রমজান মাসে রোজা অবস্থায় বা সেজদারত অবস্থায় মৃত্যুর জন্য দুআ করার বিধান।
এভাবে দুআ করা যাবে কি যে, হে আল্লাহ, আমার মৃত্যু যেন রমজান মাসে হয় বা নামাজের সেজদারত অবস্থায় হয়?
সালাতের সেজদারত অবস্থায়, রোজা অবস্থায়, আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত থাকা, কালিমা পাঠ, হজের তালবিয়া উচ্চরণ, কুরআন তিলাওয়াত বা অন্য যে কোনো ইবাদতরত অবস্থায় অথবা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শহর মদিনায় মৃত্যুর জন্য দুআ করা শরিয়ত সম্মত। কেননা এগুলো ‘হুসনুল খাতিমা‘ বা কল্যাণের উপর মৃত্যুর জন্য দুআর অন্তর্ভুক্ত।
উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি এ বলে দুআ করতেন:
اللَّهُمَّ ارْزُقْنِي شَهَادَةً فِي سَبِيلِكَ، وَاجْعَلْ مَوْتِي فِي بَلَدِ رَسُولِكَ صلى الله عليه وسلم
“হে আল্লাহ, আমাকে তোমার রাস্তায় শাহাদাত লাভের তাওফিক দান কর এবং আমার মৃত্যু তোমার রসুলের শহরে প্রদান কর।”
[বুখারি: ১৮৯০, অধ্যায়: ২৯/১৩]
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدٍ خَيْرًا اسْتَعْمَلَهُ ” فَقِيلَ كَيْفَ يَسْتَعْمِلُهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ” يُوَفِّقُهُ لِعَمَلٍ صَالِحٍ قَبْلَ الْمَوْتِ
“আল্লাহ তাআলা যখন তার বান্দা সম্পর্কে কল্যাণের ইচ্ছা করেন তখন তাকে আমল করতে দেন। বলা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কীভাবে তিনি তাকে আমল করতে দেন?
তিনি বললেন, “মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাকে নেক আমলের তাওফিক দিয়ে দেন।”
[সুনান তিরমিজি (ইফা), অধ্যায়: ৩৫/ তকদির, পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তাআলা জান্নাতিদের জন্য এবং জাহান্নামিদের জন্য একটি কিতাব (রেজিস্টার) লিখে রেখেছেন। সহিহ]
সহিহ বুখারির ভাষ্যকার ইবনে হাজার রহ. আসকালানি বলেন,
ومن ثم شرع الدعاء بالثبات على الدين وبحسن الخاتمة
“এখান থেকেই দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং হুসনুল খাতিমা বা কল্যাণের উপর মৃত্যুর জন্য দুআ করা শরিয়ত সম্মত হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়েছে।”
[ফাতহুল বারি ১১/৪৯৯]
মাজমাউল আনহার গ্রন্থের লেখক বলেন,
وأعظم الحاجات سؤال حسن الخاتمة وطلب المغفرة
“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হল, কল্যাণের উপর মৃত্যু এবং ক্ষমার জন্য দুআ করা।”
মানুষ যে অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে কেয়ামত দিন তাকে সে অবস্থায় উত্থিত করা হবে:
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মানুষ যে অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে কেয়ামতের দিন তাকে সে অবস্থায় উঠানো হবে। অর্থাৎ কেউ যদি পাপ-পঙ্কিলতা ও আল্লাহর নাফরমানিতে ডুবে থাকা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তাহলে কেয়ামতের দিন তাকে এই অবস্থাতেই উঠানো হবে আর কেউ যদি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও সৎকর্মে লিপ্ত থাকা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তাহলে পরকালে এই অবস্থাতেই তাকে উঠানো হবে।
আর এ কথায় কোন সন্দেহ নেই যে, কেয়ামতের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহর ইবাদতরত অবস্থায় আল্লাহর দরবারে দণ্ডায়মান হওয়ার মত মর্যাদা ও সৌভাগ্যের বিষয় আর কিছু হতে পারে না।
জাবির রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
يُبعَثُ كلُّ عبدٍ على ما مات عليه المُؤمِنُ على إيمانِه والمُنافِقُ على نِفاقِه
“প্রত্যেক বান্দাকে ঐ অবস্থায় কিয়ামতের দিন উঠানো হবে যে অবস্থার উপর সে মৃত্যু বরণ করেছে। মুমিনকে উঠানো হবে ঈমানের উপর এবং মুনাফিককে উঠানো হবে নিফাকির উপর।”
[সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৭৩১৩]
ইমাম নওয়াবি রহ. উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, উক্ত হাদিসে আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মর্মে খবর দিচ্ছেন যে, প্রত্যেক বান্দাকে চাই সে পুরুষ হোক অথবা নারী হোক কিয়ামতের দিন ঐ অবস্থায় উত্তোলন করা হবে যে অবস্থায় উপর সে মৃত্যু বরণ করেছিল। সে যদি ভালো কাজ ও কল্যণের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে তাহলে কল্যাণের উপরই তাকে উঠানো হবে। আর অকল্যাণ ও খারাপিতে লিপ্ত থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে সে অবস্থায় উঠানো হবে। এই কল্যাণ ও অকল্যাণের যত অর্থ ও রূপ আছে সবই এখানে প্রযোজ্য।
সুতরাং প্রতিটি মানুষের এই আগ্রহ থাকা উচিৎ, যেন ভালো অবস্থায় (সৎকর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা অবস্থায়) তার মৃত্যু হয়।
উক্ত হাদিসে এ মর্মে বান্দাকে উৎসাহিত করা হয়েছে যে, সে যেন সদা সর্বদাই কল্যাণ ও আমলে সালেহ বা সৎকর্মে লিপ্ত থাকে। কেননা, কেউ জানে না, সে কখন মৃত্যু বরণ করবে।”
জরুরি জ্ঞাতব্য
এখানে জরুরি দুটি জ্ঞাতব্য বিষয় হলো:
১. কালিমা পাঠরত অবস্থায় মৃত্যু চাওয়া, শহিদি মৃত্যু চাওয়া এবং এবং মদিনায় মৃত্যুর জন্য দুআ করায় কোনও আপত্তি নাই। কারণ হাদিসে এসব মৃত্যুর ব্যাপারে হাদিস রয়েছে। যেমন:
– মুআয ইবন জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
من كان آخرُ كلامهِ لا إله إلا اللهُ دخل الجنة
“যার শেষ কথা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
[আবু দাউদ-সহিহ]
– আনাস ইবন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ طَلَبَ الشَّهَادَةَ صَادِقًا ، أُعْطِيَهَا ، وَلَوْ لَمْ تُصِبْهُ
“যে ব্যক্তি সত্যিকারের ইচ্ছা নিয়ে শাহাদাতের (মৃত্যুর সময়ে ঈমানের সাক্ষ্য) প্রার্থনা করবে, তাকে তা দেওয়া হবে, যদিও সে শাহাদাত অর্জন না করলেও।”
[আবু দাউদ-সহিহ]
– উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি এ বলে দুআ করতেন:
اللَّهُمَّ ارْزُقْنِي شَهَادَةً فِي سَبِيلِكَ، وَاجْعَلْ مَوْتِي فِي بَلَدِ رَسُولِكَ صلى الله عليه وسلم
“হে আল্লাহ, আমাকে তোমার রাস্তায় শাহাদাত লাভের তাওফিক দান কর এবং আমার মৃত্যু তোমার রসুলের শহরে প্রদান কর।”
[বুখারি: ১৮৯০, অধ্যায়: ২৯/১৩]
এ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে মৃত্যুর জন্য দুআ করার হাদিস এমনকি সালাফদের পক্ষ থেকে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায় না। তাই এগুলো ছাড়া নির্দিষ্ট অন্য কোনও বিষয়ে দুআ না করাই ভালো। তবে সাধারণভাবে হুসনুল খাতিমা বা ভালো কাজের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় মৃত্যুর জন্য দুআ করা যেতে পারে।
২. কারও যদি সেজদা রত অবস্থায় কিংবা অন্য কোনও নেক আমলরত অবস্থায় মৃত্যু ঘটে তাহলে তার উপর ভিত্তি করে তাকে নিশ্চিত ‘জান্নাতবাসী’ বলে ধরে নেওয়া বৈধ নয়। অর্থাৎ কারও বাহ্যিক অবস্থার উপর কারও পরিণতি বিচার করা যাবে না। সর্বোচ্চ তার ব্যাপারে ভালো ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু তার প্রকৃত অবস্থা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।
তাই তো হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেছেন,
الأقدار غالبة، والعاقبة غائبة، فلا ينبغي لأحد أن يغترَّ بظاهر الحال
“তকদির বা বিধিলিপি বিজয়ী আর পরিণতি অদৃশ্য। তাই কারো উচিত নয়, বাহ্যিক পরিস্থিতি দেখে প্রতারিত হওয়া।” [ফাতহুল বারি ১১/৪৯৯]
অর্থাৎ মানুষের তকদিরে যা লেখা হয়েছে নিশ্চিতভাবে সেটাই ঘটবে। আর কার শেষ পরিণতি কী হবে তা মানুষের অজানা। সুতরাং কারও বাহ্যিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে কারও ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া যাবে না। ভালো অবস্থায় মৃত্যু হোক বা খারাপ অবস্থায় মৃত্যু হোক
হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে হুসনুল খাতিমা তথা কল্যাণময় মৃত্যু দান করুন এবং এমন অবস্থার উপর মৃত্যু দান করুন, যে অবস্থায় মৃত্যু হলে তোমার সন্তুষ্টি অর্জন করে চির সুখের নীড় জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি। নিশ্চয় তুমি দুআ কবুল কারী। আমিন।
আল্লাহু আলাম।