স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্যমানের মধ্যে বিরাট ব্যবধান : সমাধানের খোঁজে!!
প্রসঙ্গ ‘যাকাতের নিসাব’
স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্যমানের মধ্যে বিরাট ব্যবধান : সমাধানের খোঁজে!!
হাদীসের ভাষ্যমতে- ২০ দীনার স্বর্ণ (বর্তমান পরিমাপ অনুসারে ৭.৫ তোলা বা ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ) অথবা ২০০ দিরহাম রৌপ্য (বর্তমান পরিমাপ অনুসারে ৫২.৫ তোলা বা ৫৯৫ গ্রাম রৌপ্য) কিংবা এ পরিমাণ স্বর্ণ বা রৌপ্যের মূল্যের সমান অর্থ-সম্পদ থাকলে সেই অর্থ-সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও খুলাফা-ই- রাশিদীনের আমলে দীনার ও দিরহামের অনুপাত ছিল ১ঃ১০। অর্থাৎ ২০ দীনার স্বর্ণ ও ২০০ দিরহাম রৌপ্যের মূল্যমান সমপরিমাণ ছিল। এর ভিত্তিতেই সর্বনিম্ন নিসাব নির্ধারিত হয়েছিল ২০ দীনার (স্বর্ণ) অথবা ২০০ দিরহাম (রৌপ্য)।
বর্তমানে বাজারদর অনুযায়ী এ দুটির মূল্যমানের অনুপাত ১ঃ১০-এর চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কখনও এ অনুপাত ১ঃ১০০-ও ছাড়িয়ে যায়।
অর্থাৎ এ দুটির মূল্যমানের মধ্যে বর্তমানে পার্থক্য হচ্ছে অন্তত ১০০গুণ। এ অবস্থায় নিসাব স্বর্ণের দামের আলোকে নির্ধারিত হবে, না-কি রৌপ্যের দামের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে- তা নিয়ে বড়ো প্রশ্ন ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
প্রাচীন ও আধুনিক গবেষকদের মধ্যে অনেকেই রৌপ্যকে ভিত্তি করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের প্রধান যুক্তি হলো-
রৌপ্যের ভিত্তিতে নিসাব নির্ধারণ করা হলে গরীব ও নিঃস্ব জনগোষ্ঠী অধিকতর উপকৃত হবে। কারণ, এ অবস্থায় অধিক সংখ্যক লোক নিসাবের অধিকারী বলে গণ্য হবে।
পক্ষান্তরে কতিপয় আধুনিক গবেষকের মতে-
বর্তমানে স্বর্ণের ভিত্তিতেই নিসাব নির্ধারণ হওয়া উচিত। তাদের প্রধান যুক্তি হলো- বর্তমানে একদিকে রৌপ্যের মূল্যমানের অনেক পতন হয়েছে, অপরদিকে স্বর্ণের মূল্যমান বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বর্তমানে ৭.৫ তোলা স্বর্ণের দাম হচ্ছে আনুমানিক ৭,৫০,০০০/= থেকে ৯,০০,০০০/= টাকা এবং ৫২.৫ তোলা রৌপ্যের দাম হচ্ছে আনুমানিক ৬০,০০০/= থেকে ৮০,০০০/= টাকা, যা স্বর্ণের মূল্যের প্রায় ১২ থেকে ১৫ ভাগের একভাগ।
এমতাবস্থায় রৌপ্যের মূল্যকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হলে যার কাছে স্বর্ণের নিসাব পরিমাণের মাত্র দশভাগের একভাগ বা আরও কম মূল্যমানের সম্পদ রয়েছে তার ওপরও যাকাত ওয়াজিব হবে। এটি এক ধরনের অযৌক্তিক কথা।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রাহ.) বলেন,
‘‘রৌপ্যের নিসাব ২০০ দিরহাম (৫২.৫ তোলা রৌপ্য) নির্ধারণ করার পেছনে যে যুক্তি তা হচ্ছে- এ পরিমাণ রৌপ্য একটা পরিবারের পূর্ণ এক বছরকাল পর্যন্ত ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট, যদি দেশের বাজারমূল্য সঙ্গতিপূর্ণ ও স্থিতিশীল থাকে।”
কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো,
বর্তমানে সাধারণত একজন নিম্নবিত্তের অভাবী লোকেরও বছর শেষে ষাট/সত্তর হাজার টাকা জমা থাকা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আর বর্তমানে দেশে বাজারমূল্যের যে অস্থিতিশীল অবস্থা এবং খরচের যে উর্ধ্বগতি ও বহুমাত্রিকতা তাতে এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে একজন গরীব ব্যক্তির পক্ষে স্বাভাবিকভাবে দু/তিন মাসের বেশি তার ও তার স্ত্রীপরিজনের আবাসন, ভরণ-পোষণ, শিক্ষা ও চিকিৎসা খরচ মেটানো সম্ভব নয়; শহরে বসবাসকারীদের পক্ষে তা একেবারেই অসম্ভবই বলা চলে।
কাজেই বর্তমানে রৌপ্যকে যদি নিসাবের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়, তাহলে এরূপ অবস্থায় অভাবগ্রস্ত লোকেরাও যেহেতু নিসাবের মালিক হিসেবে গণ্য হবে, তাই তাদের পক্ষে আর যাকাত গ্রহণ করা বৈধ হবে না।
ড. ইউসূফ আল কারযাভী (রাহ.)-এর মতে- দ্বিতীয় মতটিই অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য ও বাস্তবসম্মত।
কারণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাকাতের যে পরিমাণ নিসাব নির্ধারিত হয়েছে (যেমন- গবাদি পশু, জমিতে উৎপাদিত ফসল ইত্যাদি) তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, স্বর্ণের নিসাবকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। যেমন- ধরুন, উট ও ছাগলের ক্ষেত্রে যথাক্রমে পাঁচটি উট, ত্রিশটি গরু ও চল্লিশটি ছাগল হচ্ছে সর্বনিম্ন নিসাব। বর্তমানে বাজার দর অনুসারে মাঝারি সাইজের পাঁচটি উট, ত্রিশটি গরু ও চল্লিশটি ছাগলের মূল্য দাঁড়াবে ন্যূনতম ৫ থেকে ১০ লক্ষাধিক টাকা।
অর্থাৎ যার কাছে এ পরিমাণের চেয়ে কম উট, গরু বা ছাগল রয়েছে তাকে নিসাবের অধিকারী হিসেবে গণ্য করা হয়নি; তাকে গরীব হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে, যদি তার কাছে অন্য কোনো সম্পদ না থাকে। কাজেই যার কাছে ৫২.৫ তোলার রৌপ্য রয়েছে; কিন্তু তার মূল্য যদি ৬০,০০০/= থেকে ৮০,০০০/= টাকার বেশি না হয়, তাকে সাহেবে নিসাব হিসেবে গণ্য করা যুক্তিযুক্ত নয়।
আমরা মনে করি,
এ প্রসঙ্গে আরও গবেষণা হতে পারে। কারণ, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রৌপ্যের পরিবর্তে যদি স্বর্ণের মূল্যমানকেই নিসাবনির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়, তবে বার্ষিক ব্যয় নির্বাহের পর ৭,৫০,০০০/= টাকার কম উদ্বৃত্ত থাকলে সে-ও যাকাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে যাবে। এটাও কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত মনে হয় না।
এ অবস্থায় সমাধানের একটি পথ এ-ই হতে পারে কিনা বিজ্ঞ গবেষকগণ চিন্তা করতে পারেন,
যাকাতদাতা ও যাকাতগ্রহীতা- দু পক্ষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে নিসাবপরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্যমান যোগ করে দুই দ্বারা ভাগ করা হবে এবং যা ভাগফল বের হবে- তাকেই নিসাবের ভিত্তি হিসেবে ধরা হবে।
উদাহরণস্বরূপ ধরুন, ৫২.৫ তোলার রৌপ্যের দাম ৭৫,০০০/০০, আর ৭.৫ তোলা স্বর্ণের দাম ৭,৫০,০০০/০০। মোট: ৭,৫০,০০০/০০+ ৭৫,০০০/০০= ৮,২৫,০০০ টাকা। ৮,২৫,০০০-এর দুভাগের এক ভাগ হলো ৪, ১২,৫০০/০০ টাকা। সুতরাং কারো কাছে যদি বার্ষিক ব্যয় নির্বাহ করার পর ৪,১২,৫০০/০০ টাকা উদ্বৃত্ত থাকে, তবেই তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।
উল্লেখ্য, একটা গরীব পরিবারের, বিশেষ করে শহরে বসবাসকারী গরীব পরিবারগুলোর মাসিক ব্যয় (বাড়িভাড়াসহ) ন্যূনতম ৩০,০০০/= থেকে ৩৫,০০০/= টাকা করে ধরলে বার্ষিক ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় চার লক্ষাধিক টাকা।
আশা করি, এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞ গবেষক ও চিন্তাশীল মুফতীগণ আরো সুচিন্তিত, যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত মতামত প্রদান করে কৃতার্থ করবেন।