শোকগাঁথা (শেষ পর্ব)
ফাতিমা (রা:) কখন মারা গেলেন?
রাসুলের (ﷺ) মৃত্যুর পর প্রথম রমজানে। সে বছরের রমজানটা একবার কল্পনা করুন। কারো মৃত্যুর পর যে কোন বার্ষিকী যেনো মৃত্যুর সমস্ত বেদনা ফিরিয়ে আনে। এবার চিন্তা করুন রাসুল (ﷺ) জীবিত থাকা অবস্থায় রমজান কেমন ছিল। তিনি প্রতিটি নামাজের ইমামতি করতেন। তাঁর উপস্থিতিতে মদিনার রমজান কতই না অভূতপূর্ব ছিল। রাসুলের (ﷺ) মৃত্যুর পর এই প্রথম রমজান মাস তাদের অতিবাহিত করতে হবে। তিনি এখন সমাধিস্থ। এই রমজান মাসের প্রথম দিকে, তৃতীয় রোজায় ফাতিমা (রা:) ঘরের সামনে উঠোনে গেলেন। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তারপর আসমা বিনতে উমাইসকে ডাকলেন। তাঁকে বললেন, “শোনো আসমা, যখন আমি মারা যাব, আমি চাই আমাকে যেন রাতের বেলা সমাধিস্থ করা হয়। আমার জানাজায় খুব বেশি লোক যেন উপস্থিত না থাকে, কেউ যনো আমার দেহের গঠন ও আকৃতি দেখতে না পারে।” তিনি বলতে চেয়েছিলেন’ খুব শালীনভাবে যেন তাঁকে বিদায় দেওয়া হয়।
কিছু কিছু আলেম বলেন, ফাতিমা (রা:) সুপরিচিত ছিলেন তার লজ্জাশীলতা ও শালীনতার জন্য। তিনি সত্যিই চাননি তাঁর দেহের আকার ও আকৃতি সবার সামনে প্রকাশিত হোক। তাই তিনি বলেছিলেন, “বড় একটি চাদরে আমাকে ঢেকে দিবে, এবং আমাকে রাতের বেলা কবর দিবে, খুব অল্প সংখ্যক লোক যেন আমার জানাজায় উপস্থিত হয়। আল্লাহ যেন আমাকে আড়াল করে রাখেন।”
আসমা (রা:) একথা উম্মে সালামাকে (রা:) জানালেন। এই সেই উম্মে সালামা (রা:) যিনি বিয়ের সময় আলী (রা:) এবং ফাতিমার (রা:) ঘর সাজিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি হাবাসা অর্থাৎ হিজরতের সময় আবিসিনিয়া থেকে আনা একটি ভারী চাদর নিয়ে আসলেন। ফাতিমা (রা:) চাদরটি দেখে খুশি হলেন। এরপর তিনি আলীকে (রা:) ডাকলেন। মৃত্যুর আগে শেষ মুহূর্ত গুলো তিনি তাঁর পরিবারের সাথেই কাটিয়েছিলেন। তিনি বলে গিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পরে আলী (রা:) যেন তাঁর বোন জয়নাবের (রা:) মেয়ে উমামাকে (রা:) বিয়ে করে। কারণ তিনি জানতেন উমামা (রা:) একজন মাতৃবৎ স্নেহশীলা মহিলা, যিনি তাঁর সন্তানদের দেখে রাখবেন।
মৃত্যুর সময় তিনি চার সন্তান – হাসান (রা:), হুসাইন (রা:), জাইনাব (রা:), ও উম্মে কুলসুমকে (রা:) রেখে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর পরিবারকে আলিঙ্গন করলেন।
সুবহানাল্লাহ! তিনি শায়িত অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। ফেরেশতারা কাছে এসে তাঁর চেহারায় নূরের জ্যোতি ছড়িয়ে দিলেন। হাসিমুখে, পরম প্রশান্তিতে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। এভাবে রাসুলের (ﷺ) কথাই সত্যি হলো। তিনি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, “আমার মৃত্যুর পর সাহাবাদের মধ্যে তুমিই প্রথম মৃত্যুবরণ করবে।” সাহাবা ও পরিবার বর্গের মধ্যে তিনিই প্রথম রাসুলের (ﷺ) সাথে মিলিত হলেন।
আলী (রা:) সবেমাত্র রাসুলকে (ﷺ) হারিয়েছেন। এখন তিনি ফাতিমাকে (রা:) হারালেন। দাফনের আগে তিনি ফাতিমাকে (রা:) গোসল দিতে সাহায্য করেছেন। গোসল করাতে গিয়ে তিনি বারবারই কেঁদেছেন। আলীকে (রা:) সেই কঠোর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে রাসুলও (ﷺ) গিয়েছিলেন, তিনিও খাদিজাহকে (রা:) নিজ হাতে কবরের নামিয়েছেন ও সমাধিস্থ করেছেন। এ অভিজ্ঞতা ছিল আলীর (রা:) জন্য সত্যিই বেদনাদায়ক। আলী (রা:) নিজেই ফাতিমার (রা:) জানাজা পড়ালেন। এক্ষেত্রে রাসুলের (ﷺ) অভিজ্ঞতার সাথে আলীর (রা:) অভিজ্ঞতা অনেকাংশে মিলে যায়। আলী (রা:) এবং ফাতিমার (রা:) ভালোবাসার বন্ধন ছিল সুদৃঢ়।
আলী (রা:) বলেন, “আর কোন কিছুই জীবনে আমাকে এতটা হতাশ এবং ক্লান্ত করেনি, যতটা এই অল্প সময়ের ব্যবধানে আমার জীবনে দুজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষের মৃত্যু করেছে। আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজনকে আমি হারিয়েছি। জীবনে যুদ্ধ-বিগ্রহ, খিলাফা, ফিতনা – কোন কিছুই আমাকে এভাবে নিঃশেষ করেনি, যেভাবে রাসুল (ﷺ) ও ফাতিমার (রা:) মৃত্যু আমাকে নিঃশেষ করেছে।”
খুব করুন সুরে বেজে উঠে এ কাহিনীর পরিসমাপ্তি। আশাব্যঞ্জক কিছুই নেই এই কাহিনীতে, আছে শুধু বেদনা – খাঁটি ও অকৃত্রিম বেদনা। এটাই ভালোবাসা ও মানবিকতা, এটাই রাহমা – অন্তরের করুণা। মনে আছে, যখন রাসুলের (ﷺ) পুত্র সন্তানের মৃত্যুতে তিনি কেঁদেছিলেন, তখন সবাই বলছিল, “আপনি কাঁদছেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ?” তিনি বলেছিলেন এটা রাহমা, এই কৃপা এবং অনুকম্পা আল্লাহ আমাদের অন্তরে দিয়েছেন একে অন্যের প্রতি। কাজেই ফাতিমার (রা:) মৃত্যুতে আলীর (রা:) এই কথাগুলো ছিল বেদনা থেকে উৎসরিত – আদি, অকৃত্রিম, হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এ বেদনা। ফাতিমাকে (রা:) সমাধিস্থ করে, তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আলী (রা:) আবৃত্তি করলেন আবেগময় সেই কবিতা –
مالِي وَقَفتُ عَلى القُبورِ مُسَلِّماً
قَبرَ الحَبيبِ فَلَم يَرُدَّ جَوابي
أَحَبيبُ مالَكَ لا تَرُدُّ جَوابَنا
اَنَسيتَ بَعدي خِلَّةَ الأَحبابِ
قالَ الحَبيبُ وَكَيفَ لِي بِجَوابِكُم
وَأَنا رَهينُ جَنادِلٍ وَتُرابِ
أَكَلَ التُرابُ مَحاسِني فَنَسيتُكُم
وَحُجِبتُ عَن أَهلي وَعَن أَترابي
فَعَلَيكُمُ مِنّي السَلامَ تَقَطَّعَت
مِنّي وَمِنكُم خِلَّةَ الأَحبابِ
পাশেই সমাধিস্থ প্রিয়তমা,
তবুও করেছি সম্ভাষণ,
দিয়েছি সালাম।
কবরে শায়িত প্রেয়শী আমার
দেয়নি এর প্রতিউত্তর,
হে আমার প্রিয়তমা,
দিচ্ছনা কেন সারা?
তবে কি গিয়েছো ভুলে
আমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত,
সেই বিমুর্ত ক্ষণ?
প্রেয়শী যেন বলে উঠলো,
কেমন করে সাড়া দিই বল?
আমিতো এখন কারাগারে বন্দি,
ধুলোবালি,পাথর গ্রাস করেছে আমায়।
আমিতো আজ মাটির কাছেই জিম্মি।
আমাতে আর আমার প্রেমিকের মাঝে
আজ এক অদৃশ্য দেয়াল।
তবুও সম্ভাষণ আমার প্রেমিকের তরে,
সম্ভাষণ যাদের এসেছি ফেলে।
ফেলে এসেছি আমি
সব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত,
আমাদের সেই যুগল পথ
সেই বিমুর্ত ক্ষণ,
আজ থেমে গেছে এই রথ।
কি বেদনাদায়ক স্বগোক্তি উঠে এসেছে কবিতায়। আশাব্যঞ্জক কোন কথা নেই, জান্নাতে মিলিত হওয়ার কোন কথাও নেই। কেবলই আদি, অকৃত্রিম, খাঁটি বেদনার অভিব্যক্তি। এমনই গভীর ভালোবাসা ছিল দুজনের। আলী (রা:) আল্লাহর প্রতি ক্ষুব্ধ হননি, নারাজ হননি। মৃত্যু এবং এর পরবর্তী প্রক্রিয়া তিনি জানেন। তার মানে এই নয় যে তিনি ব্যথিত হননি। ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমরা আমাদের প্রিয়জনদের হারাই এটা কিন্তু আমাদের থেকে আশা করা হয় না যে আমরা ব্যথিত হবো না। সবরের অর্থ এ নয়।
ধৈর্য মানে এই নয় যে আপনি ব্যথিত হবেন না, ভালোবাসা অনুভব করবেন না, প্রিয়জনদের হারিয়ে তাদের সাথে দূরত্ব অনুভব করবেন না। ধৈর্য মানে এমন কিছু না বলা যাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। এই ব্যথাকে কাজে লাগিয়ে ভালো কিছু করুন। যেমন রাসুল (ﷺ) খাদিজার (রা:) মৃত্যুর পর তাঁর বান্ধবীদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন, তাদের জন্য খরচ করতেন। এই সম্পর্ক গুলো তিনি বজায় রেখেছিলেন। আমাদেরও এমনটা করা উচিত। সেই মুহূর্তে আলী (রা:) ফাতিমার (রা:) সাথে তাঁর কথোপকথন কল্পনা করে নিয়েছিলেন। গভীর ভালোবাসা বোধ থেকেই তিনি তা করেছিলেন।
অবশ্যই আমরা জানি, রাসুল (ﷺ) উল্লেখ করেছেন, সব মুমিনদের আত্মা একত্রিত হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে তাঁরা দুজনেই জান্নাতের জন্য প্রতিশ্রুত। الحسن والحسين سيدا شباب أهل الجنة – হাসান (রা:) ও হোসাইন (রা:) জান্নাতের যুবকদের সর্দার হবেন। রাসুলের (ﷺ) উপস্থিতিতে তাঁরা আবার মিলিত হবেন انت مع من احباب – মুমিনদের সেই রাজ্যে। আমরাও আল্লার কাছে দু’আ করি আল্লাহ যেন আমাদেরকেও তাদের সাথে একত্রিত করেন। আমরাও যেন তাদের মতো হতে পারি, সেই ভালোবাসা ও করুনাকে যেন আমরাও আমাদের অন্তরে ধারণ করতে পারি। আল্লাহর নির্দেশ পালনের আনন্দে যেন আমরাও যেন আনন্দিত হই।
আমাদের নিজেদের পরিবার সহ যেন আমরা আশীর্বাদপ্রাপ্ত এই পরিবারের সান্নিধ্য লাভ করি জান্নাতুল ফেরদৌসে। আল্লাহুম্মা আমীন! এই কাহিনী অনেক দিক থেকে আমাদের পথনির্দেশনা দেয় কিভাবে আমরা আমাদের জীবনকে পরিচালিত করতে চাই, কিভাবে মৃত্যুবরণ করতে চাই, কার সাথে থাকতে চাই সেই ব্যাপারে। انت مع من احباب – যাকে আপনি ভালোবাসেন তার সাথেই আপনি থাকবেন। সেদিন আল্লাহ যেন আমাদেরকে তাদের মাঝে পান যারা তাঁর রাসুলকে (ﷺ) এবং তাঁর পরিবারকে গভীরভাবে ভালোবাসতো। এই ভালোবাসাই আমাদের একদিন একত্রিত করবে রাসুল (ﷺ) এবং তাঁর পরিবারবর্গের সাথে। আল্লাহুম্মা আমীন!
সমাপ্ত।
আলী (রা:) ও ফাতিমার (রা:) সুখের সংসার
পর্ব : ১২
মূল: ড. ওমর সুলাইমান