Table of Contents
[১]
সকাল দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট।
মুঠোফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে, ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ল মিশু। অস্থির ভঙ্গিতে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে উঠল,
“অনিক! অনিক!”
বুক ধরফড় করছে মিশুর। গত রাতেও টানা একঘন্টা ধরে, ফোনে কথা হয়েছে অনিকের সাথে। অথচ সবকিছুকে ভেস্তে দিয়ে, রাতের মধ্যেই লাশ হয়ে ফিরে এল বেচারা! আগের জনের লাশের মতোই, কল্লা আর হাত-পা কাঁটা লাশ! কীকরে সম্ভব এতোকিছু! কারা করছে এসব?
তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে, কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে, দরজার দিকে একদৃষ্টে তাঁকিয়ে রইল মিশু। অশরীরী একটি ছায়া সরে গেল দরজার এপাশ থেকে ওপাশে। দৌঁড়ে সেদিকটায় এগিয়ে গেল সে। কোথাও কেউ নেই।
মিশু চিৎকার করে উঠল,
“কে? কে ওখানে?”
কোনো উত্তর নেই।
ফোন বাজছে মিশুর। চোখ সরু করে সেখানে দাঁড়িয়েই, সেইভ করা নাম্বারটা পড়ে নিল সে। রাজের ফোন।
বিছানায় ঝাপিয়ে পড়ল মিশু, কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ বাটনটা চেপে দিল সে। ওপাশ হতে শোনা গেল রাজের গোঙানোর আওয়াজ। খানিক বাদে, শক্ত হয়ে এল রাজের কণ্ঠ,
“বলেছিলাম না! আমাদের পিছু নিয়েছে কেউ? এবার বিশ্বাস হলো তোর?”
শক্ত কণ্ঠটা ভেস্তে দিয়ে, আগের মতো গোঙাতে শুরু করল রাজ,
“দোস্ত, তিন নাম্বারে কার নাম কে জানে! কি হবে বাকিদের?”
পেটে এক গ্লাস পানি চালান করে দিয়ে, নিজেকে খানিক সামলিয়ে উত্তর দিল মিশু,
“ভয় পাসনে, রাজ। তপুকে সাথে নিয়ে এক্ষুণি চলে আয় আমার কাছে। উপায় খুঁজতে হবে আমাদের।”
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে রাজ উত্তর দিল,
“আসছি, দোস্ত।”
মুঠোফোনের লাল বাটনটা চেপে, আগের মত আবারও বিছানায় ছুঁড়ে মারল মিশু। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ সুষ্পষ্ট। সব মিলিয়ে পাঁচ বন্ধু ছিল তারা। বেঁচে আছে মোটে তিন জন। মিশু ঢের জানে, বাকিদের পালা এবার। শেষ পর্যন্ত তাদেরও মরতে হতে পারে। ঠিক লাশ হওয়া দুজনের মতো, যেকোনো সময় ধেয়ে আসতে পারে বিপদ।
চশমাটা চোখে লাগিয়ে ফেসবুকে একটা ঢুঁ মারল মিশু। দুই মাস আগে, তাদের ভ্যারিফাইড পেইজ থেকে করা পোস্টটা, ডিলিট করে দেবে কিনা ভাবছে সে। মিলিওন মিলিওন ভিউ হয়েছে পোস্টটি! কয়েকদিনে হয়ত কোটির ঘরে ঠেকবে রিএক্টের সংখ্যা! পেইজে ম্যাসেজও এসেছে প্রচুর! বেশ কিছু অপ্রীতিকর ম্যাসেজ আছে এর মধ্যে। একটা ম্যাসেজ তো একেবারে গা শিউরে দেয়ার মত। এসবকে ভয় পায়না মিশু। ডিলিট বাটনে চাপ দিতে গিয়েও, কী ভেবে বেরিরে এল সে। ডিলিট কেন করবে পোস্টটা?
মুসলিমরা কখনও দুর্বল হতে পারেনা!
[২]
চায়ের কাপগুলো টেবিলের উপর রেখে, হতাশ ভঙ্গিতে বসে আছে তিনজন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। যেন কথা বলতে ভুলে গেছে তারা! আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে গেছে সবার। মিশুর দৃষ্টি ফোনে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পেইজের ফলোয়ার ও কমেন্টগুলো নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে সে।
খানিক বাদে তপু বলে উঠল,
“কিছু বের করতে পারলি তোরা?”
মাথা নাড়ল মিশু। চায়ের কাপগুলো গুছাতে গুছাতে বলে উঠল,
“আজকের রাতটা তোরা এখানেই থেকে যা না, তপু। মনে হচ্ছে, কেউ ফলো করছে আমাকে। কপালে কী আছে, কে জানে!”
মিশুর কথা শেষ হতে না হতেই লাফিয়ে উঠল রাজ। ক্ষীণ আওয়াজে বলে উঠল,
“যতো দ্রুত সম্ভব অবস্থান চেঞ্জ করতে হবে আমাদের। তার আগে একবার থানায় যেতে পারলে হতো।”
তড়িৎ গতিতে রাজের মুখের দিকে ঘুরে বসল দুজন। উৎসুক দৃষ্টিতে তপু বলে উঠল,
“পেইজের ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?”
মুখ শক্ত হয়ে এল রাজের,
“যতো বাঁধাই আসুক, আমাদেরকে হার মানলে চলবেনা। আজ বা কাল আমাদেরও মেরে ফেলতে চাইবে তারা। কিন্তু দমে যাবনা আমরা। যারা খুন হয়েছে, তাদের সবার কথা তুলে ধরতে হবে জনসম্মুখে। আপাতত, তাদের কোণঠাসা করার আর কোনো উপায় দেখছিনা এই মুহূর্তে।”
চোখ গোল গোল হয়ে এল তপুর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে, চটজলদি প্রশ্ন করে বসল সে,
“যদি আরও বিপদ নেমে আসে আমাদের উপর, তখন কী করবি?”
“আমাদের আগে যারা খুন হয়েছে তাদের আপডেট, বাদবাকি মুসলিমদের উপর দেশে-বিদেশে নির্যাতন নিয়ে, আগের বানানো যত সিরিয়াল-ডকুমেন্টারি আছে, একটাও থামাবনা। চালিয়ে যাব। সত্যের প্রচার আমাদের ঈমানী দায়ীত্ব। হ্যাঁ, প্রচার। প্রচার করে যেতে হবে আমাদের।”
তপু উঠে বসল,
“রাজ! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? সেঁধে সেঁধে মরতে চাচ্ছিস!”
তপুকে খানিক থামিয়ে দিল মিশু। ভারিক্কি গলায় বলে উঠল,
“আমি বুঝতে পারছি, তুই কী বুঝাতে চাচ্ছিস, তপু। আমাদের পেইজটা ভ্যারিফাইড না হলে, হয়ত অনেক আগেই উড়িয়ে দিত তারা। মানছি, অলরেডি দুজন শেষ আমাদের। কিন্তু, আমাদের নিয়্যাত তো সেটা নয়। মৃত্যু দেখে পিছিয়ে পড়ব কেন আমরা, বল?”
রাজ বলে উঠল,
“এই-যে আজ মুসলিমদের এই বেহাল দশা; পথে-ঘাটে টেরোরিস্ট বানিয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের; বাকস্বাধীনতার বুলি আউড়িয়ে খাবলে খাওয়া হচ্ছে ইসলামকে, এ-দেশে ও-দেশে নির্বিচারে গুলি করা হচ্ছে মুসলিম ভাই-বোনদের, এসবের মূল কারণ কী জানিস? এসবের মূল কারণ হচ্ছে, ভয় পেয়ে দমে যাওয়া। মুসলিমরা কখনো দমে যেতে পারেনা, তপু!”
তপুর কণ্ঠে অভিমানের ছাপ,
“করেছি তো এতদিন, যতোটুকু পারি। এখন কি একটু ইস্তফা দিতে পারিনা আমরা? সবকিছু ঠিক হলে, পরে নাহয় আবার প্রচার করব।”
রাজ বলে উঠল,
“না, তপু, এখনই মোক্ষম সুযোগ। দেশবাসীর কাছে আমাদের টিম-মেম্বারদের মৃত্যুর মিছিল তুলে ধরতে হবে। আসল টেরোরিস্টদের চিনিয়ে দিতে হবে, তপু।”
গম্ভীরতর হয়ে এল তপুর চেহারা। পাশ থেকে হতাশার ভঙ্গিতে, মিশু বলে উঠল,
“ইশ! আমাদের যদি কোনো সংবাদ-মাধ্যম থাকত! তাহলে খবরগুলো আরও দ্রুত প্রচার করতে পারতাম আমরা!”
হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল রাজের।
“কে বলেছে নেই? শুধু মিডিয়া আর পত্রিকায়, কতেক রসালো শিরোনাম পৌঁছালেই কেউ সাংবাদিক হয়ে যায়না! এরজন্য দরকার সঠিক তথ্য প্রচারের হিম্মত। প্রফেশনাল সাংবাদিক না হলেও, এক অর্থে আমরা সবাই একেকজন সাংবাদিক। আর আমাদের পেইজটা হচ্ছে ছোটখাটো একটা সংবাদ-মাধ্যম, বুঝলি?”
মিশুর চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বিরবির করে সে বলে উঠল,
“বাহ! দারুণ বলেছিস তো! তা অনিকের খুনের ডকুমেন্টারির দায়ীত্ব নিচ্ছিস কে?”
মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে, টেবিলের উপর সশব্দে ঘুষি দিল রাজ, বলে উঠল,
“কাজটা রিস্কি। তবুও প্রথমে আমিই হাতে নিতে চাই অনিকের ডকুমেন্টারীটা!”
অজানা এক আতঙ্ক নিয়ে রাজের মুখের দিকে তাঁকিয়ে রইল বাকি দুজন।
[৩]
আঁধার রাত। হু হু হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলোয় ঝকমকিয়ে উঠছে রাস্তার দুপাশ। রাজের খেয়াল হল, অশরীরী কেউ ফলো করছে তাদেরকে।
আঁকাবাকা রাস্তায় যখনই বাইক ঘুরাতে যাবে, ঠিক তখনই আচমকা সরে যাচ্ছে অশরীরী ছায়াটা। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে রাজের। বুঝতে পারছে, কিছু একটা হতে চলেছে তার সাথে। বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিল সে।
তপু বলে উঠল,
“তোর বাড়িটা আর কতোদূর?”
খানিকটা এপাশ-ওপাশ তাঁকিয়ে, ফিসফিসিয়ে উঠল রাজ,
“চলে এসেছি, দোস্ত। কাছাকাছিই।”
মুহূর্তের মাঝে প্রায় চার হাত উপরে উঠে গেল রাজের বাইকটা। শূণ্যে ভাসছে তিনজন। মিনিট পাঁচেক স্তব্ধ হয়ে, জড়াজড়ি করে বসে রইল তারা। তারপর ধপাস করে পরে গেল মাটিতে। কোমড়ে খুব বড়ধরণের চোট পেয়েছে রাজ। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, একেবারেই অক্ষত ছিল তপু আর মিশু! এত উপর থেকে পড়ার পরেও, বিন্দুমাত্র কোনো ক্ষতি হয়নি বাইকের!
দরজা খুলতেই, হুমড়ি খেয়ে ঘরে ঢুকল তিনজন। হাঁপাতে হাঁপাতে বেঁতের চেয়ারটায় এসে, ধপ করে বসে পড়ল রাজ। মাথায় হাত দিয়ে, খানিকটা মিশুর দিকে ঝুঁকে বসল বেচারা।
মিশুর চোখ চরকগাছ। খানিক নড়েচড়ে আতঙ্কিত চেহারায়, রাজের দিকে তাঁকিয়ে, মিশু বলে উঠল,
“উজবুক নাকি তুই? এভাবে কেউ উড়ে আসে নাকি! দাঁড়া, পানি আনছি।”
মিশু উঠে দাঁড়াতেই তার হাতটা খপ করে ধরে ফেলল রাজ। কাঁদু কাঁদু চেহারায় বলে উঠল,
“ওয়াশরুমে নিয়ে যাবি আমায়? বেশ খারাপ লাগছে।”
ওয়াশরুমে যেতেই গড়গড় করে বমি করে দিল রাজ। ব্যাপারখানা বেশ অদ্ভূত ঠেকল মিশুর। কোথা থেকে তড়িঘড়ি করে, একখানা ট্যাবলেট এনে রাজকে খাইয়ে দিল সে।
সারারাত ব্যথায় কোঁকাল রাজ।
[৪]
শেষ রাত; তিনটে বাজার মাত্র দু মিনিট বাকি।
ধরমর করে উঠে বসল রাজ। খেয়াল হল, কেউ একজন যন্ত্রের মত টানছে তার পা ধরে। ইশারায় বেরিয়ে যেতে বলছে তাকে। আগামাথা কিছু ভেবে পেলনা রাজ। যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে। আধো-চেতন অবস্থায় টলতে টলতে দরজা খুলে বেরিয়ে এল রাজ। ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলনা সে। ফিরতি পথ ধরতে যাবে, কিন্তু কী ভেবে আঁধার চিড়ে আরও সামনে এগুতে লাগল সে।
রাজের লাশটা পাওয়া গেল দুপুর বারোটার দিকে। মিশুদের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, একটি সজনে গাছের তলায়, পরে ছিল রাজের নিথর দেহ। কে বা কারা তাকে সেখানে নিয়ে গেছে, কোনো হদীস নেই তার।
গত কয়েকদিনে ওজন অর্ধেক কমেছে তপুর। সারাদিন জায়নামাযে পড়ে থাকে বেচারা। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে কখন চোখ বুজে আসে, খেয়াল হয়না তার। এক ঢোক পানি খেয়ে, মিশুর দিকে ফিরে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে তপু বলে উঠল,
“গুনে গুনে তিনটা লাশ পাওয়া গেছে এ-পর্যন্ত। এই সপ্তাহের মধ্যে, এ-ই এলাকায় করা সর্বোচ্চ খুনের রেকর্ড! তিনজনের মৃত্যুও হয়েছে একই কায়দায়। প্রথমে গলা, আর এরপর হাত-পা কেঁটে দেয়া হয়েছে তাদের! এতোকিছুর পরেও আইন-শৃঙখলা বাহিনীর মাঝে, তেমন কোনো তৎপরতা নেই। ব্যাপারটা ভেবে দেখেছিস, মিশু?”
কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছে মিশুর। কথা বের হচ্ছেনা গলা দিয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিশু বলে উঠল,
“ধৈর্য্য হারালে চলবে না, তপু। এর একটা বিহীত না হলেই নয়। কী যে হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছিনা আমরা! আচ্ছা, আমাদের আশে-পাশের কারও কাজ নয়তো এসব?”
তপু কাঁদছে। বিস্ময় আর ক্ষোভে ফেটে পড়ছে সে। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে বলে উঠল,
“জানিনা, দোস্ত।”
মিশুর মুখ শক্ত হয়ে এল। কিছু একটা বলতে যাবে, হঠাৎ প্রচণ্ড মাথাব্যথা শুরু হল তার। পেটের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। কালবিলম্ব না করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল সে।
মিশুর দিকে একঝলক তাঁকিয়ে তপু বলে উঠল,
“আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া, আর কীই-বা করার আছে আমাদের। মাজলুমদের সহায় তো একমাত্র তিনিই।”
[৫]
আবছা আলোয় মিশু দেখল, দুটি লম্বামতন ছায়া দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখ কচলিয়ে ভালোমতন তাঁকাতেই দেখল, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে ছায়াদুটো। দূরত্ব কমার সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে উঠছে অবয়বদুটো। কাছে আসতেই, দুটো সাপ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল মিশুর চোখে। খানিক বাদে মিশুর মনে হল, কেমন ধীরে ধীরে মানুষ হয়ে যাচ্ছে সাপগুলো।
ভয় পেয়ে, এক কদম পিছিয়ে দাঁড়াল মিশু। কাঁপা কাঁপা স্বরে, জিজ্ঞেস করে উঠল,
“কারা তোমরা? কি চাও?”
ভয়ানক হাসিতে ফেটে পড়ল অবয়বদুটো। দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল,
“তোর লাশ চাই আমরা।”
মিশুর কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। তড়িৎগতিতে সে অনুভব করল, হীম-শীতল একটা স্রোতধারা নেমে যাচ্ছে তার মেরুদন্ড বেয়ে। আরেককদম পিছিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল সে,
“কী ক্ষতি করেছি তোমাদের আমি?”
রেগে আগুন হয়ে এল অবয়বদুটো। অদ্ভূত প্রতিধ্বনিতে বলতে শুরু করল,
“পেইজ চালাস কেন? বন্ধ করে দে ওই পেইজ। মুসলিমদের জাগিয়ে তুলবি তোরা? হাহাহা…..তার আগে তোদেরকেই ঘুম পাড়িয়ে দেব আমরা।”
কথাগুলো শেষ করে, মুহূর্তের মাঝে সাপ হয়ে এল মানুষের অবয়বদুটো। মিশু দেখল বিষাক্ত ফনা তুলে, তার দিকে তেড়ে আসছে দুটো কালো কুচকুচে সাপ। প্রাণপনে পিছন দিকে ছুট লাগাল সে।
জ্ঞানহীনের মতো দৌঁড়াচ্ছে মিশু। কিন্তু, রাস্তার কোনো শেষ নেই। যেন আগাগোড়া দৌঁড়ানোই কাজ তার। আচমকা পিলে চমকে উঠল মিশুর। হোচট খেয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল সে; পা কেঁটে চামড়া ছিলে গেল খানিকটা। চশমাটা ছিটকে পড়ে গেল নিচে। হাতড়ে হাতড়ে থেতলে যাওয়া চশমাটা তুলে নিল মিশু। একমনে আয়াতুল কুরসি পড়ছে সে। ততোক্ষণে খুব কাছাকাছি চলে এসেছে সাপদুটো।
কোথা থেকে একটা বাঁশ হাতে নিল মিশু। নাহ! এভাবে হবেনা। তড়িৎগতিতে বাঁশটিকে দু-খন্ড করে ফেলল সে। আগের চেয়ে আরও জোরে জোরে ঠোঁট আওড়াচ্ছে মিশু। আয়াতুল কুরসী পড়ার সাথে সাথে, কেমন তাল-বেতাল হয়ে যাচ্ছে সাপদুটোর মাথা। আরেকটু কাছে আসতেই, বাঁশদুটো দিয়ে সেগুলোর মাথা চূর্ণ করে দিল সে। দুই থেকে তিন মিনিটের মাথায় মারা গেল সাপদুটো। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মানুষকণ্ঠের কেউ একজনঃ
“কেন মারলি তুই এদের? কেন? কেন? কেন?”
মিশু আকাশের দিকে তাঁকাল। দেখল, ছয়কোনাওয়ালা একটি তারকা, জ্বলজ্বল করতে করতে এগিয়ে আসছে মিশুর দিকে। আয়াতুল কুরসি আওড়াতে আওড়াতে, হঠাৎ মিশুর চোখে ভেসে উঠল খুব পরিচিত একটি কালো টুপি। পরক্ষণে মিশুর মনে হল, আগুনে পুড়ে যাবে সে।
জোরে একটা চিৎকার দিয়ে, শোয়া থেকে ধরমর করে উঠে বসল মিশু। আশেপাশে শুধু নিগূঢ় অন্ধকার। ঘেমে নেয়ে একাকার সে।
দৌঁড়ে লাইট জ্বালাল তপু। চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বলে উঠল,
“কী হল তোর? হঠাৎ উঠে বসলি যে!”
কাঁপা কাঁপা হাতে, এক গ্লাস পানি তুলে নিল মিশু। পুরোটুকু পেটে চালান করে দিয়ে বলে উঠল,
“আয়াতুল কুরসি পড়।”
আগা-মাথা কিছুই না বুঝে ভ্যাবার মতো তাঁকিয়ে রইল তপু।
[৬]
পেইজের ইনবক্স হতে অপ্রয়োজনীয় কিছু ম্যাসেজ ডিলিট দেয়ার পর, পোস্টগুলোতে খানিক ঢুঁ মারল মিশু। প্রচুর ভিউ হচ্ছে রাজের ডকুমেন্টারীটা। ব্ল্যাকম্যাজিকের জন্য রুকইয়াহর কিছু আয়াতও শেয়ার করেছে সে পেইজে৷ হঠাৎ ভারিক্কি গলায়, পাশে থাকা তপুকে জিজ্ঞেস করে উঠল মিশু,
“ঠিকঠাকমত সকাল-সন্ধ্যার মাসনুন আমল গুলো করছিস তো, তপু? আল্লাহর পক্ষ হতে দেয়া প্রটেকশন সেগুলো, ভুলে গেলে চলবেনা।”
খানিক অভিমানের স্বরে তপু বলে উঠল,
“কি মনে করিস আমাকে? একদিনও বাদ দেইনা এখন, বুঝলি?”
“হুম, তা বুঝলাম। আমার জন্যে দোয়া করিস তো?”
“খুব করি।”
উৎসুক দৃষ্টিতে মিশু বলে উঠল,
“কী দোয়া করিস?”
“এই যেমন ধর, তোর রুকইয়াহ যেন কাজে দেয়। জাদু যেন কেঁটে যায়, এইসব আরকি।”
কথা বলা শেষে, ফিক করে হেসে দিল তপু। তারপর হঠাৎ করে স্ক্রিনে একটি খবর ভেসে উঠতেই, চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তার। তপু চেঁচিয়ে উঠল,
“দেখ! দেখ! যোসেফের লাশ পাওয়া গেছে কাল! একেবারে কল্লাছাড়া হাত-পা কাঁটা লাশ! কারা নাকি খুন করে রেখে গেছে এখানে।”
স্ক্রিনের ছবিটার দিকে একঝলক তাঁকাল মিশু। ছয়কোনা তারকাখচিত গলার চেইনের সাথে, পরনের কালো ফ্রক-কোট আর টুপি চিনতে একটুও ভুল হলনা মিশুর।
হোমপেইজে স্ক্রল করতে করতে, মিশু বলে উঠল,
“যা সন্দেহ করেছিলাম, তাই হলো।”
বেশ অবাক হয়ে, তপু জিজ্ঞেস করে উঠল,
“মানে?”
“কিছু অভিশাপের আয়াত আছে ক্বুরআনে, বুঝলি? যেগুলোর সমন্বয়ে তৈরী হয়েছে ‘রুকইয়াহ কার্স’। শত্রুকে ঘায়েল করতে এর জুড়ি নেই। কেউ তোকে জাদু করলে, জাদুকরের উপরে পাল্টা দুর্গতি নেমে আসে, সেগুলো পড়লে।”
মিশুর কথা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তপুর। তড়িৎ গতিতে সে জিজ্ঞেস করে উঠল,
“তুই পড়তি নাকি সেগুলো? এজন্যেই কি…..?”
তপুর দিকে সরাসরি মুখ করে বসল মিশু। তারপর মুচকী হেসে বলে উঠল,
“প্রথমে পড়তে চাইনি। কিন্তু কী করবো, বল? ইহুদীরা আগাগোড়াই এমন আসলে। যোসেফ শুধু আমাদের সাথে ইসলাম আর ইহুদীবাদ নিয়ে বিতর্ক করতেই দেখা করেনি। তার উদ্দেশ্য ছিল আরও বিপজ্জনক। আমাদের শরীর হতে জাদুর উপাদান সংগ্রহ করা ছিল তার মূল লক্ষ্য। আমরা টেরই পাইনি এতোকিছু। এরপর আমাদেরকে মারার জন্য একের পর এক, ব্ল্যাকম্যাজিক প্রয়োগ করেছে সে। নিজে জাদু করেই থেমে থাকেনি, কতেক জিনও চালান দিয়েছে শয়তানটা। সম্ভবত পুলিশী তৎপরতাকেও দমিয়ে রেখেছে, জিন চালান দিয়ে। সত্যি বলতে কি, আল্লাহর কাছে এসবের খুব সমাধান চাইতাম আমি। প্রথমে কার্স করতে চাইনি যোসেফকে। যখন একের পর এক আমাকে মারার জন্য জাদু করে যাচ্ছিল, তখন বাধ্য হয়ে কার্স করেছি আমি। ঠিক যেভাবে দোয়া করেছিলাম, সেভাবেই অভিশাপ নেমে এসেছে ওর উপর। কিন্তু…..”
“কিন্তু কী?”
তীক্ষ্ম হয়ে এল মিশুর দৃষ্টি। একটু থেমে সে বলে উঠল,
“আমি কার্স করেছিলাম জাদুকরের উপর। কার্স করলে যে হবহু উল্টো অভিশাপ পরে, ঠিক তা নয়। পাশাপাশি উল্টো অভিশাপের দোয়াও করেছিলাম আমি। কিন্তু যোসেফের যে ব্ল্যাকম্যাজিক জানা ছিল, আজকে ওর লাশটা না দেখলে, বুঝতেই পারতাম না!”
লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তপুর। বিরবির করে সে বলে উঠল,
“ইহুদি! ইহুদি!”
[বিঃদ্রঃ ‘রুকইয়াহ কার্স’ প্রথমেই করতে না করেন রাক্বীরা। যখন কোনো রুকইয়াহই তেমন কাজে দেয়না, জাদুকর বারবার জাদু করেই যেতে থাকে, তখন লাস্ট পর্যায়ে অধৈর্য্য হয়ে কার্স করার কথা বলেন তারা।]