পলিটিকাল সীরাহ
হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্বে দূত হিশেবে মক্কায় যান উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু। কিন্তু, যাবার কথা ছিলো উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর।
কেনো উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু না গিয়ে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কায় যান?
হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্বে বিশাল বাহিনী নিয়ে কেনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার দিকে আসছেন এই ব্যাপারটি নিয়ে কুরাইশ উদ্বিগ্ন ছিলো। তারা কয়েকজন প্রতিনিধি পাঠায়।
ইতোপূর্বে কুরাইশ এবং মদীনাবাসীর মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে। বদর, উহুদ, খন্দক যুদ্ধের পর হুদাইবিয়া। দুই পক্ষের সম্পর্ক ভালো ছিলো না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মক্কাবাসীকে অবহিত করতে প্রথমে প্রেরণ করতে চান উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে।
কিন্তু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু শ্রদ্ধার সাথে অপারগতা প্রকাশ করেন।
সীরাত পড়লে এমন কিছু উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে সাহাবীরা রাসূলের প্রস্তাবের বাইরে কাউন্টার প্রস্তাব দেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই প্রস্তাব যৌক্তিক হলে মেনে নেন।
এই প্রস্তাবটিও এমন এক প্রস্তাব ছিলো।
উমরা রাদিয়াল্লাহু আনহু আশঙ্কা প্রকাশ করেন-
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার আশঙ্কা হচ্ছে কুরাইশরা না জানি আমার ক্ষতি করে! ওদের সাথে আমার শত্রুতার কতা খুব মনে আছে। সেখানে আমার গোত্র বনু আদির এমন কেউ নেই যে আমাকে বাঁচাতে পারে। তবুও আপনি চাইলে আমি যেতে পারি।”
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এই কথার মাধ্যমে তিনটি বিষয় তুলে ধরেন।
১. তাঁর জীবনের আশঙ্কা।
২. সেখানে তাকে রক্ষা করতে পারে এমন কেউ নেই।
৩. এসব সত্ত্বেও যদি রাসূলুল্লাহ চান, তবে তিনি মেনে নিবেন; তাঁর কোনো আপত্তি নেই। অর্থাৎ, রাসূলের আনুগত্যের ব্যাপারে তাঁর কোনো কথা নেই।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আমরা যেমন সাহসী জানি, তাঁর এমন কথা শুনে কি তাঁর সাহস সম্পর্কে সন্দেহ জাগে? তিনি ঐখানে গেলে তো শহীদ হতে পারেন, আর কী?
এই ভয়ে রাসূলের নির্দেশের কাউন্টার প্রস্তাব দিবেন?
বিষয়টা এমন না। সাহাবীদের সাহস নিয়ে জানতে চাইলে যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে পারেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাহসিকতার এতো এতো উদাহরণ আছে যে, বলে শেষ করা যাবে না।
আমরা সাহাবীদের সাহস দেখি, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধিমত্তা দেখি না।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জানতেন যে, তিনি যদি মক্কায় যান, তাহলে সেখানে গিয়ে শান্তি চুক্তি বা শান্তি বার্তার বদলে সংঘর্ষ হবে। তাঁকে দেখামাত্র তারা আক্রমণ করবে, তিনিও বসে থাকবেন না। স্বাভাবিকভাবেই সেখান থেকে তাঁর ফিরে আসার সম্ভাবনাও নেই।
এই সফরে তাঁর মক্কায় যাওয়া মানে মূল উদ্দেশ্যই হাসিল হবে না। কিন্তু, যুদ্ধের ময়দানে তাঁর সাহসিকতার উদাহরণ আমরা দেখি, দেখি তিনি কীভাবে শত্রু মনে আতঙ্ক তৈরি করতেন।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুই প্রস্তাব করেন- সেখানে যেন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকেই প্রেরণ করা হয়।
কেননা, মক্কায় তখনো উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বংশধররা (বনু উমাইয়্যা) আছে এবং তারাই এখন মক্কার ক্ষমতায়। উসমান যদি মক্কায় যান, তাঁকে তারা আক্রমণ করবে না; এমনিতেই ব্যক্তি হিশেবে তারা তাঁকে পছন্দ করে।
উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন মক্কায় যান, দেখা যায় ঠিকই তাঁকে সম্মান দেখানো হয়। শুধু তাই না, তাঁকে প্রস্তাব দেয়া হয় তাওয়াফের। কিন্তু, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে তিনি তাওয়াফ করতে রাজি ছিলেন না।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কতোটা বুদ্ধিমান, রাজনীতি সচেতন, ডিপ্লোম্যাট ছিলেন এই একটি ঘটনায়ই বুঝা যায়।
তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ সরাসরি অমান্য করেননি। বরং জানিয়ে দেন- তবুও প্রস্তুত।
তিনি তাঁর পরিবর্তে এমন একজনকে প্রস্তাব দেন, যিনি তারচেয়েও ভালোভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখলে বুঝা যায় যে, তারা কনসিকুয়েন্স মাথায় রাখতেন। কী করলে কী হবে সেটা খুব ভালোভাবে খেয়াল রাখতেন।
‘যা হবার হোক’ এমনটা ভেবে তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতেন না।
রাজনীতিতে শুধুমাত্র সাহস দেখালেই হয় না, বুদ্ধির খেলাও খেলতে হয়।
উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর গোত্রের লোকজন অমুসলিম, কিন্তু তারা মক্কার ক্ষমতাবান। এজন্য তাঁকে প্রেরণ করা হয় যাতে কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু গেলে সেই সুযোগই ছিলো না।
উসমান রা. কে আক্রমণ করতে চাইলে অন্যরা বাধা দিবে। কিন্তু, উমরের রা. –এর জন্য কেউ বাধা দিবে না। সবাই একত্রিত হয়ে আক্রমণ করবে।
রাজনৈতিক দলগুলো যখন অন্য দেশের সাথে বা অন্য রাজনৈতিক দলের সাথে কোনো চুক্তি করতে চায় বা প্রস্তাব নিয়ে যায়, তখন দেখা যায় এমন কাউকেই সেখানে পাঠায় যার কথা ঐ দল/দেশ গুরুত্ব দেয়। যার কথার গুরুত্ব বিরোধী দল-মত-দেশের কাছেও আছে এমন কাউকেই এসব বিষয়ে নিযুক্ত করা হয়।
আপনি যদি রাজনীতি করেন, তাহলে সীরাতকে সবসময় সামনে রাখতে হবে। এখান থেকে প্রজ্ঞা শিখতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে ইসলামের বিজয় হয়েছে শারীরিক যুদ্ধের মাধ্যমে, বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধেও।
বদর, উহুদে শারীরিক যুদ্ধ। কিন্তু, খন্দক যুদ্ধে ৩জন সাহাবীর তিনটি বুদ্ধির কাছে সেই সময়ের ১০ হাজারের অধিক বাহিনী, যা তখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বাহিনী ছিলো, সেটা পরাস্ত হয়।
বদর, উহুদ, খন্দক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান মদীনায় আসেনি। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর মুসলিমরা অস্ত্রসজ্জিত হবার আগেই আবু সুফিয়ান মদীনাবাসীর কাছে ভিক্ষা চাইতে মদীনায় আসে! সে একটার পর একটা ঘরে যায় একটু সাহায্যের আশায়।
সেই হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিলো এক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াস, যার সাথে প্রাথমিকভাবে সাহাবীরা একমত ছিলেন না।
অথচ এটার ফলেই মক্কাবিজয় সহজ হয়।
অমুসলিম শাসকের মধ্যকার যুদ্ধে সাহাবীরা কি কোনো একপক্ষের বিজয় কামনা করতেন?
৮৩ জন সাহাবী রাজনৈতিক আশ্রয়ে তখন আবিসিনিয়ায়। আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো তিনি ন্যায়পরায়ণ।
মক্কার কুটনৈতিক তার কাছে যান সাহাবীদের ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু, সাহাবীদের যুক্তি শুনে নাজ্জাশী সাহাবীদের পক্ষেই থাকেন। আবিসিনিয়ায় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
হঠাৎ করে নাজ্জাশীর শাসন হুমকির মুখে পড়ে। একদল তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
সাহাবীরা জানতেন বিদ্রোহীরা ক্ষমতা দখল করলে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
তারা ছিলেন উদ্বিগ্ন। নদীর ওপারে যুদ্ধ হচ্ছে। যুদ্ধের নিউজ সংগ্রহ করার জন্য সাহাবীরা জিজ্ঞেস করেন- কে পারবে আমাদের জন্য যুদ্ধের সংবাদ নিয়ে আসতে?
সাহসী সাহাবী যুবাইর ইবনুল আউয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু সাঁতার কেটে ওপারে গেলেন। তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলেন যুদ্ধের পরিস্থিতি।
ফিরে আসলেন সুসংবাদ নিয়ে।
সবাই যখন শুনলো নাজ্জাশী বিজয়লাভ করেছেন, তখন আনন্দিত হলেন, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
নাজ্জাশীর জয়-পরাজয়ের ওপর নির্ভর করছিলো আবিসিনিয়ায় আশ্রয় নেয়া সাহাবীদের নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ।
নাজ্জাশী পরবর্তীতে ‘গোপন মুসলিম’ হন। তখন পর্যন্ত ছিলেন খ্রিস্টান।
দুই অমুসলিম শাসকের যুদ্ধে যৌক্তিকভাবেই সাহাবীরা একপক্ষের বিজয় কামনা করেন।
ইউ.এস ইলেকশনে মুসলিমদের অবস্থা সাহাবীদের মতো না। মানে, এতোটা স্পষ্ট না যে কোনো একজনকে সাপোর্ট করলে ইউ.এস মুসলিম বা বিশ্ব মুসলিম অনেক ভালো থাকবে।
যার ফলে দ্বিধা-সন্দেহ, আতঙ্ক অনেককিছুই কাজ করছে।
একজন অমুসলিম শাসক হিশেবে নাজ্জাশী যতোটা ন্যায়পরায়ণ ছিলেন, বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ শাসকদের মধ্যে সেই গুণটা নেই।
পবিত্র কুরআনে রোম-পারস্যের যুদ্ধের কথা আছে। আহলে কিতাবী হওয়ায় রোমের বিজয়ে মুসলিমদের আনন্দের কথারও উল্লেখ আছে।
অমুসলিম দেশের ক্ষমতার পরিবর্তনের ব্যাপারে মুসলিমরাও যে সচেতন থাকবে, ভালো কিছুর আকাঙ্খা করবে, কে ক্ষমতায় আসলে মুসলিমদের অবস্থা কেমন হবে সেই ক্যালকুলেশন যে করবে, এই শিক্ষা সীরাত থেকে পাওয়া যায়।
মক্কায় সাহাবীরা নির্যাতিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে আবিসিনিয়ায় যেতে বলেন। কেনো? সেখানে একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক আছে।
এই ঘটনা আমরা শুধু ঘটনার পরম্পরা হিশেবে সীরাতে পড়ে যাই।
আমরা কি চিন্তা করি এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা?
তিনি ইতোপূর্বে কখনো আবিসিনিয়ায় যাননি, সেখানকার শাসকের সাথে পত্রযোগেও তাঁর সম্পর্ক নেই।
সেখানে যে একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক আছেন সেটা তিনি জেনেছেন। সেটা ব্যবসায়ী, কূটনীতিক সাহাবীদের থেকে হোক বা ওহীর মাধ্যমে।
এখান থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হলো- বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা খুবই অনিশ্চিত।
পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মুসলিমদের রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে তাদের জন্য ‘আবিসিনিয়া’ এবং ‘নাজ্জাশী’ কে হবেন এই ব্যাপারে সচেতন থাকাটাই সীরাতের শিক্ষা।
স্পেনে ক্ষমতা হারানো মুসলিমদের জন্য এরকম দেশ ছিলো মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, তুরস্ক, লিবিয়া।
খিলাফত পতন পরবর্তী তুরস্কের ক্ষেত্রে এমন দেশ ছিলো জার্মানি যেখানে ৬ লক্ষের বেশি মুসলিম হিজরত করে।