সৎ ব্যবসা
মিঠুন আর মতিন দু’জন ঘি ব্যবসায়ী। তবে দুজনের উদ্দেশ্য দুই ধরনের!
একজন সৎ ব্যবসায়ী তার নাম মতিন।
স্ত্রীর হাতে তৈরি ঘরোয়া ঘি বিক্রি করে টানাটানির সংসার। বিলাসিতার ধারের কাছেও যান না। তবে সংসারে সুখের শেষ নেই। ফুটফুটে দুই ছেলে আছে। যাদের নিয়ে তার বিশাল স্বপ্ন।
ঘিয়ের বিক্রি তার মতিনের পরিমাণের চাইতে বেশি না। তবে তার লাভ হয় মতিন থেকে দিগুণ। ছেলেকে ভালো স্কুলে দিয়েছে, ভালো বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। কিন্তু ওইতো গত সপ্তাহেই স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি উঠেছে।
সংসারের চাপে মন মেজাজ সবসময় বিগড়ে থাকে মিঠুনের। কাস্টমারদের সাথেও সবসময় ভালো করে কথা বলেন না। নেওয়া আর দেওয়ার মাঝেই সম্পর্ক কাস্টমারের সাথে।
আরেকদিকে মতিন মিয়া তার কাস্টমারদের সাথে সম্পর্ক রেখেছেন বন্ধুর মত। সাধ্যের বাহিরে দাম রাখছেন না। সতর্কতার সাথে বাকির ব্যবস্থা রেখেছেন। পরিমাণে কম দিচ্ছেন না বরং কয়েক গ্রাম বেশি হলে তুলেও নিচ্ছে না। সব মিলিয়ে খুবই আন্তরিকতা বজায় রেখেছেন।
এভাবে চলল কিছুদিন…..
এখন গ্রীষ্মকাল চারিদিকে কাঠফাটা রোদ।
মিঠুনের দোকান হচ্ছে রাস্তার পাশে, আর মতিন গলির কিছুটা ভিতরে। এলাকায় যারা নতুন বেশিরভাগ তারাই মিঠুন থেকে কেনে। পরবর্তীতে মতিনের সন্ধান পেলে মতিন থেকে কিনতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
একদিন এক লোক মিঠুন থেকে ঘি নিয়ে গলির ভেতর দিয়েই নিজ ঘরে যাচ্ছিলো। সে আবার মতিনের পরিচিত। দোকানে মতিনকে দেখেই ডেকে উঠলো। হাসতে হাসতে দোকানে প্রবেশ করেই দুজন কুশল বিনিময় করলো।
হঠাৎ নিজের হাতে থাকা বাজারের ব্যাগ দেখে লোকটি সংকোচ অনুভব করে। মনে মনে ভাবলো মতিন মনে হয়তো কষ্ট পাবে। অন্য কারো থেকে ঘি কিনেছে বলে। অথচ মতিন তাকে বাকিতে কেনার মত কত সুবিধা দিয়েছিল একসময়। পরে অর্ধেক টাকা মাফও করে দিয়েছিলো। কারণ আর্থিকভাবে লোকটি সমস্যায় ছিলো।
মতিন লোকটির নিরবতা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করতেই লোকটি আমতাআমতা করে বলে,
— মতিন মিয়া দেখুন তো ঘিটা খাঁটি কি-না। আজই কিনলাম, হাতের কাছে পেয়ে। অনেক দিন পরে ঘরে ফিরলাম তো। হাতের কাছে পেয়ে বউ-বাচ্চার জন্য নিয়ে নিলাম। আ—আপনি মনে কষ্ট পাননি তো?
লোকটিকে অবাক করে মতিন মিয়া একগাল মুচকি হেসে দিলো। এবং আশ্বাস দিলো যে সে কষ্ট পায়নি। নিশ্চিন্ত হয়ে লোকটিও মৃদু হেসে দিলো।
কিন্তু ঘটনা ঘটলো ঘি পর্যবেক্ষণ করার পরে। মতিনের চোখে খুব সহজেই ধরা পড়লো ঘিয়ে ভেজাল আছে। কারণ দিনের এই টাটকা রোদেও ঘি জমে ক্রিম হয়ে আছে। যা খাঁটি ঘিয়ে হয় না। খাঁটি ঘি এতক্ষণে তরল আকার ধারণ করার কথা। বলল মতিন মিয়া।
লোকটি তো রেগে আগুন। এখুনি মিঠুনকে ধরে শায়েস্তা করতে হবে। তাকে থামিয়ে দিয়ে মতিন মিয়া বলল, থামুন! আল্লাহ মানুষকে ছাড় দেন ছেড়ে দেন না। এখন আপনি মারপিট করলে যদিও সে দোকান ছেড়ে দিক অন্য কোথাও গিয়ে সে আবার অসাধু ব্যবসায় লেগে পড়বে। উনার শিক্ষাটা এমন হওয়া উচিৎ যেনো সে ভবিষ্যতেও এমন আর না করে। এতে আমরাও সওয়াব পাবো।
বিকেল বেলা হাঁটতে হাঁটতে মিঠুনের দোকানে প্রবেশ করেন মতিন মিয়া। সালাম বিনিময় করে একটা মোড়া পেতে বসলেন। উদ্দেশ্য তার গল্পে গল্পে কিছু উপদেশ দেওয়া।
শুরু করলেন_ : জানেন ভাইজান আখিরাতে সৎ ব্যবসায়ীদেরকে আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দিয়ে রেখেছেন। আমিতো আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া আদায় করি। আল্লাহ আমাকে এমন একটা হালাল উপার্জনের নেয়ামত দান করেছেন।
কিন্তু আল্লাহপাক ইরশাদ করেন
“সেই সকল লোক যাদেরকে ব্যবসা বাণিজ্য এবং কেনা-বেচা আল্লাহর স্মরণ হতে এবং যারা সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেই দিনকে যেই দিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে”।
[সূরা নূর:৩৭]
আল্লাহ মাফ করুক এই হাদিসটি পড়লে অনেক ভয় লাগে ভাইজান। না জানি কখনো কাউকে কোনো কাস্টমারকে অসন্তুষ্ট করেছি কি-না, আল্লাহকে তখন ভুলে গিয়েছিলাম কি-না। মনে করে সময় আসার আগেই ক্ষমা চাইতে হবে।
মিঠুনের হাস্যজ্বল মুখটা মুহুর্তেই নাই হয়ে গেলো। মতিন তো চাচ্ছিলো তার মনে যেন কড়া নাড়ে। আল্লাহ মাফ করুক কারো মনে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য তার নেই, ছিলোও না। মিঠুনের ক্ষেত্রে বুঝানো সহজ হচ্ছে কারণ আল্লাহকে সে বিশ্বাস করে। আর মতিন নিজেকে উদাহরণ দিয়ে তাকে পরামর্শ দিচ্ছে। যদি মিঠুনকে সরাসরি বলতো আজ অন্যকিছু ঘটতো। আল্লাহ তাকে হেদায়েত দান করুন।
আল্লাহ বিধানের বাহিরে গেলে হালাল ব্যবসাও হারাম হয়ে যায় ভাইজান। আর হারাম আমাদের সুখশান্তি নষ্ট করে, সংসার ভেঙে দেয়। মনকে অস্থির করে তুলে। কারণ হারামে তো আরাম নেই। হালাল সবসময় বরকত অল্পতেও বরকত।
কথা বলতে বলতেই মাগরিবের আজান দিয়ে দিলো। মতিন মিঠুন থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। মিঠুনের মনে মুহুর্তেই তোলপাড় শুরু হলো। তার এত অশান্তি, খিটখিটে মেজাজ সবকিছুর সমাধান যেন মতিন দিয়ে গেলো।
আচমকা মিঠুন দাঁড়িয়ে গেলো। ড্রয়ার আর আশপাশ খুঁজে টুপি পেলো না। মনে করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হয় না। কোথায় রেখেছে ঠিক ঠিকানা নেই। মিঠুন তাড়াতাড়ি শাটার বন্ধ করে অন্য দোকান থেকে টুপি কিনতে মানিব্যাগ খুলতেই তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। “ইয়া আল্লাহ এই টাকা গুলো তো হালাল না, সৎ উদ্দেশ্যে টুপি কিনে থাকলেও তুমি কি আমায় কবুল করবে?”
মানিব্যাগটা আবার পকেটে রেখে দোকানদার থেকে বাকিতে টুপি নিলো। তাড়াহুড়ো করে মসজিদে যাওয়ার পথে মাঝ রাস্তায় এক অসহায় লোককে তার মানিব্যাগটি দান করে দিলো। এবং আল্লাহর কাছে কোনো বিনিময় আশা করলো না।
এরপরেও আল্লাহ কি এক অন্যরকম প্রশান্তি দিয়ে দিলো তার মনে যা সে আর কখনো অনুভব করেনি। আলহামদুলিল্লাহ।
মসজিদ থেকে বের হতেই মতিন আর মিঠুনের দেখা।
মতিন অবাক হয়ে বলল — আরে ভাইজান আপনে?
মতিন মিয়া মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলল —মতিন মিয়া আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিব। আসলে সব প্রসংশা আল্লাহর যিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন। আজ আসি। আল্লাহ হাফেজ।
মতিন মিয়া কিছু বুঝেও যেন বুঝলো না।
পরের দিন…..
“মতিন মিয়া আসতে পারি?”
মতিন মিয়া মাথা উঠিয়ে দেখে মিঠুন!
“আরে ভাইজান আসেন আসেন।”
“মতিন মিয়া আমিতো একটা দরকারে আসছিলাম।”
“জ্বি ভাইজান বলেন”
“আমাকে আপনার দোকানে একটা কাজ দেন।
মতিন মিয়া অবাক_
“আমি কথা দিচ্ছি অনেক পরিশ্রম করবো। দরকার পড়লে আপনার ঘি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করবো। ঘি বিক্রি হলেই আমাকে টাকা দিয়েন। আমি পুরো দোকান ছেড়ে চলে আসছি। বাসাও ছেড়ে দিছি। কাজ করে টাকা উপার্জন করে ছোট একটা বাসা নিব। তারপর বউ বাচ্চাকে আনবো। আপনি আমাকে কাজ দিয়ে দয়া করে সাহায্য করেন!”
বলেই মিঠুন মাথা নিচু করে নিলো। মতিন খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। কি যে শান্তি লাগছে তার। উঠে গিয়ে মিঠুনকে জড়িয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। তারপর থেকে দুজন একসাথে কাজ শুরু করে।
একটু একটু করে মিঠুন তার সকল কাস্টমারের টাকা ফেরত দেয় নিজ হালাল উপার্জ দিয়ে। আস্তে আস্তে দোকান বড় হয়। মিঠুন তার বউ বাচ্চা ফিরিয়ে আনে। আর মতিন আর মিঠুন বন্ধুর মতন একসাথে তাদের সৎ ব্যবসা চালিয়ে যায়।
নোটঃ মিঠুনের মত কিছু জ্ঞানী মানুষ আছে সব জানে। কিন্তু একটু মনে কড়া না নেড়ে দেওয়ার অভাবে শোধরাতে পারে না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন। আমীন।