Q/AAbdullahil Hadi

প্র্যাঙ্ক ভিডিও: ইসলামি দৃষ্টিকোণ এবং প্রচলিত আইন

আজকাল একশ্রেণীর ইউটিউবার ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিউ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন ও জনপ্রিয়তা পাওয়ার ধান্ধায় তথাকথিত প্র্যাঙ্ক বা ফান কিংবা সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট এর নামে গোপন ক্যামেরার সাহায্যে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ভিডিও ধারণ করে সেগুলো ইউটিউবে আপলোড দেয়। এ ক্ষেত্রে মানুষকে বোকা বানানোর জন্য তাদের সাথে এমন সব আচরণ ও কার্যক্রম করা হয় যা ভুক্তভোগীকে মান-সম্মানহানি ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়।

কিছু উঠতি বয়সের বিকৃত রুচির তরুণ-তরুণীর এসব কার্যক্রম বর্তমানে বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্র্যাঙ্ক ভিডিওগুলোতে কী থাকে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে তার বিধান কি?

এসব কথিত প্র্যাঙ্ক ভিডিওগুলোতে সাধারণত যে সব কন্টেন্ট থাকে সে আলোকে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটি হারামগুনাহের কাজ। শুধু তাই নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

যেমন:

১. এতে টার্গেট কৃত ব্যক্তির সাথে ইউটিউবার নানা ধরণের মিথ্যা কথা বলে তাকে বোকা বানায়। বরং মিথ্যা ও প্রতারণা মূলক কথাবার্তা ছাড়া প্র্যাঙ্ক ভিডিও তৈরি হয় না বললেই চলে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে হাসি-মজাকের ছলেও মিথ্যা কথা বলা হারাম

বাহয ইবনু হাকীম তার পিতা হতে বর্ণনা করেন। তার দাদা বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি

وَيْلٌ لِمَنْ يُحَدِّثُ فَيَكْذِبُ لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَهُ.
“সে ব্যক্তির জন্য ধ্বংস নিশ্চিত, যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে। তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস।” [তিরমিযি হা/২৩১৫; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪২০৯; মিশকাত হা/৪৮৩৪, হাদিসটিকে আলবানি হাসান বলেছেন]

তিনি আরও বলেছেন,

وَبِبَيْتٍ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا
“আর যে ব্যক্তি হাসি-মজাকের ছলেও মিথ্যা বলে না আমি তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘরের জিম্মাদার হবো।” [সুনান আবু দাউদ, অধ্যায়: ৩৬/ শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ৮. উত্তম চরিত্র সম্পর্কে-সনদ হাসান]

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি করা হারাম। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

« مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا »
“যে আমাদেরকে ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (সহিহ মুসলিম: ১০১) অর্থাৎ সে ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুত।

২. এসব ভিডিও এর নামে মানুষকে নানাভাবে ভীত-ত্রস্ত করা হয়। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষকে ভীত-ত্রস্ত করা হারাম। যেমন: কখনো মুখোশ পরিধান করে, কখনো পুলিশ বা ডাকাত সেজে, কখনো নকল সাপ বা হিংস্র প্রাণী ইত্যাদি দ্বারা ভুক্তভোগীকে আতঙ্কিত করা হয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لا يَحِلُّ لمسلمٍ أن يُرَوِّعَ مسلمًا
“কোনও মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়।” [সহিহুল জামে-লিল আলবানি, হা/৭৬৫৮]

এরা অনেক সময় কুকুর-বিড়াল ইত্যাদি নিরীহ প্রাণীকেও নানাভাবে আতঙ্কিত করে। ইসলামে এটিও জায়েজ নাই।

৩. এসব ভিডিওর মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (privacy) ভঙ্গ করা হয় বা ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে হরণ করা হয়। অথচ তা শুধু ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম নয় বরং দেশীয় বা আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধের শামিল। (এ সংক্রান্ত আইন ও শান্তি দেখুন পোস্টের শেষে)

৪. অনেক সময় ভুক্তভোগীর সামনে বিভিন্ন অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গি করা হয় এবং তার সাথে অশালীন আচরণ করা হয় যার ফলে তাকে মারাত্মক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

৫. সমাজে অশ্লীলতাকে উস্কে দেয়া হয়। যেমন: হঠাৎ কোনও তরুণীকে চুমু খাওয়া, কোনও নারীকে জড়িয়ে ধরা, হঠাৎ কাউকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়া, নারীর শরীরে মেসেজ করা ইত্যাদি।

৬. সমাজে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ বিরোধী কার্যক্রমের প্রসার ঘটে।

৭. এসব ভিডিওতে বেপর্দা নারী প্রদর্শনী করা হয় (যা ইসলামে হারাম) বরং নারীরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ভিডিও এর প্রধান উপজীব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
“যারা পছন্দ করে যে, ইমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।” [সূরা নূর: ১৯]

৮. প্র্যাঙ্ক ভিডিওগুলোতে সাধারণত: মিউজিক বা বিভিন্ন গানের রিমিক্স যুক্ত করা হয়ে থাকে।

এসব নামধারী মুসলিম ইউটিউবার এবং তাদের শ্রোতারা যেন গান-বাজনাকে হালাল মনে করে নিয়েছে। অথচ ইমরান ইবনে হুসাইন রা. হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“‏ فِي هَذِهِ الأُمَّةِ خَسْفٌ وَمَسْخٌ وَقَذْفٌ ‏”‏ ‏.‏ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَتَى ذَاكَ قَالَ ‏”‏ إِذَا ظَهَرَتِ الْقَيْنَاتُ وَالْمَعَازِفُ وَشُرِبَتِ الْخُمُورُ
“ভূমিধ্বস, চেহারা বিকৃতি এবং পাথর বর্ষণস্বরূপ আজাব এ উম্মতের মাঝে ঘনিয়ে আসবে। জনৈক মুসলিম ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! কখন এসব আযাব সংঘটিত হবে? তিনি বললেন, যখন গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র বিস্তৃতি লাভ করবে এবং মদ্যপানের সয়লাব শুরু হবে।”
[সুনান আত তিরমিযি (তাহকীককৃত), অধ্যায়: ৩১/ কলহ ও বিপর্যয়, পরিচ্ছেদ: ৩৮. আকৃতি পরিবর্তন ও ভূমি ধসের আলামত অবতীর্ণ হবে-হাসান-সহীহাহ, হা/১৬০৪)]

৯. মজার ছলে মানুষের মান-সম্মান নিয়ে টানা-হেঁচড়া করা বা তাদেরকে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। এতে বিশেষভাবে নারীরা বিভিন্নভাবে ‘ইভ টিজিং’ এর শিকার হয়। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

‏ الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ ‏
“এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না, তাকে অপদস্থ করবে না এবং হেয় করবে না।”

তিনি আরও বলেন,

‏ بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ ‏
“একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে হেয় করে। এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের রক্ত ঝরানো, ধন-সম্পদ হরণ করা এবং মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত করা হারাম।”
[সহীহ মুসলিম (ইফা) ৪৭/ সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার]

১০. প্র্যাঙ্ক ভিডিও করতে গিয়ে অনেক সময় নানা দুর্ঘটনা ঘটে। যেমন: দৌড়াতে গিয়ে আঘাত প্রাপ্ত বা রক্তাক্ত হওয়া, ভয়ে-আতঙ্কে হার্ট এ্যাটাক করা, রোগ বৃদ্ধি পাওয়া, মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি।

১১. মানুষের মনোযোগ ব্যাঘাত ঘটানো বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে সময় নষ্ট করা। কারণ প্রাঙ্ক ভিডিওর নামে এসব তথাকথিত ইউটিউবাররা যে কোনও সময় যে কারও সাথে তাদের শয়তানি কার্যক্রম শুরু করতে পারে। এতে ব্যক্তি কোনও বিষয়ে নিমগ্ন থাকলে তার মনোযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে বা দরকারি কাজে সময় নষ্ট করে।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও উবাদাহ ইবনুস সামিত রা. থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ
‘‘তোমরা নিজের বা অন্যের ক্ষতি করতে পারবে না।” [ইবনে মাজাহ্ ২৩৬৯, ২৩৭০]

১২. এসব ভিডিও ইউটিউবে আপলোড দিয়ে অর্থ উপার্জন করাও হারাম। কারণ এতে অনেক ধরণের হারাম ও অশ্লীল পণ্যের এড প্রদর্শনী এবং গান-বাজনা, মিউজিক ও বেপর্দার নারীর প্রদর্শনী থাকে।

সুতরাং এসব কারণে তথাকথিত প্র্যাঙ্ক ভিডিও তৈরি ও প্রদর্শন থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।

মনে রাখতে হবে, যত মানুষ ইউটিউব বা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এসব ভিডিও দেখে গুনাহগার হবে তত পরিমাণ মানুষের সমপরিমাণ গুনাহের ভাগীদার হবে যারা এসব ধারণ করেছে, ইডিট করেছে, ইন্টারনেটে আপলোড করেছে বা এ ক্ষেত্রে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে।

প্রাঙ্ক ভিডিও বিষয়ে আইনগত শাস্তি:

প্রাঙ্ক ভিডিও বা স্থিরচিত্র ব্যক্তির জন্য মানহানিকর দণ্ডবিধির (১৮৬০) ধারা ৪৯৯, ৫০০ অনুযায়ী। দণ্ডবিধির ধারা ৫০০ অনুযায়ী প্রাঙ্ক ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণকারীর ২ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৮ এবং ২৯ অনুযায়ী প্রাঙ্ক ভিডিও ধারণ অপরাধ, কেননা এটি ব্যক্তির জন্য মানহানিকর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ভিডিও ধারণকারীর ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। [Source: lawyersclubbangladesh]

উপরোক্ত কারণ সমূহের আলোকে প্রাঙ্ক ভিডিও ধারণ করা, আপলোড করা এবং বিনোদনের জন্য সেগুলো দেখা সবই হারাম।

সুতরাং আমাদের কর্তব্য, এ এসব তথাকথিত ‘প্রাঙ্ক ভিডিও’ এর বিরুদ্ধে গণজনসচেতনতা বৃদ্ধি করা আর প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলরা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য হল, এসব অর্থলোভী ও বিকৃত রুচির যুবক-যুবতিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহন ও তার যথার্থ বাস্তবায়ন করা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture