Writing

ওয়াজের বিনিময় গ্রহণ

ওয়ায করে কোনোরূপ সম্মানী বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা যাবে কি না?
গ্রহণ করলে কী পরিমাণ গ্রহণ করা যাবে? এ ব্যাপারে শরী‘আতের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
এ প্রশ্নের উত্তরে আমার ক্ষুদ্র অধ্যয়ন হলো:

প্রথমত, সম্মানী আর পারিশ্রমিক এক নয়। সম্মানীর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে বেশি এবং দরাদরি থাকে না বললেই চলে। পক্ষান্তরে পারিশ্রমিক বা মজুরির ক্ষেত্রে পরিশ্রমকারী ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে বেশি এবং প্রায়ই দরাদরি হয়ে থাকে। বর্তমানে ওয়াযের বিনিময়ের ক্ষেত্রে বতর্মান যে অবস্থা তৈরি হয়েছে তা আর ‘সম্মানী’র পর্যায়ে নেই বললে অত্যুক্তি হবে না; বরং তা অনেকাংশে স্পষ্ট পারিশ্রমিক বা মজুরিতে পরিণত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ওয়াযের সম্মানী বা পারিশ্রমিক গ্রহণের ক্ষেত্রে অবস্থাভেদে শরী‘আতের হুকুমও কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন- সর্বোত্তম, উত্তম, মুবাহ, মাকরূহ ও হারাম

ক. সর্বোত্তম রীতি

সর্বোত্তম রীতি হলো- কোনোরূপ সম্মানী বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা ছাড়াই ওয়ায করা। নবী-রাসূলগণ এবং আমাদের সালাফে সালিহীন এ রীতিই অনুসরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أُولَـٰئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ ۖ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ ۗ قُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا ۖ إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرَىٰ لِلْعَالَمِينَ
এরা এমন ছিল, যাদেরকে আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছিলেন। অতএব, আপনিও তাদের পথ অনুসরণ করুন। আপনি বলে দিনঃ আমি তোমাদের কাছে এর জন্যে কোন পারিশ্রমিক চাই না। এটি সারা বিশ্বের জন্যে একটি উপদেশমাত্র।
[6:90]

قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرَى لِلْعَالَمِينَ -‘‘(হে রাসূল,) আপনি বলুন, আমি তোমাদের কাছে এ জন্য কোনো বিনিময় চাই না। (আসলে) এটি তো সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ বৈ নয়।”
কাজেই শরী‘আতের দৃষ্টিকোণ থেকে একান্ত কাম্য ও প্রশংসনীয় হলো, একজন ওয়ায়িয রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খলীফা-নায়িব হিসেবে কোনোরূপ সম্মানী বা পারিশ্রমিক লাভের আশা ছাড়াই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে কেবল দাওয়াতী চেতনা নিয়ে এ দায়িত্ব পালন করবেন। এ অবস্থায় তিনি তাঁর মহৎ কাজের জন্য পূর্ণ পুরস্কার আল্লাহ তা‘আলার কাছে পাবেন।

উল্লেখ্য যে, যদি কোনো লোক ব্যক্তিগতভাবে কোনো ওয়ায়িযকে তার ইলম ও যোগ্যতার জন্য ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ আন্তরিকভাবে কোনো হাদিয়া (উপঢৌকন) দেয় এবং এ হাদিয়া যদি ওয়াযের কারণে না হয়, তবে তিনি গ্রহণ করতে পারেন। তবে এ হাদিয়া যদি ওয়াযের কারণে দেওয়া হয়, তাহলে সর্বোত্তম হলো, সেই হাদিয়াও গ্রহণ না করা। বিশিষ্ট হানাফী ফকীহ ইবনু আবিদীন (রাহ.) বলেন,

وَالْأَوْلَى فِي حَقِّهِمْ إنْ كَانَتْ الْهَدِيَّةُ ، لِأَجْلِ مَا يَحْصُلُ مِنْهُمْ مِنْ الْإِفْتَاءِ وَالْوَعْظِ وَالتَّعْلِيمِ عَدَمُ الْقَبُولِ لِيَكُونَ عِلْمُهُمْ خَالِصًا لِلَّهِ تَعَالَى ، وَإِنْ أُهْدِيَ إلَيْهِمْ تَحَبُّبًا وَتَوَدُّدًا لِعِلْمِهِمْ وَصَلَاحِهِمْ فَالْأَوْلَى الْقَبُولُ

‘‘তাঁদের (মুফতী, ওয়ায়িয .. প্রমুখের) বেলায় সর্বোত্তম রীতি হলো, হাদিয়া যদি তাদের ইফতা, ওয়ায ও তা‘লীমের কারণে দেওয়া হয়, তাহলে তা গ্রহণ না করা, যাতে তাঁদের ইলম চর্চা একান্তই আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের মানসে হয়ে থাকে। আর যদি এ হাদিয়া তাঁদের ইলম, যোগ্যতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ আন্তরিকভাবে দেওয়া হয়, তবে সর্বোত্তম হলো তা কবূল করা।”

খ. উত্তম বা নির্দোষ রীতি

যদি কোনো ওয়ায়িযের নিজের ও পরিবারের খরচ মিটানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে এতে কোনো দোষ নেই যে, তিনি প্রয়োজনীয় রাহ খরচা নিতে পারবেন এবং একান্ত জরুরত মাফিক দৈনিক খরচা নিতে পারবেন, যা কোনোক্রমেই নিজের একান্ত প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত হবে না।
ধরুন, ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম শহরে বসবাসকারী একজন মধ্যবিত্তের নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের খরচ মিটানোর জন্য বাসা ভাড়াসহ মাসে আনুমানিক ৬০,০০০/= থেকে ১,০০,০০০/= টাকা লাগে। তাহলে তিনি রাহ ও দৈনিক খরচা ব্যতীত দিনে সর্বোচ্চ প্রায় ২৫০০/= থেকে ৩৫০০/= টাকা নিতে পারেন, যদি তিনি দিনে একটি মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন। আর যদি তিনি দিনে একাধিক মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন, তাহলে রাহ ও দৈনিক খরচা ব্যতীত কোনো মাহফিল থেকে ২০০০/= টাকার অতিরিক্ত গ্রহণ করা সঙ্গত হবে না।

উল্লেখ্য যে, এরূপ অবস্থায় তিনি যেহেতু তাঁর এ কাজের কিছু বিনিময় মানুষের নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন, তাই তিনি এ কাজের পূর্ণ সওয়াব আল্লাহ তা‘আলার কাছে পাবেন না। তিনি যে পরিমাণ খরচা গ্রহণ করেন সেই অনুপাতে আল্লাহর নিকট সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেন। যুদ্ধে গনীমত লাভ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

مَا مِنْ غَازِيَةٍ أَوْ سَرِيَّةٍ تَغْزُو فَتَغْنَمُ وَتَسْلَمُ إِلاَّ كَانُوا قَدْ تَعَجَّلُوا ثُلُثَىْ أُجُورِهِمْ وَمَا مِنْ غَازِيَةٍ أَوْ سَرِيَّةٍ تُخْفِقُ وَتُصَابُ إِلاَّ تَمَّ أُجُورُهُمْ.

“কোনো যুদ্ধ বা অভিযানে অংশ গ্রহণ করে যদি তুমি গনীমতের সম্পদ লাভ করো এবং নিরাপদে ফিরে আসো, তা হলে তুমি তোমার পুরস্কারের দু-তৃতীয়াংশ নগদ পেয়ে গেলে। আর যে ব্যক্তি গনীমতের সম্পদও লাভ করতে পারলো না, অধিকন্তু সে নিহতও হলো, তার পুরস্কার পুরোটাই বাকী রইলো।”

এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, যদি কেউ তার আমলের কিছু পার্থিব কল্যাণ ও স্বার্থ দুনিয়ায় লাভ করে, তা হলে সে আখিরাতে তার আমলের পূর্ণ পুরস্কার পাবে না। কাজেই বোঝা যায়, যে ওয়ায়িয তার ওয়াযের কিছু বিনিময় দুনিয়ায় গ্রহণ করে, সে তার ওয়ায়ের পূর্ণ পুরস্কার আল্লাহ তা‘আলার কাছে পাবে না।

গ. মুবাহ; কিন্তু প্রশংসনীয় নয়

যদি কোনো ওয়ায়িযের নিজের ও পরিবারের খরচ মিটানোর জন্য ভালো ব্যবস্থা থাকে, তাহলে তিনি যদি রাহখরচা ব্যতীত দরাদরি না করে প্রচলিত প্রথা অনুসারে যৌক্তিক পরিমাণ সম্মানী গ্রহণ করেন, তাতে অসুবিধা নেই। তবে এ অবস্থায় তিনি যেহেতু তার একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত ওয়াযের বিনিময় মানুষের নিকট থেকে গ্রহণ করেন, তাই তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে তাঁর এ কাজের কোনো সওয়াব আশা করতে পারেন না। উল্লেখ্য যে, একজন আলিমে রব্বানীর জন্য এ নিয়মের অনুবর্তন অবশ্যই কাম্য নয়।

ঘ. মাকরূহ

দরাদরি করে ওয়াযের বিনিময় গ্রহণ করা মাকরূহ। এভাবে ওয়াযের বিনিময়ে গৃহীত অর্থ সম্মানীর পর্যায়ে থাকবে না; বরং পারিশ্রমিক বা মজুরির পর্যায়ে পর্যবসিত হবে। শরী‘আতের দৃষ্টিতে এটা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয় যে, কোনো ওয়ায়িয ওয়াযকে উপার্জনের একান্ত পেশায় পরিণত করবেন এবং দরাদরি করে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক আদায় করবেন। এভাবে বিনিময় গ্রহণ করা মাকরূহ এবং এরূপ বিনিময় গ্রহণকারী পেশাদার ওয়ায়িয আল্লাহ তা‘আলার কাছে পুরস্কার পাওয়ার পরিবর্তে শাস্তি পাওয়ার উপযোগী হবে। উল্লেখ্য যে, ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থকড়ি উপার্জনের উদ্দেশ্যে ওয়ায-নসীহত করা এবং একে জীবন নির্বাহের পেশায় পরিণত করা একটি অত্যন্ত জঘন্য রীতি; অধিকন্তু এটি ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান আলিমদের কুপ্রথারই অনুকরণ। ইমাম হাছফাকী (রাহ.) বলেন,

التَّذْكِيرُ … وَلِرِيَاسَةٍ وَمَالٍ وَقَبُولِ عَامَّةٍ مِنْ ضَلَالَةِ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى .

“নেতৃত্ব লাভ কিংবা সম্পদ অর্জন অথবা সর্বসাধারণের নিকট গ্রহণযোগ্যতা লাভ করার জন্য ওয়ায করা ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের গুমরাহি।”

মুফতী আহমদ রেযা খান বেরলভী (রাহ.) বলেন,

“ওয়ায-নাসীহতকে সম্পদ উপার্জন কিংবা লোকজনকে নিজের ভক্ত বানানোর মাধ্যমে পরিণত করা গোমরাহী ও প্রত্যাখ্যাত এবং ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদেরই কুপ্রথা।”

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমানে দীনের খেদমতের সাইনবোর্ডের আড়ালে চলছে প্রচ্ছন্ন ব্যবসা। ওয়াযের বিনিময়ে দর-কষাকষি, উচ্চ বিনিময়ে কন্ট্রাক্ট করা ও অগ্রিম বুকিং মানি নেওয়ার মতো চরম গর্হিত কাজ, যা আলিম সমাজের ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

ঙ. হারাম

ওয়াযের জন্য অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করে মাহফিলে অংশগ্রহণ না করা এবং অগ্রিম গৃহীত অর্থ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে ফেরত না দেওয়া চরম গর্হিত কাজ। এ অগ্রিম অর্থ ভক্ষণ করা হারাম। এটা প্রকারান্তরে অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণের নামান্তর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ-‘‘হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।”

[আমার ‘প্রকৃত আলিমের সন্ধানে’ (প্রকাশিতব্য) বই থেকে]

লিখেছেন

Picture of ড. আহমদ আলী

ড. আহমদ আলী

প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Visit all other posts by this author

প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture