হাদীসশাস্ত্রে মুহাদ্দিসদের অবদান অনস্বীকার্য। মুহাদ্দিসরা হাদীস সংরক্ষণের জন্য হাদীস লিখে রাখাকে নিজেদের জন্য অপরিহার্য করে নিয়েছিলেন। যদি প্রশ্ন করি কোন মুহাদ্দিস সবচেয়ে বেশি হাদীস লিখেছেন?
হ্যাঁ, একটু আগেই আমরা যাঁকে নিয়ে আলোচনা করেছি সেই ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (১৫৮-২৩৩ হি) রহিমাহুল্লাহই হলেন ইতিহাসখ্যাত সেই ব্যক্তি। যিনি ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হি) রহিমাহুল্লাহ, ইমাম মুসলিম (২০৬-২৬১ হি) রহিমাহুল্লাহ এবং ইমাম আবূ দাঊদ (২০২-২৭৫ হি) রহিমাহুল্লাহদের মতো জগদ্বিখ্যাত ইমামের উস্তাদ। [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা (রিসালাহ), যাহাবী, ১১/৭২] ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহর সমসাময়িক হাদীসের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (১৬১-২৩৪ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«لا نعلمُ أحدًا من لدن آدم كتب من الحديث ما كتب يَحْيَى بْن معين»
“মানুষের মধ্যে আমরা এমন কারো কথা জানি না যিনি এই পরিমাণ হাদীস লিখেছেন যা ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন লিখেছেন।”
[তারীখু বাগদাদ (বাশশার তাহকীককৃত), খতীব আল-বাগদাদী, ১৬/২৬৩]
তাঁর সমসাময়িক হাফিয মুহাম্মাদ ইবনু সা’দ (১৬৮-২৩০ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«يَحْيَى بنُ مَعِيْنٍ أَكْثَرَ مِنْ كِتَابَةِ الحَدِيْثِ، وَعُرِفَ بِهِ، وَكَانَ لَا يَكَادُ يُحَدِّثُ»
“ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ) সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন এবং সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হাদীস লিপিবদ্ধ করার কারণেই তাঁর পরিচিতি। তবে (মৌখিকভাবে) তিনি খুব কম হাদীসই বর্ণনা করেছেন।”
[সিয়ারু আ’লামিন নুবালা (রিসালাহ), যাহাবী, ১১/৯২]
সবচেয়ে বেশি হাদীস যিনি লিখেছেন তাঁকে হাদীস সংগ্রহ করার জন্যেও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। নিতে হয়েছে অনেক উস্তাদের সান্নিধ্য। হৃদয়ে ধারণ করতে হয়েছে অদম্য ইচ্ছা ও আগ্রহ। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহ নিজেই বলেন,
«أشتهي أن أقع على شيخ ثقة عنده بيت ملئ كتبا (6) أكتب عنده وحدي»
“আমি একজন বিশ্বস্ত শাইখের সাক্ষাৎ কামনা করি। তাঁর বাড়ি থাকবে কিতাবে ভরপুর। তিনি সামনেই থাকবেন আর আমি একাই লিখে নিবো।” [তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/১৪]
মুখের কথা বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য তাঁর চেষ্টা-প্রচেষ্টাও লক্ষ্যণীয়। আব্দুর রহমান রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি,
قدمنا البصرة وكان قدم يحيى بن معين قبل قدومنا بسنة فلزم أبا سلمة موسى بن إسماعيل فكتب عنه قريبا من ثلاثين [أو أربعين – 1] ألف حديث»
“আমরা বসরায় পা রাখলাম। আমাদের এক বছর আগেই ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ) সেখানে পা রেখেছিলেন। এ সুযোগে তিনি নিজেকে আবূ সালামাহ মূসা ইবনু ইসমাঈল (২২৩ হি / রহিমাহুল্লাহ)-র সঙ্গে জুড়ে নেন এবং তাঁর কাছ থেকে তিনি ত্রিশ হাজারের কাছাকাছি বা চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি সংখ্যক হাদীস লিপিবদ্ধ করেন।” [আল-জারহু ওয়াত তা’দীল, ইবনু আবী হাতিম, ১/৩১৫]
একজন উস্তাদ থেকেই তিনি কী পরিমাণ হাদীস লিখে নিয়েছেন চিন্তা করা যায়! আব্দুর রহমান রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি,
«صليت بجنب يحيى بن معين فرأيت بين يديه جزءا من رقاب (2) جلود فطالعته فإذا ما روى الأعمش عن يحيى بن وثاب أو عن خيثمة الشك من أبي فظننت
أنه صنف حديث الاعمش»
“আমি ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ) এর পাশে সলাত আদায় করছিলাম। লক্ষ্য করলাম তাঁর হাতে কাটা চামড়ার ছোট্ট একটা পাণ্ডুলিপি (চামড়ায় লেখা পাণ্ডুলিপি)। পরবর্তীতে আমি সেটি অধ্যয়ন করলাম। সেখানে আ’মাশ (৬১-১৪৮ হি / রহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণনাকৃত হাদীসগুলো পেলাম। যা তিনি ইয়াহইয়া ইবনু ওয়াসাব (১০৩ হি / রহিমাহুল্লাহ) বা খাইসামাহ (১৬(প্রায়)-৮২ হি / রহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণনা করেছেন। [আব্দুর রহমান বলেন, এখানে আমার পিতা (কার থেকে বর্ণনা করেছেন তা নিয়ে) সন্দেহ করেছেন।] আমার ধারণা তিনি আ‘মাশ বর্ণিত হাদীসগুলো একত্রিত করেছেন।” [আল-জারহু ওয়াত তা’দীল, ইবনু আবী হাতিম, ১/৩১৫]
সবার চেয়ে বেশি হাদীস লিপিবদ্ধকারী ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহ কতো সংখ্যক হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন? আহমাদ ইবনু উক্ববাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«سمعتُ أَحْمَد بْن عُقبة، قَالَ: سألتُ يَحْيَى بْن معين: كم كتبت من الحديث يا أَبَا زكريا؟ قَالَ: كتبتُ بيدي هذه ست مائة ألف حديث، قَالَ أَحْمَد: وإني أظنّ أنَّ المحدِّثين قد كَتَبوا لَهُ بأيديهم ست مائة ألف، وست مائة ألف»
“আমি ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহর কাছে জানতে চাইলাম- “আপনি কতো সংখ্যক হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন হে আবূ যাকারিয়া?”
তিনি বললেন, “আমি আমার এই হাত দিয়ে ৬ লক্ষ হাদীস লিপিবদ্ধ করেছি।”
আহমাদ (ইবনু হাম্বাল রহিমাহুল্লাহ / ১৬৪-২৪১) বলেন, “আমার ধারণা মুহাদ্দিসগণ নিজেদের হাতে তাঁর কাছ থেকে বর্ণিত ৬ লাখ হাদীস লিখেছেন এবং (অন্যান্যদের থেকে) লিখেছেন আরো ৬ লাখ।” [তারীখু বাগদাদ (বাশশার তাহকীককৃত), খতীব আল-বাগদাদী, ১৬/২৬৩]
মুহাম্মাদ ইবনু নাসর আত-ত্বাবারী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
«دخلت على يحيى بن معين فعددت عنده كذا وكذا سفطا يعني دفاتر (1) وسمعته يقول قد كتبت بيدي ألف ألف حديث وسمعته يقول كل حديث لا يوجد ها هنا وأشار بيده إلى الأسفاط فهو كذب»
“আমি ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈনের নিকট প্রবেশ করলাম। তাঁর কাছে গণনা করে আমি এই এই (অনুল্লেখিত) পরিমাণ নোটখাতা পেলাম এবং তাঁকে বলতে শুনলাম, “আমি আমার হাত দিয়ে ১০ লক্ষ হাদীস লিপিবদ্ধ করেছি।”
আমি তাঁকে আরো বলতে শুনেছি- “প্রত্যেক ঐ হাদীস যা এখানে পাওয়া যাবে না তা মিথ্যা।” এ বলে তিনি তাঁর হাত দিয়ে নোটখাতাগুলোর দিকে ইশারা করলেন।” [তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/১২-১৩]
ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন রহিমাহুল্লাহর নীতি ছিলো লেখালেখির সময় সনদ সহকারে শুধু লিপিবদ্ধ করে যাওয়া, কিন্তু মুখে প্রচারের সময় খুবই ভেবেচিন্তে বলা, এজন্য তিনি বলেন,
«إذا كتبت فقمش وإذا حدثت ففتش»
“যখন লিখবে তখন একত্রিত করো আর যখন বর্ণনা করবে তখন অনুষন্ধান করো।”
[তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/১৪]
শেষ করছি ইবনু মুবাশশির রহিমাহুল্লাহর দেখা স্বপ্নের মাধ্যমে, আমরা আল্লাহর নিকট এই স্বপ্ন বাস্তব সত্য হওয়ার বিষয়ে আশা করতে পারি, তিনি বলেন,
«رأيت يحيى بن معين في النوم فقلت ما فعل الله بك قال مهد لي بين المصراعين يعني ما بين بابي الجنة ثم ضرب بيده إلى كمه فأخرج درجا يعني وقال إنما نلنا ما نلنا بهذا يعني كتابة الحديث»
“আমি ঘুমের মধ্যে ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (রহিমাহুল্লাহ)-কে দেখলাম। তাঁকে বললাম, “আল্লাহ আপনার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন?”
তিনি বললেন, “জান্নাতের দু’ই দরজার মাঝে যা কিছু আছে আল্লাহ সেগুলো আমার অধীন করে দিয়েছেন।”
এরপর তিনি তাঁর হাত তাঁর আস্তিনের ভেতর ঢোকালেন এবং একটা ডেস্ক বের করে আনলেন এবং বললেন, “আমরা যা কিছু অর্জন করেছি তা অর্জন করেছি এর জন্যই।“ অর্থাৎ, হাদীস লিপিবদ্ধ করার জন্যে।“ [তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৬৫/৪২]