‘রাসূলের সুন্নত’ নামে সমাজে এমন এমন জিনিস প্রচলিত

এই সত্য মেনে নিতে সাহসের প্রয়োজন!
রাসূলের সুন্নত’ নামে সমাজে এমন এমন জিনিস প্রচলিত এবং সেগুলোকে এতোটাই ফযিলতপূর্ণ মনে করা হয়, যেগুলো খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যায় যে- এগুলোর প্রচার মূলত ব্যক্তিস্বার্থ জাস্টিফাই করার জন্য।

রাসূলুল্লাহর ﷺ সুন্নতের ব্যাখ্যা এবং সেগুলো মানার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে কেউ না। সুন্নতের প্রচারের ক্ষেত্রেও সবসময় কমফোর্ট জোন থেকেই বেশিরভাগ এগুলো করেন।
কয়েকটি উদাহরণ দেবো।

রাসূলুল্লাহ ﷺ লাউ পছন্দ করতেন = লাউ খাওয়া সুন্নত

এই কথাটি শুনেননি এমন মানুষ খুবই কম। অথচ এই হাদীসের প্রেক্ষাপট কী?

একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ একজন দর্জির বাড়িতে যান। সেই দর্জি তাঁর সামর্থ্যানুযায়ী রাসূলের জন্য আপ্যায়ন করান, যার মধ্যে লাউ ছিলো। রাসূলুল্লাহ ﷺ বেছে বেছে লাউ খান। সেটা দেখে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ঐদিন থেকেই লাউ খাওয়াকে পছন্দ করা শুরু করেন। রাসূলের প্রতি অসম্ভব মহব্বত থেকে তিনি এই কাজটি করেন।

রাসূলুল্লাহকে ﷺ ভালোবেসে এমন কাজ করাটাও নিঃসন্দেহে সওয়াবের। আমরাও যদি লাউ পছন্দ করি শুধু এই কারণে যে, রাসূল পছন্দ করতেন, তাহলে আমরাও সওয়াব পাবো, ইন শা আল্লাহ।

নিজেকে রাসূলের যুগে কল্পনা করুন। অথবা কল্পনা করুন জান্নাতে রাসূল ﷺ আপনার মেহমান হলেন।

আপনি সারাজীবন শুনছেন লাউ রাসূলের প্রিয়, আপনিও নিশ্চয়ই রাসূলকে লাউ দিয়ে আপ্যায়ন করতে চাইবেন।

অথচ আমরা জানিই না যে, রাসূলের সবচেয়ে প্রিয় ছিলো মাংস। শুধু মাংস না, রাসূলুল্লাহ ﷺ মাংসের মধ্যে লেগ পিস পছন্দ করতেন। তাঁর খুব কাছের সাহাবিরা জানতেন বলেই তাঁকে দাওয়াত দিলে বা নিজেরা উট-খাসি জবাই হলে তারা লেগ পিস নিয়ে যেতেন রাসূলের জন্য।

এই ঘটনাগুলো আপনি কখনো কোনো ওয়াজে শুনেছেন? কোনো বইয়ে পড়েছেন?

হলফ করে বলতে পারি- ৯৯% সাধারণ মানুষ রাসূলের মাংস পছন্দের হাদীস জীবনে কোনোদিন শুনেননি। (এই নিয়ে রেফারেন্স সহ বিস্তারিত লিখেছিলাম, লিংক কমেন্টে)।

রাসূলুল্লাহ ﷺ কখনো টেবিলে বসে খাননি, মাটিতে বসে খাওয়া সুন্নত

টেবিলে বসে না খাওয়া, মহব্বতের কারণে হুবহু অনুসরণের সওয়াবের ব্যাপারটা আগেই আলোচনা করেছি।
এই হাদীস রাসূলের জীবদ্দশায় কোনো সাহাবি বর্ণনা করেননি, বর্ণনা করার প্রয়োজনও পড়েনি।
তাহলে এই হাদীস কখন এবং কেনো প্রচার করা হয়?

রোম-পারস্য বিজয়ের পর সাহাবিদের জীবনাচারে অনেক পরিবর্তন আসে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে জীবনযাপনের ধরন আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে।

তখন অনেক সাহাবি-তাবেয়ী চেয়ার-টেবিলে খাওয়া শুরু করেন।

সেইসময় যেসব সাহাবি হুবহু রাসূলের অনুসরণের পক্ষে ছিলেন, তারা জীবনযাপন বদলাননি। তারা রাসূলের সহজ-সাধারণ জীবনযাপন তখন তুলে ধরেন। এমনকি অনেকেই আফসোস করেন-
“রাসূলুল্লাহ ﷺ কখনো ভালো খাবার খেতে পারেননি, আর আমরা এতো ভালো খাবার খাচ্ছি!”
তারা ভয় পেতেন- না জানি দুনিয়াতেই তারা সব পেয়ে যাচ্ছেন, আখিরাতে কিছু পাবেন না।

যে হাদীসে রাসূলুল্লাহ টেবিলে খাননি এই বর্ণনা আছে, একই হাদীসে আছে তিনি পাতলা রুটি খাননি। অর্থাৎ, তুলনামূলক ভালো রুটি খাননি।

আপনি টেবিলে না খেয়ে মাটিতে বসে বসে খাচ্ছেন। খাচ্ছেন কী?
মোটা চালের ভাত?
নাকি দেড়, দুইগুণ বেশি দামের চিকন চালের ভাত?
আপনি কী মানের আটার রুটি খান?
বাজারে মাছ কিনতে গিয়ে কি খুব নিম্নমানের কোনো রকম জীবনযাপনের জন্য যা লাগে সেগুলো কিনেন, নাকি সুযোগ থাকলে ইলিশ, সামুদ্রিক মাছও কিনেন?

রাসূলুল্লাহ ﷺ টেবিলে খাননি সেটা একটা ফ্যাক্ট। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের ঘরে ভালো মানের খাবার খাননি, সেটাও একটা ফ্যাক্ট।

আপনি সারাক্ষণ ওয়াজ করেন টেবিলে না খাওয়ার, কিন্তু রাসূলের মতো সহজ-সরল জীবনযাপনের জন্য কোনোরকম খাওয়া-দাওয়া করা, এই লাইফস্টাইলকে কখনো প্রমোট করেননি। এই জায়গায় মহব্বতের সুন্নতের কথা না এনে হালাল-জায়েজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেন- ভালো খাবার খাওয়াও জায়েজ।

রাসূলুল্লাহ ﷺ কখনো বিল্ডিং বাড়িতে থাকেননি, তাঁর ঘরে কখনো ফ্যান ছিলো না, আলমারি, ফ্রিজ, সোফা কিছুই ছিলো না। রাসূলুল্লাহ কখনো মোটরচালিত কোনো যানবাহনে চড়েননি।

টেবিলে বসে না খাওয়ার ফ্যাক্ট শুনতে যতোটা ফযিলতের মনে হয়, যেই উদাহরণগুলো বললাম সেগুলোও কমবেশ এমনই ফযিলতের (!)।

‘ফাতেমি মোহরানা’

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীকে পর্যাপ্ত মোহরানা না দেয়ার জন্য যেই উদাহরণ দেখানো হয়, সেটার মধ্যে অন্যতম হলো ফাতেমি মোহরানা। যার সামর্থ্য নেই, সে তো ফাতেমি মোহরানার চেয়েও কম দিতে পারে, কোনো সমস্যা নেই।

কিন্তু, আমাদের সমাজে ‘সুন্নতি মোহরানা’ শুধুমাত্র ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু যে মোহরানা দিয়েছিলেন, সেটাই বুঝানো হয়।

রাসূলুল্লাহর ﷺ বেশিরভাগ স্ত্রীর মোহরানা ‘ফাতেমি মোহরানা’ ছিলো। তবে, উম্মে হাবিবা রাদিয়াল্লাহু আনহার মোহরানা ছিলো ৪০০ দিনার; অন্যদের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। রাসূলের পক্ষে নাজ্জাশি সেটা পরিশোধ করেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ সেটা গ্রহণ করেন, সম্মতি দেন।

যেভাবে রাসূলের জীবনের কোনো ঘটনা পেলেই ‘সুন্নত পেয়েছি’ মনোভাব লালন করা হয়, সেভাবে ৪০০ দিনার মোহরানাও ‘সুন্নত’ বলার জন্য একই মানের।

৪০০ দিনার মোহরানা আজকের যুগে কতো?
আমরা commodity price অনুযায়ী যদি হিসাব করি, সেই যুগে ১ দিনার = একটি ভেড়া।
এখন একটি ভেড়ার দাম যদি কম করে হলেও ধরে নিই ১০,০০০ টাকা, ৪০০ ভেড়ার দাম হবে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা।
আর বর্তমানে যাকাত যেভাবে হিসাব করা হয়, সেভাবে হিসাব করা হলে:
২১ ক্যারেটের ১ গ্রাম স্বর্ণের দাম ৬৭২৭ টাকা। তাহলে সেই যুগের ১ দিনার = ২৮,৫৮৯ টাকা।
উম্মে হাবিবা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূলুল্লাহ ﷺ মোহরানা দেন আজকের টাকায় প্রায় ১ কোটি ১৪ লক্ষ ৩৫ হাজার ৯০০ টাকা।
আপনি সারাজীবন ওয়াজ শুনছেন রাসূলের ঘরে ২/৩ মাস চুলা জ্বলেনি, খেজুর আর পানি দিয়ে ক্ষুধা মেটানো হয়েছে।

আপনি কখনো এই হাদীস শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইন্তেকালের আগে তাঁর একেকজন স্ত্রীকে বার্ষিক আমাদের সময়ের অন্তত ১৫ লক্ষ টাকার সমমূল্যের খাদ্যের ব্যবস্থা করে গেছেন

‘রাসূলের সুন্নত মানতে গিয়ে আমিও বছরে আমার স্ত্রীকে ১৫ লক্ষ টাকা দেই’ –এই কথা কোনোদিন শুনছেন?

রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং সাহাবিদের অর্থনৈতিক জীবনের যে চিত্র এবং ‘অর্থনৈতিক সুন্নত’ সংক্রান্ত আমাদের সামনে যা এতোদিন তুলে ধরা হয়েছিলো, সেই সুন্নতকে বেশিরভাগই নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য করেই ব্যাখ্যা করেছিলেন। এই কথা মানতে খুব কষ্ট হলেও এটা কতোটা সত্য, সেটার কয়েকটি উদাহরণ দিলাম।

আমাদের সমাজে দান করে কারা? বা আমাদের সমাজে ধনী কারা?
যারা নিজেদের জীবনে দ্বীনকে ফার্স্ট প্রায়োরিটি দেয়নি।
আপনি বাংলাদেশের ১০০ জন ধনী, আপনার মহল্লা, গ্রামের ১০ জন ধনীর লিস্ট বানান। খুব সহজেই বুঝতে পারবেন।

যারা ধার্মিক, তারা গরীব। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, দানের ফযিলত সংক্রান্ত হাদীসগুলো দিয়ে টার্গেট করা হয় সমাজের সেইসব শতোভাগ বা অর্ধেক বা বিশভাগ হারামে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে। ঐ বেচারা তো এমনিতেই ভয়ে থাকে, তার ওপর যখন শুনে দান করলে সওয়াব আছে, গুনাহ মাফ হবে, তখন সে আখিরাতে বাঁচার জন্য হলেও মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানায় দান করে।

অথচ হারাম সম্পদের দানের কুফল, হারাম উপার্জনের ব্যাপারে সতর্কবাণী দান-সদকার ফযিলতের ১০০ ভাগের ৫ ভাগও করা হয় না।

সাহাবিদের সময় দান করতেন কারা?
আবু বকর, উসমান, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ, তালহা, সা’দ ইবনে উবাদা রাদিয়াল্লাহু আনহুম।
সেই যুগে সমাজে দ্বীনদার কোটিপতি যারা ছিলেন, মসজিদ নির্মাণ, যুদ্ধের প্রস্তুতি বা কূপ ক্রয়ের ব্যাপারে কোনো বেদ্বীনের কাছে দান-সদকার ফযিলত বর্ণনা করতে হতো না।

এই সমাজের যখন অর্থনৈতিক এমন দুর্গতি, মুসলিমদের যখন এমন অধঃপতন, তখনো নাকি ‘কোটিপতি সাহাবি’ বইটি মানুষকে দুনিয়ার প্রতি প্রলুব্ধ করবে?

ভাই, এই সমাজের মুসলিমদের দুনিয়াই বা কোথায়? এই সমাজে কয়জন উসমান-আব্দুর রহমান ইবনে আউফ আছেন?
দুর্নিতীবাজ, যালিম, দাড়িওয়ালা দরবেশকে আপনি বানাচ্ছেন আপনার ডোনার!
নবীজি ﷺ এবং সাহাবিদের অর্থনৈতিক জীবনকে যেভাবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেভাবে এই ভুলকেই সুন্নত মনে করছে লোকজন, সেখানে ‘কোটিপতি সাহাবি’ বইটি হলো চোখ খুলে দেবার মতো।

The Truth needs no lies। সত্য নাজ্জাশীর সামনে ছলচাতুরী না করার নাম। সত্য ইনিয়েবিনিয়ে ইসলাম না শেখানোর নাম। সত্য সব সময়ই সত্য। সত্যের রঙ একটাই; সেটা সত্য। সংকীর্ণতা দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা হয় না।

কোটিপতি সাহাবি’ হলো সেই সত্য, যেই সত্য যদি আপনি অস্বীকার করেন, তাহলে সহীহ বুখারী-মুসলিম সহ ইসলামের সব ক্ল্যাসিকাল বইকে অস্বীকার করতে হবে।

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Exit mobile version