অনেক অমুসলিম ও নাস্তিককে বলতে শোনা যায় যে, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হিন্দুরা দাবী করে যে, হিন্দুধর্ম হল, পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম। কারণ এটি প্রাচীনযুগে আর্বিভূত হয়েছে। তাই তারা একে সনাতন ধর্ম (চিরন্তন নিয়ম বা চিরন্তন পথ) বলে আখ্যায়িত করে। অনেকে আবার ইহুদি ও খৃষ্টানকে আল্লাহর নাজিল কৃত ধর্ম মনে করে। কিন্তু কুরআনের আলোকে এসব দাবীর সাথে সত্যতার ন্যূনতম সম্পর্ক নাই।
তাই আমরা এখন জানবো পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও প্রাচীনতম ধর্ম কোনটি এর প্রবর্তক কে এবং অন্যান্য ধর্মগুলো কিভাবে সৃষ্টি হল:
মানব জাতির কাছে বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত চূড়ান্ত ও নির্ভুল গাইডবুক ও আসমানি কিতাব হল, আল কুরআন- যা অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে অদ্য বধী রয়েছে অবিকল ও অবিকৃত। এই কুরআন দ্বারা প্রমাণিত যে, প্রথম মানুষ আদম আ. থেকে শুরু করে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী ও রসুলের দীন বা ধর্ম/জীবনাদর্শ ছিল একটি। তা হল, ইসলাম। অর্থাৎ কাল পরিক্রমায় আল্লাহর দেয়া একমাত্র জীবন আদর্শ হল, ইসলাম। ইসলাম ছাড়া পৃথিবীতে অতীতে বা বর্তমানে যত ধর্ম ছিল বা আছে সবই মানব রচিত কিংবা ইসলাম থেকে বিচ্যুত ও বিকৃত ধর্ম।
এ প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদিসের বক্তব্য তুলে ধরা হল:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّـهِ الْإِسْلَامُ ۗ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ
"নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম এবং যাদের প্রতি কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও ওরা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষ বশত:।"1
আল্লাহ আরও বলেন,
وَقُل لِّلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ ۚ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوا
“আর আহলে কিতাবদের এবং নিরক্ষরদের বলে দাও যে, তোমরাও কি ইসলাম কবুল করেছো? (আত্মসমর্পণ করেছ)? তখন যদি তারা ইসলাম কবুল, তবে সঠিক পথ প্রাপ্ত হলো।”2
মহামহিম আল্লাহ ইবরাহিম আ. এর রেখে যাওয়া তাওহীদ ভিত্তিক ও শিরক মুক্ত জীবনাদর্শ ইসলামকেই সত্যের পথ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। তিনি বলেন,
وَقَالُوا كُونُوا هُودًا أَوْ نَصَارَىٰ تَهْتَدُوا ۗ قُلْ بَلْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۖ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
"তারা বলে, তোমরা ইহুদী অথবা খ্রিষ্টান হয়ে যাও, তবেই সুপথ পাবে। আপনি বলুন, কখনই নয়; বরং আমরা ইব্রাহীমের আদর্শের আছি যাতে বক্রতা নেই। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।"3 আর একথায় কোন সন্দেহ নাই যে, ইবরাহিম আ. মুসলিম ছিলেন।4
মহান আল্লাহ প্রত্যেক নবী-রসূলকে এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যে তারা যেন, মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদত করার এবং শিরক থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। এই হল, ইসলামের মর্মবাণী ও মূলমন্ত্র এবং এটাই হল, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ এর মর্মার্থ।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّـهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
"আমি প্রত্যেক জাতীর মধ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত (আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর ইবাদত করা হয়) থেকে দূরে থাক।"5
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الْأَنْبِيَاءُ إِخْوَةٌ لِعَلَّاتٍ أُمَّهَاتُهُمْ شَتَّى وَدِينُهُمْ وَاحِدٌ
‘‘নবীগণ পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই। তাদের মাতা বিভিন্ন কিন্তু দ্বীন একটিই।”6
এখানে দ্বীন বলতে তাওহীদ উদ্দেশ্য, যার প্রতি আহ্বান জানানোর উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তাআলা সকল নবী-রসূলকে প্রেরণ করেছেন এবং সকল আসমানি কিতাবের মূল বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।
মহান আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে যুগ পরম্পরায় তাঁর মনোনীত নবী-রসুলগণকে এবং তাদের প্রতি যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন তাদেরকে ‘মুসলিম’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
নিম্নে কতিপয় উদাহরণ পেশ করা হল:
- নূহ আলাইহিস সালাম মুসলিম ছিলেন।7
- ইবরাহিম আ. ও ইয়াকুব আ. নবী মৃত্যুর পূর্বে তার সন্তানদেরকে ইসলামের পথে অবিচল থাকার ওসিয়ত (অন্তিম উপদেশ) দিয়েছেন।8
- ইবরাহিম আ. ও ইসমাইল নিজেদের এবং তার বংশধরকে ইসলামের উপর অবিচল রাখার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেছেন।9
- ইবরাহিম আ. ইহুদি বা খৃষ্টান নয় বরং মুসলিম ছিলেন।10
- ফেরাউনের যাদুকররা মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু বরণের জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করেছেন।
- মুসা আলাইহিস সালাম বনি ইসরাইলের মুমিনদেরকে লক্ষ করে বলেছেন, তেমারা মুসলিম হলে আল্লাহর প্রতি ভরসা করো।11
- সুলাইমান আ. সাবার রাণী বিলকিস ও তার অনুসারীদেরকে মুসলিম হিসেবে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে তার কাছে হাজির হতে ফরমান জারি করেছেন।12
- আল্লাহ তাআলা লুত আ. এর বাড়িকে মুসলিমদের বাড়ি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।13
- ঈসা আলাইহিস সালাম এর সঙ্গী হাওয়ারিগণ তাকে সাক্ষী রেখে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছেন।14
এ মর্মে আরও অনেক প্রমাণ রয়েছে।
যদিও কাল পরিক্রমায় মানুষের অবস্থা, চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ইসলামের শাখা গত বিধিবিধানে ভিন্নতা ছিল। কিন্তু মৌলিক বিশ্বাস ও মূলনীতিতে কোন পার্থক্য ছিল না।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ
‘‘তোমাদের প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট শরীয়ত ও নির্দিষ্ট পন্থা নির্ধারণ করেছি। আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তবে অবশ্যই তোমাদের সকলকে একই উম্মত করে দিতেন; কিন্তু তিনি এরূপ করেন নি। যাতে তোমাদেরকে যে বিষয় প্রদান করেছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। সুতরাং তোমরা কল্যাণসমূহের দিকে দ্রুত অগ্রসর হও।”15
প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. (شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا) এর ব্যাখ্যায় বলেন, “এখানে শরিয়ত ও পন্থা বলতে সুন্নত ও জীবন চলার পথ উদ্দেশ্য।”
মুজাহিদ, ইকরিমা, হাসান বাসরি, কাতাদা, যাহ্হাক, সুদ্দি এবং আবু ইসহাক সুবাইঈ থেকেও অনুরূপ কথা বর্ণিত আছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির) কিন্তু মানুষ নিজেরা আল্লাহর দীন ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেরাই বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদ তৈরি করে দিয়েছে।
অতীত ও বর্তান যুগের কতিপয় মানব রচিত, বিকৃত ও ভ্রান্ত ধর্ম:
Table of Contents
ইব্রাহিমিয় ধর্ম:
- খ্রিস্ট ধর্ম
- ইহুদি ধর্ম
- দ্রুজ ধর্ম
- মান্দাই ধর্ম
ভারতীয় ধর্ম:
- হিন্দু ধর্ম
- বৌদ্ধ ধর্ম
- জৈন ধর্ম
- শিখ ধর্ম
- শাক্ত ধর্ম
ইরানী ধর্ম:
- জরথুস্ত
- বাহাই ধর্ম
- ইয়াজিদি
- মাজদাক
- আল ই হক
পূর্ব এশীয় ধর্ম:
- কনফুসীয় ধর্ম
- শিন্তো ধর্ম
- তাওবাদ
- জেন ধর্ম
- হোয়া হাও
- ক্যাও দাই
অন্যান্য প্রাচীন ধর্ম:
- প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম
- আর্য ধর্ম
- সামারিতান
- প্রাচীন গ্রিক ধর্ম
(ধর্মের নামগুলো উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত)
মোটকথা, পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও প্রাচীনতম ধর্ম/জীবন চলার পথ হল, ইসলাম। এ ছাড়া ছাড়া যত ধর্ম ও মতবাদ পৃথিবীতে ছিল বা আছে সবই ভ্রান্ত, বিকৃত ও মানব রচিত। আল্লাহ মানব জাতির জন্য কখনো এতগুলো ধর্ম নাজিল করেননি। ইসলাম ছাড়া প্রতিটি ধর্মের প্রবর্তক এক বা একাধিক ব্যক্তি সমষ্টি। কিন্তু ইসলামের প্রবর্তক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা অন্য কোন মানুষ নয় বরং তা এসেছে আসমান-জমিনের অধিপতি, সমগ্র বিশ্বচরাচরের একচ্ছত্র সৃষ্টিকর্তা ও একক স্বত্বা, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, যুগে যুগে মানবজাতি শয়তানের প্ররোচনা ও কু প্রবৃত্তির তাড়নায় আল্লাহর তাওহিদ বা একত্ববাদের পথ থেকে সরে গিয়ে তাঁর সাথে শিরক (অংশী স্থাপন) করেছে এবং শয়তান প্রবর্তিত পন্থা কিংবা নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিতে আল্লাহ ছাড়া অন্য ব্যক্তি বা বস্তুর পূজা-অর্চনা শুরু করেছে।
আল্লাহ তাআলা বিশ্বমানবতাকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনাদর্শ ও মুক্তির পথ ইসলামের সুমহান আদর্শকে বোঝার, গ্রহণ করার ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন।
আমিন।
- সূরা আলে ইমরান: ১৯ ↩︎
- সূরা আলে ইমরান: ২০ ↩︎
- সূরা বাকারা: ১৩৫ ↩︎
- দেখুন: সূরা আলে ইমরান: ৬৭ ↩︎
- সূরা আন নাহল: ৩৬ ↩︎
- বুখারি, অধ্যায়: কিতাবুল আম্বিয়া ↩︎
- সূরা ইউনুস: ৭২ ↩︎
- সূরা বাকারা: ১৩১, ১৩২ ও ১৩৩ ↩︎
- সূরা বাকারা: ১২৮ ↩︎
- সূরা আলে ইমরান: ৬৭ ↩︎
- সূরা ইউনুস: ৮৪ ↩︎
- সূরা নামল: ৩১ ↩︎
- সূরা যারিয়াত: ৩৬ ↩︎
- সূরা আলে ইমরান: ৫২ ও সূরা মায়িদা: ১১১ ↩︎
- সূরা মায়িদা: ৪৮ ↩︎