এখন আমরা আলী (রা:) এবং ফাতিমার (রা:) সম্পর্কের গভীরে যাবো, তাঁদের ভালোবাসার গভীরতা প্রসঙ্গে জানবো। এটা কথিত ছিল যে তাঁদের দুজনের মধ্যে ছিল গভীর ভালোবাসা যা পরবর্তী দশ বছর বিরাজমান ছিল। আলী (রা:) ছিলেন একজন কবি। আলী (রা:) ফাতিমাকে (রা:) নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখতেন। একদিন আলী (রা:) দেখলেন ফাতিমা (রা:) সিওয়াক (দাঁতের ব্রাশ) ব্যবহার করছেন। বলুন তো সিওয়াক কোন গাছ থেকে আসে?
আরাক গাছ থেকে। সিওয়াক হল আরাক গাছের ছড়ি বা লাঠি। এখন যে কবিতাটি উল্লেখ করব তা খুবই শক্তিশালী এর প্রতীকী ভাষা ও বাক্যালংকার জন্য। সিওয়াককে উদ্দেশ্য করে আলী (রা:) তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করলেন –
حظيت يا عود الأراكِ بثغرها
أما خفت يا عود الأراك أراكَ
لو كنت من أهـل القتال قتلتك
ما فـاز منـي يا سِواكُ سِواكَ
দাড়াও দাড়াও! ওহে আরাক গাছের ছরি,
কি করে হয় তোমার এত সাহস?
আহা! তা ভেবেই তো মরি।
লাগেনা কি তোমার কোন ভয়?
যদি তোমার সাথে আমার দেখা হয়?
ছরি না হয়ে, হতে যদি নর,
পালাতে কি পারতে তুমি?
বল, কিসের বড়াই তুমি করো?
মেরেই ফেলতাম তোমায় আমি,
যদি ছরি না হয়ে হতে তুমি নর।
এ কবিতা শুনে ফাতিমা (রা:) নিজেকে ধন্য মনে করলেন, আলীর (রা:) ভালোবাসায় তিনি মুগ্ধ হলেন। এমন নয় যে আলী (রা:) তখন রাগে ফেটে পড়েছিলেন। এটা ছিল ফাতিমার (রা:) প্রতি তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর সহজাত বাগ্মিতার ব্যবহার এই কবিতায় তিনি প্রকাশ করেছেন।
কেমন ছিল তাদের সংসার জীবনের পরবর্তী দশ বছর?
রাসুল (ﷺ) যে অবস্থায় ভিতর দিয়ে গিয়েছেন, সমগ্র মদিনাবাসীকেও তার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। দারিদ্রতা তো ছিলই, ওহুদের যুদ্ধের সময় ফাতিমা (রা:) তাঁর প্রথম সন্তান হাসানকে (রা:) গর্ভে ধারণ করেছিলেন। তিনি যুদ্ধে আহতদের সেবা করতেন। রাসুল (ﷺ) ওহুদ যুদ্ধে গুরুতর ভাবে আহত হলে, ফাতিমা (রা:) তাঁর বাবার সেবা শশ্রুষা করেন।
হিজরতের তৃতীয় বছরে রোজার মাসে হাসানের (রা:) জন্ম হয়। আলী (রা:) তাঁর নাম রাখলেন حرب হারব – অর্থাৎ যুদ্ধ। রাসুল (ﷺ) এসে বললেন, “না, না, তাঁর নাম হারব রেখো না, নাম রাখ হাসান।” হাসান অর্থাৎ উৎকর্ষ, ভালো কিছুর উৎস। হাসান (রা:) অনেক দিক থেকেই বিশেষ ছিলেন। এর মধ্যে একটি হলো রাসুলের (ﷺ) সাথে তাঁর চেহারার সাদৃশ্য। আর কারো সাথে রাসুলের (ﷺ) চেহারার এতটা সাদৃশ্য ছিল না, যতটা ছিল হাসানের (রা:) সাথে। একটি বর্ণনায় এসেছে, আবু বাকর (রা:) হাসানকে কোলে নিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দিলেন এবং বললেন, “তুমি তোমার বাবার চেয়েও নানার মত দেখতে বেশি।” হাসানের (রা:) সাদৃশ্য আলীর (রা:) চেয়ে রাসুলের (ﷺ) সাথে বেশি ছিল।
রাসুল (ﷺ) সত্যিই হাসানকে ভালবাসতেন। তিনি সিজদা করার সময়, হাসান সব সময় তাঁর ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়তো। এভাবে সুজুদরত অবস্থায় হাসান এসে রাসুলকে (ﷺ) আক্রমন করত, তাঁর পিঠে চড়ে বসত, ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়তো। হাসানকে পিঠে নিয়ে রাসুল (ﷺ) তাঁর সিজদাকে দীর্ঘায়িত করতেন। যখনই রাসুল (ﷺ) হাসানকে দেখতেন, তাঁকে কোলে নিতেন এবং তাঁর জন্য দু’আ করতেন।
হাসানের জন্মের ঠিক এক বছর পরেই আল হুসাইনের জন্ম হয় হিজরতের চতুর্থ বছরে। এবার আলী (রা:) তাঁর সন্তানের নাম কি রাখলেন?
এবারও তিনি তার নাম রাখলেন হারব – যুদ্ধ। রাসুল (ﷺ) বললেন, “না, এর নাম রাখ হুসাইন” হুসাইন অর্থাৎ ছোট হাসান, আবারো ভালোর উৎস। আলী (রা:) এবং ফাতিমার (রা:) সংসার এখন চারজনের। এ চারজনই রাসুলের (ﷺ) কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং মূল্যবান।
একটি বর্ণনায় এসেছে রাসুলের (ﷺ) সাথে হাসানের (রা:) সাদৃশ্য শরীরের উপরের অংশে – চেহারা ও বাহুতে। আর রাসুলের (ﷺ) সাথে হুসাইনের (রা:) সাদৃশ্য শরীরের নিচের অংশে, পায়ের দিকে। এভাবে দুজনেরই ভিন্ন দিক থেকে রাসুলের (ﷺ) সাথে সাদৃশ্য ছিল। তাঁরা সারাক্ষনই রাসুলের (ﷺ) কোলে ঝাপিয়ে পড়তো। রাসুল (ﷺ) খুতবা দেওয়ার সময় হাসান ও হুসেনকে দেখতে পেলে খুতবা থামিয়ে মিম্বার থেকে নিচে নেমে আসতেন। দুজনকে কোলে নিয়ে আবার মিম্বারের গিয়ে বসতেন। তাঁদের কোলে নিয়েই তিনি খুতবা দিতেন। কি অভূতপূর্ব একটি দৃশ্য! একবার কল্পনা করে দেখুন তো।
আলী (রা:) ও ফাতিমার (রা:) সুখের সংসার।
পর্ব : ৬
মূল: ড. ওমর সুলাইমান