সূরা ইয়াসীনঃ সংক্ষিপ্ত আলোচনা
সূরা ইয়াসীন হলো এমন একটি সূরা, যা প্রত্যেক মুসলিমের কাছে খুবই পছন্দনীয়। নিঃসন্দেহে আমরা সমগ্র কোরআনুল কারীমকে ই ভালোবাসি। তবে, আমাদের অন্তরে এই সূরাটির জন্য একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। এর পেছনে কিছু হাদীসের উদ্ধৃতি ই মূলত, প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে। বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ কুতুবে সিত্তাহ তে অন্তত ৫টি বর্ণনা বিদ্যমান, যেখানে সূরা ইয়াসীন এর ফজীলত সম্পর্কে বলা হয়েছে। সম্ভবত, এর মাঝে সর্বাধিক জ্ঞাত বর্ণনাটি দুটো ভিন্ন সূত্র থেকে এসেছে।
হাদীসটি হলোঃ
রাসূল(সাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, “সূরা ইয়াসীন হলো কুরআনের হৃদয় বা অন্তর।”
যদিও দুটো বর্ণনা সূত্রে কিছুটা দূর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু উভয় বর্ণনা একত্রে যে মূলভাব টুকু সামনে নিয়ে এসেছে, তা পুরোপুরি বিশুদ্ধ। যে, ইয়াসীন হলো সমগ্র কুরআনের ‘ক্বলব’। এখানে ‘ক্বলব’ বলতে সারমর্ম, মূলকথা বোঝানো হয়েছে।
তিরমিজি শরীফে অন্য একটি বর্ণনা রয়েছে, যা হাসান আল বসরী(রহঃ) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। যিনি একজন প্রখ্যাত তাবে’ঈ। যদিও তা কিছুটা দূর্বল সূত্র সম্পন্ন, কেননা তা রাসূল(সাঃ) বলেছিলেন কিনা জানা যায় নি। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি এক রাতে, অর্থাৎ এক বসায় সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে, তার গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হবে।”
অর্থাৎ, এটি ও অন্যতম একটি ফজীলত।
এবং, সূরা ইয়াসীনের সবচেয়ে অথেন্টিক মর্যাদা হলো, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির শিয়রে সূরা ইয়াসীন পাঠ করা। এটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারি। কেননা আমাদের পূর্ববর্তী সালাফগণ, আলেম উলামা তারা নিজেরা এর উপর আমল করেছেন এবং আমাদের ও এর উপর আমল করতে বলে গিয়েছেন।
এখন, সূরা ইয়াসীন এর মূল ম্যাসেজ আসলে কি?
সূরা ইয়াসীনে একটি প্রারম্ভিকা, তিনটি অংশ এবং একটি উপসংহার রয়েছে। প্রারম্ভিকা অংশে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সমগ্র কুরআন এর পরিচয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে স্বল্প বাক্যে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। গ্রন্থ, নবী(সাঃ), সীরাত, এবং লক্ষ্য।
সূরার প্রথম শব্দ یٰسٓۚ . এর পরপরই কুরআন কে উল্লেখ করে বলা হলো, وَالْقُرْآنِ الْحَكِيمِ (বিজ্ঞানময় কুরআনের কসম) এবং, এরপর ই নবী(সাঃ) কে নিয়ে বলা হলো, اِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِیْنَۙ (তুমি নিঃসন্দেহে রসূলদের অন্তর্ভুক্ত)। তার কাজ কি? তিনি কি করছেন? عَلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍؕ (সরল-সোজা পথ অবলম্বনকারী)। অর্থাৎ, আপনার কাছে এখন মেসেজ রয়েছে, রাসূল বা পথপ্রদর্শক ও রয়েছেন, পথনির্দেশ বা কোন পথে চলতে হবে তা ও জানা আছে। এবং গন্তব্য একটা ই, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা।
এভাবেই ইন্ট্রোডাকশন পার্ট সাজানো হয়েছে।
সূরা ইয়াসীনের প্রথম অংশ, এখানে অতীত বা ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশ, বর্তমান অর্থাৎ আমাদের চারিপাশে বিদ্যমান নিদর্শনসমূহের কথা বলে। এবং তৃতীয় অংশ, ভবিষ্যৎ অর্থাৎ আমাদের পরিণত নিয়ে অবগত করে। ইয়াওমুল কিয়ামাহ, জান্নাত, জাহান্নাম নিয়ে আলোচিত হয়েছে।
প্রথম অংশ, সূচনা এবং উপসংহার অংশে একটি বিষয় খুবই প্রাসঙ্গিক। তা হলো, মৃত ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করা এবং নিজেকে পুনরুজ্জীবিত হবার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ এর সেই সময়ের জন্য প্রস্তুত করা। এটিই সূরা ইয়াসীনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মূল শিক্ষা! এবং এই কারণেই কোন ব্যক্তি মারা যাবার পূর্বে তার সামনে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবার বিষয়ে এতো গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আপনি প্রকৃতপক্ষে মারা যাচ্ছেন না। আপনাকে জীবনের সমাপ্তি তো ঘটছে না। এটি কেবল এই নশ্বর দুনিয়া থেকে আপনার অস্তিত্বের বিদায়। কিন্তু পরবর্তী দুনিয়ায় আপনি অনন্তকালের জন্য জীবন লাভ করবেন। আপনার কেবল শারীরিক মৃত্যু হচ্ছে। রূহের কোন মরণ নেই।
মরণাপন্ন ব্যক্তির সামনে সূরা ইয়াসীন পাঠের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যক্তির রূহকে শরীর থেকে আলাদা হবার জন্য প্রস্তুত করা।
দেখুন, সূরা ইয়াসীন এর ভূমিকা অংশে জীবন এবং মরণ এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম অংশে যে ঘটনার কথা এলো, সেখানেও জীবন এবং মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যক্তিটিকে হত্যা করা হলো এবং কি বলা হলো? قِیْلَ ادْخُلِ الْجَنَّةَؕ
(প্রবেশ করো জান্নাতে)। সে জান্নাত লাভ করলো। অর্থাৎ, এখানে ও জীবন এবং মরণ এর ব্যাপার টা এসেছে। মধ্যভাগে, যেখানে আল্লাহ চারপাশে বিদ্যমান নিদর্শন উল্লেখ করেছেন; আল্লাহ তিনটি বিষয় উল্লেখ করেন। প্রথমত, وَ اٰیَةٌ لَّهُمُ الْاَرْضُ (এদের জন্য নিষ্প্রাণ ভূমি একটি নিদর্শন) অর্থাৎ পৃথিবী! দ্বিতীয়ত, বেহেশত। এবং সর্বশেষ নিদর্শন হচ্ছে মানবসত্তার সৃষ্টিরহস্য।
বস্তুতপক্ষে আল্লাহ প্রদত্ত এই তিনটি উপমা, অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কেননা, এই বিশ্বজগত আমাদের চারদিকের সমস্ত কিছু নিয়ে গঠিত। একইভাবে, জান্নাত ভূমন্ডলের সীমার উপরিভাগে আসমানে রয়েছে। এবং সর্বশেষ, আল্লাহ আমাদের যে কাজগুলো করবার ক্ষমতা দিয়েছেন; তা সর্বশক্তিমান সত্তা প্রদত্ত নেয়ামত।
যা কিছু আমাদের দ্বারা সৃষ্ট, তা হয়তো পৃথিবী এবং জান্নাতের মতো আল্লাহর সরাসরি সৃষ্ট কিছু নয়। কিন্তু, যখন ই আমরা হাত দ্বারা কিছু তৈরি করছি, আল্লাহ বলছেন আমিই তোমাকে এ কাজ করবার বিচক্ষণতা দিয়েছি, তোমাকে এ কাজ করবার প্রয়োজনীয় উপকরণ সমূহ তো আমি ই আঞ্জাম দিয়েছি। আমি তোমাকে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির উপর দিয়ে ভ্রমণ করবার ক্ষমতা দিয়েছি। সুউচ্চ দালান, সুপার কম্পিউটার বানাবার শক্তি তোমায় আমি ই দিয়েছি। তোমার নিজের দ্বারা একা এটি কখনোই সম্ভব হতো না। আমি তোমাকে তুখোড় বুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্কের অধিকারী করেছি, যা কাজে লাগিয়ে তুমি এসব তৈরি করলে। তাই এসব আয়াতসমূহ ও প্রকৃতপক্ষে আমার অস্তিত্ব ই প্রমাণ করে।
এবার ভবিষ্যতের কথায় আসা যাক। যার সূচনা وَنُفِخَ فِي الصُّورِ (তারপর একটি শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে) দিয়ে। এরপর আসে, সেই আয়াতটি যা আমরা ‘ইশার সালাতের সময় পাঠ করে থাকি। إِنَّ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ الْيَوْمَ فِي شُغُلٍ فَاكِهُونَ (জান্নাতীরা আজ আনন্দে মশগুল রয়েছে)। কিছু পরেই রয়েছে জাহান্নামীদের প্রতি ধিক্কার। কিভাবে তারা সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখে ও অস্বীকার করতে থেকেছে।
সর্বশেষে আসছে, সূরার উপসংহার অংশটি। সমাপ্তি অংশ আলোকপাত করে একটি ঘটনার প্রতি। আমরা প্রত্যেকেই সেই অস্বীকারকারী ব্যক্তির ঘটনা শুনেছি যে একটি হাড় নিজ হাতে ভেঙে টুকরো টুকরো করে রাসূল(সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলোঃ হে মুহাম্মদ! তুমি কি আসলেই মনে করো যে ভেঙে টুকরো হয়ে ধূলায় মিশে যাওয়া এই অস্থি থেকে তোমার স্রষ্টা কোনভাবে কোন অস্তিত্বের পুনরুজ্জীবন দিতে সক্ষম? সে নিজ হাতে তা রাসূলের সামনে ভেঙে ফেলছিলো। তখন আল্লাহ এ আয়াত নাজিল করলেন,
وَ ضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَّ نَسِیَ خَلْقَهٗؕ قَالَ مَنْ یُّحْیِ الْعِظَامَ وَ هِیَ رَمِیْمٌ
অর্থঃ “সে আমার সম্পর্কে এক অদ্ভূত কথা বর্ণনা করে এবং নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়। সে বলে: (এই) অস্থিসমূহ যখন পচে গলে যাবে তখন কে তাকে জীবিত করবে?”
[সূরা ইয়াসীন:৭৮]
তাঁর প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ আয়াত নাজিল করে কুরাইশদের অন্তরকে যেকোন সংশয় উদ্ভূত হবার সম্ভাবনা থেকে মুক্ত করে দিলেন। সে আমাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। অথচ সে নিজেকে ই ভুলে গেছে। নিজের দিকে একবার গভীরভাবে তাকিয়ে দেখো। তুমি, দিব্যি হেঁটে চলা এক জীবন্ত সত্তা, যে কিনা অস্থি মাংসের সমন্বয়ে গঠিত, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না তুমি আসলে কোথা থেকে এসেছো? তোমার আদি রূপ কি ছিলো? তুমি কি তোমার নিজস্ব সত্তার প্রতি এতোই অন্ধ হয়ে পড়েছো যে এখন তোমায় নিছক এক অস্থি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে? এবং এটিই হচ্ছে সেইসব মূর্খ লোকেদের আচরণ, যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে।
তোমার সৃষ্টিকৌশলের মাঝে যে নিদর্শন রয়েছে তার চাইতে কোন নিদর্শন ই সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। তুমি নিজে ই সবচাইতে বিস্ময় জাগানিয়া সৃষ্টি। এর চাইতে বড় কোন নিদর্শন হতে ই পারে না। তুমি যদি এ মহান নিদর্শন উপলব্ধি করতে ই ব্যর্থ হও, তাহলে তুমি এমনটা কি করে ভাবো যে চারিপাশের অন্য কোন নিদর্শন তোমাকে উপলব্ধির দুয়ার খুলে দেবে! তোমার নিজের কলকব্জাগুলো নিয়ন্ত্রণে একজন সৃষ্টিকর্তার অবশ্য ই প্রয়োজন রয়েছে এটি ই যদি তুমি বুঝতে না পারো, তবে অন্য মাখলুক গুলোর “খালিক” কে তুমি কেমন করে চিনতে পারবে?
قُلْ یُحْیِیْهَا الَّذِیْۤ اَنْشَاَهَاۤ اَوَّلَ مَرَّةٍؕ وَ هُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِیْمُۙ
অর্থঃ “তাকে বলো, এদেরকে তিনি ই জীবিত করবেন যিনি প্রথমে এদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি সৃষ্টির প্রত্যেকটি কাজ জানেন।”
(সূরা ইয়াসীন:৭৯)
কাফের যারা, যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে, তাদেরকে ও তিনিই সৃষ্টি করেছেন। কারণ তার সৃষ্টি করার জন্য কেবল এতটুকু ই প্রয়োজন যে তিনি বলবেন, হও। এবং তা হয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
اِنَّمَاۤ اَمْرُهٗۤ اِذَاۤ اَرَادَ شَیْــٴًـا اَنْ یَّقُوْلَ لَهٗ كُنْ فَیَكُوْنُ
অর্থঃ “তিনি যখন কোন কিছুর ইচ্ছা করেন তখন তাঁর কাজ হয় কেবল এতটুকু যে, তিনি তাকে হুকুম দেন, হয়ে যাও এবং তা হয়ে যায়।”
( সূরা ইয়াসীন:৮২)
যদি কেবলমাত্র একটি আয়াত উল্লেখ করতে হয়, যা সূরা ইয়াসীনে আলোচিত সমস্ত শিক্ষার ভাবার্থ ধারণ করবে, তাহলে তা হবে ১২ নং আয়াতটি, যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেছেনঃ
اِنَّا نَحْنُ نُحْیِ الْمَوْتٰى وَ نَكْتُبُ مَا قَدَّمُوْا وَ اٰثَارَهُمْۣؕ وَ كُلَّ شَیْءٍ اَحْصَیْنٰهُ فِیْۤ اِمَامٍ مُّبِیْنٍ۠
অর্থঃ “আমি অবশ্যই একদিন মৃতদেরকে জীবিত করবো, যা কিছু কাজ তারা করেছে তা সবই আমি লিখে চলছি এবং যা কিছু চিহ্ন তারা পেছনে রেখে যাচ্ছে তাও আমি স্থায়ী করে রাখছি। প্রত্যেকটি জিনিস আমি একটি খোলা কিতাবে লিখে রাখছি।”
আল্লাহ আমাদের সূরা ইয়াসীনের সারনির্যাস স্বীয় জীবনে সঠিক রূপে উপলব্ধি করে তার উত্তম প্রতিফলন করবার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা কুরআন’কে বিচারের সেই ভয়াবহ দিনে আমাদের জন্য সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে গ্রহণ করুন। আমীন।