আজ বিখ্যাত একটি গল্প বলতে যাচ্ছি, এবং এই গল্পটিতে খুব সুন্দর একটি শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ সুবাহানাল্লাহু তা’য়ালা যখন সূরা হুজুরাত নাজিল করলেন তখন অনেক সাহাবী ভয় পেয়ে গেলেন, কারণ আল্লাহ বলেছেন –
اَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَرۡفَعُوۡۤا اَصۡوَاتَکُمۡ فَوۡقَ صَوۡتِ النَّبِیِّ
হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না।
[৪৯:২]
সূরা হুজুরাতকে সূরাতুল আদব – আদবের সূরাও বলা হয়, কারণ এই সুরাটি আমাদেরকে সর্বাঙ্গীন আদব শেখায় — আমাদের এবং আল্লাহর মধ্যে, আমাদের এবং রাসূলের (ﷺ) মধ্যে, মুমিনদের পরস্পরের মধ্যে, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে আদব শেখায়।
এই সূরাটি নাযিল হওয়ার পর সাহাবীরা অসম্ভব ভীত হয়েছিলেন। বিশেষ করে প্রথম দুটি আয়াত – যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা সেইসব সাহাবীদের উপদেশ দিচ্ছেন যারা রাসূলকে (ﷺ) যথাযথ আদব দেখাচ্ছিলেন না। একটি বর্ণনায় এসেছে এই আয়াতটি আবু বকর (রা:) এবং ওমর (রা:) প্রসঙ্গে। আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা এই দুই মহান সাহাবীকেও উপদেশ দিয়েছেন রাসূলের (ﷺ) সামনে তাদের গলার স্বর নিচু করার জন্য। স্বভাবগতভাবে ওমর (রা:) ছিলেন গভীর এবং উচ্চ কণ্ঠস্বরের অধিকারী। কিন্তু এই আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর তিনি এতটাই আস্তে কথা বলতেন যে রাসূলকে (ﷺ) তাঁর কথা পুনরাবৃত্তি করতে বলতে হতো।
যেই সাহাবী এই আয়াতের কারণে সত্যিই ভীত হয়েছিলেন তিনি হলেন সাবিত ইবনু কায়েস (রা:)। তার পরিচয়টা আগে বলি। তিনি ছিলেন আনসারদের খতিব, আনসারদের মুখপাত্র। তিনি মদিনার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই তার কণ্ঠস্বর ছিল সবচেয়ে উচ্চ। যখন যুদ্ধ হতো, সমাবেশ হতো, তখন তিনি সেখানে খতিব থাকতেন। কাজেই তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি উচ্চস্বরে রাসূলকে (ﷺ) ডাকতেন।
সূরা হুজুরাতের (পারা:২৬; সূরা ৪৯) দ্বিতীয় আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাবিত (রা:) অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রাসূল (ﷺ) তার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করলেন, যেমন তিনি সবার ক্ষেত্রেই করেন। সাবিতকে (রা:) আশেপাশে দেখতে না পেয়ে তিনি সাদ ইবনে মুয়াজকে (রা:) জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাবিতের কি হয়েছে?
তিনি কোথায়?
তিনি কি অসুস্থ?
তাকে যে অনেকদিন ধরে দেখছি না, আমাদের কি উচিত তাকে দেখতে যাওয়া?’
সাদ ইবনে মুয়াজ (রা:) তখন বললেন, ‘দেখুন সাবিত (রা:) আমার প্রতিবেশী, তিনি অসুস্থ হলে তো সবার আগে আমারই জানার কথা।’ সাহাবায়ে কেরামদের মানসিকতাটা একবার লক্ষ্য করে দেখুন। কি সুন্দর মানসিকতা, সাদ (রা:) বলছেন তার প্রতিবেশীর অসুস্থতার কথা তো তারই সবার আগে জানার কথা। তাই সাদ (রা:) বললেন, ‘আমার মনে হয় না তিনি অসুস্থ, তারপরও আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’
তাই সাদ (রা:) তার প্রতিবেশীর খোঁজ নিতে গেলেন। সাবিত (রা:) দরজায় এসে দাঁড়ালে সাদ (রা:) দেখতে পেলেন তার দুই চোখ রক্তাক্ত, অর্থাৎ অতিরিক্ত কান্নাকাটির ফলে তার চোখ দুটি লাল হয়ে আছে। সাদ (রা:) জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার, কি হয়েছে?
সাবিত (রা:) বললেন, ‘এই যে সূরা হুজুরাতের এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে, এবং আপনারা সবাই জানেন আমার আওয়াজ সবার চেয়ে উঁচু, রাসূলের (ﷺ) কন্ঠের উপর আমি আমার কন্ঠকে উচ্চতর করেছি, কাজেই এই আয়াতটি আমাকে নির্দেশ করছে। নিশ্চয়ই আমি জাহান্নামীদের একজন। আল্লাহ আমাকে তিরস্কার করে কুরআনের একটি আয়াত নাজিল করেছেন, কাজেই জাহান্নামে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই।’
সাদ (রা:) রাসূলের (ﷺ) কাছে ফিরে এসে পুরো ঘটনা বললেন। রাসূল (ﷺ) সব শুনে বললেন, ‘বরং তিনি জান্নাতবাসী!’ সুবহানাল্লাহ, কল্পনা করতে পারেন এ কথা শুনে তখন সাবিতের (রা:) তখন কেমন লেগেছিল?
এই গল্পের শুরুতে একজন ভাবছেন তিনি জাহান্নামে যাবেন, কিন্তু গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি রাসূলের (ﷺ) কাছ থেকে জান্নাতের নিশ্চয়তা পেয়েছেন। রাসূলের (ﷺ) মুখে এ কথা শুনে সাবিত (রা:) উচ্চস্বরে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার…. তাকবীর দিতে শুরু করলেন, এবং রাসূলের (ﷺ) কাছে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন।
সুবহানাল্লাহ, এটাই আল্লাহর রহমত। এই সিরিজের কয়েক পর্ব আগে আমরা আল্লাহর রহমত থেকে কখনোই নিরাশ না হওয়ার প্রসঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। রাসূল (ﷺ) আমাদের বলেছেন, কিভাবে একজন মানুষ জাহান্নাম থেকে মাত্র এক হাত দূরে থাকা সত্ত্বেও জান্নাতবাসীদের মত একটি কাজ করে জান্নাতী হয়ে গেলেন। আর এর জলজ্যান্ত উদাহরণ হলেন সাবিত (রা:), যিনি জাহান্নামীদের মত নিন্দিত হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত রাসূলের (ﷺ) কাছ থেকে জান্নাতের নিশ্চয়তা পেয়েছেন।
আমরা আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকেও জান্নাতবাসী করেন, এবং আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত না করেন যারা রাসূলের (ﷺ) কন্ঠের উপর নিজেদের কণ্ঠস্বরকে উঁচু করে। আমরা যখন রাসূলের (ﷺ) একটি হাদীস শুনি, তখন আমরা আমাদের নিজের কথাকে যেনো হাদীসের চেয়ে বেশি গুরুত্ব না দেই। আমরা আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে রাসূলের (ﷺ) সুন্নত দ্বারা সুশোভিত করে তোলেন।
আল্লাহুম্মা আমীন!
তিনি জান্নাতী!
কুরআনের মানুষ
পর্ব : ২৬
মূল: ড. ওমর সুলাইমান