পৃথিবীতে প্রথম মসজিদ কোনটি

প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর সালাত ফরজ করা হয়েছে। মহান আল্লাহতালা মুসলিম সম্প্রদায়কে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে দিয়েছে। এই নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় করার জন্য মুসলিম সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে এবং যেগুলোকে পরবর্তী সময়ে মসজিদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

যদিও গোটা জমিনটাই মসজিদ, এরপরও বিশ্বের যেখানেই মুসলমানরা বাস করছে সেখানেই গড়ে উঠেছে মসজিদ। আল্লাহর ইবাদাত, সমাজের পরস্পরে মেলবন্ধনসহ নানাবিধ হিকমতে জমিনের প্রান্তে প্রান্তে গড়ে উঠেছে মসজিদ। এক পরিসংখ্যান মতে, সারা বিশ্বে প্রায় ২৫ লাখেরও বেশি মসজিদ রয়েছে। বাংলাদেশে রয়েছে ২.৫ লাখেরও বেশি মসজিদ। আর শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই রয়েছে ৬ হাজার মসজিদ। আয়তনের সঙ্গে সংখ্যার তুলনা করলে বাংলাদেশেই মসজিদের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি।

মসজিদের পরিচয়

জামে মসজিদ:

বিশ্বের প্রাচীন মসজিদের তালিকা :

পবিত্র কুরআনে চারটি মসজিদের কথা উল্লেখ আছে। এই মসজিদগুলি প্রথম কখন নির্মিত হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়, তবে এগুলিকে বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই মসজিদগুলি ইসলামিক ইতিহাস- ঐতিহ্যের সর্বোচ্চ স্থান ও মর্জাদা বহন করে থাকে এবং পবিত্রতম ইবাদতগৃহ হিসাবে বিবেচিত হয়।

এখানে আমি বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদগুলির মধ্যে ৮ টির তালিকা উল্লেখ করছি যেগুলো এখনও বিদ্যমান । এখানে মসজিদগুলির প্রাচীনতা নির্ধারণ করা হয়েছে এর নির্মানকাল অনুযায়ী । এই মসজিদগুলির মধ্যে প্রায় সব মসজিদই কয়েক শতাব্দী ধরে বেশ কয়েকবার সম্প্রসারণ এবং সংস্কার করা হয়েছে।

নিম্নে মসজিদগুলোর বয়স, নির্মাণকাল, প্রাচীনতা অনুযায়ী ঊর্ধক্রমে উল্লেখ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ…

মসজিদ আল হারাম (Masjid al-Haram)

মক্কা, পৃথিবীর প্রথম মসজিদ।
সেখানে রয়েছে মসজিদে হারাম, পবিত্র কোরআন নাজিলের মাঠ-ময়দান-মরু-পাহাড়-গ্রাম। সেখানকার আকাশে-বাতাসে মিশে আছে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-এর নানা স্মৃতি।
মক্কাকে বলা হয়, মসজিদে হারাম, বাক্কা, উম্মুল কুরা, বায়তুল আতিক, মায়াদ, আল বালাদ, আল বালাদুল আমিন, করিয়া, ওদি, তিহামা প্রভৃতি।

কুরআন-হাদীসের এই বিবরণ প্রমাণ করছে, মসজিদুল হারাম পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদ।
তবে কে প্রথম এই মসজিদ তৈরি করেছেন, তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। কোন কোন মুফাসসিরের (তাফসীরকারক) মতে, আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা প্রথম বর্তমান কাবাঘরের স্থানে একটি ঘর তৈরি করেন। আবার অনেক মুফাসসীর মত প্রকাশ করেছেন, হযরত আদম (আ.) প্রথম এ স্থানে আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি ঘর তৈরি করেন। কালের বিবর্তনে এই ঘর ধ্বংস ও পরিত্যাক্ত হওয়ার পর আল্লাহ নতুন করে হযরত ইবরাহীম (আ.) কে এখানে আল্লাহর ইবাদতের জন্য ঘর তৈরির নির্দেশ দেন।

শুধু প্রাচীনতমই নয়, মসজিদুল হারাম বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। ৪ লাখ ৮ শত বর্গমিটার আয়তনের এই মসজিদে একসাথে ৪০ লাখ মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের সম্প্রসারণ কাজ এখনো চলমান আছে।

মসজিদ আল হারাম বা মসজিদে হারাম ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান, যা পবিত্র কাবাকে ঘিরে অবস্থিত। সৌদি আরবের মক্কা শহরে এর অবস্থান। মুসলিমরা নামাজের সময় কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়ান।

কুরআনে বর্ণিত রয়েছে যে হযরত ইব্রাহীম (আ) ও হযরত ইসমাইল (আ) দুজন একত্রে কাবা নির্মাণ করেন। ইবরাহিম (আ) কাবার পূর্ব কোণে হাজরে আসওয়াদ পাথর স্থাপন করেছিলেন যা হাদিস অনুযায়ী বেহেশত থেকে আগত। এই পাথর একসময় দুধের মত সাদা ছিল কিন্তু মানুষের গুনাহর কারণে এটি কালো হয়ে পড়ে। ইবরাহিম (আ) এর নির্মিত কাবার মধ্যে এই পাথরটিই একমাত্র আদি বস্তু হিসেবে টিকে রয়েছে।

কাবা নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ইবরাহিম (আ) কে হজ্জের জন্য আহ্বান করতে আদেশ দেয়া হয়। কুরআনের সূরা হজ্জে উল্লেখ আছে…

আর মানুষের কাছে হজ্জ ঘোষণা করে দাও। ওরা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেটে ও ধাবমান উটের পিঠে চড়ে, আসবে দুরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে। 
(সূরা হজ্জ, আয়াত ২৭)

কাবা ২১৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে নির্মিত হয় বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। ইসলাম অনুযায়ী কাবা পৃথিবীর প্রথম ইবাদতের স্থান।

প্রাথমিকভাবে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলেও কালক্রমে কাবা পৌত্তলিকতার চর্চা শুরু হয়। মক্কা বিজয়ের আগে এখানে ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি ছিল।
হজ ও ওমরার জন্য মসজিদুল হারামে যেতে হয়। এর ভেতরে ও বাইরে নামাজের স্থান মিলে মসজিদের বর্তমান কাঠামো প্রায় ৮৮.২ একর।এখানে একসঙ্গে ১০ লাখ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। হজের সময় প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এখানে উপস্থিত হন। এই মসজিদ সব সময় খোলা থাকে।

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) দু’জন একত্রে কাবা নির্মাণ করেন।
বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন,

হজরত রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ইরশাদ করেছেন, শুধু তিনটি মসজিদের উদ্দেশে সফর করা যাবে- আমার এই মসজিদ (মসজিদে নববী), মসজিদে হারাম ও মসজিদে আকসা।
-সহিহ মুসলিম

আল্লাহর আদেশে হযরত আদম (আ.) এর প্রথম কাবা তৈরির পর কালের বিবর্তনে তা ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ.) কে কাবা তৈরির আদেশ দিলে তিনি তার ছেলে ইসমাইল (আ.) এর সহায়তা নিয়ে নতুন করে কাবা তৈরি করেন। যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) কাবা তৈরি করেন, সেটি মাকামে ইবরাহীম নামে পরিচিতি লাভ করে। কাবা তৈরি করতে গিয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর যখন উঁচু হয়ে দাঁড়ানোর দরকার ছিলো, তখন আল্লাহর নির্দেশে পাথরটি ইবরাহীম (আ.) কে নিয়ে উঁচু হয়ে যেতো। আবার যখন ইবরাহীম (আ.) এর নিচু হয়ে পাথর নেওয়ার প্রয়োজন হতো, তখন পাথরটি আবার নিচু হয়ে যেতো। কাবার নিকটেই বর্তমানে বিশেষ বেষ্টনীর মধ্যে পাথরটি সংরক্ষিত রয়েছে।

হযরত ইবরাহীম (আ.) এর পরেও আরো অনেকবার কাবা পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। এই সংস্কার করতে গিয়ে কাবা আর তার পুরনো আকৃতিতে থাকেনি।

খুব সাম্প্রতিক সময় পর্যন্তও সপ্তাহে দু’দিন কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য সর্বসাধারণের জন্য এর দরজা খোলা থাকতো। যেকেউই তখন কাবার ভেতরে গিয়ে নামাজ আদায় ও দোয়া করতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে ভিড় বেড়ে যাওয়ায় এখন সাধারণের জন্য তা আর খোলা হয় না। শুধু বছরে দু’বার পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য কাবার দরজা খোলা হয়। এছাড়া কদাচিৎ অনুমতি পাওয়া বিশেষ বিশেষ অতিথিদের জন্য কাবার দরজা খোলা হয়।

আগে কাবায় প্রবেশের জন্য একটি দরজা এবং বের হওয়ার জন্য আরেকটি দরজা ছিলো। এছাড়া কাবার একপাশে একটি জানালা ছিলো। বর্তমানে শুধু একটি দরজা রেখে অপর দরজা ও জানালাটি পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পৃথিবীর কাবার মতোই ঊর্ধ্বজগতে আল্লাহর আরশের কাছে অবিকল অপর একটি কাবা রয়েছে। প্রতিদিনই সত্তর হাজার ফেরেশতা ‘বাইতুল মামুর’ হিসেবে পরিচিত ঊর্ধ্বজগতের এই কাবায় ইবাদত করতে আসেন।

কুরআন কারীমে সূরা তূরের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ এই ঘরের শপথ করে (وَالْبَيْتِ الْمَعْمُورِ) কিয়ামতের নিশ্চয়তা প্রকাশ করেছেন।

হযরত মালিক ইবনে সা’সা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ মিরাজ যাত্রার হাদীসে বর্ণনা এসেছে, মিরাজের রাতে রাসূল (সা.) বাইতুল মামুর দেখে এর সম্পর্কে জিবরাইল (আ.) এর কাছে জানতে চান। হযরত জিবরাইল (আ.) তখন তাকে বলেন,

“এটি বাইতুল মামুর যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা এসে ইবাদত করেন। এরপর তারা যখন চলে যান, দ্বিতীয়বার তারা আর এখানে প্রবেশের সুযোগ পান না।” (অর্থাৎ প্রতিদিনই নতুন ফেরেশতার দল এখানে ইবাদতের জন্য আসেন।)
(বুখারী ও মুসলিম)

মসজিদ আল আকসা (Haram al-Sharif) , ফিলিস্তিন

মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল আকসা। মক্কা, মদিনার পরে ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটিই পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ। মেরাজের রাতে রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ মক্কা থেকে প্রথমে মসজিদে আকসায় আগমন করেন।

ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে রাসুলের صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ওপর যখন নামাজ ফরজ হয়, তখন তিনি ও সাহাবীরা মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন

ইসলামে আল আকসা মসজিদ :

আল আকসা পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ। মক্কায় মসজিদুল হারাম নির্মাণের ৪০ বছর পরে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। প্রথম কে আল আকসা নির্মাণ করেন তা নিশ্চিত করে জানা না গেলেও এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের তিনটি মত পাওয়া যায়।

কেউ বলেন, এই মসজিদের প্রথম নির্মাতা হলেন আদিপিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম। কেউ বলেন, নুহ আলাইহিস সালোমের সন্তান সাম এই মসজিদের আদি নির্মাতা। আবার কারো মতে, হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম প্রথম এই মসজিদের ভিত্তি নির্মাণ করেন।

আধুনিক গবেষকরা হজরত আদম আলাইহিস সালামকে এই মসজিদের প্রথম নির্মাতা বলে মতামত দিয়েছেন। নূহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনে ধ্বংস হওয়ার পরে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এর পুনঃনির্মাণ করেন। পরবর্তীতে তার বংশধররা এই মসজিদের পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করেন। কালের পরিক্রমায় হজরত মুসা আলাইহিস সালামেরসহ অনেক নবী এই মসজিদের সংস্কার কাজ কাজ করেন। হজরত দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিস সালামের সময় পর্যন্ত অনেক সংযোজনের মধ্য দিয়ে মসজিদুল আকসা বিস্তৃত কম্পাউন্ডে রূপান্তরিত হয়।

হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করি, ‘হে আল্লাহর রাসুল, প্রথম কোন মসজিদ নির্মিত হয়েছে?’ তিনি বলেন, ‘মসজিদুল হারাম।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘তারপর মসজিদুল আকসা।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের?’ তিনি বললেন, ‘৪০ বছরের।’
(ইবনে মাজাহ)

মিরাজের রাতে রাসূল (সা.) সকল নবী-রাসূলকে নিয়ে আল-আকসা মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেছিলেন। রাসূল (সা.) এর ইমামতিতে এই নামাজ আদায় করা হয়।

পূর্ব জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদের ভেতর ইসরাইলি বাহিনীর সদস্যরা।

বর্তমানে প্রায় সারা বছরই এমনকি পবিত্র রমজান মাসেই অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে তাণ্ডব চালাচ্ছে ইসরাইল।
মসজিদের ভেতরে ঢুকে নামাজরত ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের ওপর হামলা করেছে, ছুড়েছে টিয়ার গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড। হাজার হাজার শিশু, নারীসহ নিরিহ মুসলিমদের উপর নির্যাতন করছে ।

মসজিদ আল মা’শার আল হারাম (Al-Mashʿar Al-Ḥarām) মুজদালিফা

মক্কা, প্রাচীনতম একটি মসজিদ।
মসজিদ আল-মা’শার আল-হারাম, যাকে পবিত্র স্থাপনা ও স্মৃতিস্তম্ভও বলা হয়, এটি মক্কার কাছে মুজদালিফায় একটি খোলা ছাদ বিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদটিক ব্যাপারে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং এটি বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত। তবে এটি কখন প্রথম নির্মিত হয়েছিল তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যায় না।

এই স্থানটি হজ্জ্বের কর্যাবলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বহন করে। কাবায় হজ্জের নির্দিষ্ট কার্যাক্রমের পর হজ্জযাত্রীরা মিনায় যাত্রা করে এবং আল-মাশর আল-হারামে চলে যায়। তারা মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করে এবং মুজদালিফায় রাত কাটায়। পরদিন তারা মিনায় যায় এবং মুজদালিফায় ফিরে ফজরের নামাজ আদায় করে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

মসজিদ আস সাহাবা (Mosque of the Companions)

ইরিত্রিয়া, ৬১৩ সালে নির্মিত।
মসজিদ আস-সাহাবা বা সাহাবাগণের মসজিদ ইরিত্রিয়ার বন্দর নগরী মাসাোোয়াতে অবস্থিত। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে ৬১৩ সালে নির্মিত মসজিদটিকে আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম মসজিদ বলে মনে করা হয়। মসজিদটি মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করে আসা সাহাবা কেরামগণের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। বর্তমান স্থাপনাটি অনেক পরে নির্মিত হয়েছে কারণ কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন মেহরাব (সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে) এবং মিনার (নবম শতাব্দী পর্যন্ত) ইসলামী স্থাপত্যশৈলীতে তখন পর্যন্ত বিকাশ লাভ করেনি।

মসজিদে নাজ্জাশি বা নাজাশি (Al Nejashi Mosque)

ইথিওপিয়া, ৬১৪ সালে নির্মিত।
ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে ৭৯০ কিলোমিটার দূরে, টিগ্রের ঐতিহাসিক নেগাশ গ্রামে বাদশাহ নাজ্জাশির স্মৃতিবিজড়িত আল-নাজ্জাশি মসজিদ অবস্থিত। স্থানীয় মুসলিমরা এই মসজিদকে ‘দ্বিতীয় মক্কা’ বলে থাকে। ইসলামের অন্যতম প্রাচীন এই মসজিদ ৬১৪ -১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়।

প্রাথমবার হযরত মুহাম্মদ সা. এর ১৫ জন সাহাবী এই এলাকায় হিজরত করে এসেছিলেন এবং আবিসিনিয়ার রাজা তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা করেছিলেন। দ্বিতীয়বার প্রায় ১০১ সাহাবীর আরেকটি দল হিজরত করে এখানে এসেছিলেন। তাদের দাওয়াতের দ্বারাই আফ্রিকায় ইসলামের প্রসার ঘটে।

পৃথিবীর প্রথম মুসলিম বাদশাহ নাজ্জাশি এই মসজিদের পাশেই সমাহিত আছেন। মসজিদের পেছনের বিখ্যাত ‘সাহাবা সড়ক’ পেরোলেই নাজ্জাশিসহ ১৫ জন সাহাবির কবরস্থান। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকার পর, ২০১৮ সালে তুর্কি সাহায্য সংস্থা ‘টিকা’র সহায়তায় ঐতিহাসিক মসজিদটির পুনর্নির্মাণ ও আধুনিকায়ন করা হয়। মুসলিম পর্যটকদের কাছে এটি প্রিয় স্থান। প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক এই ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শন করেন।

মসজিদে ক্বিবলাতাইন (Masjid al-Qiblatayn)

জেইলা, সোমালিয়া। ৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত।
মসজিদ আল-কিবলাতায়ন হলো আফ্রিকায় মহানবী হসরত মুহাম্মদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ কর্তৃক প্রেরীত (হিজরতকৃত) ইসলামের প্রথম দিকের সাহাবীদের দ্বারা নির্মিত তিনটি প্রাচীনতম মসজিদের মধ্যে একটি।

মদিনার মসজিদ আল-কিবলাতায়নের সাথে সোমালিয়ার এই মসজিদে কিবলাতাইনের বিভ্রান্তি নিরসনে বলে রাখা দরকার যে, মসজিদ দুটি আলাদা। সোমালিয়ার মসজিদটি ৬১৫ সালে ও মদীনার মসজিদটি ৬২৩ সালে নির্মিত হয়েছে। দুটি মসজিদেই ২ টি ক্বিবলা বা নামাজের দিক থাকায় এদের নাম এমন হয়েছে।

মসজিদটি সোমালিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আওদাল অঞ্চলের জেইলা শহরে অবস্থিত একটি মসজিদ। এই মসজিদটি লাবো-কিবলা মসজিদ নামেও পরিচিত। ৭ম শতকের প্রথম দিকে কুরাইশ নেতাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জুলুম – নির্জাতন থেকে নিজেদের বাঁচাতে মহানবীর সা. পরামর্শক্রমে সাহাবীগণ মক্কা থেকে হিজরত করে আফ্রিকায় (আবিসিনিয়ায় যার বর্তমান নাম ইথিওপিয়া) চলে যান।

তারা পূর্বের আবিসিনিয়া, বর্তমান ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া এবং সোমালিয়াসহ বেশ কয়েকটি অংশে আশ্রয় নিয়েছিল সেই সাথে সে সব স্থানে মসজিদও নির্মাণ করেন । আফ্রিকায় প্রাচীন তিনটি মসজিদ এখনও বিদ্যমান; মসজিদ আল-কিবলাতাইন, আল নেজাশি মসজিদ এবং মসজিদ আশ-সাহাবাহ ।

বর্তমানে মসজিদটির বেশিরভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এই মসজিদে দুটি মিহরাব রয়েছে: একটি মক্কার দিকে উত্তরমুখী এবং অন্যটি উত্তর-পশ্চিম দিকে জেরুজালেমের ( মসজিদুল আকর ) দিকে মুখ করা। কাবা শরীফ মুসলমানদের বর্তমান কিবলা হওয়ায় কিবলা পরিবর্তনের পর থেকে ইমাম শুধুমাত্র উত্তরমুখী মিরহাবেই নামাজ পড়াতেন। এজন্য একে মসজিদুল কিবলাতাইন বলা হয় ।

মসজিদে কুবা (Quba Mosque)

মসজিদে কুবা হলো হযরত মুহাম্মদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ নির্মিত প্রথম মসজিদ। রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ মসজিদটির প্রথম ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর সাহাবীরা رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন।

কুবা একটি বিখ্যাত কূপের নাম। সময়ের পরিক্রমায় এ কূপকে কেন্দ্র করে যে জনবসতি গড়ে উঠেছে, তাকেও কুবা বলা হতো। এরই সূত্রে মসজিদের নাম হয়ে যায় মসজিদে কুবা।

এই ছোট মসজিদটি মদিনা থেকে ৩.৫ মাইল দূরে কুবা গ্রামে নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তীতে মদিনা শহর সম্প্রসারিত হলে এই গ্রামকে শহরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মদীনায় হিজরত করার পর মুহাম্মদ কুলসুম বিন হাতেমের বাড়িতে ১৪ দিন অবস্থান করেন। পরে তিনি ওই স্থানে কুবা মসজিদ নির্মাণ করেন।

মসজিদে কুবা হল সেই মসজিদ যেখানে হযরত মুহাম্মদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এর ইমামতিতে প্রথম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রতি শনিবার হযরত মুহাম্মদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এই মসজিদে দুই রাকাত নামাজ পড়তে যেতেন। তিনি তার অনুসারীদেরকেও তাই করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, বলেছেন,
“যে ব্যক্তি নিজ বাড়িতে অযু করে এবং মসজিদে কুবায় আসে এবং সেখানে দুই রাকাত আদায় করে, তাকে একটি ওমরাহর সওয়াব দেওয়া হবে।”

পবিত্র কোরআনে কুবার অধিবাসী ও মসজিদে কুবার প্রশংসা করেন আল্লাহ তাআলা। তিনি বলেন,
‘যে মসজিদ প্রথম দিন থেকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে অবস্থান করা আপনার জন্য অধিক সঙ্গত। সেখানে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা পবিত্রতা পছন্দ করে। আর আল্লাহ পবিত্র ব্যক্তিদের ভালোবাসেন।’
(সুরা তওবা, আয়াত : ১০৮)

মসজিদে নববী (Al-Masjid an-Nabawi)

মদীনা, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত।
মসজিদে নববী যা নবীর মসজিদ নামেও পরিচিত, মদিনায় হিজরতের পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. দ্বারা নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ ( ১ম নির্মিত মসজিদ – মসজিদে কুবা)। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ এবং ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত। গুরুত্বের দিক থেকে মসজিদুল হারামের পর মসজিদে নববীর স্থান।

ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত,
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার এ মসজিদে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মসজিদে হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদে এক হাজার নামাজ আদায় করার চেয়েও উত্তম।’
-(বুখারী : ১১৯০; মুসলিম : ১৩৯৪)

যে জমিতে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল সেটি সাহল ও সুহায়েল নামে দুই এতিম যুবকের । হযরত মুহাম্মদ সা. মদিনায় পৌঁছানোর আগে, জায়গাটি কবরস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সাহল এবং সুহেল যখন জানতে পারলেন যে হযরত মুহাম্মদ সা. মসজিদের জমি খুঁজছেন, তারা এটি উপহার হিসাবে অফার করে। তিনি এতিম ভাইদের অর্থের প্রয়োজন বুঝতে পেরে মূল্য পরিশোধের জন্য জোর দেন। পরে আবু আইয়ুব আল-আনসারী রা. রাসূল সা. এর পক্ষে অর্থ প্রদান করেন। মূলত মসজিদটি একটি উন্মুক্ত ভবন ছিল যা একটি ধর্মীয় বিদ্যালয়, আইন আদালত এবং ইসলামের অনুসারীদের জন্য একটি মিলনস্থল হিসাবে ব্যবহৃত হত।

পরবর্তীকালের মুসলিম শাসকরা মসজিদ সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করেছেন। উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে সম্প্রসারণের সময় হযরত মুহাম্মদ সা. এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম দুই খলিফা হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রা. এর সমাধি মসজিদের অংশ হয়। মসজিদের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত সবুজ গম্বুজ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটি রাসূল সা. এর স্ত্রী হযরত আয়শা রা. এর বাড়ি ছিল।

এই গম্বুজের নিচেই হযরত মুহাম্মদ সা. এবং তার পরবর্তী শাসক দুইজন সমাধি রয়েছে। ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দে কবরের উপর একটি কাঠের গম্বুজ নির্মিত হয়। এটি পরবর্তীতে ১৫শ শতাব্দীতে কয়েকবার এবং ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে একবার পুনর্নির্মিত ও সৌন্দর্য‌বর্ধি‌ত করা হয়। বর্তমান গম্বুজটি ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ কর্তৃক নির্মিত হয়। এবং ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সবুজ রং করা হয় ফলে এর নাম সবুজ গম্বুজ হয়েছে।

সুলতান প্রথম আবদুল মজিদ ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ পুনর্নির্মাণ শুরু করেন। এতে মোট ১৩ বছর লেগেছিল। মূল উপকরণ হিসেবে লাল পাথরের ইট ব্যবহার করা হয়। মেঝে ১২৯৩ বর্গ মিটার বৃদ্ধি করা হয়। দেয়ালে ক্যালিগ্রাফিক শৈলীতে কুরআনের আয়াত উৎকীর্ণ করা হয়। মসজিদের উত্তরে কুরআন শিক্ষার জন্য মাদরাসা নির্মিত হয়।

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের মধ্যে এখানেই সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়।

সংগ্রহিত


Exit mobile version