পর্কে তাঁর জন্মদাত্রী মা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই আমানতের খেয়ানত তিনি করেননি। নিজের আপন মাকেও সেই কথাটি তিনি বলেননি।
[সহীহ বুখারী: ৬২৮৯]

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার আমানত:

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার আমানতের খেয়ানত হলো সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মানতের খেয়ানত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি হবে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম পর্যায়ের, যে তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সাথে মিলিত হয়। অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়।”
[সহীহ মুসলিম: ৩৪৩৪]

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার গোপনীয় বিষয়গুলো হলো আমানত। সেই আমানত বন্ধু-বান্ধবীর সাথে শেয়ার করা যাবে না। গোপন বিষয়গুলো অন্য কাউকে বলা যাবে না। স্বামী-স্ত্রী যদি নিজেদের একান্ত গোপনীয় ব্যাপারগুলো অন্যের সাথে শেয়ার করে, সেটা হবে সর্বনিকৃষ্ট পর্যায়ের আমানতের খেয়ানত।

তবে, হ্যাঁ, প্রয়োজনে কিছু কথা বলা যেতে পারে। যেমন: ডাক্তারের কাছে। তাছাড়া, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে টানাপোড়ন হলে সেটার মিটমাটের জন্য তারা তৃতীয় পক্ষের পরামর্শ নিতে পারে; সেগুলো ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু, সাধারণ নিয়ম হলো, গোপনীয়তা প্রকাশ করা যাবে না।

শেষকথা হলো, আমানত আর ঈমান অনেকটা পাশাপাশি। ‘ঈমান’ ও ‘আমানত’ একই ক্রিয়ামূল থেকে। আমানত হলো, আপনি কাউকে কিছু বলে স্বস্তি লাভ করেন।

উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:

“আমি কারো নামাজ, রোজা দেখে তাকে যাচাই করি না। কাউকে যাচাই করি তার আমানতদারিতা দেখে; নামাজ-রোজা তো সবাই পড়ে, সবাই রাখে।”

আমানতদারিতার গুণ অর্জন করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। কিন্তু, এই গুণ ভাঙ্গতে একটি ছোট্ট ভুলই যথেষ্ট। এজন্য আমাদেরকে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

লিখেছেন

Picture of আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture