সাহাবীদের বিয়ের মোহরানা

সাহাবীদের মোহরানা ছিলো বৈচিত্র্যময়। কোনো কোনো সাহাবীর মোহরানা এক টাকাও ছিলো না, আবার কোনো কোনো সাহাবীর মোহরানা কোটি টাকার বেশি ছিলো!
স্বামীর ইসলাম গ্রহণ ছিলো রুমাইসা বিনতে মিলহান রাদিয়াল্লাহু আনহুর মোহরানা। একজন সাহাবীর মোহরানা ছিলো তাঁর মুখস্থ কুরআন স্ত্রীকে শুনানো।

অন্যদিকে মোহরানা, অনেক সাহাবী স্ত্রীকে উচ্চ মোহরানা দেন। যেমন: উমর ইবনুল খাত্তাব, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা

উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মেয়ে উম্মে কুলসুম রাহিমাহাল্লাহকে বিয়ে করেন, তখন তাঁকে ৪০,০০০ দিরহাম দেন।

সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম ধনী ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি তাঁর স্ত্রীকে মোহরানা বাবদ ৩০,০০০ দিরহাম দেন।

চল্লিশ হাজার এবং ত্রিশ হাজার দিরহাম মানে যথাক্রমে ৩৩৩৩ ও ২৫০০ দিনার। আরো সহজে বললে, তখন ১ দিনার দিয়ে একটি ভেড়া কেনা যেতো। বর্তমানে একটি ভেড়ার দাম ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা হলে তাদের মোহরানা দাঁড়ায়- আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রায় আড়াই কোটি টাকা, উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রায় তিন কোটি ত্রিশ লক্ষ টাকা।

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বেশিরভাগ স্ত্রীর মোহরানা ছিলো ৪২ দিনার; অন্তত ৪ লক্ষ টাকা।

তবে, উম্মে হাবিবা রাদিয়াল্লাহু আনহার মোহরানা সবচেয়ে বেশি ছিলো ৪০০ দিনার; যা নাজ্জাশী নবিজীর পক্ষে উপহার হিশেবে দিয়েছিলেন। তখনকার অর্থের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী হিশেব করে অন্তত ৪০ লক্ষ টাকা হয়।

সাহাবীদের যুগে মোহরানা নির্ধারণ আর আমাদের যুগের মোহরানা নির্ধারণের অন্যতম পার্থক্য হলো অবস্থা বিবেচনা। সাহাবীদের যুগে পাত্রের অবস্থা মূল্যায়ন করা হতো, পাত্র কী দিতে পারবে সেটাকে প্রাধান্য দেয়া হতো।

আর আমাদের যুগে পাত্রের সামর্থ্য না দেখে শুধু শুধু কাগজে-কলমে ৫ লক্ষ, ১০ লক্ষ লেখা হয়। নিজের এতো টাকা একসাথে পাত্র জীবনে দেখেনি এমনও হয়!

যার কারণে, মোহরানার হিশাব কাবিননামায়ই থাকে, সেটা আদায় হয় না। অথচ পাত্রের সামর্থ্য বিবেচনা করলে এমনটা হতো না। ‘বেশি মোহরানা’ এটাকে সামাজিকভাবে প্রেস্টিজের বিষয় বানানো হয়েছে। যার কারণে এটা বিয়ের সৌন্দর্য নষ্ট করেছে।

অথচ উচিত ছিলো, যে ৫০,০০০ টাকা মোহরানা দেবার সামর্থ্য রাখে, তার জন্য ৫০,০০০ ধরা, যে ১ কোটি টাকা দেবার সামর্থ্য রাখে, তার জন্য ১ কোটি নির্ধারণ করা।

জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর একজন মেয়ে ছিলো। যার নাম আয়িশা বিনতে তালহা রাহিমাহাল্লাহ। আয়িশা বিনতে তালহা ছিলেন অসম্ভব রূপবতী এবং মর্যাদাসম্পন্না নারী

আল্লামা ইবনে কাসির বলেন, আয়িশা ছিলেন তাঁর যুগের সবচেয়ে সুন্দরী নারী!

আয়িশা বিনতে তালহার দ্বিতীয় বিয়ে হয় মুসআব ইবনে যুবাইর রাহিমাহুল্লাহর সাথে। তখন মুসআব ইবনে যুবাইর ছিলেন ইরাকের গভর্রনর। অর্থাৎ, তাঁর শ্বশুর যে শহরে ব্যবসা করতেন, সেই শহরের গভর্নর ছিলেন মুসআব।

মুসআব তাঁর স্ত্রীকে মোহরানা বাবদ ১ লক্ষ দিনার দেন। যা বর্তমান সময়ের অর্থমূল্যে হিশেব করতে গেলে চক্ষু চড়কগাছ হবে। আয়িশা বিনতে তালহার মোহরানা বর্তমান অর্থমূল্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ছিলো!

মুসআব রাহিমাহুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর আয়িশা বিনতে তালহাকে বিয়ে করেন উমর ইবনে উবাইদুল্লাহ আত-তাইমী রাহিমাহুল্লাহ।

তিনিও তাঁর স্ত্রীকে সমান মোহরানা দেন। তবে, তিনি দেন রৌপ্যমুদ্রা। ১০ লক্ষ দিরহাম। যা প্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো!

আয়িশা বিনতে তালহা রাহিমাহাল্লাহ ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবীর মেয়ে। দুই বিয়েতে তাঁকে এতো বেশি মোহরানা কেনো দেয়া হলো এই নিয়ে তৎকালীন যুগে বেশ সমালোচনা হয়।

মানুষজন বলাবলি করে- “মেয়েটাকে ১০ লক্ষ দিরহাম মোহরানা দেয়া হলো, অথচ সেনাদলের নেতারা ক্ষুধায় দিন কাটাচ্ছে!”

কিন্তু, আয়িশা রাহিমাহাল্লাহর স্বামী এসব সমালোচনায় কান দেননি।

তথ্যসূত্র: ইমাম আয-যাহাবী, সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা: ৪/৩৬৯-৩৭০, আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৯/৪৮০, তাবাকাত ইবনে সা’দ: ৮/৩০১।

উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে বিয়েতে মোহরানার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এই সময় রোম ও পারস্য বিজয় হয়। মুসলিমদের অর্থভাণ্ডারে কোটি কোটি টাকা আসতে থাকে। ফলে, পূর্বের তুলনায় তারা অনেক বেশি মোহরানা দেয়া শুরু করে।

খলিফা এটা নিয়ে বেশ কনসার্ন ছিলেন।

একদিন খলিফা মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দিলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, সাহাবীরা যেন মোহরানার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়েতে মোহরানা ছিলো প্রায় চারশো দিরহাম। এখন যেন কেউ খুব বেশি মোহরানা না দেয়। তিনি জানিয়ে দেন,
সাবধান! আমি যেন না শুনি কেউ ৪০০ দিরহামের বেশি মোহরানা নির্ধারণ করেছে!

এটা ছিলো উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খুতবার প্রথমাংশ। বেশিরভাগ মানুষ খুতবার এই অংশের উদ্ধৃতি দেয় কিন্তু পরের অংশের উদ্ধৃতি দেয় না। অনেক সাধারণ মানুষ পরের ঘটনা হয়তো জানেই না।

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খুতবা শুনে কুরাইশের একজন মহিলা বললেন, “হে আমিরুল মুমিনীন! আপনি কি মানুষকে ৪০০ দিরহামের বেশি (প্রায় ৪ লক্ষ) মোহরানা নির্ধারণ করতে নিষেধ করেছেন?”

খলিফা বললেন, “হ্যাঁ।”

সেই মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কুরআনের ঐ আয়াত পড়েননি?”

এই বলে সেই মহিলা কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করে শুনান:

“যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী পরিবর্তন করতে ইচ্ছা কর এবং তাদের একজনকে ‘প্রচুর ধন-সম্পদ’ প্রদান করে থাক, তবে তা থেকে কিছুই ফেরত গ্রহণ করো না।” [সূরা নিসা ৪:২০]

এই আয়াতের উদ্ধৃতি দিলে উমর ইবনুল খাত্তাব তাঁর পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসেন। তিনি শুধু ব্যক্তিগতভাবেই সরে আসেননি, আবার মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দিয়ে জানিয়ে দেন, তিনি তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।

মহিলার কথা শুনে তিনি বলেন, “হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন। উমরের চেয়ে তো প্রত্যেকেই অনেক বেশি জানে।”

তিনি মিম্বারে দাঁড়িয়ে পুনরায় খুতবা দেন:

“হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদেরকে ৪০০ দিরহামের বেশি মোহর দিতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু, এখন বলছি যে, যে কোনো লোক তার সম্পদ থেকে ইচ্ছেমতো মোহরানা নির্ধারণ করতে পারবে।”

উমর ইবনুল খাত্তাব পরবর্তীতে উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ের সময় নিজেই ৪০,০০০ দিরহাম মোহরানা দেন; যা অর্থমূল্যে প্রায় ৫ কোটি টাকার বেশি!

সাধারণত আমরা নিজেদের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট হলে কারো কথার উদ্ধৃতি দেই। প্রয়োজনে যতোটুকু উদ্ধৃতি দিলে স্বার্থ হাসিল হয়, ততোটুকু উদ্ধৃতি দেই, বাকিটুকু এড়িয়ে যাই।

যেকোনো সমাজে মোহরানা নির্ধারিত হবে সামর্থ্যানুযায়ী। সামর্থ্যের অধিক হলে বাড়াবাড়ি হবে। এদেশে যারা কোটিপতি, লক্ষপতি বা বিদেশে থাকে, তাদের মোহরানা তুলনামূলক বেশিই হবে। অন্যদিকে, যারা ছাত্রবয়সে বিয়ে করে, তাদের মোহরানা কম হবে। পঞ্চাশ হাজার, এক লক্ষ।

আবার যারা দিনমজুর, রিক্সাচালক, তাদের মোহরানা হয়তো বিশ-ত্রিশ হাজার হবে৷

উভয়পক্ষ যদি মোহরানা পরিশোধের নিয়ত রাখে, তাহলে তারা সামর্থ্যের দিক বিবেচনা করে। আর পরিশোধের নিয়ত না থাকলে কাগজে ৫ লক্ষ, ১০ লক্ষ লিখিয়ে নেয়, কিন্তু ১০% পরিশোধ করে না।

তথ্যসূত্র: তাফসীর ইবনে কাসির: ২/৩১৬ (সূরা নিসার ২০ নাম্বার আয়াতের তাফসীর), মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: ১০৪২০, ইমাম কুরতুবি, আল-জামি লি-আহকামিল কুরআন: ৫/৯৫, জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাফসীরে দুররুল মানসূর: ২/১৩৩, যামাখশারী, তাফসীরে কাশশাফ: ১/৩৫৭।

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Exit mobile version