কুরবানির গোশত ৩ ভাগ করার বিধান
ঈদুল আজহা হল, সামাজিক সম্প্রীতি, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ বোধ ও ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত ঈমান ও তাকওয়া দীপ্ত এক মহান উৎসবের নাম। এটি মুসলিম জাতির বৃহত্তর জাতীয় উৎসব। এই উৎসবের আনন্দময় একটি দিক হল, কুরবানি করা। কুরবানি মহান আল্লাহর বিশেষ একটি নিয়ামত। এই নিয়ামত পুরোটা একাকী উপভোগ না করে যদি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশী এবং সমাজের অসহায়-দরিদ্র পীড়িত মানুষের মাঝে ভাগাভাগি করা হয় তাহলে তা হয় কতই না উত্তম! এর মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য, পারস্পারিক সম্প্রীতি, ভালবাসা ও সহমর্মিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং মনে উদারতা সৃষ্টি হয়। এর বিপরীতে তা আত্মীয়-স্বজন ও গরিবদের মাঝে বিতরণ না করাটা খুবই নিন্দনীয় ও কৃপণতা সুলভ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
বলা হয়, “ভোগে সুখ নাই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।” প্রকৃতপক্ষে ভোগ-বিলাসিতায় প্রকৃত সুখ পাওয়া যায় না। প্রকৃত সুখ আসে আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। আর ত্যাগ মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। দুস্থ ও অসহায় মানুষের মুখে একটু হাসি ফুটানো একদিকে বিশাল সওয়াবের কাজ অন্যদিকে এতে করে অন্তরে বয়ে যায় অনির্বচনীয় প্রশান্তি ও সুখের ফল্গুধারা। আর এটাই ঈদুল আজহার অন্যতম শিক্ষা।
কুরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করা মুস্তাহাব:
কুরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ নিজের খাওয়া, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে উপহার দেওয়া এবং এক ভাগ গরিব-অসহায় মানুষকে দান করা মুস্তাহাব বা উত্তম।
নিম্নে আমরা এ প্রসঙ্গে হাদিস, সাহাবিদের আমল ও বক্তব্য এবং বিজ্ঞ ফকিহদেরদের মতামত ও ফতোয়া উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عن ابن عباس، في صفة أضحية النبي – صلى الله عليه وسلم – قال: يطعم أهل بيته الثلث، ويطعم فقراء جيرانه الثلث، ويتصدق على السؤال بالثلث. رواه الحافظ أبو موسى الأصفهاني، في الوظائف، وقال: حديث حسن.
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কুরবানির বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, “তিনি কুরবানির মাংস একভাগ নিজের পরিবারকে খাওয়াতেন, একভাগ গরিব প্রতিবেশীদের খাওয়াতেন এবং একভাগ যারা চাইতে আসতো তাদেরকে দান করতেন।” [এটি বর্ণনা করেন আবু মুসা আল আসপাহানি আল ওয়াজায়েফ গ্রন্থে এবং বলেন, হাসান হাদিস]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকেও অনুরূপ বক্তব্য ও আমল পাওয়া যায়। [আল মুগনি] যেমন:
বিখ্যাত তাবেঈ, আলকামা রাহ. বলেন,
بعث معي عبد الله بهديه، فأمرني أن آكل ثلثا، وأن أرسل إلى أهل أخيه عتبة بثلث، وأن أتصدق بثلث
“আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা, আমার সাথে তার হাদি (হজের কুরবানির পশু) পাঠালেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, যেন এক তৃতীয়াংশ খাই, এক তৃতীয়াংশ তার ভাই উতবার পরিবারের নিকট পাঠাই এবং এক তৃতীয়াংশ সদকা (দান) করে দেই।”
ইবনে উমর রা. বলেন,
الضحايا والهدايا ثلث لك ، وثلث لأهلك ، وثلث للمساكين
কুরবানি এবং হাদি (হজের কুরবানি) এর এক তৃতীয়াশ তোমার, এক তৃতীয়াংশ তোমার পরিবার এবং এক তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনদের জন্য।”
[আল মুগনি]
বিজ্ঞ ফকিহদের ফতোয়া ও অভিমত:
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেন,
نحن نذهب إلى حديث عبد الله: يأكل هو الثلث، ويطعم من أراد الثلث، ويتصدق على المساكين بالثلث
“আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর হাদিস অনুযায়ী মত পোষণ করি। তিনি নিজে এক তৃতীয়াংশ খেতেন, এক তৃতীয়াংশ যাকে ইচ্ছা খাওয়াতেন এবং এক তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনদেরকে দান করে দিতেন।” [আল মুগনি, অধ্যায়: কুরবানি, মাসআলা: কুরবানির তিনভাগের একভাগ খাওয়া, একভাগ উপহার দেওয়া এবং একভাগ সকদা (দান) করা মুস্তাহাব]
ইবনে কুদামা হাম্বলি বলেন,
“الاستحباب أن يأكل ثلث أضحيته، ويهدي ثلثها، ويتصدق بثلثها، ولو أكل أكثر جاز
“কুরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ খাওয়া, এক তৃতীয়াংশ হাদিয়া (উপহার) দেওয়া এক তৃতীয়াংশ সদকা (দান) করা মুস্তাহাব। যদি বেশির ভাগ খায় তাহলেও জায়েজ আছে।”
[আল মুগনি, ৯/৪৮৮]
হানাফি ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রদ্দুল মুহতারে এসেছে,
وَالْأَفْضَلُ أَنْ يَتَصَدَّقَ بِالثُّلُثِ وَيَتَّخِذَ الثُّلُثَ ضِيَافَةً لِأَقْرِبَائِهِ وَأَصْدِقَائِهِ وَيَدَّخِرَ الثُّلُثَ
“উত্তম হলো, এক তৃতীয়াংশ সদকা করে দেবে, এক তৃতীয়াংশ নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদেরকে মেহমানদারির জন্য রাখবে এবং আরেক তৃতীয়াংশ (নিজের জন্য) জমা রাখবে।”
[সূত্র: রদ্দুল মুহতার ৯/৪৭৪, বাদায়ে সানায়ে, ৪/২২৪]
কোনও কোনও আলেম তা দুভাগ করা উত্তম বলেছেন। একভাগ নিজের জন্য আরেক ভাগ গরিব-মিসকিনদের জন্য। এটি ইমাম শাফেয়ীর পরবর্তী অভিমত। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ
“অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।”
[সূরা হজ: ২৮]
সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি বিশ্ববরেণ্য ফকিহ আল্লামা শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. বলেন,
الأضحية شرعها الله لعباده ، وجعلها قربةً يتقرب بها إليه في عيد النَّحر، في الحاضرة والبادية، ولم يُحدد سبحانه ما يأخذه منها صاحبها، وما يُعطيه الفقراء، فقال : فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ [الحج:28]، والآية الأخرى: فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ [الحج:36].
فالمشروع للمؤمن في ضحيَّته أن يأكل ويُطعم، فإذا أخرج الثلث ووزعه للفقراء وأكل الثلثين مع أهل بيته؛ فلا بأس ولا حرج في ذلك، ولو أخرج أقلَّ من الثلث؛ كفى ذلك، وإن أعطى الفقراء أيضًا من جيرانه وأقاربه؛ فلا بأس، فالأمر في هذا واسعٌ، والحمد لله
“আল্লাহ তাআলা কুরবানিকে বান্দাদের জন্য শরিয়ত সম্মত করেছেন এবং কুরবানির ঈদের দিন তা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের মাধ্যমে হিসেব নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কুরবানি দাতা সেখান থেকে কতটুকু গ্রহণ করবেন তা নির্ধারণ করে দেননি। বরং তিনি বলেছেন, فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ “অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।” [সূরা হজ: ২৮] অন্য আয়াতে তিনি বলেন,
فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ
“তা থেকে তোমরা নিজেরা খাও এবং খাওয়াও এমন দরিদ্র ব্যক্তিকে যে আত্মমর্যাদার কারণে কারও কাছে কিছু চায় না এবং এমন ব্যক্তিকে যে মানুষের কাছে ভিক্ষা করে।”
[সূরা হজ: ৩৬]
সুতরাং শরিয়তের নিয়ম হল, একজন মুমিন ব্যক্তি কুরবানির গোশত নিজে খাবে এবং অন্যকে খাওয়াবে। তবে যদি তিনভাগের একভাগ বের করে দেয় এবং তা গরিব-অসহায় মানুষের মধ্যে বণ্টন করে এবং বাকি দু ভাগ তার পরিবার সহকারে খায় তাহলে তাতে কোনও সমস্যা বা সংকোচ নেই।
আর যদি এক তৃতীয়াংশের কম বের করে তাও যথেষ্ট হবে। যদি তার গরিব নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশীদেরকে দেয় তাতেও কোনও সমস্যা নেই। এ ক্ষেত্রে প্রশস্ততা রয়েছে। আল হামদুলিল্লাহ।” [শাইখের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট]
সুতরাং কারো পরিবারে যদি সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে তাদের জন্য গোশতের বেশি প্রয়োজন হয় তাহলে বেশিরভাগ রেখে দিতে পারে। উল্লেখ্য যে নিজের স্ত্রী সন্তান ও পরিবারবর্গকে গোশত খাওয়ানোও সদকার অন্তর্ভুক্ত।
মোটকথা, সবচেয়ে উত্তম হল, কুরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করা। এক ভাগ নিজের খাবার জন্য, একভাগ আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে উপহার দেওয়ার জন্য এবং একভাগ সমাজের দু:স্থ ও অসহায় মানুষকে দান করার জন্য। এটি মুস্তাহাব। তবে বাড়িতে লোকসংখ্যা বেশি হলে বেশির ভাগ তাদের জন্য রাখা হলেও তাতে কোনও সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। সমান সমান তিন ভাগে ভাগ করা আবশ্যক নয়। বরং বিষয়টিতে প্রশস্ততা রয়েছে-আলহামদুলিল্লাহ।
আল্লাহু আলাম।