এক সময় পৃথিবীতে মানুষ দীর্ঘ হায়াত পেত। হাজার বছর কিংবা তারও বেশি। সেটা কমে কমে এখন একশ’র নিচে চলে এসেছে। কেউ কেউ একশ’র বেশিও বাঁচে। তখন সেটি খবর হয়ে ওঠে। সালমান আল-ফারসী এরকম একজন। তিনি দীর্ঘ হায়াত পেয়েছিলেন। কয়েকশ বছর। তার যুগে অন্য কেউ এত হায়াত পাননি। দীর্ঘ জীবনের ঘটনাও দীর্ঘ হয়। এজন্য তার ইসলামগ্রহণের ঘটনা এক-দুইদিনের নয়; বরং শত বছরের। আল্লাহ তাকে বিশেষভাবে ইসলামের জন্য মনোনীত করেছিলেন।
পারস্যের ইসফাহান অঞ্চলে একটি গ্রামের নাম জায়ান। এ গ্রামেই তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। যুবক বয়স পর্যন্ত তিনি এখানেই ছিলেন। তার বাবা ছিলেন গ্রামের সর্দার। সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। ধনীদের বিভিন্ন বাতিক থাকে। তার বাবারও ছিল। কী এক অমঙ্গলের আশঙ্কায় প্রিয় ছেলেকে গৃহবন্দী করে রাখলেন। ‘পায়ে বেড়ি পর্যন্ত পরালেন। যুবক বয়সে বন্দিত্ব ভালো লাগার কথা নয়। সালমানেরও ভালো লাগল না। একদিন সুযোগ বুঝে ঘর ছেড়ে পালালেন।
স্রষ্টার ইবাদতে খুব আগ্রহ ছিল সালমানের। এজন্য জীবন উৎসর্গ করতে চাইতেন। পিতার ধর্ম ছিল মাজুসী। তিনি আগুনের পূজা করতেন। আর সারক্ষণ আগুন জ্বালিয়ে রাখার-দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সালমানকেই। এসব কাজে তার আগ্রহের কমতি ছিল না। একদিন গ্রামের এক গীর্জায় ঢুকে পড়েন তিনি। তাদের প্রার্থনা-পদ্ধতি তার মন কেড়ে নেয়। সেই থেকে খ্রিস্টধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তখন এ ধর্মের উৎস ছিল শামে। তিনি স্থানীয় খ্রিস্টানদের সহায়তায় দামেস্কে পাড়ি জমান।
দামেস্কে তিনি নতুন। এই প্রথম গ্রামের বাইরে কোথাও এলেন। কাউকেই চেনেন না। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে এক গীর্জায় গিয়ে উঠলেন। গীর্জার পুরোহিতকে নিজের বাসনা বললেন: ‘আমি খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আমার ইচ্ছা, আপনার সাহচর্যে থেকে আপনার খিদমত করা, আপনার নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করা এবং আপনার সঙ্গে প্রার্থনা করা।’ এতে পুরোহিত রাজি হলো। তিনি তার সঙ্গে থাকা শুরু করলেন। I
ধনীর আদরের দুলাল ছিলেন সালমান। সবছেড়ে এই বৈরাগ্য জীবনেই তিনি শান্তি খুঁজে পেলেন। কিন্তু এ শান্তি বেশিদিন টিকল না। পুরোহিতের কর্মকাণ্ড তার ভালো লাগল না। ধর্মীয় নেতা হতে হলে সৎ হতে হয়। পুরোহিতটা মারাত্মক অসৎ। অসৎ লোকের সঙ্গে থাকা মুশকিল। সেবা করা আরও কঠিন। অন্য কোথাও যাবেন, সে উপায়ও নেই। বাধ্য হয়ে এখানেই থাকতে লাগলেন।
সালমানের ভাগ্য বরাবরই সুপ্রসন্ন। কিছু দিনের মধ্যেই অসৎ লোকটি মরে গেল। তার জায়গায় এলো নতুন পুরোহিত। নতুন মানুষটিকে তার ভালো লাগল। তিনি দুনিয়া-বিরাগী এবং ইবাদতগুজার; সঠিক খ্রিস্টধর্মের প্রচারক এবং ধারক।
সালমান সর্বস্ব দিয়ে তার সেবা করতেন। দুজন আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠেন। এভাবে লম্বা একটা সময় অতিবাহিত হলো। তারপর সেই পুরোহিত ইন্তেকাল করলেন। মৃত্যুর আগে সালমানকে আরেকজন পুরোহিতের সন্ধান দিয়ে গেলেন। সেই পুরোহিত থাকেন মাসুলে। এখন তাকে মাসুলে যেতে হবে। তিনি গেলেন।
সালমানের আবার নতুন জীবন শুরু হলো। মাসুলের লোকটিও ভালো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তিনিও পরপারে পাড়ি জমান। এবার সন্ধান পেলেন নাসসিবিনে আরেক পুরোহিতের। গেলেন। নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী এ পুরোহিতও বেশিদিন বাঁচলেন না। তিনি মৃত্যুর আগে সালমানকে বললেন, ‘অমুক নামে আমুরিয়্যাতে এক লোক আছেন। তুমি তার সাহচর্য অবলম্বন করো। এ ছাড়া আমাদের এ সত্যের উপর অবশিষ্ট আর কাউকে আমি জানি না।’
জীবন উৎসর্গিত না হলে কেউ এমনভাবে ইবাদত-বন্দেগীতে লেগে থাকে না। এ পর্যন্ত চারজন পুরোহিতের সঙ্গ লাভ করেছেন। খ্রিস্টধর্মের যাবতীয় বিষয়াদি, গির্জার নানা কর্মকাণ্ড, প্রার্থনা পদ্ধতি, উৎসব-কোনো কিছুই শেখা বাকি নেই। চাইলেই তিনি এখন পুরোহিত সেজে বিলাসী জীবন কাটাতে পারেন। কিন্তু তিনি শিষ্যত্বকেই বেছে নিলেন। আমুরিয়্যাতে গিয়ে হাজির হলেন। ওই লোককে খুঁজে বের করলেন। তার সঙ্গে থাকার অনুমতি চাইলেন। অনুমতি মিলল।
নতুন পুরোহিত লোকটি আগের তিনজনের মতো একই পথ ও মতের অনুসারী। সালমানের ভালো লাগল। তবে এ ভালো লাগাও বেশিদিন টিকল না। অদৃশ্যের ইশারায় তিনিও খুব দ্রুত
জীবনের অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে গেলেন। এ সময় সালমান তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার অবস্থা তো আপনি ভালোই জানেন। এখন আমাকে কী করতে বলেন, কার কাছে যেতে পরামর্শ দেন?’
পুরোহিত বললেন,
‘বৎস, আমরা যে সত্যকে ধরে রেখেছিলাম, সে সত্যের ওপর ভূ-পৃষ্ঠে অন্য কোনো ব্যক্তি অবশিষ্ট আছে বলে আমার জানা নেই। তবে অদূর ভবিষ্যতে আরব দেশে একজন নবী আবির্ভূত হবেন। তিনি ইবরাহীমের দ্বীন নতুনভাবে নিয়ে আসবেন। তিনি তার জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বড়বড় কালো পাথরের যমীনের মাঝখানে খেজুর উদ্যানবিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরত করবেন। দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট কিছু নিদর্শনও তার থাকবে। তিনি হাদিয়ার জিনিস তো খাবেন, কিন্তু সদাকার জিনিস খাবেন না। তার দুকাঁধের মাঝখানে নবুওয়াতের মোহর থাকবে। তুমি পারলে সে দেশে যাও।’
এরপর পুরোহিত মারা গেলেন। এখন সালমান পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। এখন গন্তব্য অনেকদূর। পথ চেনা নেই। একা একা যাওয়াও সম্ভব নয়। কোনো কাফেলা পেলে সহজ হতো। আরবরা এখানে ব্যবসা করতে আসে। সবসময় আসে না। বছরের নির্দিষ্ট কিছু মাসে আসে। এরকম কোনো আরব কাফেলার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
সব অপেক্ষাই একদিন শেষ হয়। সময় এমনই। সালমানের অপেক্ষাও শেষ হলো। একটা আরব কাফেলা পাওয়া গেল। আম্মুরিয়াতে থাকাকালে তিনি কিছু গরু ও ছাগলের মালিক হয়েছিলেন। সেগুলোর বিনিময়ে কাফেলার লোকজন তাকে নিতে রাজি হলো।
কাফেলার লোকজন কেমন, সালমানের তা জানার অবকাশ ছিল না। তখন আরবদের চরিত্র বলতে কিছু ছিল না। এ কাফেলার লোকজনও তেমন। তারা সালমানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। ওয়াদী-আল-কুরা নামক স্থানে তাকে এক ইহুদীর নিকট বিক্রি করে দিল। এভাবে বিক্রি হয়ে গেলে মানুষ আর স্বাধীন থাকে না। দাস হয়ে যায়। সালমানও দাস হয়ে গেলেন।
ওয়াদী-আল-কুরা হচ্ছে মদীনা ও শামের মধ্যবর্তী একটি জায়গা। মাঝপথে এসে তাকে এখন একজন ইহুদীর দাসত্ব করতে হচ্ছে। তবে এ অবস্থা বেশিদিন চলেনি। অল্পদিনের মধ্যেই ওই ইহুদীর এক চাচাতো ভাই বেড়াতে এলো। সে ইয়াসরিবে বনু কুরাইযা গোত্রে বসবাস করে। সালমানকে তার পছন্দ হলো এবং খরিদ করে নিল। পণ্য আর মানুষ বিক্রিতে তখন কোনো তফাৎ ছিল না।
সালমানের মনিব পাল্টে গেল। এ ব্যাপারে দাসদের কিছু করার থাকে না। তবে সালমান এতে খুশি হলেন। শীঘ্রই তিনি তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেন। হলোও তা-ই। নতুন মনিবের সঙ্গে তিনি ইয়াসরিবে এসে পৌঁছলেন। তার চেহারায় আনন্দের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল। এ আনন্দ তখন দেখার কেউ ছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনি তার কাঙ্ক্ষিত শহরে এসে পৌঁছেছেন। খেজুর উদ্যানবিশিষ্ট ভূমি-ইয়াসরিব (মদীনা)।
রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ হিজরত করে এখন কুবায় অবস্থান করছেন। চারদিকে এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে। ইহুদীদের পল্লীতেও এ খবর ঢেউ তুলেছে। সালমান তখন খেজুর গাছের চূড়ায়। খেজুর সংগ্রহ করছেন। দাস হিসেবে এটি ছিল তার স্বাভাবিক কাজ। দাসত্বের শৃঙ্খল তাকে তার অভিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। সর্বশেষ নবীর আগমনের অপেক্ষা করছেন। তার সঙ্গে সাক্ষাতের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। এটা যে ঘটবে, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তবে সেই প্রতিক্ষিত নবী যে তার শহরেই এসে পড়েছেন, এখনো তিনি তা জানার সুযোগ পাননি।
একটু পরেই একজনকে তার দিকে দৌড়ে আসতে দেখলেন। কাছে আসতেই তাকে চেনা গেল। লোকটি তার মনিবের ভাতিজা। তার আসার ভঙ্গি একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। উত্তেজনা আর আবেগে সে হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে। হয়তো নতুন কোনো সংবাদ জানাতে সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কাজের ফাঁকে সালমান লোকটিকে লক্ষ্য করছে। সে চিৎকার করতে করতে বলছে: ‘হে অমুক…!’
তার মনিবকেও খুব উত্তেজিত মনে হলো। সে এসব হইচইয়ের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না।
লোকটি অবশেষে তাদের নিকটে এসে দম নিল। তারপর বলল, ‘আল্লাহ বনী কায়লাকে (আউস ও খাযরায গোত্র) ধ্বংস করুন। আমি কেবলই সেখান থেকে এসেছি। আল্লাহর কসম, তারা এখন কুবাতে মক্কা থেকে আজই আগত এবং ব্যক্তির কাছে সমবেত হয়েছে, যে কিনা নিজেকে নবী বলে মনে করে।’
সেই অবস্থা। আনন্দের আতিশয্যে তার শরীর কাঁপছে। হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, তিনি গাছের নিচে বসা মনিবের ঘাড়ের ওপর ধপাস করে পড়ে যাবেন! যে মানুষটির জন্য তিনি বছরের পর বছর অপেক্ষা করছেন, সেই মানুষটি এখন তার কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়েছেন। আর এখন তার স্বাধীনতা নেই। চাইলেই ছুটে যেতে পারছেন না। রাসূলকে দেখার দেরি সহ্য হচ্ছে না তার।
তিনি আর গাছের উপর বসে থাকতে পারলেন না। দ্রুত নিচে নেমে এলেন। মনিবের ভাতিজাকে জিজ্ঞেস করলেন: ‘তুমি কী বললে-কী সংবাদ?’ এ কথা বলতেই মনিব তার গালে সজোরে এক চড় বসিয়ে দিল। দাসত্বের শৃঙ্খল বড় কঠিন। তখন মনিবরা দাস-দাসীদের মানুষই মনে করতে না। তাদের আবেগ প্রকাশের কোনো সুযোগ ছিল না। আবেগ থাকলেও তা লুকিয়ে রাখতে হতো। সালমান তা পারেননি। এটিই তার মনিবকে ক্ষেপিয়ে তোলে। চড় মেরেই সে শান্ত হয়নি। মারধোরও শুরু করে এবং বলে ‘এর সাথে তোমার সম্পর্ক কী?’ তারপর বলল, ‘যাও, যা করছিলে তা-ই করো।
সালমানের সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। চোখের পাপড়ি ভিজে উঠল। অসহায়ত্বেরও সীমা থাকে। দাসদের জন্য এর কোনো সীমা নেই। তাদের কষ্ট দেখে কেউ কষ্ট পায় না। সাহায্যও করে না। তিনি আবার খেজুরবৃক্ষে চড়লেন। কাজ করার চেষ্টা করছেন। এত কষ্ট নিয়ে কাজ করা যায় না। কিছু করারও নেই। কতকাল ধরে তিনি সত্য দ্বীন পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করছেন। আমুরিয়্যার পুরোহিতের কথা তার মনে পড়ছে। দিবালোকের মতো তিনটি সত্য নিদর্শনের কথা তিনি বলেছিলেন। সেগুলো মিলিয়ে দেখার তীব্র বাসনা তাকে আরও অস্থির করে তুলছে।
সন্ধ্যার আগে তার ছুটি মিলবে না। সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক বাকি। আজ যেন সময় যাচ্ছে না। সূর্যের গতি মনে হয়, থেমেই গেছে। পাথরের মতো নিশ্চল শরীরে তিনি কাজ করছেন। সময় যায় সময়ের মতোই। একসময় সূর্য ডুবল। তখনই তিনি কিছু জিনিস সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
সন্ধ্যার অন্ধকার চারিদিকে। অন্ধকার ক্রমাগত ঘনভূত হচ্ছে। এর মধ্যে তিনি পথ চলছেন। তার দীর্ঘ পথ চলা শেষ হতে যাচ্ছে। দামেস্ক, মাসুল, নুসাইবিন এবং আমুরিয়্যা শেষে এখন এই ইয়াসরিবে। পুরো পৃথিবী তার কাছে অন্যরকম লাগছে। এই রাতে আকাশও বড় বেশি উজ্জ্বল। পূর্ণিমার চাঁদের আলো ভেসে উঠছে-যে আলো তাকে আরেক অপার্থিব আলোর পথ দেখাচ্ছে।
বহু প্রতীক্ষিত রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ অবশেষে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এতকাল তিনি যেসব পুরোহিতদের সঙ্গ লাভ করেছিলেন, ভেবেছিলেন-তিনি তাদের মতোই একজন হবেন। কিন্তু তাকে সেরকম লাগছে না। তার চেহারা থেকে জোতির্ময় আলো বের হচ্ছে। এ আলো পুরো কুবাকে আলোকিত করে ফেলেছে। তিনি তার সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলছেন।
সালমানের কাছে যা ছিল, তিনি তা রাসূলের হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমি এগুলো আপনার জন্য সদকা হিসেবে সংগ্রহ করেছি। শুনেছি আপনি একজন পুণ্যবান ব্যক্তি। আপনার কিছু সহায়-সম্বলহীন সঙ্গী-সাথী আছেন। আমি দেখলাম, অন্যদের তুলনায় আপনিই এগুলো পাওয়ার অধিক উপযুক্ত।’
সালমান খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ তার জিনিস স্পর্শই করলেন না। তিনি তার সঙ্গীদের বললেন, ‘বিসমিল্লাহ বলে খাও।’
সালমান ভিন্ন কিছুই জানতে চেষ্টা করছিলেন। তার মাথায় আমুরিয়া্যার পাদ্রীর কথা ঘুরপাক খাচ্ছে এবং তিনি দেখতে চাচ্ছেন, তার বর্ণনা ঠিক কি না। যেহেতু পাদ্রী বলেছিল যে, তিনি সদকার জিনিস খাবেন না; সুতরাং রাসূল হওয়ার প্রথম শর্তটি মিলে গেছে। তার ঠোঁট থেকে বের হলো: ‘এটি প্রথম নিদর্শন! আল্লাহর কসম, তিনি সদকার খাবার খান না।’
তারপর তিনি ফিরে এলেন। পরের দিন আবার কিছু জিনিস সংগ্রহ করে রাসূলের নিকট এসে হাজির হলেন। এবার তিনি বললেন, ‘আমি দেখেছি, আপনি সদকার খাবার খাননি। আপনি বিশ্বস্ততা ও দয়া দেখিয়েছেন এবং আমি এটি খুব পছন্দ করি। এবার আপনার জন্য সদকা নয়, কিছু হাদিয়া এনেছি।’
রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ তার হাদিয়া গ্রহণ করলেন এবং সাহাবীদের সঙ্গে তিনি নিজেও সেখান থেকে খেলেন।
দ্বিতীয় নিদর্শনও মিলে গেল। তিনি তার আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না এবং আনমনে বলে উঠলেন, ‘এটি দ্বিতীয় নিদর্শন! তিনি হাদিয়ার খাবার গ্রহণ করেন এবং তা থেকে নিজেও খান।’
তারপর আরেকদিন সালমান রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এর কাছে গেলেন। রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ তখন ‘বাকী আল-গারকাদ’ কবরস্থানে তার এক সঙ্গীকে দাফন করছিলেন। সালমান দেখলেন, রাসূল গায়ে ‘শামলা’ (এক ধরনের ঢিলা পোশাক) জড়িয়ে বসে আছেন। তিনি তাকে সালাম দিলেন। তারপর রাসূলের পেছনের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আমুরিয়ায়ার পাদ্রীর বর্ণিত তৃতীয় নিদর্শন-নবুওয়াতের মোহর-খুঁজতে লাগলেন। রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে পিঠের চাদরটি সরিয়ে নিলেন। তখন সালমান মোহরটি স্পষ্ট দেখতে পেলেন। অতঃপর তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈমানের ঘোষণা দেন।
তখন থেকে সালমান رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ মনিবের কাজের বাইরে বেশিরভাগ সময় রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এর সঙ্গেই কাটাতেন।’
সালমান رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ গোলামীর কারণে বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। পরে রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এর সহায়তায় দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করেন। তারপর তিনি খাইবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে তিনিই পরীখা খননের পরামর্শ দেন। রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এর সোহবতে তিনি ইলম ও মারেফাতে বিশেষ পাদর্শিতা লাভ করেন। যুহুদ ও তাকওয়ার তিনি ছিলেন বাস্তব নমুনা। জীবনে কোনো বাড়ি তৈরি করেননি। কোথাও কোনো প্রাচীর বা গাছের ছায়া পেলে সেখানেই শুয়ে যেতেন। উসমান ইবনে আফফান রা.-এর খেলাফতকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তার সম্পদের মধ্যে ছিল একটি বড় পিয়ালা, তামার একটি থালা এবং একটি পানির পাত্র।
লিখেছেন
মুহাম্মদ আদম আলী
বইঃ সাহাবীদের ইসলাম গ্রহণের গল্প