যাতুর-রিকা অভিযান শেষে মুসলিম বাহিনী ফিরছে। বাহিনীর সবাই অবশ্য সমান গতিতে চলছে না। ধীরগতির উটের ফলে কেউ কেউ পিছিয়ে পড়ছে। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) উটও ধীরগতির। তিনি আস্তে আস্তে অগ্রসর হচ্ছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর একজন সাহাবীকে পেছনে দেখে খোঁজ নিতে গেলেন। তিনি ডাক দিলেন- “এখানে কে?”
আমি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ।
তোমার কী হলো? এতো পেছনে কেনো?
আমার ধীরগতির উটের কারণে পেছনে পড়ে যাচ্ছি।
তোমার উটটি এখানে বসাও। আর তোমার কাছে কি কোনো লাঠি আছে?
জাবির (রা:) তাঁর হাতের লাঠিটি রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতে দিলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উটের পিঠে চাবুক মেরে হাঁকালেন। উটটি এবার বেশ দ্রুতগতির উটে পরিণত হলো। এমনকি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহর (রা:) উট রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উটের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো।
উটের গতি দেখে জাবির (রা:) যেই মুহূর্তে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার উটটি আমার কাছে বিক্রি করবে?”
উটটি ছিলো জাবিরের (রা:) শেষ সম্বল। তাঁর ঋণগ্রস্ত বাবা শহীদ হবার পর বাবার অনেক ঋণ তাঁকে পরিশোধ করতে হয়, সাতজন বোনকে দেখাশোনা করতে হয়। এই উটটি বিক্রি করে দিলে তাঁর কাছে আর কিছুই থাকবে না।
ধীরে চলার ফলে একটু আগে যে উটের প্রতি তিনি বিরক্ত ছিলেন, এখন সেই উটটি রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উটের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে। আর এখন কিনা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উটটি কিনে নিতে চাচ্ছেন!
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আপনাকে আমি এটা গিফট করলাম। আপনার কিনতে হবে না।” কিন্তু, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফ্রি-তে নিতে চাচ্ছেন না। তিনি বললেন, “না, এটা আমার কাছে বিক্রি করো।”
রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে উট বিক্রি করে কিভাবে জাবির (রা:) টাকা নিবেন?
তিনি বারবার রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে লাগলেন, “না, ইয়া রাসূলুল্লাহ! উটটি আপনার জন্য গিফট।” রাসূলুল্লাহও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাল ছাড়লেন না। তিনি জাবিরকে (রা:) বললেন,
”আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন! আমি উটটি কিনতে চাই।”
জাবিরও (রা:) জোরাজুরি করতে থাকেন। তিনি রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে উট বিক্রি করবেন কিভাবে?
শেষপর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পঁচিশবার জাবিরকে (রা:) জোরাজুরি করলে জাবির (রা:) রাজী হোন।
প্রত্যেকবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাবিরের জন্য বলেন ‘আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন!’ জাবির (রা:) তাঁর জন্য রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’আ গণনা করেন।
[জামে আত-তিরমিজি: ৩৮৫২]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর কোনো সাহাবীর জন্য একসাথে এতোবার মাগফিরাতের দু’আ করেননি। রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’আ থেকে উপকৃত হবার জন্য হয়তো জাবির (রা:) উট বিক্রি করতে এতো জোরাজুরি করেন।
জাবির (রা:) উট বিক্রি করতে সম্মত হবার পর দরদাম শুরু করেন। “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি তাহলে কতো দিবেন?”
এক দিরহাম!
না না, তা হবে না। এতে তো আমি ঠকে যাবো।
আচ্ছা, তাহলে দুই দিরহাম।
তাতেও হবে না।
সুযোগ পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাবিরের সাথে একটু রসিকতা করলেন। যে জাবির (রা:) এতক্ষণ ধরে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফ্রি-তে উট দিতে চাচ্ছিলেন, সেই জাবির (রা:) এবার এক দিরহাম, দুই দিরহামে উট বিক্রি করছেন না!
দুজন দরদাম করতে করতে শেষ পর্যন্ত জাবির (রা:) চল্লিশ দিরহামের (চার দিনার) বিনিময়ে উটটি বিক্রি করতে সম্মত হন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তাহলে মদীনা পর্যন্ত উটটিতে তুমি চড়ে যাবে।”
মদীনায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিল্লালকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, “জাবিরকে তাঁর উটের দাম এবং সাথে আরো কিছু অর্থ দিয়ে দাও।” রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথামতো বিলাল (রা:) জাবিরকে উটের মূল্য এবং সাথে আরো কিছু স্বর্ণ দিলেন।
রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে উট বিক্রি করে জাবির (রা:) ফিরে যেতে লাগলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ডাক দিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাবিরকে বললেন,
“শোনো ভাতিজা! উটের লাগাম হাতে নাও। তোমার উট তুমি নিয়ে যাও, আর তোমার উটের মূল্যও তুমি নিয়ে যাও।”
[সীরাত ইবনে হিশাম: ৩/২০৬-২০৭, সহীহ বুখারী: ২৩০৯, সহীহ মুসলিম: ৩৫৩৩]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মূলত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহকে (রা:) সাহায্য করতে চাচ্ছিলেন। বাবা হারানো ইয়াতিম ছেলে তিনি। এতোগুলো বোনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।
উট কেনা, মূল্য পরিশোধ এগুলো ছিলো বাহানা মাত্র। তিনি চাচ্ছিলেন না, জাবিরকে (রা:) দান করে মনে কষ্ট দিতে। উট কিনে তাঁকে এমনভাবে দান করলেন, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহর (রা:) কাছে এটাকে ‘দান’ বলে মনেও হলো না।