নবীর কন্যা যায়নাব বিনতে মুহাম্মদ এর জীবনী

যায়নাব رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ এর জন্ম পরিচয়

রাসূলুল্লাহ এর এবং তাঁর প্রথম সহধর্মিণী খাদীজাতুল কুবরার মিলন-জাত সন্তান-সন্তুতির মধ্যে সর্বপ্রথম কে জন্ম গ্রহণ করেন- পুত্র কাসেম, না কন্যা যায়নাব এ নিয়ে মতভেদের কিছুটা অবকাশ রয়েছে। কিন্তু কন্যাগণের মধ্যে বড় যে যায়নাব এ সম্পর্কে কোনই মতভেদ নেই।

রাসূলুল্লাহ-এর নবুওয়াত লাভের মোটামুটি দশ বৎসর পূর্বে যায়নাব জন্ম গ্রহণ করেন। তখন রাসূলুল্লাহ-এর বয়স ৩০ (ত্রিশ) এবং উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা (রাযিঃ)-এর বয়স ৪৫ (পয়তাল্লিশ) বৎসর। যায়নাবের শৈশব সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য জানা যায় না। মহৎ-চরিত্র পিতা এবং গুণবর্তী ও ধনবর্তী মাতার স্নেহচ্ছায়ায় ও উত্তম লালন-পালন গুণে যায়নাব যে এ সময় আদর্শ কন্যা রূপে গড়ে উঠছিলেন- একথা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।

বিবাহ ও স্বামীর মার্জিত আচরণ

রাসূলুল্লাহ-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বেই যায়নাব (রাযিঃ)-এর বিবাহ্ অল্প বয়সে তার আপন খালাত ভাই আবুল ‘আস ইবনু রাবী’ (ইবনু আবদিল উয্যা ইবনু আব্দি শামস ইবনু আব্দি মান্নাফ)-এর সঙ্গে সুসম্পন্ন হয়।

শুধু যায়নাব رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ-এরই নয়, রাসূলুল্লাহ তাঁর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কন্যা রুকাইয়া رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ এবং উম্মু কুলসুম رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ-এর শুভ বিবাহ্ আবু লাহাবের দুই পুত্র যথাক্রমে উৎবা এবং উতাইবার সঙ্গে আরও কম বয়সে সম্পন্ন করে ফেলেন। কিন্তু নবুওয়াত লাভের পর আবূ লাহাব এবং তার স্ত্রী উম্মু জামীলা (হাম্মা-লাতাল হাতাব)-এর ইসলামের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ ও রাসূল-এর সাথে দুশমনীর কারণে তাদের কড়া হুকুমে উক্ত বিবাহ বন্ধন তালাকের মাধ্যমে ছিন্ন করে ফেলা হয়। সে কথা যথাস্থানে বিবৃত হবে।

এখানে যায়নাব (রাযিঃ)-এর বিয়ের কথা এবং প্রতিকুল পরিবেশেও স্বামী-স্ত্রীর একে-অপরের ভালবাসার গভীরতা এবং অটলতার কথা বর্ণনা হচ্ছে।

খাদীজা (রাযিঃ)-এর এক সহোদরা ভগ্নি ছিলেন যার নাম ছিল হালাহ। ‘রাবী’ ইবনু আবদিল উয্যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এদের মিলনজাত ছেলের নাম আবুল ‘আস। হালাহ মাঝে মাঝে বোন খাদীজার বাড়ীতে আসতেন এবং যায়নাবকে দেখতেন। যায়নাবের দৈহিক সৌন্দর্য, মিষ্টি মধুর কথা, বুদ্ধিমত্তা এবং আকর্ষণীয় চাল-চলন দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি হন এবং ভগ্নি-ন্যাকে পুত্রবধূ রূপে নিজ গৃহে নেয়ার আশা হৃদয়ে পোষণ করেন। অবশেষে তিনি তার বোনের নিকট একদিন বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন এবং বলেন: দু’জনে মানাবে ভাল।

হালাহ-এর প্রস্তাব শুনে খাদীজা (রাযিঃ) নিজে কোন মতামত ব্যক্ত না করে একদা সুযোগ বুঝে স্বামী রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর নিকট কথা তুলে ধরলেন। আবুল আস বুদ্ধি, সাহসিকতা, বীরত্ব, আচার-ব্যবহার সব দিক দিয়েই বর হিসেবে ছিল পছন্দনীয়। কাজেই রাসূলুল্লাহ এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন এবং যথাসময় নিয়ম মাফিক বিবাহ্ সম্পন্ন হল। পূর্বেই বলা হয়েছে। এ বিবাহ্ কার্য সম্পন্ন হয় রাসূলুল্লাহ-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে এবং তখন যায়নাব (রাযিঃ)-এর বয়স দশ বৎসরের নিম্নে।

যায়নাব (রাযিঃ)-এর বিয়ের পর ৪০ (চল্লিশ) বৎসর বয়সে রাসূল নবুওয়াতের মহা অবদান এবং রিসালাতের মহান দায়িত্ব লাভ করেন। তাঁর প্রতি প্রভু পরোয়ারদিগারের নিকট হতে দ্বিতীয় প্রত্যাদেশ নাযিল হলঃ

“হে বস্ত্রাবৃত (কাপড়ে ঢাকা) রাসূল! উঠুন, সতর্ক করুন; আর ‘ আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন; ….”1

তিন বৎসর পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ইসলামের প্রচার কার্য চালান হল। তারপর রাসূল র-এর অভিজ্ঞতা ও ধৈর্যধারণ ক্ষমতা যখন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হল এবং মুসলমানদের সংখ্যা ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে পৌঁছে গেল তখন নির্দেশ এলঃ

“হে রাসূল। আপনি প্রচার করুন যা আপনার উপর আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে তা।”2

আরও নির্দেশ এল “আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দেরকে সাবধান করুন” -(সূরা আশ্-শু’আরা ২১৪০)।

যায়নাব (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ-এর কলিজার টুকরা আর জামাতা আবুল ‘আস নিকটতম আপন জন। যথা সময়ে তাদের নিকটও ইসলামের বাণী প্রচারিত হল। যায়নাব (রাযিঃ) সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলেন। কিন্তু আবুল ‘আস উক্ত আহ্বানে সাড়া দিলেন না। তিনি মুশরিকদের দলেই থেকে গেলেন। স্ত্রী সত্য ধর্ম ইসলাম কুকূল করলেন আর স্বামী পিতৃ পুরুষের মিথ্যা ধর্মেই অবিচল থাকলেন। তবু তাদের মধ্যে প্রাক ইসলামী বিবাহ বন্ধন অটুটই থেকে গেল। এর অনেকগুলো কারণ ছিল: I

প্রথমত: স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে ভালবাসা ছিল অত্যন্ত গভীর,
দ্বিতীয়ত: ইসলামের সে প্রাথমিক অবস্থায় মুসলমানরা ছিল খুবই দুর্বল,
তৃতীয়ত: মুসলমান ও মুশরিকের বিবাহের নিষিদ্ধতা সম্পর্কীয় আয়াত তখন নাযিল হয়নি।
চতুর্থত: রাসুলে কারীম মাসলাহাতের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিবর্তে বন্ধন অটুট রাখাই শ্রেয় মনে করেছিলেন এবং পরিণামে তা যুক্তিসঙ্গত ও কল্যাণপ্রদ প্রতিপন্ন হয়েছিল।

ইসলামের সঙ্গে কুরাইশদের দুশমনী এবং বিরোধিতা যখন বেড়ে চললো, তখন কুরাইশদের কতক লোক আবুল ‘আসের নিকট গিয়ে যায়নাব (রাযিঃ)-কে তালাক্ব দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করল, এমন কি তার উপর চাপ সৃষ্টি করে তালাক দিতে যাধ্য করার জোর চেষ্টা চালাল। অবশেষে তাকে এ বলে প্রলোভিত করারও চেষ্টা করল, “তুমি আমাদের দুশমন মুহাম্মাদ-এর মেয়েকে বিবাহ করেছ। তুমি তাকে তালাক দাও। তার পরিবর্তে কুরাইশদের যে কোন সুন্দরী মেয়েকে তুমি পছন্দ কর, আমরা তাকেই তোমার সাথে বিবাহ্ দেবার ব্যবস্থা করব।”

আবুল ‘আস তাদের সব যুক্তিতর্ক এবং প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করলেন। ফলে তাদের হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হল।

মুহাম্মাদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এ সংবাদ শুনে খুশী হলেন। আবুল ‘আস-এর মার্জিত আচরণ এবং সুস্থ বিচার বুদ্ধির জন্য তিনি প্রশংসা করলেন যা পরবর্তীতে আরও অনেক সময়েই করেছেন।

দাওয়াতের কাজে সহযোগিতা রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এর নিজ বংশ এবং নিজ গোত্রে সে কুরাইশদের- যারা আল্লাহর একত্ববাদের কথা ভুলে গিয়ে শির্ক তথা পুতুল পূজার গুমরাহীতে লিপ্ত ছিল তাদেরকে- সত্য পথের সন্ধান দিলেন। ভ্রান্ত পথে চলার। পরিণতি সম্পর্কে হুঁমিয়ার বাণী উচ্চারণ করলেন এবং এক আল্লাহর স্বরূপ তুলে ধরলেন। তিনি তাদের ডাক দিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন:

“হে লোক সকল! তোমরা শুনে রাখ, আল্লাহ এক, তাঁর কোনই শারীক নেই। তিনিই বিশ্ব জগতের খালিক ও মালিক- সৃষ্টা ও অধিশ্বর। তিনিই মানুষ এবং অন্য সব সৃষ্টবস্তুর অভাবমোচক- দুঃখ-কষ্টের অপসারক এবং বিপদউত্তারক। অতএব তোমরা একমাত্র তাঁরই ‘ইবাদাত-বন্দেগী কর, তাঁরই নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। নিজ হস্তে তৈরী মূর্তিগুলোকে তোমাদের জন্য সুপারিশকারী এবং সাহায্যকারী ভেবো না। আল্লাহকে ভয় এবং সমীহ করে চল আর গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা কর। অন্যথায় ক্বিয়ামাতের ভয়াবহ দিবসে তিনি তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন।”

এই ছিল সেই বাণী যা শুনে মক্কার অধিবাসীগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। এ ধরনের বাণী যতই তারা শুনতে লাগল ততই তাদের উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততা বেড়ে চলল। যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন তাদের নিকট আদর্শ-চরিত্র ও বিশ্বস্ততম ব্যক্তি তিনি হয়ে উঠলেন তাদের সবচেয়ে অপ্রিয় ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তি- ঘোরতর শত্রু। তারা তাঁর প্রতি ও তাঁর মুষ্টিমেয় অনুসারীদের প্রতি অকথ্য অত্যাচার উৎপীড়ন শুরু করে দিল। তিনি যে পথ দিয়ে চলাফেরা করতেন সে পথেই কাফিররা কাঁটা ছড়িয়ে রাখত। তাঁর গলায় মোটা চাদর জড়িয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি করত। কখনও বা আল্লাহর ঘর কাবা গৃহে নামাযে সিজদারত অবস্থায় রাসূলের উপর উটের নাড়িভুড়ি চাপিয়ে দিত।

যায়নাব (রাঃ) তখন কিশোরী এবং বিবাহিতা। তিনি মহান পিতার উপর কুরাইশদের এই অন্যায় বর্বর আচরণে মর্মাহত ও উদ্বেগাকুল হয়ে পড়তেন। তিনি অস্থির হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসতেন।

একদিনের একটি ঘটনা নিম্নে বর্ণনা দেওয়া হল:

“মুদারিক ইবনু হারিস ‘আমেদী (রাঃ)-এর বর্ণনা মতে তিনি বলেন,
ইসলাম-পূর্ব জাহিলিয়াতের যুগে আমার পিতার সঙ্গে একবার হজ্ব করতে মক্কায় গিয়েছিলাম। মিনা প্রান্তরে আমি দেখতে পেলাম: একটি লোক দাঁড়িয়ে, তাকে পরিবেষ্টিত করে আছে অসংখ্য লোক! আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে ঐ লোকটি যাকে এত লোকে ঘিরে রেখেছে? তিনি বললেন: “এ হচ্ছে সেই পথভ্রষ্ট বেদুঈন। যার নাম মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), সে তার বাপ দাদার ধর্ম ত্যাগ করে নতুন ধর্ম প্রচার করছে।”

এই কথাগুলো বলে আমার পিতাও ঐ সমাবেশের দিকে এগিয়ে গেলেন, আমিও তাঁর অনুসরণ করলাম। গিয়ে দেখি রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ লোকদেরকে উপদেশ দিয়ে চলেছেন আর লোকেরা তাঁর কথা না শুনে উল্টো তাঁর প্রতি পাথর ছুঁড়ে মারছে এবং ধূলোবালি নিক্ষেপ করে চলেছে। তারা এই অমানুষিক আচরণ চালাতে গিয়ে প্রখর রৌদ্রে ক্লান্ত ও শ্রান্ত হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। ঠিক এমনি সময় আমরা দেখতে পেলাম একটি সুন্দরী কিশোরী বালিকা ব্যথিত, বিচলিত এবং ক্রন্দনরত অবস্থায় দৌড়ে সেখানে এসে উপস্থিত হল। তার হাতে পানির একটি পাত্র আর জামার বোতামগুলো খোলা। এই নিষ্কলঙ্ক মাসূম বালিকাটির পরিচয় সমবেত লোকদের মুখেই জানা গেল। তারা বলাবলি করতে লাগল, ঐ দেখ মুহাম্মাদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এর মেয়েটি এসে গেছে।

কিশোরী যায়নাবের তখনকার অবস্থা বর্ণনাতীত। বুযুর্গ পিতার ঐ অবস্থা দর্শনে কন্যা যায়নাব অত্যন্ত ব্যথিত। সহানুভূতি ও দরদভরা হৃদয় নিয়ে তিনি পিতার সাহায্যে সেখানে সমুপস্থিত। বুক ফেটে তার কান্না বেরিয়ে আসছে, চোখ দিয়ে অশ্রু-ধারা ঝরে পড়ছে। সেই অবস্থায় তিনি পানি ভর্তি পাত্রটি পিতার হাতে এগিয়ে দিলেন আর অঝোরে কেঁদে চললেন। তার মাথা এবং জামার বোতাম খোলা, সে দিকে তাঁর মোটেই খেয়াল নেই। রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ কন্যাকে লক্ষ্য করে মায়াভরা কণ্ঠে ডেকে বললেন: প্রিয়তমা কন্যা! জামার বোতাম আগে লাগিয়ে নাও। তুমি এত বেশী বিচলিত এবং পেরেশান হচ্ছ কি জন্য?

আল্লাহর রাস্তায় চলতে গিয়ে তোমার আব্বা পরাজিত ও পর্যুদস্ত হবেন- এ ভয় এ আশঙ্কা তুমি কস্মিনকালে তোমার হৃদয়ে স্থান দিও না।

যতই দিন যেতে লাগল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরামহীন প্রচারের ফলে মুসলমানের সংখ্যা ক্রমে ক্রমে ততই বেড়ে চলল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর চাচা মহাবীর হামযা (রাঃ) এবং সিংহ-হৃদয় ওমর ইবনু খাত্তাবের (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের ফলে তাদের সাহসিকতা এবং উৎসাহদীপ্ত সহযোগিতার ফলে ইসলামের শক্তি বর্ধিত হয়ে চলল। ফলে ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবীর ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নেতৃত্বে শোভাযাত্রা সহকারে মুসলমানগণ কাবা গৃহে গমন এবং তথায় প্রকাশ্যে জামা’আতের সঙ্গে শুকরিয়ার নামায আদায় করার তাওফীক লাভ করলেন।

এ সব দেখে কাফিরদের মনে হিংসার আগুন দিগুণ জ্বলে উঠল। তারা মুসলমানদের উপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ১১৮ জন মুসলমান দু’বারে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য হন।

মুসলমানগণ ইসলামের বাণী সেখানে বহন করে নিয়ে যান এবং ইসলামের নাম, সুখ্যাতি ও শক্তি আরবের বাইরেও প্রসারিত হতে থাকে। ইসলামের এই দুর্বার অগ্রগতিতে মক্কার কাফিরগণ তাদের ভবিষ্যৎ ভেবে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত হয়ে উঠে।

যায়নাবের (রাঃ) মদীনায় হিজরত হলো না

নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আপন জন্মভূমি মক্কা মুয়ায্যমার মায়া পরিত্যাগ করে যখন মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করতে বাধ্য হলেন, তখন পর পর তাঁর তিন কন্যাও মদীনায় গিয়ে তাঁর নৈকট্য ও সাহচর্যে অবস্থানের সৌভাগ্য লাভ করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মক্কায় মুশরিক স্বামী আবুল ‘আসের গৃহে রয়ে যেতে বাধ্য হলেন বড় কন্যা যায়নাব (রাঃ)।

স্নেহময়ী মাতা চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন, অত্যাচার ও যুলম-নির্যাতনের শিকার হয়ে মহান পিতা জন্মভূমি ছেড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তিনশত মাইল দূরে- এক অজানা অচেনা পরিবেশে। স্বামী আবুল ‘আস যদিও রাসূল (ﷺ) এর প্রতি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধাসম্পন্ন, তবু ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তিতে আতঙ্কিত মক্কাবাসীদের সাথে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রায় অংশ নিতে বাধ্য হন।

মহান পিতা নবী কারীম (ﷺ) এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফিরদের বিপুল সমর সম্ভার সহ যুদ্ধ যাত্রায় এবং তাতে স্বীয় স্বামীর অংশ গ্রহণের ফলে স্বামীর ভবিষ্যৎ চিন্তায় কাতর যায়নাব (রাঃ)-এর নারীসূলভ কোমল হৃদয় তখন মানসিক দ্বন্দ্বে ও অস্থিরতায় কিরূপ বিচলিত হয়ে উঠেছিল তা শুধু হৃদয় দিয়েই অনুভব করা যায়।

যায়নাবের স্বামী বন্দী হলেন

হিজরী দ্বিতীয় সালে এবং নবুওয়াতের চতুর্দশ বর্ষে- ইসলামের প্রথম এবং সুদূর ফলপ্রসারী ধর্মযুদ্ধ বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়। এক তৃতীয়াংশেরও কম সংখ্যক যোদ্ধা খুব অল্প সমর-সরঞ্জাম নিয়ে বিপুল অস্ত্র সজ্জিত এক হাজার যোদ্ধার সমবায়ে গঠিত কুরাইশ-বাহিনীকে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে পরাভূত ও পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হন। এই যুদ্ধে মুসলমানদের ৩১৩ জন মুজাহিদের মধ্যে মাত্র ১৪ জন শাহাদাৎ বরণ করেন। অপর পক্ষে অধিকাংশ কুরাইশ নেতা সহ মোট ৭০ জন শত্রু সৈন্য নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হয়। বন্দীদের অন্যতম ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জামাতা- যায়নাব (রাঃ)-এর স্বামী আবুল ‘আস। বন্দীদের সকলকে মদীনায় আনা হল।

তাদের হত্যা করা হবে- না মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে এই বিষয়ে রাসূল (ﷺ) সাহাবাদের (রাঃ) পরামর্শ চাইলেন। আবু বকর (রাঃ) সহ অধিকাংশ সাহাবা (রাঃ) মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। দয়াল নবী এই পরামর্শ গ্রহণ করলেন। মুক্তি পণ রূপে কেউ দিলেন অর্থ ও কেউ অন্য কিছু। তবে যে সকল বন্দী লেখা পড়া জানত, রাসূল (ﷺ) তাদেরকে বলে দিলেন যে, তোমরা প্রত্যেকে মদীনার দশ জন বালককে লেখা-পড়া শিখিয়ে দাও- এটাই তোমাদের মুক্তিপণ।

মুক্তি যেভাবে পেলেন

অর্থের বিনিময়ে মুক্তিকামী বন্দীদের অর্থ আসল মক্কা থেকে। বিরহ বেদনা কাতর যায়নাব (রাঃ) স্বামীর মুক্তিপণ স্বরূপ আপন দেবর ‘আমর ইবনু রবীকে তাঁর সেই হার ছড়াটি দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন- যে হারটি তাঁর মাতা খাদীজা (রাঃ) তাঁর বিয়েতে উপহার স্বরূপ প্রদান করেছিলেন।

রাসূল (ﷺ) সেই হারটি দেখেই চিনতে পারলেন এবং চমকিত হলেন। প্রিয়তমা সহধর্মিনী ও সহমর্মিণী খাদীজার (রাঃ) উপহার দেয়া সেই হারটি থেকে কন্যাকে বঞ্চিত করতে তাঁর কোমল প্রাণে আঁচড় কাটল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাহাবীদের (রাঃ) অনুমতি ছাড়া তিনি নিজে থেকে কিছুই বললেন না।

সাহাবীদের ডেকে তিনি বললেন, তোমাদের যদি কোন আপত্তি না থাকে এবং যদি সম্ভব মনে কর, তা হলে এই হারের বিনিময় ছাড়াই তোমরা আবুল ‘আসকে মুক্তি প্রদান করতে পার।

ইসলামের জন্য খাদীজার (রাঃ) অতুল্য ত্যাগ এবং অনুপম খিদমতের কথা স্মরণ করে আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর মানসিক অবস্থা দর্শনে এমন কে আছে যে বিরূপ অভিমত ব্যক্ত করতে পারে?
তারা সবাই সানন্দে এবং এক বাক্যে সম্মতি দিলেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিন্তু বিনা শর্তে আবুল ‘আসকে মুক্তি দিলেন না। তিনি একটি শর্ত আরোপ করলেন। শর্তটি হচ্ছে এই যে, আবুল ‘আস মক্কায় ফিরে গিয়েই যায়নাবকে (রাঃ) মদীনায় পিতার নিকট ফেরত পাঠিয়ে দেবে। আবুল ‘আস এই শর্ত মেনে নিয়ে মক্কায় ফিরে এলেন এবং এসেই যায়নাব (রাঃ)-এর মদীনায় প্রেরণের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু সহজে এবং সুস্থ দেহে যায়নাব (রাঃ)-এর পক্ষে মদীনায় পিত্রালয়ে পৌঁছা সম্ভব হয়নি।

মদীনায় হিজরতের পথে বাধা

মদীনার পথে রওয়ানা হওয়ার পর মক্কার অদূরে যে অপ্রীতিকর ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে যায়নাব (রাঃ) মক্কায় ফিরে আসতে বাধ্য হন অতঃপর সেই মর্মস্পর্শী ও হৃদয়-বিদারক ঘটনাটি বিবৃত হচ্ছে।

যায়নাব (রাঃ)-কে মক্কা থেকে মদীনায় নিয়ে আসার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবুল ‘আসের সাথে তাঁর পালিত পুত্র এবং বিশ্বস্ত অনুচর যায়িদ ইবনু হারিসাকে (রাঃ) পাঠিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে এই নির্দেশ প্রদান করলেন: “তুমি ‘বানি ইয়াজুজ’ নামক স্থানে অপেক্ষা করতে থাকবে। যখন যায়নাব (রাঃ) সেখানে পৌঁছে যাবে তখন তাকে তুমি সাথে করে মদীনায় নিয়ে আসবে।” যায়িদ (রাঃ) যথাসময় সেখানে পৌছে অধীর আগ্রহে যায়নাব (রাঃ)-এর আগমন প্রত্যাশায় প্রতীক্ষা করে চললেন।

এদিকে আবুল ‘আস মক্কায় এসে প্রতিশ্রুতি অনুসারে স্বীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা কেনানার সাথে যায়নাব (রাঃ)-কে ‘বাতনি ইয়াজুজ’ পর্যন্ত পৌঁছে দেবার নির্দেশ প্রদান করলেন।

যায়নাব গোপনে গোপনে মক্কা ত্যাগের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। কিন্তু তবুও কথা গোপন থাকল না। যায়নাবের (রাঃ) মক্কা ত্যাগের আয়োজনের কথা জানাজানি হয়ে গেল এবং এ নিয়ে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল। কেউ কেউ ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। কিন্তু কুট বুদ্ধি সম্পন্ন কিছু সংখ্যক লোক যাত্রা পথে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিলো।

যায়নাব (রাঃ) কিছু দিন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। অবশেষে অবস্থা কিছুটা অনুকূল ভেবে আল্লাহর উপর ভরসা করে দেবর কেনানাকে সাথে নিয়ে উটের পিঠে আরোহণ করে মদীনার পথে রওয়ানা হলেন।

কাফিররা এ সংবাদ যথাসময়ে জানতে পারল। কিছু সংখ্যক লোক উত্তেজনার বশে প্রতিরোধ সৃষ্টি এবং যায়নাব (রাঃ)-কে গ্রেফতারের জন্য বেরিয়ে পড়ল। এই দলে ছিল হোব্বার ইবনু আসওয়াদ নামে এক নিষ্ঠুর প্রকৃতির যুবক। এ ছিল খাদীজা (রাঃ)-এর চাচাত ভাই এর পুত্র এবং সেই সূত্রে যায়নাবের (রাঃ) রক্ত সম্পর্কীয় ভাই। কাফিররা ‘যি-তুয়া’ নামক স্থানে উটসহ যায়নাব (রাঃ) ও কেনানাকে ঘিরে ফেলল। তারা তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে চলল, বর্শা দ্বারাও আঘাত হানল। বর্শার এক আঘাতে যায়নাব (রাঃ)-এর উট মারাত্মক ভাবে আহত হল। কোন কোন বর্ণনায় যায়নাব (রাঃ)-এর পবিত্র দেহও তীর বর্শার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হল।

সর্বসম্মত মতে যায়নাব (রাঃ) উট থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। এই সময় তিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। পতন জনিত প্রচণ্ড আঘাতে তাঁর গর্ভপাত ঘটে গেল। তখন তাঁর অবস্থা অত্যন্ত করুণ এবং হৃদয়বিদারক। এই অবস্থায় কাফিরগণ রক্তরঞ্জিত যায়নাবকে (রাঃ) অধিকতর শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। যায়নাবের দেবর কেনানা এবার জীবনপণ করে প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি তার তীরদানী থেকে তীর বের করে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “থামো। এখন যে কেউ এক পদ আমাদের দিকে অগ্রসর হবে তাকেই এই তীরের শিকারে পরিণত হতে হবে।” কেনানার উগ্রমূর্তি দেখে কাফিরগণ হিম্মত হারিয়ে ফেলল, তারা সেখানে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল।

এই সময় কুরাইশ সরদার আবু সুফিয়ানের তথায় আগমন ঘটল। তিনি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কেনানাকে লক্ষ্য করে বললেন: “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। তুমি তোমার উদ্যত তীরটা সরিয়ে নাও, আমরা তোমার সাথে কিছু কথা বলে নেই।”

কেনানা তীর বন্ধ করে বললেন- কি বলবার আছে তাড়াতাড়ি বলুন। আবু সুফিয়ান তখন বললেন: “কেনানা! তোমার তো অজানা নেই- মুহাম্মাদ (ﷺ) এর সাথে কী নিয়ে আমাদের বিরোধ। তাঁর হাতে আমাদের পরাজয় এবং বিপর্যয় ঘটছে এবং তার ফলে যে অবমাননা আমাদের বরদাশত করতে হয়েছে সে সম্পর্কেও তুমি ওয়াকিফহাল। যদি মুহাম্মাদের ((ﷺ)) মেয়েকে মদীনায় যেতে দিই তা হলে লোকে ভাববে আমরা বড় দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমাদের মধ্যে নানারূপ কথা উঠবে এবং একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। কাজেই তুমি এখন যায়নাব (রাঃ)-কে নিয়ে মক্কায় ফিরে চল। উত্তেজনা কমে গেলে এবং অবস্থা কিছুটা শান্ত হলে তাঁকে সুযোগমত নির্বিঘ্নে মদীনায় পৌঁছিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে।”

কেনানা আবু সুফিয়ানের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং যায়নাব (রাঃ)-এর আঘাতজনিত অবস্থা ও পরিস্থিতির বিষয় বিবেচনা করে আপাতত মক্কায় ফিরে যাওয়াই যুক্তিসঙ্গত মনে করলেন।

আহত ও অসুস্থ যায়নাব (রাঃ) মক্কায় ফিরে গেলেন এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলেন। অতঃপর অবস্থা বুঝে কেনানা তার ভ্রাতৃবধূ যায়নাব (রাঃ)-কে নিয়ে পুনরায় মদীনার পথে রওয়ানা হলেন। ‘বানি ইয়াজুজ’ উপত্যকায় পৌঁছে তথায় অপেক্ষারত যায়েদ ইবনু হারিসার (রাঃ) হাতে যায়নাব (রাঃ)-কে সোপর্দ করে তিনি মক্কায় ফিরে এলেন।

যায়িদ (রাঃ) নবী-নন্দিনী যায়নাব (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে যথা সময় মদীনায় পৌঁছলেন এবং সসম্মানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে তাঁর আদরের দুলালীকে অপর্ণ করলেন।

স্নেহময়ী কন্যার নিকট তাঁর মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা শুনে দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। নবী সহধর্মিণী আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) বর্ণনা করেন: এই সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত দুর্ঘটনার কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলে উঠেন:
“আফসোস! আমার কন্যা যায়নাব আমার সব কন্যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ- আর তাকেই শুধু আমার প্রতি তাঁর ভালবাসার কারণে কাফিরদের হাতে এরূপ কষ্ট ও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হল।”

স্বামীর মক্কায় একাকী জীবন

যায়নাব (রাঃ) মদীনায় পিত্রালয়ে বসবাস করতে লাগলেন। তাঁর স্বামী আবুল ‘আস মক্কায় অবস্থান করে ব্যবসা বাণিজ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখলেন। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ ও সফল ব্যবসায়ী, অত্যন্ত কর্মঠ ও আমানতদার এবং বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। ব্যবসার দ্রব্য নিয়ে তিনি সিরিয়া প্রভৃতি স্থানে গমন করতেন। উল্লেখিত গুণের জন্যই অনেকে আবুল ‘আসের মাধ্যমে তাদের পণ্য দ্রব্যাদি দেশ-বিদেশে কেনা বেচা করাত।

আবুল ‘আস একাকী জীবন যাপন করে চললেন। মাঝে মাঝেই তাঁর সুন্দরী গুণবতী প্রিয়তমা স্ত্রী যায়নাব (রাঃ)-এর কথা মনে পড়ত। তাঁর বিরহ বেদনা তাকে বিষণ্ণ ও ব্যথিত করে তুলত, আর কবিতার আকারে তার বেদনা-ক্লিষ্ট মনের সেই আহাজারির অভিব্যক্তি ঘটত। এমন একটি কবিতার দুটি পঙ্কতি তাবাকাতের বরাতে বর্ণিত হয়েছে যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে: I

“আমি যখন ‘এরাম’ নামক স্থানটি অতিক্রম করছিলাম, তখন যায়নাব (রাঃ) আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল আর তখনই আমার মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই দু’আ উচ্চারিত হল: হে আল্লাহ তুমি রোগমুক্ত ও সুস্থ রাখো তাকে (আমার প্রিয়তমা নারীকে) যে অবস্থান করছে (মদীনার) হরমে। আল-আমীন ((ﷺ))-এর কন্যাটিকে তাঁর কল্যাণ কাজের জন্য পুরস্কৃত করুন, প্রত্যেক স্বামী প্রশংসা করে থাকে তাকে (তার গুণবতী স্ত্রীকে) যাকে সে উত্তম জানে।”

দিন বয়ে চলল এবং এক এক করে চার চারটি বৎসর অতিক্রান্ত হল। ইসলামের শক্তি বেড়ে চলল কিন্তু আবুল ‘আস তখন পর্যন্ত ইসলাম কবুল করলেন না। কারণ একটিই: আল্লাহর হুকুম তখন পর্যন্ত হয়নি।

যায়নাব স্বামীকে আশ্রয় দিলেন

৬ষ্ঠ হিজরীতে সেই প্রত্যাশিত হুকুম এল, তিনি ইসলাম কবুল করলেন। কি ভাবে- সে কথাই নিম্নে বিবৃত হচ্ছে।

আবুল ‘আস তার সঙ্গী-সাথী সহ বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে সিরিয়ায় গেলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত ১৭০ জনের একটি মুজাহিদ বাহিনীর সাথে তাদের মুকাবিলা হল। ছোটখাটো যুদ্ধের পর কাফিরগণ পরাজিত হয়ে বন্দী হল। তাদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের যে মালপত্র ছিল সবই মুসলমানদের হস্তগত হল। আবুল ‘আস কিন্তু কৌশলে বন্দী দশা থেকে নিজেকে মুক্ত করে সোজা মদীনায় চলে আসলেন এবং এসেই তাঁর প্রাক্তন জীবন-সঙ্গিনী নবী-দুলালী যায়নাব (রাঃ)-এর আশ্রয় প্রার্থনা করলেন।

একদিকে ভূতপূর্ব স্ত্রীর নিকট আশ্রয় লাভের জন্য আবুল ‘আস-এর করুণ মিনতি, অপর দিকে প্রাণ-প্রিয় পূর্ব স্বামীর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য যায়নাব (রাঃ)-এর আকুল হৃদয়-কামনা; সহানুভূতি ও প্রেমের স্মৃতি এই দুই দাবী উপেক্ষা করা যায়নাব (রাঃ)-এর মত খোলামন ও প্রেমময়ী নারীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি আবুল ‘আসকে আশ্রয় দিলেন। প্রত্যুষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফজরের নামায পড়ছিলেন তখন (কোন কোন, রিওয়ায়াতে আছে যে, নামায থেকে ফারিগ হয়েছেন এমন সময়) যায়নাব (রাঃ) সাহস সঞ্চয় করে সুমধুর মৃদু আওয়াযে ঘোষণা করলেনঃ

“ইন্নী ক্বাদ আজারতু আবাল ‘আস।”

“আমি আবুল ‘আসকে আশ্রয় প্রদান করেছি।” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ কন্যার সুমধুর কণ্ঠে উচ্চারিত এই ছোট্ট ঘোষণা শুনলেন। তিনি নামায শেষ করেই সাহাবাদের (রাঃ) লক্ষ্য করে বললেন:

“হে লোকসকল! তোমরা কি কিছু শুনতে পেয়েছ? তারা সমস্বরে বললেন: জি হ্যাঁ, আমরা শুনতে পেয়েছি।

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমালেন,
কসম সেই আল্লাহর যার হাতে আমার জীবন। গায়িবের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর জন্যই সুনির্দিষ্ট, অন্য কেউ এর অধিকারী নয়, আমিও নই। সত্যই যায়নাবের (রাঃ) এই ঘোষণার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমিও জানতাম না যে, আবুল ‘আস যায়নাবের (রাঃ) আশ্রয়ে আছে।

তারপর তিনি বললেন: যদি সাধারণ একজন মুসলমানও কাউকে আশ্রয় দেয়, তা হলে সমস্ত মুসলমানের (তথা সরকারের) উচিত তা রক্ষা করা।
এরপর তিনি যায়নাব (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং বললেন: বেটী! আবুল ‘আসের প্রতি যথারীতি লক্ষ্য রাখবে, তার যেন কোনরূপ কষ্ট না হয়, তার আদর যত্নের যেন কোন ত্রুটি না ঘটে, তবে তুমি তার থেকে অবশ্য নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবে।

আবুল ‘আসের প্রতি রাসূল (ﷺ) এই সহৃদয় ও নমনীয় মনোভাব দর্শনে যায়নাব (রাঃ) উৎসাহিত হয়ে উঠলেন এবং আবুল ‘আসের জন্য একটি বড় রকম সুপারিশ জানালেন।
যায়নাব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট আবুল ‘আসের আটককৃত মালামালসহ তাকে মুক্ত করে দেয়ার অনুরোধ জানালেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জবাব দিলেনঃ হে আমার স্নেহময়ী কন্যা! এ ব্যাপারটি আমার একার ফায়সালার বিষয় নয়, এটা সমগ্র মুসলিম জামা’আতের এখতিয়ারভুক্ত। তারা যদি রাযী হয় উত্তম, না হলে আমার করার কিছু নেই।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবাগণকে (রাঃ) ডেকে বললেন: দেখ! আমার এবং আবুল ‘আসের মধ্যে যে সম্পর্ক তা তোমরা সবাই জান, এবারও যদি তোমরা আবুল ‘আসকে তার মালামালসহ- যা তোমরা গনীমাতরূপে পেয়েছ, মুক্তি প্রদান কর তবে তা আমার পক্ষে হবে খুবই খুশীর কারণ। তা ছাড়া এর জন্য তোমাদের প্রতি সে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে (যার ফল হবে অত্যন্ত শুভ)। তবে এ ব্যাপারে আমি তোমাদের বাধ্য করছি না। তোমরা নিজেরা বিবেচনা করে দেখ।

সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ইচ্ছা এবং তাঁর খুশীর কারণ পূরণ না করে তাঁর বিরোধিতা করবেন- এমনটি হতেই পারে না। তারা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। সুতরাং তারা তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন এবং গনীমাতের মালগুলো এনে রাসূল (ﷺ) এর সম্মুখে হাজির করলেন।

আবুল ‘আস মুক্তি পেলেন এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে তাঁর ব্যবসার সমস্ত দ্রব্য সম্ভারও পেলেন। ফের তাঁর প্রতি যায়নাব (রাঃ)-এর আকর্ষণ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তার জন্য সুপারিশ আর তাঁর প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্নেহপূর্ণ ব্যবহার ও দয়ার্দ্র আচরণ তাঁকে অভিভূত করে তুলল। এর ভিতর দিয়ে ইসলামের মহান নীতি ও উদার আদর্শ তাঁর নিকট দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়ে উঠলো। তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলেন কিন্তু একটি বিশেষ বিবেচনায় তিনি তখন ইসলামে দীক্ষিত হলেন না। সেটা কী তা একটু পরেই জানা যাবে। অবশেষে স্বামী ইসলাম গ্রহণ করলেন।

আবুল ‘আস তার মালপত্র নিয়ে নিরাপদে মক্কায় ফিরে এলেন। তাঁর নিকট মক্কার কুরাইশদের অনেকের অনেক টাকা পয়সা ও দ্রব্যাদি গচ্ছিত ছিল। তিনি মক্কায় ফিরে এসেই প্রত্যেককে যার যার গচ্ছিত টাকা কড়ি ও দ্রব্যাদি বুঝিয়ে দিলেন। তারপর কুরাইশদের একত্রে ডেকে তাদের লক্ষ্য করে বললেন: এখন আমার নিকট তোমাদের কারও কোন দেনা পাওনা নেই তো? সকলেই বললেন- না, কারও কোন কিছুই পাওনা নেই। তুমি প্রত্যেকের প্রাপ্য পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছ। তুমি একজন দায়িত্বসম্পন্ন, কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।

আবুল ‘আস তখন বললেন: তোমরা এখন শুন এবং মনোযোগ দিয়ে শুনঃ আমি এখনই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছি। এই কথা বলেই তিনি সকলের সম্মুখে সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন:

“আশহাদু আল্-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ।”

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত পক্ষে অন্য কোন উপাস্য নাই, তিনি এক ও একক, তাঁর কোনই শরীক নাই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দাস এবং রাসূল।

কাফিররা তার ইসলাম গ্রহণের কথা এবং ঘোষণা শুনে হতভম্ভ ও স্তম্ভিত হয়ে গেল। তিনি তাঁদের লক্ষ্য করে আরও বললেন: আল্লাহর কসম! আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর খিদমতে তাঁর কন্যার আশ্রয়ে যখন অবস্থান করছিলাম তখনই ইসলাম কবুল করতাম। করিনি শুধু একটি কারণে আর তা হচ্ছে এই যে, তোমরা হয়ত ভাবতে যে, তোমাদের গচ্ছিত অর্থ ও দ্রব্যাদি আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যেই আমি ইসলাম কবুল করেছি। এ ভ্রান্ত ধারণা যাতে আদৌ সৃষ্টি না হতে পারে, সেজন্যই আমি তোমাদের গচ্ছিত সব কিছু প্রত্যার্পণ করে তারপর ইসলাম কবূল করলাম।

সপ্তম হিজরীর মুহাররাম মাসের ঘটনা এটি। এর পরপরই আবুল ‘আস মক্কা-মুয়ায্যমা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ নিয়ে গেলেন। আবুল ‘আস মদীনায় পৌঁছে সোজা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর খিদমতে হাযির হলেন এবং তাঁর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা বিবৃত করলেন।

রাসূল (ﷺ) কৌতুহলের সাথে জিজ্ঞেস করলেন: আবুল ‘আস। তুমি যখন বন্দী অবস্থায় এখানে অবস্থান করছিলে এবং যখন তোমাকে তোমার মালসহ মুক্ত করে দেয়া হল তখন তুমি কেন ইসলাম কবুল করলে না?

আবুল ‘আস আরয করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি মনে মনে তখনই ইসলাম গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু মুখে কালিমায়ি শাহাদাত শুধু এ জন্যই উচ্চারণ করিনি যে, লোকে এই বলে অভিযোগ দিবে যে, ভয়ে ভীত হয়ে এবং মাল ফেরত পাওয়ার লোভে আমি ইসলাম কবুল করেছি।

আবুল ‘আসের ইসলাম গ্রহণের সুসংবাদে মদীনার মুসলমানদের মনে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল।

যায়নাবের শিশু সন্তানের ইন্তিকাল

আবুল ‘আস ইসলাম কবুল করার পর যায়নাব (রাঃ)-এর সাথে তার পুনর্মিলনের বাধা অপসারিত হল। দীর্ঘ ছয় বৎসরের বিচ্ছেদ বেদনা এবং দুঃসহ বিরহ যাতনা ভোগের পর স্বামী-স্ত্রীর একান্ত বাঞ্ছিত মিলন ঘটল।

মনে হয় আবুল ‘আস ও যায়নাব (রাঃ) দম্পতির জন্য নিকটেই কোন বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবার সানন্দে তাঁর প্রিয়তমা কন্যা যায়নাব (রাঃ)-কে অনুমতি দান করলেন। স্বামী-স্ত্রী নতুন করে সুখের নীড় রচনায় মনোনিবেশ করলেন। সে নীড় রচিত হল এবং দুই অথবা তিনটি সন্তান সহ তাঁরা সেই সুখের সংসারে সন্তোষ-ধন্য জীবন যাপন শুরু করলেন।

কিন্তু খুব বেশী দিন এ সুখ স্থায়ী হতে পারল না। প্রথমে তাদের একটি সন্তান আল্লাহর আহ্বানে এ অস্থায়ী জগত থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করল।

সহীহ বুখারীতে উসামা ইবনু যায়িদ (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন-

আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে বসে আছি এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর এক কন্যার খাদিম এসে খবর দিলো যে, তার মনিব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ডেকে পাঠিয়েছেন। কেননা তার সন্তান মৃত্যু শয্যায় শায়িত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলে পাঠালেন, যাও গিয়ে কন্যাকে বলো: ইন্না লিল্লাহি মা আখাযা ওয়া লাহু মা আ’তা ওয়া কুলু শায়য়িন ইন্দাহু বিআজালিম মুসাম্মা।

“আল্লাহ যা ফিরিয়ে নেন তা অবশ্যই তাঁর এবং যা তিনি প্রদান করেন তাও তাঁরই, আর প্রত্যেক বস্তুর নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত হয়ে আছে তাঁর নিকট।”

“কন্যাকে একথাও বলে দিওঃ সে যেন সবর করে এবং ধৈর্য ধারণ করে চলে।”

খাদিম চলে যায়। কিন্তু আবার ফিরে আসে। এসে বলে: তিনি আল্লাহর কসম দিয়ে বলেছেন যেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তাশরীফ নিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন না গিয়ে পারলেন না। তাঁর সাথে গমন করেন সা’দ ইবনু উবাদা (রাঃ) এবং মা’আয ইবনু জাবাল (রাঃ)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সেই শিশুটিকে দেখান হল, তখন তার শেষ অবস্থা। নিশ্বাস প্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে, নাড়ির গতি থেমে যাচ্ছে, ঢেকুর বেড়ে চলেছে………।

আল্লামা কাজী সুলাইমান মনসুরপুরী (রঃ) তাঁর বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ ‘রাহমাতুললিল আলামীন’ দ্বিতীয় খণ্ড ৯৮ পৃষ্ঠায় এই হাদীসের উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন, খুব সম্ভব এই শিশুটি ছিল আলী (সাবতির রাসূল) ইবনু আবিল ‘আস।

কিন্তু পরবর্তী পর্যালোচনায় জানা যাবে যায়নাব (রাঃ)-এর প্রথম পুত্র আলীর মৃত্যু আরও পরের ঘটনা।

উপরোক্ত ঘটনাটি আরও একটু বিস্তারিত ভাবে বর্ণিত হয়েছে। আমরা নিম্নে তার অনুবাদ পেশ করছি:

যায়নাবের একটি শিশু সন্তান ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাঁকে স্বল্পায়ু করেছিলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর অবস্থা যখন সংগীন হয়ে উঠল এবং মৃত্যুর আশঙ্কা নিশ্চিতরূপে দেখা দিল, তখন যায়নাব (রাঃ) তাঁর পিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সংবাদ দিয়ে তাঁর আদুরে নাতীকে দেখে যাওয়ার জন্য ডেকে পাঠালেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারলেন শিশুর অন্তিম মুহূর্ত অতি নিকটে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ার্দ্র হৃদয় এবং করুণাপ্রবণ। শিশুদের অস্থিরতা, অস্বস্তি এবং কষ্ট যাতনা দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত ও বিচলিত হয়ে পড়তেন।

এ জন্যই প্রথমে তিনি তথায় যেতে ইতস্ততঃ করছিলেন। কিন্তু স্নেহের মেয়ে পুনরায় যখন আল্লাহর কসম দিয়ে ডেকে পাঠালেন তখন তিনি আর সে ডাক উপেক্ষা করতে পারলেন না। দৌহিত্রকে তিনি দেখতে গেলেন। যায়নাব মুমূর্ষু শিশুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোলে দিলেন। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই রুগ্ন শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়েছেন তখন শিশুটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানী চেহারার প্রতি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু-পূর্ব হেচকী শুরু হয়ে গেল। কোলের উপর এবং চোখের সামনে এই বিদায় দৃশ্য অবলোকন করে তাঁর কোমল হৃদয় বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হল এবং চোখ দিয়ে অশ্রু-ধারা ঝড়ে পড়তে লাগল। একজন সাহাবা বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! কী আশ্চর্য, আপনিও কাঁদছেন?

জওয়াবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: এ হচ্ছে আমার প্রিয় কন্যার প্রিয় সন্তান, তাঁর মৃত্যুতে ব্যথিত হৃদয়ের শোকাবেগে চক্ষু দিয়ে অশ্রু-ধারা নির্গত হওয়া কোন দোষের কথা নয়। (অবশ্য চিৎকার করে কান্না কাটি করা দূষণীয়)

যায়নাব (রাঃ)-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য

নবী নন্দিনী যায়নাব (রাঃ)-এর জীবনী সম্পর্কে খুব বেশী তথ্য পাওয়া যায় না। যতটা আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি মোটামুটি তা পাঠক-পাঠিকাদের সম্মুখে পরিবেশন করেছি। উক্ত বিবরণীতে তাঁর সম্বন্ধে অনেক কথাই বলা সম্ভব হয়নি। তবে যতটা তথ্য পাওয়া গেছে এবং পরিবেশিত হয়েছে তা থেকে তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং আদর্শ রমণীর পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে উঠে।

নারী জীবনের তিনটি রূপ কন্যা, স্ত্রী-গৃহিণী এবং মাতা যায়নাব (রাঃ) ছিলেন সুন্দরতম চরিত্র ও মহত্তম আচরণের প্রতীক, মানুষের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আদর্শা রমণী খাদীজাতুল কুবরার (রাঃ) প্রথমা কন্যা এবং হয়ত বা প্রথম সন্তান।

দশ বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কৈশোরের সূচনায় এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে যায়নাব (রাঃ) খালাতো ভাই আবুল ‘আসের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। কন্যা রূপে তাঁর ইসলাম কবুল করার আহ্বানে ত্বড়িত সাড়া প্রদান এবং তা এমন অবস্থায় যখন প্রিয়তম ব্যক্তি- আপন স্বামী তা গ্রহণ করতে নারায।

চির সত্যবাদী মহান পিতার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ছাড়াও তাঁর ইসলাম গ্রহণের মধ্যে আমরা তাঁর চরিত্রের যে দিকটি দেখতে পাই তা হচ্ছে: সত্যকে সহজে চেনার ক্ষমতা এবং যা সত্য তা প্রতিকূল পরিবেশেও বরণ করে নেয়ার অতুল্য সাহসিকতা।

আমরা দেখতে পাই কিশোরী কন্যা যায়নাব (রাঃ) বিবাহিতা হয়েও এবং শ্বশুর গৃহে কাফির পরিবারে অবস্থান করেও পিতার উপর কাফিরদের অমানুষিক অত্যাচারের কথা শুনে ব্যথিত ও বিচলিত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন, মহান পিতার প্রতি নির্মম অত্যাচারের চিহ্ন দর্শনে অঝোরে কেঁদেছেন এবং প্রয়োজনীয় সেবা শুশ্রূষা করেছেন। আরও দেখতে পাই তিনি ‘শিআবি আবি তালিবে’ পিতা এবং অন্যান্য আপন জনের সাথে দীর্ঘ

অন্তরীণ জীবনের অন্তহীন ও দুঃসহ কষ্ট যাতনা স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছেন।

রিসালাতের মহান দায়িত্ব কর্তব্য পালনে নিয়োজিত নির্যাতিত পিতার প্রতি- বিরুদ্ধ পরিবেশে অবস্থানরত কন্যার কর্তব্য পালন এবং তাঁর সাথে একাত্মতা প্রকাশের সুন্দরতম আদর্শ আমরা যায়নাবের (রাঃ) মাঝে এই সব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে দেখতে পাই।

ইসলামের বিজয়ের প্রতি আগ্রহ-প্রবণতা, মহান পিতার সহিত মিলিত হওয়ার ব্যগ্র-ব্যাকুলতা, বিরুদ্ধ পরিবেশে অবস্থানের অস্থিরতা এবং স্বীয় পিতা ও উদীয়মান মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে অন্যায় সমরে স্বামীর অংশ গ্রহণে এবং উহার ফলাফল শ্রবণে একদিকে আনন্দ অপর দিকে স্বামীর জন্য উদ্বিগ্নতা, পরবর্তী পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন স্বামীর সাথে মিলনের জন্য হৃদয়ের আকুলতা প্রভৃতি বিচিত্র মানসিক দ্বন্দ্বের শিকারে পরিণত হন যায়নাব (রাঃ) একের পর এক।

এই সব ঘাত প্রতিঘাতে ক্ষতবিক্ষত যায়নাব (রাঃ) তাঁর সত্যপ্রীতি ও পিতৃ-অনুরাগের জন্য কাফিরদের নিষ্করুণ হস্তে সাংঘাতিকভাবে আহত এবং রক্তরঞ্জিত হন। ধৈর্য ও তিতিক্ষার অতুলনীয় নিদর্শনও আমরা তার মধ্যে লক্ষ্য করি এই সব পর্যায়ক্রমিক ঘটনাবলীর মধ্যে।

এখানেই তার পরীক্ষার শেষ নয়- তাঁর এক শিশু সন্তানকে আল্লাহ তুলে নিয়ে তাঁর সবর এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর তাওয়াক্কুলের চরম পরীক্ষা গ্রহণ করেন এবং তিনি তাতেও উত্তীর্ণ হন।

কন্যার দুঃখে ও বেদনায় মহান পিতার উৎকণ্ঠা, কন্যার হৃদয়-প্রবণতার প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সহৃদয়তা এবং তাঁর সার্বিক মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে কন্যার প্রতি পিতার কর্তব্য পালনের মহান আদর্শের আমরা সুন্দরতম নিদর্শনই দেখতে পাই মহা মানব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আচরণ ও সুব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে যার আলোচনা আমরা উপরে করে এসেছি।

স্ত্রীরূপে যায়নাব (রাঃ)

স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে রক্ত সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু সেটা মোটেই দাম্পত্য সম্পর্কের মুখ্য কথা নয়। পারস্পরিক ভালবাসা, প্রেম ও প্রীতির সম্পর্কই হচ্ছে উক্ত বন্ধনের সফলতা এবং সার্থকতার মূল সূত্র। অকৃত্রিম প্রেম ও নিবিড় ভালবাসা আদর্শ স্বামী-স্ত্রীর অপরিহার্য গুণ এবং অমূল্য ভূষণ।

যায়নাব (রাঃ) ও আবুল ‘আস (রাঃ)- উভয়ের মধ্যে আমরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই বাঞ্ছিত গুণের চমৎকার সমাবেশ দেখতে পাই।

বিভিন্ন ঘটনা ও আচরণে আমরা উভয়ের পারস্পরিক ভালবাসার গভীরতার পরিচয় লাভ করি। ধর্মে পৃথক পথ অবলম্বন এবং মুসলিম-কাফিরদের মধ্যে প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও দুজনের কেউই তাদের দাম্পত্য বন্ধন ছিন্ন করতে প্রস্তুত নন বরং বন্ধন অটুট রাখতেই একান্ত অভিলাষী।

কুরাইশদের কতক লোক আবুল ‘আসের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল যায়নাব (রাঃ)-কে তালাক দেয়ার জন্য। এমন কি তাঁর পরিবর্তে আবুল ‘আসের পছন্দ মত কুরাইশদের যে কোন সুন্দরী মেয়েকে তার সাথে বিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও তারা প্রদান করে। কিন্তু আবুল ‘আস তাদের সে প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে যায়নাবের প্রতি তার অটুট প্রেম ও গভীরতম ভালবাসার নির্ভুল প্রমাণ প্রদান করেন।

বদর যুদ্ধে পরাজিত কাফিরদের মধ্যে যারা বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হয়, তাদের মধ্যে আবুল ‘আসও ছিল অন্যতম। তার মুক্তিপণ রূপে যায়নাব (রাঃ) কর্তৃক তাঁর মাতৃপ্রদত্ত সোনার হার প্রেরণের মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর স্বামী-অনুরাগের অতল গভীরতা এবং অত্যুজ্জ্বল ত্যাগের পরিচয় পাই।

পরবর্তী পর্যায়ে মদীনায় পিতৃগৃহে অবস্থান কালে পুনরায় বন্দী আবুল ‘আসকে আশ্রয় প্রদান এবং দখলকৃত মালামাল সহ তাকে মুক্ত করে দেয়ার

জন্য পিতার নিকট নির্ভর সুপারিশের মধ্যেও আমরা আবার আবুল ‘আসের প্রতি যায়নাব (রাযিঃ)-এর অকৃত্রিম ভালবাসা ও অবিচ্ছিন্ন অনুরাগ দেখতে পাই যার শুভ পরিণতি ঘটে তাঁদের আকাঙ্খিত পুনর্মিলনে।

যায়নাব (রাঃ)-এর ইন্তিকাল

‘আবুল ‘আস-এর সাথে পুনর্মিলনের মাত্র বৎসরাধিক কাল পর ৮ম হিজরীর কোন এক সময় স্বয়ং যায়নাব (রাঃ) ইহজগত থেকে মাত্র ৩১ বৎসর বয়সে চির বিদায় গ্রহণ করলেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)

মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার সময় মক্কার এক কাফিরের বর্শা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে উটের পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়ার কারণে তাঁর যে গর্ভপাত ঘটে যায় সেই আঘাত এবং গর্ভপাত জনিত রক্তক্ষরণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি। পুনঃ পুনঃ রোগের আবির্ভাব ঘটতে থাকে, অবশেষে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে ও রোগ তীব্রতর হয়ে উঠে এবং তিনি আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর অনন্ত সান্নিধ্যে প্রস্থান করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) এর চার বৎসর পর ১২ হিজরীর যিল-হজ্ব মাসে আবুল ‘আসও (রাঃ) পরলোক গমন করেন।

গোসল ও কাফন দান

উন্মু আইমান, সাওদা, উম্মু সালামা এবং উন্মু আতিলাঃ যায়নাবের (রাঃ) গোসল দানে শরীক হন। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর নির্দেশ মত তারা গোসল প্রদান করেন।

উন্মু আতিয়া বলেন, আমি নিজে যায়নাব (রাঃ) বিনতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোসল দানে অংশ নিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং গোসলের তরীকা বর্ণনা করছিলেন, আর আমরা তা হুবহু পালন করছিলাম। তিনি বলেছিলেন প্রত্যেক অঙ্গ তিন তিন বার অথবা পাঁচ পাঁচ বার করে ধুয়ে দেবে।

এর তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেকটি অঙ্গ পরিষ্কার ভাবে ধৌত এবং ময়লামুক্ত হওয়া চাই। তিন বারেই যদি তা সম্পন্ন হয় তবে তাই যথেষ্ট নতুবা পাঁচ বার ধৌত করবে যেন সমস্ত শরীর সন্দেহাতীত ভাবে নির্মল ও পবিত্র হয়ে যায়।

মৃত দেহের গোসল শেষে রাসূল (ﷺ) এর নির্দেশ মত তাকে কাফনের ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু আর্থিক অসংগতির কারণে কাফনের কাপড় প্রয়োজন মত যোগাড় না হওয়ায় রাসূল (ﷺ) উহা পূরণের জন্য স্বীয় ব্যবহারের লুঙ্গী কাফনের জন্য প্রদান করলেন। তাঁর নির্দেশ মত মাথায় তিনটি বেনী পাকান হল এবং সুগন্ধী (কাফুর) দ্রব্য ব্যবহার করা হল।

মাতৃহারা সন্তানদের অবস্থা

মাতৃহারা সন্তানদের অবস্থা ও রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর ভালবাসা, যায়নাব (রাঃ) মৃত্যুকালে তাঁর দু’টি সন্তান রেখে যান। একটি পুত্র, অপরটি কন্যা। পুত্রের নাম আলী, কন্যার নাম উমামাহ। তার জীবদ্দশায় তার একটি সন্তানের অল্পবয়সে মৃত্যুর কথা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।

আলী হিজরতের পূর্বে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। কখন এবং কার সাথে কি ভাবে তার মদীনায় আগমন ঘটে তার কোন বিবরণ জানা যায় না। তবে এটা জানা যায় রাসূল (ﷺ) তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তিনি সুন্দরতম শিক্ষা-দীক্ষা, আদব-কায়দা ও সৎ-চরিত্র লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে সর্বদা সাথে রাখতেন। যদি জিহাদ অভিযানে বাইরে যেতেন তখনও অনেক সময় তাকে সাথে নিয়ে যেতেন। মক্কা অভিযান কালেও আলী তাঁর নানার সাথে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন তখন কিশোর আলী রাসূল (ﷺ) এর সাথে একই উটে সওয়ার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ মাতৃ-হারা এ কিশোর দৌহিত্রকে কিরূপ ভালবাসতেন উক্ত ঘটনা থেকে তা সহজেই অনুমান ও অনুভব করা যায়।

এক মতে ‘আলী ইবনু ‘আবিল ‘আস তাঁর পিতার জীবদ্দশায় যৌবন প্রাপ্তির পূর্বেই ইন্তিকাল করেন। কিন্তু অন্য মতে আবু বাক্কার (রাযিঃ)-এর খিলাফাতকালে ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাৎ বরণ করেন।

যায়নাব (রাযিঃ)-এর কন্যা উমামাহ্ (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ-এর স্নেহলাভে ধন্য হন। রাসূলুল্লাহ তাঁর প্রিয় কন্যার রেখে যাওয়া একমাত্র কন্যা উমামাহকে কিরূপ ভালবাসতেন তার একাধিক বিবরণ হাদীস ও সীরাত গ্রন্থসমূহে দেখতে পাওয়া যায়।

সহীহ বুখারীর কিতাবুস্ সালাতে আবূ ক্বাতাদাহ্ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে: “রাসূলুল্লাহ তদীয় কন্যা যায়নাব (রাযিঃ) এবং (জামাতা) ‘আবুল ‘আস ইবনু রাবী ইবনু ‘আব্দিশ শামস-এর শিশু কন্যা উমামাহ্ (রাযিঃ)-কে (স্বীয় গরদানে) বহন করে নামায পড়তেন। যখন তিনি সিজদায় যেতেন, তখন তাঁকে (মাটিতে) বসিয়ে দিতেন এবং যখন সিজদাহ্ হতে উঠে দাঁড়াতেন, তখন তাকে পুনঃ (ঘাড়ে) তুলে নিতেন।”3

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে একবার কোন এক ব্যক্তি রাসূল-এর খিদমাতে কিছু তোহফা প্রেরণ করেন। সে তোহফার মধ্যে ছিল একটি সোনার হার। হারখানা হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ তাঁর পরিবারের সকলের সামনে ঘোষণা করলেন, আমি এ হারটি তাকেই দেব যে আমার নিকট সব চেয়ে অধিক প্রিয়। তাঁর পবিত্র সহধর্মিণীগণ তখন বুঝে নিলেন যে, ঐ হার আয়িশাহ্ (রাযিঃ) ছাড়া আর কারো ভাগ্যেই জুটবে না। কিন্তু দেখা গেল তাদের ধারণা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ উমামাহ্ (রাযিঃ)-কে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁর গলায় সে হারটি পরিয়ে দিলেন।

এমনি ভাবে আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশিও যখন রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর নিকট কিছু তোহফা পাঠালেন তখন তার মধ্যে প্রাপ্ত সোনার আংটিটি তিনি উমামাহর (রাঃ) হাতে দিয়ে বললেন: এই আংটিটা তুমি পরে নাও।

তাবাকাতুল কুবরা গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ইরশাদ করেন: আমার পরিবার পরিজনের মধ্যে উমামাহই (রাঃ) আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়।

একাদশ হিজরীতে উমামাহ (রাঃ) বয়ঃপ্রাপ্তা হন। ইতিপুর্বেই তাঁর পিতা আবুল ‘আসের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যু কালে আবুল ‘আস (রাঃ) যুবাইর ইবনু আওয়ামকে (রাঃ) এই ওয়াসীয়াত করে যান যে, তিনি যেন তার কন্যা উমামাহকে (রাঃ) কোন সৎ পাত্রের হাতে অর্পণ করেন।

অপরদিকে ফাতিমাতুয যোহরা (রাঃ) তাঁর অন্তিম কালে আলীকে (রাঃ) ওয়াসীয়াত করে যান, তাঁর মৃত্যুর পর যদি কাউকে বিবাহ করতে হয়, তাহলে তিনি যেন তাঁর ভগ্নী-কন্যা উমামাহকে (রাঃ) স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন।

আলী (রাঃ) ফাতিমার (রাঃ) ওয়াসীয়াত মুতাবিক উমামাহকে (রাঃ) স্ত্রীরূপে বরণ করতে আগ্রহ প্রদর্শন করেন। যুবাইর (রাঃ) দেখলেন আলীর (রাঃ) চাইতে সৎ পাত্র আর কে হতে পারে? তিনিও সন্তুষ্টির সাথে আলীর (রাঃ) হাতে উমামাহকে (রাঃ) অর্পণ করে তাঁর প্রতি ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করলেন।

আলীর (রাঃ) ঔরসে উমামাহর (রাঃ) কোন সন্তান জন্মের কোন তথ্য পাওয়া যায় না।

আলীর (রাঃ) শাহাদাতের পর তাঁর ওয়াসীয়াত মুতাবেক উমামাহ বিশিষ্ট সাহাবী মুগীরা ইবনু নওফালকে (রাঃ) স্বামীরূপে বরণ করেন। স্বামীরূপে করে মুগীরার (রাঃ) ঔরসে উমামাহ (রাঃ)-এর একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তাঁর নাম রাখা হয় ইয়াহইয়া। ইয়াহইয়া শৈশবেই ইহজগৎ ত্যাগ করেন।

মাতারূপে যায়নাব (রাযিঃ)

পুত্র ও কন্যার প্রতি স্নেহানুরাগ, আন্তরিক মায়া এবং রোগ বিরোগে উদ্বেগ ও শোকাকুলতা মাতৃ হৃদয়ের এক স্বাভাবিক ব্যাপার ও সহজাত বৃত্তি। এ বৃত্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল যায়নাব (রাযিঃ)-এর মধ্যেও। তার কিঞ্চিৎ পরিচয় আমরা উপরে পেয়েছি। তথ্যের অভাবে পূর্ণ পরিচয় থেকে আমরা বঞ্চিত।

ইসলাম-প্রীতি, রাসূলপ্রীতি এবং পিতৃ অনুরাগের জন্যই তিনি কাফিরদের হাতে আঘাত প্রাপ্ত হন- সে আঘাতের প্রতিক্রিয়াতেই তাঁকে যুবতীকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়। যুবতী বয়সে একটি বিকাশোম্মুখ ফুল ঝরে পড়ায় আমরা তাঁর পূর্ণ সুবাস থেকে বঞ্চিত হলেও তাঁর জীবনী থেকে যতটুকু শিক্ষনীয় তাও নেহায়েত কম নয়। আল্লাহ আমাদের সকলকে, বিশেষ করে আমাদের মা ও বোনদেরকে তাঁর মহৎ জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও প্রেরণা লাভের তাওফীক্ব প্রদান করুন-আমীন ॥

সংগ্রহীত
লেখকঃ- হুসাইন বিন সোহরাব
বইঃ- প্রিয় নবীর কন্যাগণ

  1. সূরা আল-মুদ্দাসসির ১-১৩ ↩︎
  2. সূরা আল-মায়িদাহ ৬৭ ↩︎
  3. বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাঃ ৫১৬], [আধুনিক প্রকাশনী, হাঃ ৪৮৬) ↩︎
Exit mobile version