তোতলা ২য় পর্ব

মা আমি বিয়েতে রাজি আছি।
কথাটা বলেই মুচকি হেসে ফেলল রুবা। রেবেকা বেগম আনন্দে বিমোহিত হয়ে বললেন;
আলহামদুলিল্লাহ। আমি জানতাম আমার মেয়ে কখনো আমার কথার বিরুদ্ধে যাবে না। একটু দাড়া এই খুশিতে এক দফা মিষ্টি খাওয়া হয়ে যাক!
রেবেকা বেগম ফ্রিজ খুলে মিষ্টি বের করতে করতে ভিডিও কল করলেন জাহিদকে। জাহিদ তখন সবে কাজ থেকে ফিরেছে।
আসসালামু আলাইকুম আম্মু। হঠাৎ এত রাতে ফোন দিলে যে!
ওয়ালাইকুমুস সালাম। ফোন দিয়েছি কেন সেটা পরে শোন, আগে একটা মিষ্টি খা। হা কর।
ওহ..হো! ইয়াম নিয়াম ইয়াম…। খেয়েছি। এখন বলো ঘটনা কি?

রেবা বিয়েতে রাজি হয়েছে রে! এই নে বোনের সাথে কথা বল।
আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি রে! হঠাৎ মত পাল্টালো কি করে? তোর না তোতলা জামাই পছন্দ না!
খুব যে অপছন্দ সেটাও না। ভাবছি বিয়ের পর ওনাকে কিছুদিন ট্রেনিং দেওয়াবো।
দেখিস আবার ট্রেনিং দিতে গিয়ে নিজেই আবার তোতলা হয়ে না যাস। হাহাহা…!
হিহি। তুমিও নাকি ছোট বেলায় তোতলা ছিলে ভাইয়া?
কে বললো তোকে?
আম্মু বললো। শুনো, এবার দেশে আসলে কিন্তু আর যেতে দেওয়া হবে না তোমাকে। এখানেই বিয়ে করে থাকতে হবে। আমি তো অলরেডি পাত্রি দেখা শুরু করে দিয়েছি!

হুম, দেখ দেখ ভালো করে দেখ। তবে আমারও কিন্তু তোতলা মেয়ে চাই। তোতলা ছাড়া বিয়েই করবো না!
হাহাহা.! কেন? হঠাৎ তোতলাদের প্রতি এতো মায়া জাগলো কেন?
তোতলা মেয়ে বিয়ে করলে একটা বিশেষ লাভ আছে বুঝলি!
কি লাভ?
এরা আর যাই হোক ভালো করে ঝগড়া করতে পারবে না। বদমাস, বেয়াদব, বাদর ইত্যাদি উচ্চারণ করতে গিয়ে শুধু ব..ব..ব… করতে থাকবে, সেই সুযোগে বৃন্দাবন থেকে ঘুরে আসা যাবে। হাহাহা…!

জাহিদের কথা শুনে রুবা এবং রুবার মা দুজনেই হাসতে লাগলো। এমন সময় হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। রেবেকা বেগম বললেন; দেখ তো কে এসেছে!
রুবা দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই যা দেখতে পেলো তা সে কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি। গোটা দশেক গুণ্ডা টাইপের ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাফান। ছেলেগুলোর মুখে বিদঘুটে হাসির রেশ। রুবা ভালো করেই বুঝতে পারছে, বিয়ে না করার জন্য হুমকি দিতেই এটা রাফানের কারসাজি। রাফান যে এতোটা উশৃংখল হতে পারে সে বিষয়ে তার ধারণা ছিলো না! অবস্থা বেগতিক দেখে রুবা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা লাগিয়ে ভালোমতন খিল এঁটে দিলো।

কে এসেছে রে?
কেউ না মা।
কলিং বেল কে বাজালো তবে! নিশপু নাকি?
হতে পারে।

নিশপু পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়ার ছেলে। ক্লাস ফাইভে পড়ে। রুবা তাকে গণিত পড়ায়। মাঝেমধ্যে স্কুল যাওয়ার পথে কলিং বেল চেপে পালিয়ে যায় সে। এটা তার একটা খেলা। এভাবে রুবাকে ক্ষেপিয়ে বেশ মজা পায় সে।
মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে দেখে রাফানের রাগের আর সীমা রইল না। সে দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে কল করলো রুবাকে। রুবা কল ধরেই বলল;
এসব কি শুরু করেছেন আপনি?
বাহ! তুমি থেকে আপনিতে চলে গেলে!
মাত্র চার মাসের পরিচয়! এতো সেনসেটিভ হওয়ার কি আছে বুঝলাম না।
তোমার কাছে চারমাস হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে সেটাই অনন্ত কাল। আমি আর কিছু বুঝতে চাই না। আমাকে তো ভালো করেই চেনো, কি কি করতে পারি আমি!

জানি তো! ক্ষমতার জোরে সবকিছু করতে পারেন আপনি। কিন্তু মনে রাখবেন যা-ই করেন না কেন আমি আর আপনাকে ভালোবাসি না বরং ঘৃণা করি।
ফোন কেটে দিলো রুবা। নম্বরটাও ব্লাকলিস্ট করে রাখলো। রাফানের সাঙ্গপাঙ্গরা এক যোগে বলে উঠলো;
ভাই দরজা ভাঙবো নাকি? হুকুম দেন শুধু।

রাফান শান্ত ভঙ্গিতে বলল;
না থাক। এখন কিছু করবো না। দেখি আগে, ও যদি সত্যি সত্যি ওই ইন্দুরের বাচ্চাকে বিয়ে করে তাহলে রক্তের বন্যা বইয়ে দিবো একদম।
বসের কথা শুনে সাঙ্গপাঙ্গদের ভেতর বেশ উল্লাস খেলে গেল। যেন রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়ার জন্যই পৃথিবীতে তাদের আবির্ভাব হয়েছে!

বিয়ের সময় মেয়েদের কাঁদতে হয় এই কথাটি রুবা একদম ভুলে গেছে। তার কেন জানি বারবার হাসি পাচ্ছে শুধু। এই তো ক’দিন আগেও মায়ের সাথে ঘুমাতো রুবা, সেই ছোট্ট রুবা আজ বিয়ের পীড়িতে বসতে যাচ্ছে যেন বিশ্বাস-ই হচ্ছে না তার নিজেকে। রুবার বান্ধবীরা কতো করে বলল; একটু কান্না কর, না কাঁদলে মানুষ কি বলবে! উল্টো রুবা ফিক করে হেসে দেয়।

যাক, যথা নিয়মে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা আরম্ভ হলো। বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো রকম অ-ইসলামিক কার্যকলাপ চলবে না এটাই আমরুলের শর্ত ছিলো। এবং হলোও তাই! বরং পুরোপুরি সুন্নাত অনুযায়ী বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। সুন্নাতের ব্যপারে আমরুল কোথাও এতটুকুন ছাড় দিতে নারাজ৷ এমনকি বিয়ের সময় একটা ছবিও তুলতে দেয় নি সে। রুবা দেখলো তার বোকাসোকা বরটা কতোটা গুরুত্ব সহকারে ছবি তোলার ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে!
রাত তখন দশটা বাজে। রেবেকা বেগম রুবাকে আমরুলের হাতে তুলে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পরলেন। সাথে রুবাও কাঁদতে লাগলো। মা-মেয়ের কান্না দেখে আমরুল কি করবে কিছুই বুঝতে পারলো না। গাড়িতে ওঠার আগ পর্যন্ত মাথা নিচু করে রইলো সে। গাড়ি ছাড়ার পর রুবাকে বলল;
আ..আপনি…!

এই পর্যন্ত বলে নিশ্চুপ। কারণ সে জানে রুবা তোতলামি পছন্দ করে না। আর আমরুল না তোতলিয়ে কথাও বলতে পারে না। কি এক বিপত্তি!
বাসর ঘরেও কম বিপত্তিতে পরতে হয়নি তাকে! বিছানায় বসে আছে রুবা। আমরুল ওজু করে দুই রাকাআত শুকরিয়ার নামাজ পড়ে ঘরে ফিরলো৷ ঘরে ঢুকতেই দরজার সাথে খেল এক ধাক্কা। ধাক্কা খেয়ে একেবারে পরে যাওয়ার যোগাড়। রুবা ছুটে এসে হাত ধরে বলল;
আপনি এতো ধাক্কা খান কেন?

আমরুল ফিক করে হেসে ফেলল। রুবা হা হয়ে তার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি অদ্ভুত সুন্দর ভাবে হাসতে পারে লোকটা! এমন পবিত্র হাসি কখনো দেখে নি রুবা। ঘন দাড়ির ভেতর দিয়ে হাসির উদ্ভাসিত আলো পুরো মুখ ব্যপ্তি ছড়িয়ে গেছে। রুবা নেশাগ্রস্তের মতো বলে ফেলল;
এতো সুন্দর হাসি!
কিন্তু সে হাসি আর কতক্ষণ! রুবার কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে আমরুল যে মাথা নিচু করে বসে আছে তো আছেই। রুবা এবার অভিমানের সুরে বলল;
বাসর ঘরে কেউ এমন করে চুপচাপ বসে থাকে? কথা বলুন!

আমরুল একটু মাথা তুলে বলল;
আ..আমি যে তো..তোতলা!
রুবা এবার আমরুলের হাত ধরে ফেলল। এবং এটাই তার প্রথম স্পর্শ! তাই অনেকটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতেই বলল;
আর কখনো এভাবে বলবেন না প্লিজ! তোতলামিতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আর হ্যাঁ, আমি আপনাকে ভালো করে কথা বলানোর ট্রেনিং করাবো। কথা বলতে আর কোনো সমস্যা হবে না আপনার!
এবার আমরুল চোখ তুলে তাকালো রুবার দিকে। তাকিয়েই বলল;
আলহামদুলিল্লাহ!

এই প্রথম চোখাচোখি হলো তাদের। মুহুর্তেই রুবার শরীরের শিরা উপশিরায় অদ্ভুত একটা হিল্লোল বয়ে গেল। সামনের বসে থাকা মানুষটার প্রতি ভীষণ ভালোবাসা অনুভব হলো তার। আমরুলও রুবার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই মধুর মুহুর্তটি যে রবের দেওয়া চমৎকার একটি নেয়ামত সে কথা স্মরণ করে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো আমরুলের। রব তাকে কতোই না ভালোবাসে! এমন চমৎকার একটা মেয়ের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন!

বলে রাখা ভালো, আমরুল কিন্তু রুবার থেকেও বেশি আবেগপ্রবণ। এবং যাকে একবার ভালো লেগে যায় সে যদি শত্রুতেও পরিণত হয় তবুও তাকে কখনো দূরে সরিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করে না। আর লজ্জা একবার কেটে গেলে অনেক দ্রুতই বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে সে।
এ..একটা সু..সু..সুরা তেলাওয়াত কলি?
কথা খুঁজে না পেয়ে অনেকক্ষণ পর এটাই বলে ফেললো আমরুল!
রুবা তৎক্ষনাৎ হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারলো না। যে সামান্য একটু কথা বলতেই তোতলায় সে আবার সুরা তেলাওয়াত করবে কি করে! তারপরেও রুবা সম্মতি দিয়ে বলল;
আচ্ছা করুন। শুনি।

রুবাকে অবাক করে দিয়ে আমরুল সুরা রহমানের তেলাওয়াত শুরু করলো। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো কোথাও এতটুকুন তিলমাত্র তোতলানো না সে। কি অদ্ভুত সুন্দর তার কণ্ঠ! যেন বেহেস্তের বাগানের মাঝে বসে কোন জান্নাতি তেলাওয়াত করছে! অপুর্ব সুরের মূর্ছনায় মোহিত হয়ে অঝোর কান্নায় ভেঙে পরলো রুবা। সাথে আমরুলও ওই আয়াতে গিয়ে আর কান্না সামলাতে পারলো না

“অতএব হে জ্বীন ও মানব, তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?”

লিখেছেন

আরিফ আব্দুল্লাহ

লালমনিরহাট সরকারি কলেজের বাংলা ডিপার্টমেন্ট অনার্স ৩য় বর্ষে পড়াশোনা করছি।
আমার জীবন মরন সবকিছু স্রষ্টার জন্য

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

লালমনিরহাট সরকারি কলেজের বাংলা ডিপার্টমেন্ট অনার্স ৩য় বর্ষে পড়াশোনা করছি।
আমার জীবন মরন সবকিছু স্রষ্টার জন্য

Exit mobile version