উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে বিয়েতে মোহরানার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এই সময় রোম ও পারস্য বিজয় হয়। মুসলিমদের অর্থভাণ্ডারে কোটি কোটি ‘টাকা’ আসতে থাকে। ফলে, পূর্বের তুলনায় তারা অনেক বেশি মোহরানা দেয়া শুরু করে।
খলিফা এটা নিয়ে বেশ কনসার্ন ছিলেন।
একদিন খলিফা মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দিলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, সাহাবিরা যেন মোহরানার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়েতে মোহরানা ছিলো প্রায় চারশো দিরহাম। এখন যেন কেউ খুব বেশি মোহরানা না দেয়। তিনি জানিয়ে দেন,
“সাবধান! আমি যেন না শুনি কেউ ৪০০ দিরহামের বেশি মোহরানা নির্ধারণ করেছে!”
এটা ছিলো উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খুতবার প্রথমাংশ। বেশিরভাগ মানুষ খুতবার এই অংশের উদ্ধৃতি দেয় কিন্তু পরের অংশের উদ্ধৃতি দেয় না। অনেক সাধারণ মানুষ পরের ঘটনা হয়তো জানেই না।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খুতবা শুনে কুরাইশের একজন মহিলা বললেন,
“হে আমিরুল মুমিনীন! আপনি কি মানুষকে ৪০০ দিরহামের বেশি (প্রায় ৪ লক্ষ) মোহরানা নির্ধারণ করতে নিষেধ করেছেন?”
খলিফা বললেন, “হ্যাঁ।”
সেই মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কুরআনের ঐ আয়াত পড়েননি?”
এই বলে সেই মহিলা কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করে শুনান:
“যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী পরিবর্তন করতে ইচ্ছা কর এবং তাদের একজনকে ‘প্রচুর ধন-সম্পদ’ প্রদান করে থাক, তবে তা থেকে কিছুই ফেরত গ্রহণ করো না।”
[সূরা নিসা:২০]
(মাওলানা মুহিউদ্দিন খান অনূদিত)
এই আয়াতের উদ্ধৃতি দিলে উমর ইবনুল খাত্তাব তাঁর পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসেন। তিনি শুধু ব্যক্তিগতভাবেই সরে আসেননি, আবার মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দিয়ে জানিয়ে দেন, তিনি তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।
মহিলার কথা শুনে তিনি বলেন,
“হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন। উমরের চেয়ে তো প্রত্যেকেই অনেক বেশি জানে।”
তিনি মিম্বারে দাঁড়িয়ে পুনরায় খুতবা দেন:
“হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদেরকে ৪০০ দিরহামের বেশি মোহর দিতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু, এখন বলছি যে, যে কোনো লোক তার সম্পদ থেকে ইচ্ছেমতো মোহরানা নির্ধারণ করতে পারবে।”
[তাফসীর ইবনে কাসির: ২/৩১৬ (সূরা নিসার ২০ নাম্বার আয়াতের তাফসীর), মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: ১০৪২০, ইমাম কুরতুবি, আল-জামি লি-আহকামিল কুরআন: ৫/৯৫, জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাফসীরে দুররুল মানসূর: ২/১৩৩, যামাখশারী, তাফসীরে কাশশাফ: ১/৩৫৭]
উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু পরবর্তী নিজে যখন বিয়ে করেন, তখন তিনিও উচ্চ মোহরানা দেন। পরবর্তী যুগের এটা ছিলো আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা।
উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মেয়ে উম্মে কুলসুম রাহিমাহাল্লাহকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু, উম্মে কুলসুম আমিরুল মুমিনিনের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। কারণ, খলিফার ‘লাইফস্টাইল’ তাঁর পছন্দ ছিলো না।
অতঃপর উমর ইবনুল খাত্তাব বিয়ে করেন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মেয়ে উম্মে কুলসুম বিনতে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহাকে।
সেই বিয়েতে খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু স্ত্রীকে মোহরানা দেন ৪০,০০০ দিরহাম। [ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবী, উমর ইবনুল খাত্তাব: ১/৪৩]
যা বর্তমান বাজারমূল্যে আনুমানিক ৪ কোটি টাকার বেশি।
অন্যদিকে ধনী সাহাবি আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর স্ত্রীকে মোহরানা দেন ৩০,০০০ দিরহাম! [তাবাকাতে ইবনে সা’দ: ৩/৯৬]
যা বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ৩ কোটি টাকার মতো।!
তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর একজন মেয়ে ছিলেন। তাঁর নাম আয়িশা বিনতে তালহা রাহিমাহাল্লাহ। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম সুন্দরী। তাঁকে প্রথমে বিয়ে করেন যুবাইর ইবনুল আউয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে মুসআব ইবনে যুবাইর রাহিমাহুল্লাহ।
তালহা ও যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা দুজন ছিলেন বন্ধু, দুজনই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি। এক বন্ধুর ছেলের সাথে আরেক বন্ধুর মেয়ের বিয়ে হয়।
মুসআব ইবনে যুবাইর রাহিমাহুল্লাহ তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর মেয়ে আয়িশাকে বিয়ে করেন ১ লক্ষ দিনার মোহরানা দিয়ে। মুসআব ইবনে যুবাইর তখন ছিলেন ইরাকের গভর্নর। [ইমাম আয-যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৪/৩৬৯-৩৭০, আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৯/৪৮০, তাবাকাত ইবনে সা’দ: ৮/৩০।]
যা বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা সমমূল্যের!
তিনি ইন্তেকাল করলে আয়িশা রাহিমাহাল্লাহকে বিয়ে করেন উবাইদুল্লাহ আত-তাইমী রাহিমাহুল্লাহ। উবাইদুল্লাহ আত-তাইমী আয়িশাকে মোহরানাস্বরূপ দেন ১০ লক্ষ দিরহাম। [ইমাম আয-যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৪/৩৬৯-৩৭০, আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৯/৪৮০, তাবাকাত ইবনে সা’দ: ৮/৩০।]
যা বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা সমমূল্যের!
আয়িশা বিনতে তালহা রাহিমাহাল্লাহ তাঁর দুই বিয়ের মোহরানার টাকা দিয়ে অন্তত ২ লক্ষ ভেড়া কিনতে পারতেন। যার অর্থমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
সাহাবিদের সময় মোহরানা ছিলো মূলত সামর্থ্য ভিত্তিক। যার যতো সামর্থ্য ছিলো, সে তেমন মোহরানা দিতেন।
সাহাবিদের পরবর্তী যুগে মোহরানার পরিমাণ কতোটা বেড়ে যায় সেটার একটি তুলনা দিলে বুঝতে সুবিধা হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বেশিরভাগ বিয়ের মোহরানা ছিলো ৫০০ দিরহাম।
[মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ১৬৬৩০]
৫০০ দিরহামে ১৫৩০ গ্রাম রুপা। ১ গ্রাম রুপার দাম ১৪০ টাকা ধরলে ‘ফাতেমি মোহরানা’ আজকের বাজারমূল্যে প্রায় ২ লক্ষ ১৪ হাজার।
তবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হাবিবা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মোহরানা হিশেবে ৪০০ দিনার দেন (কোনো কোনো বর্ণনামতে ৪০০০ দিরহাম)।
[ইবনে হাজার আসকালানী, আল-ইসাবা: ৪/৩০৬, সুনানে আবু দাউদ: ২১০৮]
রাসূলুল্লাহর পক্ষে এই অর্থ প্রদান করেন বাদশাহ নাজ্জাশী। যা আজকের বাজারমূল্যে রূপার হিশেবে প্রায় ২১ লক্ষ টাকা, অর্থের ক্ষয়ক্রমতার হিশাব মূল্যে ৪০ লক্ষ টাকার বেশি!
- সেখানে সাহাবিদের পরবর্তী যুগে মোহরানা যেভাবে বৃদ্ধি পায়:
- আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ৬০ গুণ
- উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর মোহরানা ৮০ গুণ
- তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর মেয়ে আয়িশা রাহিমাহাল্লাহর ২০০ গুণ!
মোহরানা পুরোটাই নির্ভর করে পাত্রের সামর্থ্যের ওপর। কিন্তু, আমাদের দেশে পাত্রের সামর্থ্য বিবেচনা না করে শুধুমাত্র কাগজে লিখিয়ে নেয়া হয় ১০ লক্ষ, ২০ লক্ষ!