অংশিদারী কুরবানীতে একজনের উদ্দেশ্য খারাপ হয় তাহলে কি কুরবানী হবে
অংশিদারী কুরবানীতে কোন একজনের উদ্দেশ্য যদি খারাপ হয় তাহলে কি কুরবানী হবে?
একটি কথা বহুল প্রচলিত, “অংশিদারী কুরবানীতে কোন একজনের উদ্দেশ্য যদি খারাপ হয়, তা হলে শরীকদার কারও কুরবানী হবে না।”
একথার বাস্তবতা কি এবং কতটুকু সত্য?
কুরবানীর নিয়ত ও উদ্দেশ্য বিষয়ক একটি জরুরি মাসআলা,
বিষয়টি বুঝবার আগে একটি বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার।
এক হলো কুরবানী সহীহ-শুদ্ধ হওয়া, আরেক হলো কুরবানী কবুল হওয়া। কুরবানী সহীহ হওয়ার বিষয়টি দুনিয়ার সাথে সস্পৃক্ত। আর কবুল হওয়ার বিষয়টি আখিরাতের সাথে সম্পৃক্ত।
আমলের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা ওই আমলের নিয়ত করা বা নাকরার উপর নির্ভরশীল, নিয়ত শুদ্ধ বা অশুদ্ধ হওয়ার সাথে এর সম্পর্ক নেই।
একজন মানুষ তার আমল সহীহ করার বিষয়টি সর্বান্তকরণে করতে পারে এবং সেটাই তার দায়িত্ব। এর মাধ্যমে আমল সহীহ হওয়ার নিশ্চয়তা লাভ করতে পারে। আর ইখলাস ও নিয়তশুদ্ধ করার মাধ্যমে আখিরাতে কবুলের আশা করতে পারে। কিন্তু কবুলে নিশ্চয়তা লাভ করতে পারে না।
একইভাবে একজন মুফতী কোনো আমলের সহীহ হওয়া-না-হওয়ার বিষয়ে ফতওয়া দিতে পারেন এবং এক্ষেত্রে কিছু বলার অধিকার রাখেন। কিন্তু তিনি তা কবুল হবে কি হবে না, তা নিয়ে কিছুই বলতে পারেন না।
এবার আসুন মূল মাসআলায়।
কুরবানীর পশুতে অংশিদার হওয়ার দুটি উপায় ও উদ্দেশ্য হতে পারে।
এক হলো শরীয়তের আদেশ পালনার্থে পশু যবাই করে কুরবানী করা। কুরবানী ভিন্ন অন্য কোনো নিয়ত তার নেই, যদিও কুরবানী দিয়ে নাম-সুনাম কুড়ানো কিংবা বদনাম ঘুচানোর মনোভাবও এতে যুক্ত ছিল।
উদাহরণত মনে করুন, কোনো সামর্থ্যবান কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় ও যবাই করলো, অথবা অসামর্থ্য বা অন্য কোনো কারণে কারও কুরবানী দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কুরবানী দিচ্ছে একথা ভেবে যে, আমি যদি কুরবানী না করি, তা হলে সমাজে আমাকে ছোট হতে হবে। কুরবানী না করলে আমার সন্তানেরা কার ঘরে যাবে, নতুন আত্মীয় হয়েছে, তাদের কাছে ছোট হতে হবে ইত্যাদি। অর্থাৎ, শরীয়তের প্রবর্তিত কুরবানী করাই তাদের নিয়ত ছিল, তবে তাতে কিছু বদনিয়ত ঢুকে পড়েছে। যেমন কেউ শরীয়তের নামাযই আদায় করছে, তবে লোক দেখানোর জন্য।
এক্ষেত্রে মাসআলা হলো- যদি সে একাকী কুরবানী দেয়, তা হলে কুরবানীর অন্যান্য শর্ত পূর্ণ হলে তার কুরবানী সহীহ হয়ে যাবে। যেভাবে রিয়াকারের নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে যদি নামাযের যাবতীয় আরকান আহকাম ঠিক রেখে আদায় করে থাকে। তবে রিয়ার কারণে আখিরাতে কুরবানী কবুল না হওয়ার আশংকা রয়েছে।
তদ্রুপ যদি এরা অংশিদারে কুরবানী দেয়, তা হলেও তার ও অন্যান্য শরীকদারদের কুরবানী সহীহ হয়ে যাবে। তার নিয়তের অশুদ্ধতার কারণে অন্যদের কুরবানী অশুদ্ধ হবে না। কারণ, ইখলাসের সাথে আমলের শুদ্ধতার কোনো সসম্পর্ক নেই, বরং তার সম্পর্ক আমলের কবুলিয়াতের সাথে।
তবে জেনে শুনে মুখলিস মানুষ এমন রিয়াকারের সাথে কুরবানী না করা উত্তম। কারণ, ভয় আছে অংশিদারের বদ-নিয়তের কারণে আখিরাতে তার কুরবানী প্রত্যাখ্যাত হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে কারও বদনিয়াত প্রকাশ হয়ে গেলে শরীকে কুরবানী না করে একাকী করাই শ্রেয়।
দ্বিতীয়ত, কুরবানীর পশুতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য কেবলই গোশত সংগ্রহ করা। যেমন বৌভাত, জিয়াফত, খতনা, পার্টি ইত্যাদি করার জন্য তার গোশতের প্রয়োজন পড়েছে। সে উদ্দেশ্যে আসন্ন কুরবানীর পশুতে অন্য কারও সাথে অংশিদার হয়েছে।
অথবা সে অন্য পশুতে কুরবানী করছে, কিন্তু এ পশুতে বিশেষ কোনো সুবিধা পেয়ে তাতে অংশ নিচ্ছে নিছক গোশত সংগ্রহের জন্য। অন্যথা তার এ কুরবানীর পশুতে শরীক হওয়ার বিলকুল ইচ্ছা ছিল না।
বিষয়টি আরেকভাবে পরিস্কার হতে পারে।
মনে করুন, দু ভাইয়ের কুরবানীর বাজেট একলাখ টাকা। সেই টাকা নিয়ে তারা বাজারে গেল গরু কিনতে। কিন্তু সেখানে এক লাখ টাকায় কোনো গরু পাওয়া যাচ্ছে না। বরং সবই বড় বড় গরু। এদিকে সময় কম। কালই ঈদ। এমতাবস্থায় গরু বিক্রেতা কসাই প্রস্তাব দিল ঠিক আছে আপনারা এক লাখ টাকা দিন এবং দুই লাখ টাকা দামের এ পশু নিয়ে যান। অর্ধেক আপনাদের, বাকি অর্ধেক আমার। কসাইর উদ্দেশ্য বাকি গোশত সে বাজারে বিক্রি করে দিবে, কুরবানীর কোনো নিয়ত তার নেই।
এক্ষেত্রে মাসআলা হলো, শরীকদারদের একজনের উদ্দেশ্য যদি এরূপ গোশত সংগ্রহ করা হয়, তা হলে অন্য শরীকদারদের কারও কুরবানী সহীহ হবে না, যদিও শরীকদারদের উদ্দেশ্য ইখলাসের সাথে কুরবানী করা হয়।
অনুরূপভাবে কোনো অংশিদারের অংশ যদি একসপ্তমাংশের চেয়ে কম হয়, যেমন দু ভাই মিলে এক শরীক কুরবানী করলো, তা হলে কারও কুরবানী সহীহ হবে না।
এই দু মাসআলার পার্থক্যের কারণ সম্ভবত এই- কুরবানী হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশুর প্রাণ উৎসর্গ করার নাম। আর পশুর প্রাণ হলো অভিভাজ্য, যদিও দেহ ও গোশত বিভাজ্য। এই অবিভাজ্য প্রাণকে অবিভাজ্য উদ্দেশ্যে, তথা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে হবে। তা হলে সেটা ইবাদত হিসাবে গন্য হবে।
যখন কোনো একজন শরীকদারের উদ্দেশ্য গোশত সংগ্রহ হয়, তখন উদ্দেশ্য ভাগ হয়ে যায়। আর অখণ্ড প্রাণকে খন্ডিত উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা সম্ভব নয়। করলে সেটা আর ইবাদত থাকে না। এজন্য একজনের উদ্দেশ্য ভিন্ন হওয়ার কারণে অন্য কারও কুরবানী সহীহ হবে না।
মোটকথা, কেউ কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশু যবাই করলো, কিংবা কুরবানীর পশুতে শরীক হলো, তার কুরবানী সহীহ ও শুদ্ধ হয়ে যাবে, যদিও তার নিয়তে গরমিল থাকে। কারণ সবার উদ্দেশ্য আল্লাহর আদেশ পালন করে দাসত্ব প্রকাশ করা।
আর কেউ যদি কুরবানী করার উদ্দেশ্যে নয়, কেবল প্রয়োজনীয় গোশতের উদ্দেশ্যে অন্যদের কুরবানীর পশুতে শরীক হলো, তা হলে কারও কুরবানীই সহীহ হবে না, যেভাবে কুরবানী নিয়ত না থাকলে নিজের জবাইকৃত পশু দ্বারাও কুরবানী আদায় হবে না।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল, “অংশিদারদের একজনের নিয়ত খারাপ হলে কারও কুরবানী সহীহ হবে না।” কথাটা আংশিক সত্য বটে, পুরোপুরি সত্য নয়।
আল্লাহু আ’লাম। ফাফহাম!