কুরআন পড়ার সেরা উপায়

মানুষকে একটা প্রশ্ন প্রায় জিজ্ঞেস করতে শোনা যায়, বিশেষ করে আমরা যখন রমজান মাসে প্রবেশ করি। রোজায় কুরআন খতম করতে হলে আমাকে কত ঘন ঘন কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে?
আমি কি পুরো কুরআন খতম করব, নাকি আমার লক্ষ্য হবে শুধু তেলাওয়াত করে যাওয়া?
নাকি এই রোজায় দুইবার কুরআন খতম করার জন্য আমি নিজেকে তাগাদা দিব?

এছাড়া এসব প্রশ্ন তো আছেই – কিভাবে আমি কুরআন খতম এবং কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখবো এবং আমার তেলাওয়াতকেও উপভোগ করব?
আমি যদি কুরআন ভালো করে তেলাওয়াত করতে না পারি, তাহলে কি আমি কুরআনের অনুবাদ পড়ার দিকে মনোযোগ দিব?
নাকি আমি খানিকটা বিরতি দিয়ে বুঝে বুঝে কুরআন পড়বো?

আমি প্রথমেই বলতে চাই আপনি যেকোন উপায়েই হোক কুরআনের সাথে লেগে থাকুন। যেকোনো উপায়ে নিজেকে কুরআনের সাথে জড়িয়ে রাখা ইবাদতের একটি রূপ। আপনি কুরআনের তেলাওয়াত শুনুন, বা নিজে তেলাওয়াত করুন, অথবা এর আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করুন – এইসবই ইবাদত বিইজনিল্লাহি তা’য়ালা।

এমনকি কুরআন বোঝার উদ্দেশ্যে এর অনুবাদ পড়াও ইবাদতের একটি রূপ। এটি কুরআনের প্রকৃত আয়াত তিলাওয়াত করার মত নয়, তবে কুরআনের অনুবাদ পড়ার উদ্দেশ্য যদি হয় জ্ঞান অর্জন, আল্লাহর নৈকট্য লাভ, এবং কুরআনকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করা – তবে তাও ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে ইনশাআল্লাহ।

প্রথমত আপনি একাধিক উপায় নিজেকে কুরআনের সাথে জড়িয়ে রাখতে চান। দ্বিতীয়ত রমজান অবশ্যই কুরআন তেলাওয়াতের মাস। সালাফ এবং ধার্মিক পূর্বসূরীদের জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি তারা রমজান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এই মাসে তারা যতটা না অধ্যয়ন করতেন তার চেয়ে বেশি কুরআন নিয়ে চিন্তা করতেন এবং তেলাওয়াত করতেন।

এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের (রা.) সুন্দর একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা এমনভাবে কুরআন তেলাওয়াত করো না যেন গাছ থেকে পাকা খেজুর পড়ছে, আবার এত দ্রুত কুরআন তেলাওয়াত করো না যেন তোমরা কবিতা আবৃত্তি করছো।’ এর অর্থ হল কুরআন বিক্ষিপ্তভাবে তেলাওয়াত করা যাবে না, এবং খুব দ্রুত কবিতার মতও আবৃত্তি করা যাবে না।

তিনি আরো বলেছেন কুরআনের যে আয়াতগুলো আপনাকে বিস্মিত করে, আপনাকে থামিয়ে দেয়, সেই আয়াতগুলো আপনি এমন ভাবে পড়ুন যেন আপনার হৃদয় আন্দোলিত হয়। কুরআন তেলাওয়াতের সময় কারো উদ্বেগ যেন এরকম না হয় যে তাকে এই সুরাটি শেষ করতে হবে, বা এতোটুকু পড়তে হবে।

স্পষ্টতই কুরআন তেলাওয়াতের বিভিন্ন গতি আছে এবং এই ক্ষেত্রে পরিমাণটি মাথায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে আপনি যদি কুরআন খতম করার বা এর কিছু অংশ পড়ার জন্য কোন লক্ষ্য নির্ধারণ না করেন, তবে আপনি পিছিয়ে পড়তে পারেন। তাই ইনশাআল্লাহ তা’আলা নির্দিষ্ট সময়কাল এবং একটি পরিমাপযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে ধীর গতিতে আয়াতের তেলাওয়াত বিবেচনা করুন যাতে আপনি এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে পারেন।

কাজেই আপনার লক্ষ্য হবে নির্ধারিত কিছু সময় আপনি কুরআন তেলাওয়াত করবেন, এবং কিছুটা সময় এই নিয়ে ভাববেন, এবং যে আয়াতগুলো আপনার হৃদয়কে আন্দোলিত করে সেই আয়াতগুলোতে থামবেন এবং গভীরভাবে চিন্তা করবেন। কিছু উলামাদের মতে কুরআন তেলাওয়াত এবং কুরআন খতম এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে যাতে আপনি আপনার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন। রাতের কিয়ামেও আপনি কুরআন তেলাওয়াত করতে পারেন যেমন করতেন আমাদের রাসূল (সা.)।

রাসূল (সা.) কখনো কখনো কুরআনের একটি আয়াত বারবার তেলাওয়াত করে সারা রাত কাটিয়ে দিতেন, এবং সেই বিশেষ আয়াত তেলাওয়াত করে তিনি কাঁদতেন এবং আয়াতটি দিয়ে দু’আ করতেন। কাজেই রাতের কিয়ামের তেলাওয়াতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে যেখানে আপনি ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করবেন, তা নিয়ে চিন্তা করবেন, কাঁদবেন এবং দু’আ করবেন।

শুধু রাতের বেলায় নয়, আপনি দিনের বেলাতেও ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারেন এবং তা উপভোগ করতে পারেন। ধরুন আপনি বাহিরে প্রকৃতির কাছাকাছি বসে কুরআন তেলাওয়াত করলেন, যে আয়াতগুলো আপনার হৃদয়কে আন্দলিত করে সেই আয়াতগুলোতে কিছুটা থামলেন, আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করলেন, উপরের দিকে তাকিয়ে বললেন আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ!

ইবনে মাসউদ (রা.) অবশ্যই কুরআনকে খুব বেশি ভালবাসতেন। কুরআনের হাওয়ামিম – অর্থাৎ যেই সূরা গুলো হা মিম দিয়ে শুরু হয়েছে, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন কুরআনের এই সূরাগুলোতে তিনি যখন প্রবেশ করতেন তাঁর মনে হতো তিনি একটি সুন্দর বাগানে প্রবেশ করেছেন। আপনি যখন এরকম সুন্দর কোন বাগানে এসে পৌঁছাবেন, তখন আপনি কি করবেন? আপনি থামবেন, ফুলগুলোর সৌন্দর্য অবলোকন করবেন, এদের ঘ্রাণ নিবেন, এবং বাগানের এই সৌন্দর্যকে আপনার হৃদয়ে ধারণ করার চেষ্টা করবেন, তাই না?

কুরআনে বিশেষ কিছু সূরা বা অংশের প্রতি আপনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হতে পারেন, যদিও পুরো কুরআনের সাথে আমাদের সংযুক্ত হওয়া উচিত। আপনার জীবনে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে কুরআনের কিছু সূরা এবং এর গল্পের সাথে হয়তো আপনি আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে পেরেছেন।

এমনকি ইবনে মাসউদ (রা.) যিনি অবশ্যই সম্পূর্ণ কুরআনকে ভালবাসতেন, কিছু কিছু সূরায় এসে তিনি থেমে যেতেন, কারণ সেই বিশেষ সূরাগুলোর তেলাওয়াত তিনি বেশি উপভোগ করতেন। অন্য আরেকটি বর্ণনায় তিনি হাওয়ামিম সুরা গুলোর বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এই সুরাগুলো যেন সুন্দর রেশমী পোশাকের মত।

তাই প্রিয় ভাই ও বোনেরা কুরআন এমন ভাবে তেলাওয়াত করুন যেন কিছুটা সময় আপনি কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারেন, সেই সাথে কতটুকু তেলাওয়াত করবেন তা নিয়েও আপনার একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে। এমনকি সালাফ এবং ধার্মিক পূর্বসূরীরাও কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন, এবং সেই সাথে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ কুরআন তেলাওয়াতের চেষ্টাও তারা করেছেন। বস্তুত কুরআনের সাথে ব্যয় করা প্রতিটি মুহূর্তই ইবাদত। এই কুরআনের মাসে আল্লাহ যেন কুরআনের মাধুর্য দিয়ে আমাদের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করেন, আমাদের জিব্বাকে কুরআনের তেলাওয়াত দিয়ে ব্যস্ত রাখেন, এবং আমাদেরকে কুরআনের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
আল্লাহুম্মা আমীন!

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version