কোন মুসলিম ব্যক্তি ঋণ রেখে মৃত্যুবরণ করলেও তার জানাজা পড়া ফরজ। জানাজা বিহীনভাবে তাকে দাফন দেওয়া হারাম। কারণ ঋণ রেখে মৃত্যুবরণ করলে মানুষ ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় না।
আর ইসলামের বিধান অনুযায়ী কোন মুসলিম মৃত্যুবরণ করলে জীবিতদের জন্য ফরজ হলো, তার কাফন, জানাজা এবং দাফনের ব্যবস্থা করা। এটি ফরজে কেফায়া। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক মুসলিম যদি তা পালন করে তাহলে অন্য সকলেই গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু কেউ তা না করলে সকলেই গুনাহগার হবে।
– হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা রা. সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
أَسْرِعُوا بِالْجَنَازَةِ فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ – لَعَلَّهُ قَالَ – تُقَدِّمُونَهَا عَلَيْهِ وَإِنْ تَكُنْ غَيْرَ ذَلِكَ فَشَرٌّ تَضَعُونَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ
“মৃতকে তাড়াতাড়ি দাফন করে দাও। যদি সে ব্যক্তি সৎকর্মশীল হয় তবে তাকে কল্যাণের দিকে অগ্রসর করে দিলে। আর যদি অন্য কিছু হয় তবে মন্দকে তোমাদের কাঁধ হতে সরিয়ে দিলে।”
[সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ১২/ জানাজা সম্পর্কিত, পরিচ্ছেদ: ১৪. অনতিবিলম্বে জানাজা সম্পন্ন করা প্রসঙ্গ]
এই বিধানের মধ্যে সকল মুসলিম শামিল। বিশেষ কোন গুনাহগার ব্যক্তিকে এই বিধানের বাইরে রাখা হয়নি। ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিকে এই বিধানের থেকে বাহির করতে হলে আলাদা সুস্পষ্ট হাদিস থাকা আবশ্যক। কিন্তু তা নেই। সুতরাং কোন ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা গেলেও এই হাদিসের আলোকে তার জানাজার ব্যবস্থা করতে হবে।
তাছাড়া এটি মুসলিমদের পারস্পরিক পাঁচ বা ছয়টি হকের মধ্যে অন্যতম যা সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে।
তাই কোন ঋণগ্রস্থ মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তাকে বিনা জানাজায় দাফন করা হলে তার ফরজ হক লঙ্ঘন করার কারণে সকল মুসলিম গুনাহগার হবে। (আল্লাহ ক্ষমা করুন, আমিন)
ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি মারা গেলে জানাজা দেওয়ার বৈধতার প্রমাণে দুটি হাদিস এবং আলেমদের ফতোয়া উল্লেখ করা হলো:
১. জাবের রা. সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ অবস্থায় মারা গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তার জানাজা পড়তেন না।
একবার তাঁর নিকট একটি লাশ আনা হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তার উপর কোনো ঋণ আছে কি? সাহাবিগণ বললেন, হ্যাঁ, দু দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ঋণ আছে।
তিনি বললেন,
صَلُّوا عَلَى صَاحِبِكُمْ
“তোমরা তোমাদের সাথীর জানাজা পড়ো।”
তখন আবু কাতাদাহ আল-আনসারি রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ঋণ পরিশোধের জিম্মা আমি নিলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাজা পড়লেন।
পরবর্তীতে আল্লাহ যখন তাঁর রাসুলকে বিভিন্ন যুদ্ধে বিজয়ী করলেন, তখন তিনি বললেন, “আমি প্রত্যেক মুমিনের নিকট তার নিজের জীবনের থেকেও অধিক নিকটতর। সুতরাং কেউ ঋণ রেখে মারা গেলে তা পরিশোধের দায়িত্ব আমার। আর কেউ সম্পদ রেখে মারা গেলে তার হকদার তার উত্তরাধিকারীগণ।”
[সুনান আবু দাউদ (তাহকিককৃত), অধ্যায়: ১৭/ ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিচ্ছেদ: ৯. ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধে কড়াকড়ি করা]
২. আরেকটি হাদিস,
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যখন কোন ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির জানাজা উপস্থিত করা হত তখন তিনি জিজ্ঞেস করতেন,
“সে তার ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থ-সম্পদ রেখে গেছে কি?”
যদি তাঁকে বলা হত যে, সে তার ঋণ পরিশোধের মতো অর্থ-সম্পদ রেখে গেছে তখন তার জানাজা পড়তেন। অন্যথায় বলতেন,
“তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জানাজা আদায় করে নাও।”
পরবর্তীতে যখন আল্লাহ মুসলিমদের অনেক বিজয় দান করলেন তখন তিনি বললেন, আমি মুমিনদের জন্য তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক নিকটবর্তী। তাই কোন মুমিন ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা গেলে তা পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার। আর যে ব্যক্তি অর্থ-সম্পদ রেখে যায়, সেগুলো তার উত্তরাধিকারীদের।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
এই দুটি হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, মুসলিমগণ ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির জানাজা সালাত আদায় করবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির জানাজা পড়ার জন্য সাহাবিদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন,
صَلُّوا عَلَى صَاحِبِكُمْ
“তোমরা তোমাদের সাথীর জানাজা আদায় করো।”
অতএব ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির জানাজা বৈধ হওয়ার জন্য উপরোক্ত হাদিস দুটিই যথেষ্ট।
এখন প্রশ্ন হল, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির জানাজা পড়েননি?
আলিমগণ এর দু ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যথা:
১. তিনি এমনটি করেছেন এই সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য যে, মানুষ যেন ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ঢিলেমি না করে। বরং যত দ্রুত সম্ভব ঋণ পরিশোধে আগ্রহী হয়। যেমনটি বলেছেন, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রহ.। [ফাতহুল বারী]
অতএব সমাজের অনুসরণীয় বড় আলেম ও গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণে ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি, আত্মহত্যা কারী এবং পাপিষ্ঠ লোকদের জানাজা থেকে বিরত থাকে তাহলে তা জায়েজ রয়েছে। যেন অন্যরা এ ব্যাপারে সতর্ক হয়। তবে অন্যান্য মুসলিমদের জন্য তাদের জানাজা পড়ায় কোন বাধা নেই।
এই মত ব্যক্ত করেছেন ইবনে তাইমিয়া সহ একদল বিদ্বান।
২. অন্য একদল আলেমের মতে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম পর্যায়ে ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির জানাজা পড়তেন না যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কেউ তা পরিশোধের দায়িত্ব না নিত। কিন্তু পরবর্তীতে যখন আল্লাহ তাআলা ইসলামের বিজয় দান করেন এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ-সম্পদ জমা হয় তখন তিনি ঋণগ্রস্থ মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করতেন এবং তাদের জানাজার সালাত আদায় করতেন। যেমনটি পূর্বোক্ত হাদিসের শেষাংশে বলা হয়েছে। অর্থাৎ আগের বিধানটি মানসুখ বা রহিত হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে ইমাম মুনযেরি রহ. বলেন,
قد صح عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه كان لا يصلي على المدين، ثم نسخ ذلك
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহিহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির জানাজার সালাত পড়তেন না। কিন্তু পরবর্তীতে তা রহিত হয়ে যায়।” [আত তারগীব ওয়াত তারহীব]
এছাড়াও আধুনিক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি বিশ্ববরেণ্য আলেম আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায. এবং এই শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন প্রমূখগণ ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির জানাজা পড়া বৈধ বলে ফতোয়া দিয়েছেন।
আল্লাহু আলম।