প্রত্যাবর্তন

আয়নার সামনে বসে টানা দুই ঘন্টা সময় নিয়ে সাজুগুজু করলো চম্পা। কপাল বরাবর লাল টিপটা তার সৌন্দর্যকে কয়েক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। শেষমেশ মুচকি হেসে নিজেকে কেমন লাগছে তা দেখে নিলো।
চম্পা মনে মনে বলল— আরেহ, আমি এতো সুন্দরী হলাম কবে!

চম্পার এই নিখুঁতভাবে সাজার পেছনে কারণ হচ্ছে নব্য প্রেম। গত মাসে ফেইসবুকে সায়মন নামের একজন ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছে তার। আজকে তাদের প্রথম দেখা হওয়ার তারিখ।
রেডি হয়ে রুমমেট শিমলাকে গিয়ে বলল “দেখত আমায় কেমন লাগছে?

শিমলা বলল “বাহ, তুই যে এত সুন্দরী আমি তো এর আগে খেয়ালই করিনি!
চম্পা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল “সারাদিন বই পুস্তক আর রুমে ঘাপটি মেরে বসে থাকলে বুঝবি কি করে?
শিমলা কিছু বলল না।
‘আমি গেলাম’ বলে চম্পা নিচে নেমে গেল।
রিকশায় উঠে অকারণেই বারবার ঠোঁট চেপে হাসছে চম্পা। ভাবছে সায়মনের কথা।

এত অল্প সময়ের মধ্যে তাদের প্রেমটা হয়ে যাবে এটা সে কল্পনাও করেনি। এতো স্মার্ট একটা ছেলে সায়মন, সে ওর প্রেমে পরবে? এটা ভাবা যায় না। কিন্তু হল ঠিক তার বিপরীত। সায়মনের কথা শুনে মনে হয় চম্পা নয় যেন সায়মনই তাকে বেশি পছন্দ করে। বিষয়টা চম্পার কাছে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পাওয়ার মতো ছিল।

ফোনে, মেসেঞ্জারে, ইমুতে একমাসের মতো কথাবার্তা হয়েছে তাদের। তারপর থেকে দেখা করার জন্য বারবার বায়না করছে সায়মন। চম্পার ইচ্ছে থাকলেও সায়মনের সাথে সে আগ্রহ দেখায়নি। তবুও সায়মনের জোরাজোরিতে সে রাজি না হয়ে পারলো না।

কথা ছিল তাদের দেখা হবে পার্কে। রিকশায় ওঠার পর সায়মন ফোন দিয়ে চম্পাকে একটা বাসার এড্রেস দিয়ে বলল “এখানে চলে এসো।

চম্পা কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো “বাসায় কেন?

সায়মন বলল “তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
“কি সারপ্রাইজ?
“বলে দিলে আর সারপ্রাইজ রইল কোথায়?
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আসছি।

ভয়, আতঙ্ক, বিষন্নতা, চোখের জল, সব মিলিয়ে চম্পার চেহারাটা একটা ভূতুড়ে পরিবেশ থেকে উঠে আসা কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানবের মতো লাগছে। শিমলার অনেক মায়া হচ্ছে, কিন্তু তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। এমন সিচুয়েশনে সুস্থ কিছু ভাবাও যায় না। সবকিছুই কেমন যেন ঘুলিয়ে যায়।

শিমলা মুখ খুলল “প্রাণে মেরে ফেলার কি দরকার ছিল?

চম্পা বললো “কি করবো তখন বুঝতে পারছিলাম না। ওই পশুটা আমার ওপর জোর করছিল। আমি শুধু তার কাছ থেকে ছুটে আসার জন্য ধাক্কা দিয়েছিলাম। চম্পা কাঁদো কাঁদো গলায় কথাগুলো বলে থামলো।

শিমলা বললো “তারপর?

চম্পা আবার বলতে থাকলো

“ফ্লোরে বঁটি ছিলো আমি জানতাম না। ধাক্কা খেয়ে ও বঁটির ওপর গিয়ে পরে যায়।

” তারপর?

“তারপর মাথায় বঁটির অনেকটা অংশ ঢুকে গিয়ে ছটফট করতে করতে মারা যায়। তখন আমার কি-ই বা করার ছিল বল? আমি বোকার মতো কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে তারপর চলে এলাম। এইটুকু পথ কিভাবে যে এলাম আমি নিজেও বলতে পারব না।

শিমলা কিছু বললো না।

চম্পা আবার বললো “আমার মনে হচ্ছে পশুটা মরে গিয়ে ভালো হয়েছে। এসব ছেলেদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ওরা মানুষরূপী পশু ।

শিমলা বললো “শুধু ছেলাটারই দোষ, তোর দোষ ছিল না?

“আমার কি দোষ ছিল?

এখন এসব কথা রাখ। চল, ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খেয়ে নে। হেহারাটা কেমন মিইয়ে গেছে।

চম্পা অনেক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করে এলো। রুমে এসে মনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। যে মেয়েটার রক্ত দেখলেই মাথা ঘুরিয়ে পরে যাওয়ার অবস্থা হয়, সে কি-না আজ খুন করে চলে এসেছে?

চম্পা এটা ভাবতেই পারছে না। ইচ্ছে করছে মাথা থেকে এই চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলতে, কিন্তু পারছে না। বারবার রক্তমাখা লাশটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠছে।

শিমলার কথায় ঘুমানোর চেষ্টা করলো চম্পা। কিন্তু সে ঘুমোতে পারছে না। ঘুম যেন তাকে ছুটি দিয়ে চলে গিয়েছে। বাধ্য হয়ে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমাতে হল চম্পাকে। অনেক লম্বা ঘুম দিলো সে।

ঘুম ভাঙলো রাত দশটায়। চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে কানে। নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে নেমে এলো চম্পা। বেলকনিতে জায়নামাজ বিছানো। জায়নামাজের ওপর সিজদাহ্য় পড়ে কাঁদছে শিমলা।

রবের কাছে বান্ধবীর হেদায়াত চাইছে। বলছে

“রাব্বে কারীম, আপনি চম্পাকে হেদায়েত দিয়ে দিন, ওকে সঠিক পথে নিয়ে আসুন, আপনি ওকে পথহারা করে রাখিয়েন না। ফিরিয়ে দিন রব, ফিরিয়ে দিন।

কথাগুলো বলতে বলতে শিমলা ডুকরে কেঁদে উঠল। শিমলা যে এত কাঁদতে পারে চম্পার এটা জানা ছিল না। এভাবে কাঁদতে দেখলে যে কারও তার প্রতি মায়া লেগে যাবে।

সহসা চম্পা অনুভব করতে পারল তার চোখদ্বয় পানিতে ভরে উঠেছে। ভিতরে মনটাও কেমন যেন ছটফট করছে। ইচ্ছে করছে শিমলার সাথে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে শরিক করে নিতে। যেন কেঁদে কেঁদে সকল কষ্ট আর যাতনার পাহাড়গুলোকে শেষ করে দিতে পারে।

চম্পার হৃদয়ের সকল অসুস্থতা বরফের মতো গলে গলে চোখের পানির সাথে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। দুজন একসাথে অনেক্ষণ রবের দরবারে কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতে একসময় চম্পার মনে হল ভিতরটা একেবারেই হালকা হয়ে গিয়েছে। সবকিছুই যেন ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।

সকালে নিজেকে অনেকটা হালকা অনুভব করলো চম্পা। তার কাছে মনে হচ্ছে রবের দরবারে কাঁদার চেয়ে শান্তির কোন মুহূর্ত পৃথিবীতে নেই। কত শান্তির একটা মুহূর্ত। অথচ এই শান্তিকে ভুলে আবর্জনার স্তুপের ভিতর কতই না খুঁজেছে একটুখানি প্রশান্তির আবহাওয়া।

আফসোস হচ্ছে চম্পার। এই শান্তির সন্ধান সে এতদিন কেনো পায়নি?
শিমলার কথা সে এতদিন কেনো শুনেনি?
কেনো সে এতদিন শিমলাকে অবহেলা করেছে?
কেনো ধর্মান্ধ বলে অবজ্ঞা করেছে তাকে দিনের পর দিন? এইসব ভেবে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।

চম্পার সারাটাদিন কেটেছে অপেক্ষায়। কখন রাত আসবে, রবের দরবারে আবারো লুটিয়ে পড়বে। মনের কষ্টগুলোকে চোখের অশ্রুর সাথে ঝেড়ে ফেলে নিজেকে আবারো শিতল করে নিবে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আসলো রাত। অজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল চম্পা।

নিজের সবগুলো ভুল রবের দরবারে প্রকাশ করে করে চম্পা কান্না করছে। যতই কান্না করছে ততই নিজের জীবনের অপরাধগুলো যেন সামনে ভেসে আসছে।

চম্পা ভাবতো সে কোন ভুল পথে চলছে না, সে যে পথে চলছে আধুনিক যুগে একটা মেয়ের সে পথে চলাই উচিৎ। কিন্তু এখন তার চিন্তা পাল্টে গেছে। মনে হচ্ছে এতদিন সে ভুলের মধ্যে ছিল। অপরাধে ডুব দিয়ে রবের কাছ থেকে সে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।

কাঁদতে কাঁদতে জায়নামাজে ঘুমিয়ে গেল চম্পা। রাত শেষ হয়ে এল। ভোরের আলো উঁকি দিল বেলকনিতে। আঁধার পৃথিবী আবারো আলোকিত হতে শুরু করলো। শিমলা নামাজ শেষ করে বেলকনিতে এসে পেল চম্পাকে। ঘুমোচ্ছে চম্পা। মুখে হাসির রেখা সুস্পষ্ট। চেহারাটা আলোয় জ্বলজ্বল করছে। যেন জান্নাতী চেহারা। শিমলা ভাবলো ফজর পড়ে বোধহয় আবারো শুয়েছে চম্পা। ভোরের সূর্যটা কত মিষ্টি হয় তা চম্পাকে দেখানোর জন্য হাত ধরে ডাকলো শিমলা। কিন্তু সাথে সাথেই কেঁপে ওঠলো সে। সশব্দে বলে উঠলো

“ইন্না-লিল্লাহী ও ইন্না ইলাইহি রাজিউন”

লিখেছেন

মফস্বলে জন্ম, মফস্বলেই বেড়ে উঠা। লেখালেখি শখের একটি অংশ কেবল। তবুও দ্বীন নিয়ে লিখতে চাই সবটুকু দিয়ে। হতে পারে শখটা একদিন আকাশ ছুঁবে ইনশা আল্লাহ।
যবে লুকাইব ভুবন ছাড়িয়া খুঁজিস না কেহ হে আপন,
ভুলে যাইস তোরা আমারো কীর্তি মাটি খুঁড়িয়া দিস দাফন।

Exit mobile version