সালাতের ভিতরে ও বাহিরে কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে তাজবিদের বিধিবিধান

সালাতের ভিতরে ও বাহিরে কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে তাজবিদের বিধিবিধানগুলো (যেমন: মাদ্দ, গুন্নাহ, সিফাত ইত্যাদি) যথাযথ অনুসরণ করা কি আবশ্যক?
না কি এ ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে গুনাহগার হতে হবে?

তাজবিদের নিয়ম-কানুন অনুসরণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারযোগ্য অভিমত অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত কথা হল,
সালাতের ভিতরে অথবা বাইরে হোক কুরআন তিলাওয়াতের সময় তাজবিদের যে সকল বিধিবিধান অনুসরণ না করলে শব্দের পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থের বিকৃতি ঘটে সেগুলো অনুসরণ করা ওয়াজিব। কিন্তু যেগুলো কেবল তিলাওয়াতের সৌন্দর্য বর্দ্ধন করে অর্থাৎ সেগুলো অনুসরণ না করলেও অর্থের বিকৃতি ঘটে না সেগুলো অনুসরণ না করলেও কোন গুনাহ নেই ইনশাআল্লাহ। যেমন:
– মাখরাজ অনুযায়ী অক্ষরের সঠিক উচ্চারণ করা আবশ্যক। কেননা অনেক ক্ষেত্রে মাখরাজের অনুসরণ না করার ফলে এক অক্ষরের পরিবর্তে অন্য অক্ষর উচ্চারিত হয়। যার কারণে অর্থেরও পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন:
القلب (আল ক্বালবু)
অর্থ: হৃদয়, অন্তর, অন্তকরণ।
الكلب (আল কালবু)
অর্থ: কুকুর।

এখানে দেখা যাচ্ছে, ق (ক্বাফ) এর স্থানে ك (কাফ) উচ্চারণের কারণে শব্দের অর্থটা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে!
– মদ্দে তবাঈ বা এক আলিফ পরিমাণ টেনে পড়াও অনেক সময় জরুরি। অন্যথায়শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন:
يعف “তিনি মার্জনা করেন”
يعفوا “তারা মার্জনা করেন।”
এখানে মাদ্দে ত্ববাঈ এর উপর ভিত্তি করে অর্থগতভাবে একবচন বহু বচনে পরিবর্তন হয়ে গেছে!
কিন্তু ইজহার, ইকলাব, ইদগাম, ইখফা, গুন্নাহ এবং মাদ্দে তবাঈ ছাড়া অন্যান্য মাদ্দ সমূহ (যেমন: মাদ্দে মুত্তাসিল, মুনফাসিল, লাজিম, আরেযী, লীন, বদল ইত্যাদি), হরফের সিফাত (অক্ষর উচ্চারণের ক্ষেত্রে মোটা-চিকন, কলকলা..) ইত্যাদি কেবল তিলাওয়াতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এগুলোর ব্যতিক্রম হলেও অর্থ পরিবর্তন হয় না।

সুতরাং সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ না করলেও গুনাহ হবে না বা সালাতের সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ। তবে সর্বাবস্থায় যথাসাধ্য তাজবিদের নিয়ম-কানুনগুলো অনুসরণ করে কুরআন তিলাওয়াত করা মুস্তাহাব (উত্তম) এতে কোন সন্দেহ নাই।
এ ব্যাপারে কয়েকজন বিজ্ঞ আলিমের অভিমত তুলে ধরা হল:

মোল্লা আলী কারি রহ. বলেন,
وينبغي أن تراعى جميع قواعدهم وجوباً فيما يتغير به المبنى، ويفسد به المعنى، واستحباباً فيما يحسن به اللفظ، أو يستحسن به النطق حال الأداء – شرح الجزرية” (ص/20)
“সে সব ক্ষেত্রে কারিদের (তাজবিদের) নিয়ম-কানুনগুলো আবশ্যিকভাবে লক্ষ রাখা উচিৎ, যে সব ক্ষেত্রে শব্দের গঠন পরিবর্তন হওয়ার পাশাপাশি অর্থেরও বিকৃতি ঘটে এবং এবং সে সব ক্ষেত্রে এগুলোর প্রতি লক্ষ রাখা উত্তম যে সব ক্ষেত্রে শব্দটি সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় বা পড়ার সময় উচ্চাণরটা সুন্দর হয়।” (শারহুল জাযারিয়া, পৃষ্ঠা ২০)

শাইখ উসাইমিন রহ. বলেন,
أما التجويد فليس بواجب، التجويد تحسين للفظ فقط، وتحسين اللفظ بالقرآن لا شك أنه خير، وأنه أتم في حسن القراءة، لكن الوجوب بحيث نقول من لم يقرأ القرآن بالتجويد فهو آثم قول لا دليل عليه، بل الدليل على خلافه”
“আর তাজবিদ ওয়াজিব নয়। তাজবিদ শব্দকে সুন্দর করে মাত্র। কুরআনের শব্দকে সুন্দর করা নি:সন্দেহে কল্যাণকর। এটি কিরাআতকে সুন্দর করার ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গতা দান করে। কিন্তু তাজবিদকে ওয়াজিব বলা অর্থাৎ “এ কথা বলা যে, যে ব্যক্তি তাজবিদ অনুযায়ী কুরআন পড়বে না সে গুনাহগার হবে” এর পক্ষে কোনও দলিল নাই। বরং এর বিপরীতেই দলিল রয়েছে।”

শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন:
“তাজবিদ ও কিরাআতবিদগণ কর্তৃক উল্লেখিত তাজবিদের নিয়ম-কানুনগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া ভালো। এটি কিরাআত সুন্দর করার অন্তর্গত। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
« زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ »
“তোমরা সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত কর।” [হাদিসটি ইমাম আহমদ, ইবনে মাজাহ, নাসায়ী ও হাকেম রহ. হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং তা সহীহ]
সুতরাং যদি গুন্নাহ, তারকিক (বারিক/চিকন করা), তাফখিম (পোর/মোটা করা) ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রাখা হয় তাহলে তা উত্তম। কিন্তু আমার কাছে যা মনে হয় এটা আবশ্যক নয়-যদি স্পষ্টভাবে ত্রটি-বিচ্যুতি ছাড়া পাঠ করে।”

শাইখ সালেহ আল ফাউযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন,
“قراءة القرآن بالتجويد مستحبة من غير إفراط، وليست واجبة، وإنما الواجب تجويد القرآن من اللحن والخطأ في الإعراب”
“তাজবিদ সহ কুরআন তিলাওয়াত করা মুস্তাহাব। তবে এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। এটা ওয়াজিব নয়। বরং ওয়াজিব হল, ইরাব (উচ্চারণ ও প্রকাশ করা) এর ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত করে সুন্দরভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা।”
আল্লাহু আলাম।

Exit mobile version