কুরআন পাঠে আমার বাবার একাগ্রতা

শৈশবকাল থেকে আমি কখনো দেখিনি যে আমার বাবা এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেছেন, অথবা সপ্তাহে একবার কুরআন খতম করেননি। আমি খুব অবাক হয়ে একবার আমার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বাবা কখন থেকে ধর্মের প্রতি এতটা নিবেদিত?”
আমার মা উত্তর দিয়েছিলেন, “যখন থেকে আমাদের বিয়ে হয়েছে অর্থাৎ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি তাকে এরকমই দেখে আসছি, এবং আমি শুনেছি কৈশোর থেকেই তিনি এই অভ্যাস গড়ে তুলেছেন।”

একসময় আমার বাবার গুরুতর অসুখ ধরা পড়ে। তখন পরিবারের সবাই আমরা তাকে জোর দিয়েছিলাম তিনি যেন বিদেশে গিয়ে তার চেকআপ এবং চিকিৎসা করান।

অবশেষে, সবার চাপাচাপিতে তিনি চেকআপের জন্য আমেরিকা যেতে রাজি হন, এবং সেখানে তিন মাস অবস্থান করেন। যখন তিনি ফিরে আসেন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় আমেরিকা কেমন লাগলো?

উত্তরে তিনি বলেন: “দারুণ!! দেশটিকে আমার সত্যিই খুব পছন্দ হয়েছে, ওইখানে অবস্থানরত দিনগুলো ছিল আমার জীবনে কাটানো সবচেয়ে সুন্দর কিছু দিন।” বাড়ির সবাই অবাক হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “কেন, সেখানে এমন কি ঘটেছে, বা কার সাথে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে যে কারণে দেশটিকে আপনার এত পছন্দ হলো?” আমার মা শারীরিক সমস্যার কারণে তার সাথে ভ্রমন করতে পারেনি, মাকে তিনি বললেন, “দেশটিকে আমি এত পছন্দ করেছি কারণ দেশটির রাত আমাদের রিয়াদের রাতের তুলনায় অনেক বেশি দীর্ঘ। সেখানে আমি প্রতি তিন দিনে একবার করে কুরআন খতম করেছি, এবং প্রতি সপ্তাহে দুইবার। এখানে প্রতি তিন চার দিনে কুরআন খতম করা তুলনামূলকভাবে কষ্টসাধ্য।

এভাবেই আমার বন্ধু তার বাবার অবিস্মরণীয় স্মৃতির কথা আমার কাছে উল্লেখ করেছেন। এই গল্পটি থেকে কিছু শিক্ষা আমি তুলে ধরতে চাই –

এই গল্পটি আমার মনে ভীষণভাবে দাগ কেটে গেছে, কারণ আমি নিজেও বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করছি এবং আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় সৌদি আরবে কেটেছে, কিন্তু আমি কুরআন সম্পর্কে কখনো এভাবে ভাবিনি। হয়তো আমি কুরআনকে তেমনভাবে আঁকড়ে ধরতে পারিনি যেমনভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন আমার বন্ধুর বাবা। এই গল্পটি সম্পর্কে এটাই ছিল আমার প্রথম প্রতিফলন। যখন আমরা কোন কিছুর প্রতি ভীষণভাবে অনুরক্ত হই, আমরা কেবলমাত্র তা চাই না, বরং প্রতি মুহূর্তে এর সন্ধান করি, এবং এটা ছাড়া বাঁচতে পারি না।

একবার চিন্তা করে দেখুন তো আপনি দিনে কতবার আপনার সেলফোন ব্যবহার করেন; নিউজফিড, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেক্সট মেসেজ, ফেসবুক স্ট্যাটাস, ইনস্টাগ্রাম স্টোরি, লেটেস্ট টুইট, ইউটিউব এবং টিকটক ভিডিও দেখার জন্য? অনেক সময় আমার মনে হয় মানুষের জীবনে একমাত্র পঠিত book হল Facebook.

এবার তুলনা করে দেখুন, আপনি প্রতিদিন কতবার মুসহাফ খুলে কুরআনের একটি পৃষ্ঠা, সূরা বা নিদেনপক্ষে দশটি আয়াত পাঠ করেন? পড়াশুনা এবং ক্যারিয়ার নিয়ে আপনি কতটা সিরিয়াস, এবং এর জন্য কি পরিমান অর্থ ও সময় ব্যয় করতে ইচ্ছুক, সে কথা না হয় বাদই দিলাম।

আল্লাহ তাআলা বলেন –

وَقَالَ ٱلرَّسُولُ يَٰرَبِّ إِنَّ قَوۡمِى ٱتَّخَذُواْ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ مَهۡجُورًا
আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।1

আমি জানি এমন অনেকেই আছেন যারা কুরআন পড়তে জানেন, কিন্তু তারা কেবল রোজার মাসেই কুরআন খতম করার চেষ্টা করেন। আবার এমন অনেকে আছেন যারা কুরআন পড়তে জানেন না, কিন্তু কুরআন শিক্ষার ব্যাপারেও ততটা সিরিয়াসও নন। বছর কয়েক ধরে তারা হয়তো মনে মনে ভাবছেন কুরআন শিক্ষার ব্যাপারে কিছু একটা করতে হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করা হয় না।

আমি ভাবছি আমাদের মধ্যে এমন কি অনুপস্থিত রয়েছে যা আমাদের হৃদয়কে কুরআনের সাথে তেমন ভাবে সংযুক্ত এবং অনুরক্ত করছে না, যেভাবে করা উচিত! আল্লাহর কিতাব শেখার জন্য আমাদেরকে আরও বেশি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হলে, আমাদের আসলে কি করা উচিত।

উত্তরটি সহজ “আমাদের অবশ্যই কুরআন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে”, আমাদের বুঝতে হবে আল-কুরআন আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আল-কুরআন তেলাওয়াত করা হল সবচেয়ে পুরস্কৃত ইবাদতের একটি এবং সবচেয়ে সহজ কাজগুলির মধ্যে একটি।

আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে তার নেকী হবে। আর নেকী হয় দশ গুণ হিসাবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম মিলে একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, এবং মীম আরেকটি হরফ।”2

আল-কুরআনের নামের মাঝেই রয়েছে এর বর্ণনা। কুরআনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করার জন্য জন্য এর কিছু প্রতিশব্দ এখানে উল্লেখ করা হলো –

কুরআনকে আত্মা হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ কুরআন আমাদের আত্মাকে জীবিত রাখে। এছাড়া কুরআনকে জীবনদানকারী হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ জীবনের প্রকৃত অর্থ কুরআনেই অন্তর্নিহিত, এবং কুরআন অধ্যায়নের মাঝেই তা উপলব্ধি করা যায়।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন –

يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٌ لِّمَا فِى ٱلصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحۡمَةٌ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ
হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত।3

আল-কুরআন একটি সম্মানিত কিতাব এবং যে কেউ তা পড়বেন এবং অনুসরণ করবেন তিনি কেবল এই জীবনেই নয়, পরবর্তী জীবনেও সম্মানিত হবেন ইন শা আল্লাহ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন –

তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই, যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে তা শেখায়।4

অন্য আরেকটি হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন –

‘কুরআনের শিক্ষা লাভকারীকে বলা হবে, পড়, আরোহণ কর আর দুনিয়াতে যেভাবে ধীরে ধীরে পাঠ করতে সেভাবে ধীরে ধীরে পাঠ করে যাও। অতএব যে আয়াতে তোমার পাঠ শেষ হবে সেখানে হবে তোমার মনযিল।’5

আপনি কি জানেন যে ইমাম ইবনে আল-সালাহ বলেছেন যে ফেরেশতারা মানুষের কুরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য জড়ো হয় কারণ কুরআন পড়তে পারার ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছেন কিন্তু ফেরেশতাদের নয়।

আমি বিশ্বাস করি যে আল্লাহ আমাদের জন্য কুরআনের সাথে সংযোগ স্থাপন করা সহজ করেছেন, তবে সমস্যাটি কুরআনের নয়, সমস্যা আমাদের অন্তরের। আমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে।

আমরা অনেকেই কুরআনের গুরুত্ব বুঝি এবং এর শিক্ষা এবং তেলাওয়াতের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি, তারপরও আমরা পুরোপুরিভাবে কুরআনের সাথে সম্পৃক্ত হতে বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারি না। “আমি জানি না….আমি এতবার ব্যর্থ হয়েছি যে আমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়! আমার আগ্রহ আছে কিন্তু দৃঢ় সংকল্প ও ইচ্ছাশক্তি নেই”…. কথাগুলো খুব পরিচিত শোনাচ্ছে, তাই না?

আল্লাহ কি বলেছেন শুনুন –

يُؤۡفَكُ عَنۡهُ مَنۡ أُفِكَ
যে পথভ্রষ্ট হয়েছে তাকেই তা (কুরআন) থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।6

অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার কামনা-বাসনায় ভ্রান্ত হয়ে খারাপ কাজে ব্যস্ত সে কুরআন থেকে প্রতারিত হয়।

ইবনে মাসউদ বলেছেন:
“যদি আপনার অন্তর পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ হয়, তবে আপনি কখনো অনুভব করবে না যে আপনার জীবনে আপনার প্রভুর বাণীর প্রয়োজন নেই।”

একজন ব্যক্তি আল হাসান আল বাসরির কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি রাতে নামাজ পড়তে এবং কুরআন তেলাওয়াত করতে চাই, কিন্তু প্রতিরাতেই এমন হয় যে আমি ঘুম থেকে উঠতে পারিনা, এমনকি যদি আমি তাড়াতাড়িও ঘুমাতে যাই। আপনি কি বলতে পারেন আমি কেন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছি?” উত্তরে হাসান বাসরি বলেছিলেন, “আপনার দিনের বেলার পাপ আপনাকে বাধা দিচ্ছে।”

আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন-

وَمَآ أَصَٰبَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِيكُمۡ وَيَعۡفُواْ عَن كَثِيرٍ
আর তোমাদের প্রতি যে মুসীবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন।7

মানুষের জীবনে কুরআনকে ভুলে যাওয়ার চেয়ে বড় বিপর্যয় আর কি হতে পারে?

سَأَصۡرِفُ عَنۡ ءَايَٰتِىَ ٱلَّذِينَ يَتَكَبَّرُونَ فِى ٱلۡأَرۡضِ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّ وَإِن يَرَوۡاْ كُلَّ ءَايَةٍ لَّا يُؤۡمِنُواْ بِهَا وَإِن يَرَوۡاْ سَبِيلَ ٱلرُّشۡدِ لَا يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًا وَإِن يَرَوۡاْ سَبِيلَ ٱلۡغَىِّ يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًاۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَذَّبُواْ بِئَايَٰتِنَا وَكَانُواْ عَنۡهَا غَٰفِلِينَ
যারা অন্যায়ভাবে যমীনে অহঙ্কার করে, আমার আয়াতসমূহ থেকে তাদেরকে আমি অবশ্যই ফিরিয়ে রাখব। আর তারা সকল আয়াত দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না এবং তারা সঠিক পথ দেখলেও তাকে পথ হিসাবে গ্রহণ করবে না। আর তারা ভ্রান্ত পথ দেখলে তা পথ হিসাবে গ্রহণ করবে। এটা এ জন্য যে, তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং সে সম্পর্কে তারা ছিল গাফেল।8

ইবনে মাসউদ বলেছেন:
“আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, একজন বিশ্বাসীর হৃদয়ে আল-কুরআনের প্রতি ভালোবাসা, এবং গান বাজনার প্রতি ভালোবাসা একসাথে থাকতে পারেনা। এদের একটি অন্যটিকে কবর দিয়ে দেয়।”

এটা সত্যিই খুব ভীতিকর! আমাদের পাপ কীভাবে আমাদেরকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে এবং ফলস্বরূপ এটি আমাদেরকে তাঁর হেদায়েত থেকে থেকে বঞ্চিত করতে পারে।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন:
“তিনটি জায়গায় আপনার হৃদয়ের সন্ধান করুন: যখন আপনি কুরআন শুনেন, যখন (আল্লাহর) জ্ঞান অন্বেষণ করেন, এবং যখন আপনি একান্তে থাকেন। আপনি যদি এই জায়গাগুলিতে এটি খুঁজে না পান, তবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন যেন তিনি আপনাকে একটি হৃদয় দিয়ে আশীর্বাদ করেন, কারণ আপনার হৃদয় নেই।”

এই বৃদ্ধ লোকটি আমাকে টাইম ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে ভাবতে শিখিয়েছে। আমি ভেবে দেখলাম জীবনে কত সুযোগ আমি মিস করেছি, আমার সময়কে আরো কত সুন্দর ভাবে কাজে লাগাতে পারতাম যা মৃত্যুর সময় এবং পুনরুত্থান দিবসে আমার উপকারে আসতো।

আমাদের সবার হাতেই দিনে ২৪ ঘন্টা সময় থাকে, কিন্তু আমরা ভিন্ন হয়ে যাই এই সময়কে কাজে লাগানো প্রক্রিয়ায়। সময়কে সর্বোত্তম এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হলে জীবনের লক্ষ্য এবং অগ্রাধিকারকে আগে বুঝতে হবে। আর এই বিষয়গুলো যদি আপনার কাছে অস্পষ্ট হয়, তবে সময় নষ্ট হবেই।

এই মানুষটি তার শৈশব থেকেই জানতেন যে কুরআন তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তাই তিনি তার জীবনের লক্ষ্য অর্জনে মনোনিবেশ করতে পেরেছিলেন।

আপনি কি জানেন যদি আপনি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে বা পরে চার পৃষ্ঠা কুরআন পড়েন, আপনি প্রতি মাসে পুরো কুরআন খতম করতে পারবেন, অর্থাৎ প্রতিদিন আপনি বিশ পৃষ্ঠা কুরআন পড়ছেন। যাদের নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াতের অভ্যাস আছে তাদের জন্য এতে আধা ঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়।

প্রতি রাতে কমপক্ষে ১০ টি আয়াত পড়ুন। যদি আপনি কুরআন পড়তে না পারেন তবে এর তেলাওয়াত শুনুন, আরবি পড়তে না পারলে ইংরেজিতে বা আপনার নিজের ভাষায় কুরআনের অনুবাদ পড়ুন। আপনার মূল লক্ষ্য যেন হয় কুরআনের সাথে লেগে থাকা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রাতের সালাতে দশটি আয়াত তিলাওয়াত করবে, তার নাম গাফিলদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে না। আর যে ব্যক্তি (রাতের) সালাতে এক শত আয়াত পাঠ করবে, তার নাম অনুুগত বান্দাদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে। আর যে ব্যক্তি সালাতে দাঁড়িয়ে এক হাজার আয়াত তিলাওয়াত করবে, তাকে অফুরন্ত পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে।9

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে।”10

যেকোনো ভালো কাজে ধারাবাহিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে কিংবা বা বিদেশ, তরুণ কিংবা বৃদ্ধ, সুস্থ কিংবা অসুস্থ – সব অবস্থাতেই এই মানুষটি তার কুরআন পাঠের অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন। আল্লাহ যখন আমাদেরকে কোন ভাল কাজে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে দেখেন, তিনি আমাদের সাহায্য করেন, আমাদের পথ দেখান এবং আমাদের কাছ থেকে তা কবুল করেন। কাজেই যুবক-যুবতী বা বৃদ্ধরা এখন এমন কিছু ভালো কাজ শুরু করুন যা আপনি প্রতিদিন ধারাবাহিকতার সাথে করবেন। আপনি প্রতিদিন যা করেন তার উপর আপনার মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ‘হুসনুল খাতিমা‘ – সুন্দর মৃত্যু অর্থাৎ ভালো কাজের উপর আপনার মৃত্যুর জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে আপনি যেন প্রতিদিন ভালো কাজ করেন।

নিশ্চিত করুন যে আপনি ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যাসটি আপনার বাচ্চাদের মধ্যে রোপন করেছেন, হতে পারে তা কুরআন তেলাওয়াত, জিকির আযকার, বিতরের নামাজ, দান-সাদকা বা ভালো কিছু বই পড়া বা দয়ার কাজ করা।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল হলো, যা সদাসর্বদা নিয়মিত করা হয় যদিও তা অল্প হয়।”11

ভালো কাজে কিভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন?

আপনার পছন্দমত কিছু ভালো কাজ বেছে নিন এবং এর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করুন।
এটিকে আপনার প্রতিদিনের সময়সূচীর অংশ করুন। অন্য কথায় আপনাকে অবশ্যই এর জন্য সময় নির্ধারণ করতে হবে।

প্রথমদিকে নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য নোট লিখে রাখতে পারেন, বা আপনার ফোনে এলার্ম দিতে পারেন। এমনকি আপনি অন্য কারো সাথেও কাজ করতে পারেন যতক্ষণ না আপনি এই অভ্যাস গড়ে তুলেন।

নিজের উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপবেন না, প্রথম দিকে ধারাবাহিকভাবে অল্প কিছু ভালো কাজের অভ্যাস করলেই চলবে।

ইসলামের একটি আকর্ষণীয় ধারণা হল “কাজা” – ইবাদতের অনুপস্থিত কাজকে পুষিয়ে নেওয়া, হোক তা বাধ্যতামূলক কিংবা ওয়াজিব। এটি আপনাকে আপনার ইবাদতে ধারাবাহিক হতে সাহায্য করবে। ইবাদতে বা যেকোন ভালো কাজে এক বা তার বেশি সময় অনুপস্থিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনি আবার প্রথম থেকে শুরু করবেন বা কাজটি ছেড়ে দিবেন, আপনার কাছে সর্বদা দ্বিতীয় সুযোগ রয়েছে।

বিনীত হোন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন, তিনি আপনার অন্তরকে উন্মোচিত করবেন ইন শা আল্লাহ।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করেন, আমি সেরূপই, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি তার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে; আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে লোক-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, তবে আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই, যদি সে আমার দিকে এক বাহু অগ্রসর হয়; আমি তার দিকে দু’ বাহু অগ্রসর হই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দৌড়ে অগ্রসর হই।12

ইমাম সুফিয়ান আল-সাওরি বলেন,
“আমি ২০ বছর শেষ রাতের কিয়ামের (নামাজ) সাথে সংগ্রাম করেছি, কিন্তু আমি এখন ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি উপভোগ করছি।”

وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ
আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন।13
وَجَعَلۡنَا مِنۡهُمۡ أَئِمَّةً يَهۡدُونَ بِأَمۡرِنَا لَمَّا صَبَرُواْۖ وَكَانُواْ بِئَايَٰتِنَا يُوقِنُونَ
আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।14

আল্লাহ তা’আলা যেন কুরআনকে আমাদের হৃদয়ের বসন্ত করে দেন, দুনিয়া এবং আখিরাতে পথপ্রদর্শনের জন্য আলোকবর্তিকা করে দেন, এবং আমাদের অন্তরে কুরআনের প্রতি ভালবাসাকে বৃদ্ধি করে দেন, এবং এই ভালোবাসাকে কবুল করে নেন, আমিন ইয়া রব্বিল আলামিন।

  1. সূরা ফুরকান: ৩০ ↩︎
  2. তিরমিজি: ২৯১০ ↩︎
  3. সূরা ইউনুস-১০:৫৭ ↩︎
  4. সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২৭ ↩︎
  5. তিরমিজি:২৯১৪ ↩︎
  6. সূরা আয-যারিয়াত-৫১: ৯ ↩︎
  7. সূরা আশ-শুরা-৪২: ৩০ ↩︎
  8. সূরা আল-আরাফ-৭: ১৪৬ ↩︎
  9. আবু দাউদ:১৩৯৮ ↩︎
  10. সহীহ মুসলিম: ১৯১০ ↩︎
  11. সহীহ বুখারী: ৬৪৬৪ ↩︎
  12. সহিহ মুসলিম: ৭৪০৫ ↩︎
  13. সূরা আল-আনকাবুত-২৯: ৬৯ ↩︎
  14. সূরা আস-সিজদা-৩২: ২৪ ↩︎

মূল: শায়েখ ওয়ালীদ বাসাইউনি

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version