Q/AAbdullahil Hadi

কুরআনের কসম এবং কুরআন হাতে নিয়ে কসম করার বিধান

কুরআনের কসম করার বিধান:

ইসলামের দৃষ্টিতে কসম করার সঠিক নিয়ম হলো, কেবল আল্লাহর নাম বা তাঁর গুণের কসম খাওয়া। যেমন: “আল্লাহর নামে কসম করছি…” বা “আল্লাহর ইজ্জতের কসম করছি…”। কারণ আল্লাহর নামে কসম খাওয়ার চেয়ে বড় কিছু আর হতে পারে না।

কেউ যদি কুরআনের কসম করে এই বিশ্বাসে যে, এটি আল্লাহর কালাম বা বাণী তবে তা বৈধ। কারণ আল্লাহর কালাম তাঁর গুণের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামি শরিয়তে আল্লাহর গুণের কসম করা বৈধ। কারণ আল্লাহর গুণ তাঁর সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কিন্তু যদি কেউ কুরআন দ্বারা কাগজ, কালি ও আরবি বর্ণমালাকে বোঝায় তবে তা বৈধ নয়; বরং এটি শিরকের অন্তর্ভুক্ত। কারণ কাগজ, কালি ও আরবি বর্ণমালা মাখলুক বা সৃষ্ট জিনিস।

সুতরাং কুরআনের কসম পরিহার করাই উত্তম।

এ প্রসঙ্গে বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ. বলেন,

إذا حلف بالمصحف قصده القرآن بكلام الله فلا بأس؛ لأن القرآن كلام الله، فإذا قال: وعزة الله، أو وكلام الله، أو بالمصحف، وقصده القرآن مقصوده كلام الله U فهذا يمين لا بأس به، هذه يمين لا بأس بها، ولا حرج فيها، والحمد لله، مثلما لو قال: وعزة الله، وعلم الله، وكلام الله لا بأس، يحلف بصفة من صفات الله، كما لو قال: والرحمن والرحيم، والعزيز، والحكيم، فهكذا إذا قال: وعزة الله، ورحمة الله، وعلم الله، وكلام الله لا بأس

“যদি কেউ কুরআনের কসম করে এবং তার উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর বাণী তথা কালামুল্লাহ তাহলে এতে কোনও সমস্যা নেই। কারণ কুরআন আল্লাহর কালাম।

সুতরাং যদি কেউ বলে: “আল্লাহর ইজ্জতের কসম“, “আল্লাহর কালামের কসম” বা “কুরআনের কসম” এবং তার উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর বাণী, তাহলে এটি বৈধ কসম হবে এতে কোনও সমস্যা নেই, আলহামদুলিল্লাহ।

এটি তেমনই যেমন কেউ বলে: “আল্লাহর ইজ্জতের কসম“, “আল্লাহর জ্ঞানের কসম“, “আল্লাহর বাণীর কসম“— এতে কোনও অসুবিধা নেই। কেননা এটি আল্লাহর একটি সিফত বা গুন।। যেমন কেউ যদি বলে: “রহমানের কসম“, “রহিমের কসম“, “আযীযের কসম“, “হাকীমের কসম“— এগুলোও বৈধ কসম।

একইভাবে, “আল্লাহর ইজ্জতের কসম“, “আল্লাহর রহমতের কসম“, “আল্লাহর জ্ঞানের কসম“, “আল্লাহর বাণীর কসম” বলাও বৈধ।”

কুরআন হাতে (আল্লাহর নামে) কসম করার বিধান

কুরআনের উপর হাত রেখে কসম করা, তা সরাসরি কুরআনের পাতার ওপর হোক বা তার মলাটের ওপর হোক— শরিয়ত অনুমোদিত নয়। বরং বহু আলেম এটিকে সুন্নাহ পরিপন্থী বা বিদআত বলেছেন।

নিম্নে এ প্রসঙ্গে বিশ্ববরেণ্য কতিপয় আলিমের ফতোয়া উল্লেখ করা হলো:

ইবনে কুদামা আল হাম্বলি রহ. তার “আল-মুগনি” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কতিপয় আলেম কসমকে আরও দৃঢ় করার জন্য কুরআনের ওপর হাত রেখে কসম করাকে পছন্দ করেছেন। কিন্তু তিনি বলেন:

وَهَذَا زِيَادَةٌ عَلَى مَا أَمَرَ بِهِ رَسُولُ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فِي الْيَمِينِ، وَعلى ما فَعَلَهُ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُونَ وَقُضَاتُهُمْ، مِنْ غَيْرِ دَلِيلٍ وَلَا حُجَّةٍ يُسْتَنَدُ إلَيْهَا، وَلَا يُتْرَكُ فِعْلُ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – وَأَصْحَابِهِ لِفِعْلِ ابْنِ مَازِنٍ وَلَا غَيْرِهِ.انتهى.

“এটি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পদ্ধতিতে কসম নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তার থেকে যেমন অতিরিক্ত কিছু তেমনি এটি খোলাফায়ে রাশেদিন এবং তাদের বিচারকদের বিচারকার্য থেকে অতিরিক্ত। এর পক্ষে কোনও গ্রহণযোগ্য দলিল বা প্রমাণ নেই। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবিদের আমল ছেড়ে ইবনে মাজিন বা অন্য কারও আমল অনুসরণ করা উচিত নয়।”

কুরতুবি রহ. তার তাফসিরে লিখেছেন:

“শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারীরা কসমের কঠোরতা বাড়ানোর জন্য কুরআনের ওপর হাত রেখে কসম নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে ইবনুল আরাবি (রহ.) এটিকে বিদআত বলেছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে, সাহাবিদের মধ্যে কেউ কখনো এই পদ্ধতি অবলম্বন করেননি।”

শাইখ ইবনে উসাইমিন রহ. সৌদি আরবের জনপ্রিয় “নুরুন আলাদ-দারব” শীর্ষক এক রেডিও অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন:

وإذا حلف بالله سبحانه وتعالى فإنه لا حاجة إلى أن يأتي بالمصحف ليحلف عليه، فالحلف على المصحف أمر لم يكن عند السلف الصالح، لم يكن في عهد النبي صلى الله عليه وسلم ولا في عهد الصحابة، حتى بعد تدوين المصحف لم يكونوا يحلفون على المصحف بل يحلف الإنسان بالله سبحانه وتعالى بدون أن يكون ذلك على المصحف.

“যদি কেউ আল্লাহর নামে কসম করে তাহলে কুরআন হাতে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কুরআনের ওপর হাত রেখে কসম করা আমাদের সালাফদের যুগে ছিল না। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবিগণ এবং এমনকি কুরআন সংকলনের পরও প্রচলিত ছিল না। বরং মানুষ আল্লাহর নামে কসম খেত কুরআন হাতে না নিয়েই।”

তিনি আরও বলেন:

الحلف على المصحف لتأكيد اليمين: وهذه صيغة لا أعلم لها أصلاً من السنة فليست مشروعة
“কসম দৃঢ় করার জন্য কুরআনের ওপর হাত রেখে কসম নেওয়ার কোনও ভিত্তি আমি সুন্নতে পাইনি। এটি শরিয়তসম্মত নয়।”

“লাজনাতুদ দায়িমাহ” (সৌদি স্থায়ী ফতোয়া কমিটি) তাদের ফতোয়ায় বলেছেন:

الحلف على المصحف أو على (صحيح البخاري) لا أصل له في الشرع، وإنما هو من عمل بعض الجهال، فيجب ترك هذه العادة، وتعظيم اليمين بالله عز وجل من غير أن يكون ذلك على المصحف أو (صحيح البخاري) أو غيرهم

“কুরআন বা ‘সহিহ বুখারি’ এর ওপর হাত রেখে কসম করার কোনও শরয়ি ভিত্তি নেই। এটি কিছু অজ্ঞ লোকের প্রচলিত কাজ মাত্র।

সুতরাং এ ধরনের প্রথা পরিহার করা উচিত এবং আল্লাহ তাআলার নামে কসমকে যথাযথভাবে সম্মান করা উচিত, তবে তা কুরআন বা অন্য কোনও কিতাবের ওপর হাত রেখে করা উচিত নয়।” [ফতোয়াগুলোর উৎস: Islam Q&A]

বিজ্ঞ আলেমদের উপরোক্ত ফতোয়া ও আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, কুরআন হাতে নিয়ে কসম করা সাহাবিদের যুগে প্রচলিত ছিল না এমনকি কুরআন সংকলিত হওয়ার পরও সাহাবি ও তাবেয়িদের মধ্যে এটি দেখা যায়নি। সুতরাং কুরআনুল কারিমের উপর হাত রেখে কসম করা শরিয়ত সম্মত নয় বরং বিদআত।

আল্লাহ তাআলা ও তাঁর গুণ ছাড়া অন্য কিছুর কসম খাওয়া শিরক:

মুসলিমদের জন্য মনে রাখা আবশ্যক যে, ইসলামে একমাত্র আল্লাহ এবং তার সিফত বা গুণাবলী ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তি, বস্তু, গাছ, মাছ, পাথর, পীর, মাজার, মাটি, দানা, বাবা, মা, সন্তান ইত্যাদির কসম খাওয়া শিরক। তবে এটি বান্দার নিয়তের উপর নির্ভর করে কখনো শিরকে আসগর (ছোট শিরক) আবার কখনো শিরকে আকবার (বড় শিরক) হতে পারে।

ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর নামে কসম করল, সে কুফরি করল অথবা শিরক করল।”
[আবু দাউদ: ৩২৫১, সহিহ]

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

لَا تَحْلِفُوا بِآبَائِكُمْ مَنْ حَلَفَ بِاللَّهِ فَلْيَصْدُقْ، وَمَنْ حُلِفَ لَهُ بِاللَّهِ فَلْيَرْضَ، وَمَنْ لَمْ يَرْضَ بِاللَّهِ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ
“তোমরা তোমাদের পিতাদের নামে কসম করো না। যে আল্লাহর নামে কসম করে, সে যেন সত্য বলে; আর যার জন্য আল্লাহর নামে কসম করা হয়, সে যেন সন্তুষ্ট হয়। আর যে সন্তুষ্ট হলো না, তার সাথে আল্লাহর কোনও সম্পর্ক নেই।” [সহিহ মুসলিম: ১৬৪৪]

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন:

مَنْ كَانَ حَالِفًا فَلْيَحْلِفْ بِاللَّهِ أَوْ لِيَصْمُتْ
“যে কসম করতে চায়, সে যেন আল্লাহর নামে কসম করে অথবা চুপ থাকে।”
[সহিহ বুখারি: ২৬৭৯]

ইবনে মাসউদ রা. বলেন:

لَأَنْ أَحْلِفَ بِاللَّهِ كَاذِبًا أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَحْلِفَ بِغَيْرِهِ صَادِقًا
“গায়রুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তি বা বস্তুর নামে সত্য কসম করার চেয়ে, আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা আমার কাছে অধিক প্রিয়।”
[ইরওয়াউল গালিল, হা/২৫৬২]

কেউ যদি পরিস্থিতি শিকার হয়ে কুরআন হাতে নিয়ে কসম খেতে বাধ্য হয়:

কুরআন হাতে কসম করা যেমন জায়েজ নয় তেমনি কাউকে কুরআন হাতে নিয়ে কসম করতে বা এ জন্য বাধ্য করা জায়েজ নয়। কিন্তু যদি কোনও ব্যক্তি নির্দোষ হওয়ার পরও তাকে কোনও গুরুতর অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয় এবং অভিযোগকারী ব্যক্তি তাকে অজ্ঞতা বশতঃ কুরআন হাতে নিয়ে কসম খেতে বাধ্য করতে চায় অন্যথায় তাকে জেল-জরিমানা বা বিভিন্ন ধরণের শাস্তির সম্মুখীন করা হবে-এমন পরিস্থিতিতে নিরপরাধ ব্যক্তি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য কুরআন হাতে নিয়ে কসম খেতে পারে। এতে তার গুনাহ হবে না বরং যে তাকে বাধ্য করেছে সে গুনাহগার হবে। তবে অন্তরে সে এ কাজকে হারাম বলে বিশ্বাস করবে।

হাদিসে এসেছে, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ اللَّهَ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِي الْخَطَأَ وَالنِّسْيَانَ وَمَا اسْتُكْرِهُوا عَلَيْه»
‘নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতের অনিচ্ছা বশত: এবং ভুলে যাওয়ার কারণে ঘটে যাওয়া গুনাহ এবং জোর জবরদস্তি মূলক কৃত গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।”
[আবু দাউদ, হা/৭২১৯-সহিহ]

এ ক্ষেত্রে সে সে পবিত্র অবস্থায় কুরআন হাতে নিয়ে আল্লাহর নামে কসম করবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture