সবরের মুকুট
এক
রেজাল্ট পাওয়ার পর ক্লাসে বসে আছে রাসেল। চোখে তার অশ্রু। পাশেই বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে বসে আছে রাশেদ। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে আজ। রাসেল এবং রাশেদ দুজনেই মেধাবী শিক্ষার্থী। রাসেলের ক্লাস রোল এক আর রাশেদের দুই। মঈনউদ্দীন স্যার সবার রেজাল্ট দেওয়ার পর রাসেল আর রশেদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। রাসেলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘জীবনে সফলতার চূড়ায় পৌঁছাতে আরো বেশি চেষ্টা লাগবে। আমরা তোমাদের থেকে বেষ্ট রেজাল্টটাই আশা করেছিলাম রাসেল!’
রাসেল মলিন চেহারায় স্যারের দিকে তাকালো। হঠাৎ করেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। পাশেই রাশেদ বসে ছিলো। স্যারের কথা শুনে কেঁদে ফেললো সে। হতাশ কন্ঠে কয়েকবার আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে তার ফলাফলের জন্য দোষারোপ করে ফেললো সে।
রাসেল আর রাশেদের বাসায় যাওয়ার পথ একই।তারা যেতে যেতে আসরের আজান দিলো। রাসেল মসজিদে গিয়ে সালাত আদায়ের প্রস্তাব করতেই রাশেদ এক প্রকার রেগে গেলো। বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এত তাহাজ্জুদ পড়লাম তাতে লাভ কি হলো রাসেল? কত দোয়া করলাম একটা গোল্ডেনের জন্য! আল্লাহর কাছে নাকি সব কিছুর ভান্ডার রয়েছে। তাহলে আমাকে একটা প্লাস দিলে কিইবা ক্ষতি হতো তাঁর? আমাকে আর এসবের জন্য বলবি না রাসেল! এখন মনে হচ্ছে হুদাই রাত জেগে শরীরের ক্ষতি করলাম। কাজের কাজ কিছুই হলো না!’
রাশেদের মন্তব্য শুনে রাসেল ভ্রু কুঁচকে ফেললো। রাশেদকে থামিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হয়তো এতেই আমাদের কল্যাণ রেখেছেন, ইনশাআল্লাহ।’
‘কীসের কল্যাণ? বাড়িতে গিয়ে এখন সবার বকা খাওয়ার কল্যাণের কথা বলছিস? ভালো মার্ক না পাওয়ায় আমার প্রিয় কলেজে ভর্তি না হতে পারা কল্যাণের কথা বলছিস? আর কত অন্ধ বিশ্বাসে ডুবে থাকবি রে? তোরা কি অন্ধ?’ রাশেদ এক প্রকার চ্যাঁচিয়ে কথাগুলো বলেই নিজের পথ ধরল।
রাসেল কতক্ষণ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল। পুরো বছর পড়েও প্লাস না তুলতে পারা ছাত্রের চেয়ে পরীক্ষার আগের এক মাস পড়েই প্লাস না তুলতে পারা ছাত্রের কষ্ট কি করে বেশি হতে পারে এটা রাসেলের মাথায় এলো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে ভাবল, এই ফলাফলেই হয়তো এমন কোনো কল্যাণ লুক্কায়িত আছে যা এই মুহূর্তে সে জানেনা। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যে কোনো কাজেই বান্দার কল্যাণ নিহিত থাকে।
আসরের সালাত শেষ করে রাসেল বাড়ি ফিরল।
দুই
সতেরো বছর পর……………
রাশেদ দোকান খুলে তাড়াহুড়ো করে ঝাড়ু দিয়ে ফেললো। কেননা আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার বউ গতকালকে তার তিনবছরের মেয়েকে নিয়ে ঝগড়া করে বাবার বাড়ি চলে গেছে। প্রতিদিন প্রতিদিন একই ঝঞ্ঝাাট আর ভালো লাগে না তার। প্রতিদিন তার বউই ডেকে ঘুম থেকে তুলে দেয়। দোকান ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এগারোটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই।
বিকাল হয়ে গেছে। অথচ আজ রাশেদের দোকানে খুব কম সংখ্যক ক্রেতাই এসেছেন। রাশেদ বিষন্ন মনে দোকান আজকের জন্য বন্ধ করে ফেলবে ভাবল। রাত্রের দিকে শ্বশুড়বাড়ির দিকে একটু যাওয়ার জন্য মনস্থির করে ফেলল। তাকেই সব মিটমাট করতে হবে কেননা ঝগড়ার মুল হোতা তো সেই! আরেকটু বিক্রির জন্য বসল সে। হঠাৎ কয়েকজন বস্তির ছেলে একজন সুন্নতি পোষাক পড়া লোককে ধরে তার দোকানে নিয়ে আসল। এতগুলো ছেলেকে দেখে রাশেদ একটু বিরক্তই হলো। হঠাৎ সেই লোকটি রাশেদকে লক্ষ করে বলল, ‘ভাই, বাচ্চারা একটু কেনাকাটার জন্য আসছে। ওরা নিজেদের জন্য জামা নিবে আর পরিবারের জন্যও নিবে। ওদেরকে জামা কাপড় দেখান।’ বলেই লোকটি এক পাশে গিয়ে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
রাশেদ একটু অবাক হলো লোকটির কথায়। তারপরেও সে কথা না বাড়িয়ে জামা কাপড় দেখাতে শুরু করল। এখনো কয়েকজনের জামা-কাপড় কিনা বাকি থাকতেই পাশের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসলো। লোকটা চেয়ার থেকে উঠে রাশেদের থেকে অনুমতি নিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। রাশেদকেও সালাতের কথা বলায় সে অনিহা প্রকাশ করল।
সালাত পড়ে আসতেই ছেলেগুলো আংকেল আসছে বলে চিল্লিয়ে উঠলো। ইতিমধ্যেই সবার কাপড় নেওয়া শেষ। রাশেদ হিসাব করে দেখল সব কাপড়ের দাম মোট ২৯৭০০ টাকা আসে।
লোকটাকে টাকার পরিমানের কথা বলতেই তিনি বললেন, ‘ ভাই আমার কাছে ১০ হাজারের মতো আছে। বাকিগুলো পরে পরিশোধ করলে হবে? আমার লোক এসে দিয়ে যাবে।’
রাশেদ একটু রেগে গিয়ে বলল, ‘টাকা না থাকলে আমার এত সময় নষ্ট করলেন কেন?’
লোকটা মুসকি হেসে বলল,’ আচ্ছা রাগ করবেন না ভাই। আমি কিছু সময়ের মধ্যেই টাকা দিবো,ইনশাআল্লাহ। ‘
বলেই লোকটা ছেলেদেরকে চলে যেতে চলে কার সাথে ফোনে কথা শেষ করে রাশেদের পাশে এসে বসল। রাশেদকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনার নাম কী ভাই? আমার একসময়ের এক বন্ধুর সাথে আপনার চেহারার বেশ মিল আছে।’
‘রাশেদ। আপনার নাম?’
‘রাশেদ! আমি রাসেল।’ বিস্ময়ে রাসেল রাশেদের হাত জড়িয়ে ধরল।
এত বছর পর দুই বন্ধুর দেখা হওয়ায় দুজনেই খুব আনন্দিত হলো। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। কিছু সময় পর দুজনে স্থির হয়ে বসল। এমন সময় এক লোক এসে রাসেলকে সালাম দিয়ে তার হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল দিয়ে চলে গেলো। রাশেদ আর না পেরে বলেই ফেলল, ‘তুই তো দেখি মহা বড়লোক হয়ে গেছিস রে বন্ধু।’
‘ আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে কল্যাণকর জীবন চেয়েছিলাম। তিঁনি আমাকে নিরাশ করেননি। তিঁনিই তো উত্তম পরিকল্পনাকারী।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমি পড়াশোনা শেষে তিন বছর চেষ্টা করেও কোনো জব পাইনি। চাকরির বাজারের কথা তো জানিসই। অতঃপর এই ব্যবসা নিয়েই আছি। তুই কি করছিস বলতো?’
‘মাশাআল্লাহ, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তোর ব্যবসায় বারাকাহ দান করুক, আমিন। আমি একটা জব পেয়েছিলাম। কিন্তু জয়েনিং এর কয়েকদিন পর দেখলাম সেখানে ঘুষের কারবার। তাই ছেড়ে দিলাম। পরে বাবার সহযোগিতায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করালাম, আলহামদুলিল্লাহ। তাতে এখন কয়েক’শ কর্মী কাজ করে। সবই তো সেই মহান সত্ত্বার দয়া, যিঁনি তার বান্দার উপর রহম করছেন, আলহামদুলিল্লাহ।’
‘মাশআল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ।’
‘এই আলহামদুলিল্লাহ টা যদি তুই সেদিন কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট না পাওয়ার পরও বলতে পারতি তাহলে হয়তো তুই আজ আরোও বেটার পজিশনে থাকতি। গায়েবের খবর একমাত্র রবই ভালো জানেন। রাশেদ, তুই কিন্তু আমার থেকে কয়েক পয়েন্ট বেশিই পেয়েছিলি। অথচ তুই রবের ফয়সালাতে সন্তুষ্ট ছিলি না। যেতটুকু পেয়েছিস তারও কোনো শোকরিয়া করিস নি। আমি কিন্তু তোর থেকে খারাপ রেজাল্ট করেও শোকরিয়া আদায় করেছিলাম। আর রবের নিকট কল্যাণ চেয়েছিলাম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, “….যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর তবে তোমাদের আরো দিব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর। “(সূরা ইবরাহিম)
রবের প্রতিশ্রুতি সত্য। তিনি আমাকে এত দিয়েছেন যে আমি শোকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবো নারে। অথচ তুই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের খুব ছোট একটা পরীক্ষাতেই অকৃতকার্য হয়েছিস। শুধু তাই না তুই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ফরজ ইবাদত গুলোর প্রতিও অনীহা প্রকাশ করেছিলি। অথচ তোর রবের ফয়সালাতেই সন্তুষ্ট হওয়া উচিত ছিলো। হয়তো একটু শোকরিয়া আদায় করলেই তোর জীবনটা আজ আরও সুন্দর হতে পারতো। গায়েবের খবর একমাত্র রবই ভালো জানেন।’
রাসেলের হাত শক্ত করে চেপে ধরল রাশেদ। অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, ‘আল্লাহকে ভুলে গিয়ে আমি জীবনের পদে পদে ঠকে গিয়েছি রাসেল। আর তুই আল্লাহকে না ভুলার কারনে জীবনের প্রতি পদে জিতে গিয়েছিস। আমি জীবনের মানে খুঁজে পাইনা মাঝে মাঝে। সবকিছুই দুর্বিষহ লাগে। আমি আল্লাহকে আবারও খুঁজে পেতে চাই। আবারও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের তাগিদে মসজিদে ছুটে যেতে চাই। এক টুকরো সুখের খোঁজে সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্যে পেতে চাই। এই রাসেল? আমি এতকাল অবাধ্য থেকেছি বলে আল্লাহ আমায় নিশ্চয়ই দূরে ঠেলে দিবেন না তাই নারে? আমাকে এক টুকরো জান্নাতের সুখ খুঁজে পেতে সাহায্য করবি?
আবারও আল্লাহকে চিনে নেওয়ার জন্য আমার পাশে থাকবি?’ কথা বলার এ পর্যায়ে রাশেদের গলা ধরে এলো। রাসেল সম্মতি সূচক মাথা নাড়তেই রাশেদের চেহারায় হাসি দেখা দিলো। যে হাসি অকৃত্রিম! যে হাসি আল্লাহ প্রদত্ত! যে হাসি রবকে খুঁজে পাওয়ার! রবকে একান্ত আপন করে পাওয়ার!