পিতার অন্তিম মুহূর্তে
আয়েশার (রা:) বর্ণনায় রাসুলের (ﷺ) জীবনের শেষ মুহূর্তটি সত্যিই খুব স্পর্শকাতর। রাসুলের (ﷺ) মৃত্যুকে যে আঙ্গিক থেকেই বর্ণনা করা হোক না কেন, তা নতুন একটি স্তরের সংযোজন করে এবং সেই সমাজের জন্য তাঁর মৃত্যু কতটা গুরুত্ব বহন করেছিল তা প্রতীয়মান করে।
আয়েশা (রা:) বর্ণনা করেছেন সেই মুহূর্তগুলো যখন রাসুলের (ﷺ) জ্বর, ব্যথা, তাঁর অসুস্থতা এমন এক পর্যায়ে যে চেতন ও অবচেতনের মাঝে তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন, ঘামাচ্ছেন, জ্বরে তপ্ত হয়ে আছেন। সেই মুহূর্তে তিনি হাঁটতেও পারছিলেন না। এমন সময় ফাতিমা (রা:) ঘরে প্রবেশ করলেন।
প্রতিবার ফাতিমা (রা:) ঘরে প্রবেশ করলে রাসুল (ﷺ) কি করতেন?
উঠে দাঁড়িয়ে কন্যার হাত ধরে তিনি তাঁকে বসাতেন, কপালে চুমু খেয়ে তাঁকে সম্মান জানাতেন। এখন তিনি তা করতে পারছেন না, কারণ তিনি অসুস্থ। তিনি নড়াচাড়াও করতে পারছেন না। আয়েশা (রা:) বলেন রাসুল (ﷺ) উঠে বসতে চাইলেন এবং বললেন, “مرحبا بابنتي – আমার সুন্দর কন্যাকে স্বাগতম!”
তিনি হাসলেন, এবং মৃত্যুশয্যায় সেই বিশেষ মুহূর্তে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করলেন। কন্যাকে অভ্যর্থনা জানাতে তিনি উৎসাহিত হলেন। মৃত্যুর আগে জীবনের শেষ দিন গুলোর মধ্যে সেই মুহুর্তেই তাঁর শক্তি, সম্মান ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল নিজ কন্যাকে দেখে।
ফাতিমাকে (রা:) রাসুল (ﷺ) কাছে আসতে বললেন, ইশারায় তাঁকে তাঁর ডান পাশে বসতে বললেন। তিনি ফাতিমাকে (রা:) কানে কানে কিছু বললেন, এবং ফাতিমা (রা:) ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। রাসুল (ﷺ) আরো একবার ফাতিমাকে (রা:) সান্ত্বনা জানালেন এবং শান্ত হতে বললেন। আবারো তিনি কন্যাকে কিছু বললেন এবং এবার ফাতিমা (রা:) হাসতে শুরু করলেন। এরপর ফাতিমা (রা:) রাসুলকে (ﷺ) আলিঙ্গন করলেন। এই সেই শেষ আলিঙ্গন। ফাতিমা (রা:) খুশি মনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত, তাই না?
আয়েশা (রা:) ফাতিমাকে (রা:) জিজ্ঞেস করলেন,
“তিনি তোমাকে কি বলেছেন?”
ফাতিমা (রা:) বললেন, “এ কথা আমি আপনাকে বলব না, এটা আমার আর আমার বাবার মধ্যে গোপন একটা ব্যাপার।” বিশেষ একটা মুহূর্ত! তাঁর বাবা তাঁকে যা বলেছিলেন তিনি তা কাউকে বলতে চাইলেন না। পরবর্তীতে অবশ্য ফাতিমা (রা:) আয়েশাকে (রা:) বলেছিলেন, “আপনার কি মনে আছে, আপনি আমাকে কি জিজ্ঞেস করেছিলেন?”
আয়েশা (রা:) বললেন, “হ্যাঁ”। তখন তিনি আয়েশার (রা:) কাছে প্রকাশ করেছিলেন রাসুল (ﷺ) তাঁকে কি বলেছিলেন।
পিতা-কন্যা এক সাথে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। ফাতিমা (রা:) ছিলেন দুজনেরই অংশ – কিছুটা খাদিজার (রা:), কিছুটা রাসুলের (ﷺ)। রাসুল (ﷺ) পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, ফাতিমা (রা:) ইতিমধ্যে তাঁর মাকে হারিয়েছেন, বোনদের হারিয়েছেন। এখন তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় বাবাকে হারাতে যাচ্ছেন। সেই বাবা যিনি তাঁর জীবনের সবকিছু জুড়ে। প্রথমবার রাসুল (ﷺ) তাঁকে ডেকে বলেন, “এই যাত্রায় আমি আর বেঁচে থাকছি না, আমি মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছি।” ব্যাপারটা অনেকের জন্যই অকল্পনীয়, যদিও পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ
আপনি অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবেন, এবং তারাও মৃত্যুবরণ করবে।
[৩৯:৩০]
কিন্তু সাহাবাদের মনে রাসুলের (ﷺ) অবস্থান এতটাই উপরে ছিল যে, তারা কল্পনাই করতে পারেননি যে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। কাজেই ব্যাপারটা জ্ঞাত হওয়া সত্বেও তারা তা মেনে নিতে পারছিল না। তারা কল্পনাও করতে পারেননি যে তিনি মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছেন। পবিত্র কুরআনে দুবার তাঁর মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে।
أَفَإِي۟ن مَّاتَ أَوْ قُتِلَ
যদি তিনি নিহত হন, বা মৃত্যুবরণ করেন।
[৩:১৪৪]
রাসুল (ﷺ) যখন ফাতিমাকে (রা:) বলেছিলেন তিনি আর বাঁচবেন না, ফাতিমা (রা:) তৎক্ষণাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় বার রাসুল (ﷺ) কন্যাকে দেখে বলেছিলেন, “আমার পরে পরিবারের মধ্যে তুমি প্রথম মৃত্যুবরণ করবে।” নিজের মৃত্যুর সংবাদ শুনে কেউ হাসবে – ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত, তাই না?
মাত্র ২৭ বছরের তরুণী একজন মা। “আমার পরে তুমিই পরিবারের মধ্যে প্রথম মৃত্যুবরণ করে আমার সাথে মিলিত হবে।” এ ব্যাপারটা ফাতিমাকে (রা:) আনন্দিত করেছিল। আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু তুমি আমার সাথে সহসাই মিলিত হবে, তুমি অসুস্থ নও, তোমার কোন শারীরিক সমস্যাও নেই। আমি তোমার বিরুদ্ধে দু’আও করছি না।
রাসুল (ﷺ) অহংকার করে কোনো কথা বলেননি, অসার কোনো কথা, বা নিজের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য কোন কথা বলিনি। ওহী প্রাপ্ত হয়েই তিনি কথাটি বলেছিলেন। এটাই ছিল ফাতিমার (রা:) হাসির কারণ। প্রাণাধিক পিতাকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন, এবং তাঁর সান্নিধ্যের এতটাই প্রত্যাশী তিনি ছিলেন।
আলী (রা:) ও ফাতিমার (রা:) সুখের সংসার
পর্ব : ১০
মূল: ড. ওমর সুলাইমান