উম্মে সালামা: ধৈর্যশীলতা এবং সহনশীলতার প্রতীক যে মহিয়সী রমণী
উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) : ধৈর্যশীলতা এবং সহনশীলতার প্রতীক যে মহিয়সী রমণী।
মক্কায় মুসলমানদের ওপর কুরাইশদের অত্যাচার বেড়ে যাওয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুমতিক্রমে অন্যান্যদের সাথে উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এবং আবু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দম্পতি মদিনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
পথিমধ্যে,
উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এর গোত্র বনু মুগীরার লোকেরা তাদের বাধা দিয়ে বললো, “আমরা আমাদের মেয়েকে এ কঠিন পরিস্থিতিতে যেতে দিবো না।”
এরপর তারা আবু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে উটের লাগাম কেড়ে নিয়ে উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) কে তাদের সাথে নিয়ে চললো।
এদিকে আবু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর গোত্র আবু আবদিল আসাদের লোকেরা এসে তাদের শিশুপুত্র সালামা কে তাদের দখলে নিয়ে বনু মুগীরা গোত্র কে বলল,
“তোমরা যদি তোমাদের মেয়েকে তাঁর স্বামীর সাথে যেতে না দাও, তাহলে আমরা আমাদের সন্তানকে তোমাদের মেয়ের সাথে থাকতে দিবো না।”
ইতিমধ্যে, যেহেতু হিজরতের নির্দেশনা চলে এসেছিলো তাই আবু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) একাকী মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
এভাবে স্বামী, স্ত্রী, পুত্রের এক নির্মম বিচ্ছেদ ঘটলো। আর সে বিচ্ছেদ বেদনায় উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা আবতাহ উপত্যকায় টিলার উপর বসে কাঁদতে লাগলেন।
কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বনু মুগীরার এক ব্যক্তি এ দৃশ্য দেখে ভীষণ ব্যতিত হলেন। এরপর তিনি গোত্রের লোকদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আপনারা মেয়েটির এ দুর্দশা দেখেও কেন তাঁকে মুক্তি দিচ্ছেন না? কেন তাঁকে তাঁর স্বামী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন? তাঁকে মুক্তি দিন এবং স্বামী সন্তানের সাথে মিলিত হতে দিন।”
অতঃপর উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) গোত্রের লোকদের অন্তরে দয়ার সঞ্চার হলো। তারা উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) কে তাঁর স্বামীর কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। আর এ খবর শুনে বনু আবদিল আসাদ গোত্রও শিশু সালামাকে উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) র কাছে পাঠিয়ে দেন।
এরপর তিনি সালামাকে কোলে বসিয়ে উটে করে মক্কা থেকে একাকিনী তান’ঈম অবধি পৌঁছালেন। সেখানে উসমান ইবন আবি তালহা এর সাথে তাঁর দেখা হলো। পরবর্তীতে উসমান ইবন আবি তালহা উটের লাগাম টানতে টানতে উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) কে মদীনায় পৌঁছে দিলেন। আর এভাবে স্বামী-স্ত্রী-সন্তান পুনরায় একত্রিত হলেন।1
বস্তুত: হিজরতের সময় উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ও তাঁর পরিবারকে নানারকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়, অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাঁরা গেছেন। কিন্তু তারপরও দ্বীনের প্রতি তিনি ছিলেন পাহাড়সম অটল।
সুবহানআল্লাহ।
উম্মুল মুমিনীনের মর্যাদা লাভঃ
উহুদযুদ্ধের ডাক পড়লো।
আবু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সেই ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে যোগদান করলেন। যুদ্ধে একই নামের প্রতিপক্ষ আবু সালামা হাশামীর নিক্ষিপ্ত একটি তীরে তিনি আহত হোন। পরবর্তীতে সেই ক্ষতের আঘাতে তিনি ইন্তিকাল করেন।
আবু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) -র মৃত্যুর পর উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) সন্তান সহিত বিধবা হলেন। তাঁর একাকীত্ব, দুর্দশা এবং দুঃখ বেদনার কথা চিন্তা করে প্রথমে আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এবং এরপর উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু তিনি উভয়কে ফিরিয়ে দেন। পরবর্তীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা গ্রহণ করেন।
বস্তত: স্বামীর ইন্তিকালে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। কিন্তু সে মুসিবতেও তাওয়াক্কুল এবং সবরের ওপর তিনি অবিচল থেকেছেন এবং উত্তম স্থলাভিষিক্ত এর জন্য আল্লাহ পাক এর কাছে দু’আ করে গেছেন।
উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিতঃ
“আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, কোনো মুসলমান যখন কোনো বিপদে পতিত হয়, তখন সে যদি আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) বলে এবং এর সাথে এ দু’আ পাঠ করে,
اللّٰهُمَّ أْجُرْنِيْ فِيْ مُصِيْبَتِي وَأَخْلِفْ لِيْ خَيْرًا مِنْهَا
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমাকে বিপদে ধৈর্য ধারণের সাওয়াব দান করো এবং এর চেয়ে উত্তম স্থলাভিষিক্ত করে দাও।
তবে আল্লাহ পাক তাকে উত্তম দিয়ে ধন্য করবেন। যখন আবু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইনতিকাল করলেন তখন আমি বললাম, আবু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে উত্তম আর কে হতে পারে? তাঁর পরিবারই প্রথম যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে হিজরত করেছিলো। এরপর আমি এ দু’আ পাঠ করলাম। ফলে আল্লাহ পাক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আমার জন্য দান করলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার নিকট হাতিব ইবন আবি বালতায়াকে দিয়ে বিবাহের পয়গাম পাঠালেন। আমি বললাম, আমার একটি মেয়ে (দুগ্ধপোষ্য) রয়েছে আর আমি একটু অভিমানী। তিনি বললেন, তোমার মেয়ের জন্য আমি দু’আ করছি যেন আল্লাহ তার সুব্যবস্থা করে দেন এবং এটাও দু’আ করছি যে, তিনি তোমার অভিমানকে দূর করে দেন।”2
আল্লাহু আকবার।
ইসলামে তাঁর অবদানঃ
উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এর প্রকৃত নাম ছিলো হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহা)। তবে তিনি “উম্মে সালামা” নামেই অত্যধিক পরিচিত।
তিনি ছিলেন “কাদীমুল ইসলাম” (প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী) দের একজন। ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় যখন সবাই দ্বিধা দ্বন্দে ঘুরপাক খাচ্ছিলো তিনি সে সময় নিরদ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করেন। একই সাথে তিনি ছিলেন, “জুল-হিজরাতাইন” (দুই হিজরতের অধিকারী)
তিনি আবু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর সাথে প্রথমে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এরপর মদিনায় হিজরত করেন।
এছাড়াও তাঁকে “ফকীহ সাহাবীয়া” হিসেবে গন্য করা হয়। হাদীস গ্রন্থসমূহে তাঁর ৩৭৮ টি হাদিস পাওয়া যায়।
উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাওয়াক্কুল, সহনশীলতা ও ধৈর্যশীলতার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আর সে ধৈর্য এর পুরস্কার স্বরুপ আল্লাহ পাক তাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বারা সম্মানিত করেছেন, সুবহানআল্লাহ।
বিপদের ধৈর্যধারণ, সহনশীলতা ও তাকওয়ায় আমরাও যেন হয়ে উঠতে পারি তাঁর মতো, আমীন।