কোনো অমুসলিম ভালো কাজ করলেও কি জাহান্নামে যাবে
আইনস্টাইন, মেন্ডেলার মতো ব্যক্তিরাও কি জাহান্নামে যেতে পারেন।
প্রথমেই আমরা একটি হাদিস বর্ণনা করছি। আইয়ামে জাহেলিয়ার (ইসলামপূর্ব মূর্খতার যুগ) সময়ে ইবনে জুদ‘আন নামের এক ব্যক্তি মানুষের ব্যাপক উপকার করতেন। কিন্তু তিনি ঈমান না নিয়েই মৃত্যুবরণ করেন।
একদিন আয়িশা (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন,
‘হে আল্লাহর রাসুল! জাহেলি যুগে ইবনে জুদ‘আন আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করতেন, গরিব-মিসকিনদের খাবার খাওয়াতেন; এই সব কাজ তার কোনো উপকারে আসবে কি?’
নবিজি উত্তরে বললেন, ‘‘না, এসবে তার কোনো উপকার হবে না; কারণ সে কোনোদিন বলেনি—
رَبِّ اغْفِرْ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ.
‘হে আমার রব! বিচারের দিনে আমার গোনাহ-খাতা মাফ করে দিও!’1
হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববি (রাহ.) বলেন,
‘সে আখিরাতকে সত্য সাব্যস্ত করতো না, তাই সে কাফির; সুতরাং তার ভালো কাজগুলো তাকে উপকার পৌঁছাবে না।’2
তবে, আল্লাহ্ চাইলে তার শাস্তি কিছুটা কমাতে পারেন কিংবা তাকে হয়তো তার ভালো কাজের প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব, কেউ যদি ঈমানহীন অবস্থায় মারা যায়, তবে সে জাহান্নামে যেতে হবে। মেন্ডেলা, এডিসন, টেসলা, ফ্লেমিং, লুই পাস্তুর বা হাতেম তায়ির মতো মানবহিতৈষী (Philanthropist) কেউ যদি ঈমান না এনে মারা যান, তবে তাদেরও একই পরিণতি হবে।
অন্যের প্রতি সহানুভূতি জানানো, কারও দুঃখ দূর করা, মা-বাবার সেবা করা, সৃষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত থাকা, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা ইত্যাদি ভালো কাজের প্রতিদান হয়তো দুনিয়ার জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের মাধ্যমে দেওয়া হবে (সহিহ মুসলিম) অথবা পরকালে শাস্তি হালকা হওয়ার মাধ্যমে (এটি বাযযারের বর্ণনায় এসেছে, যদিও হাদিসটি মুনকার)।
আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
‘‘কোনো কাফির যদি দুনিয়াতে কোনো নেক আমল করে, তবে এর প্রতিদানস্বরূপ দুনিয়াতেই তাকে জীবনোপকরণ প্রদান করা হয়ে থাকে।’’3
কিন্তু, কোনো অমুসলিম পরকালের চিরস্থায়ী নাজাত (মুক্তি)—কুরআনের ভাষায় চূড়ান্ত সফলতা—কখনই পাবে না। কেননা, পরকালে নাজাতের জন্য ‘ঈমান’ পূর্বশর্ত। এ ব্যাপারে উম্মাহ একমত।4
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘‘কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন তালাশ করলে, তা কখনো তার কাছ থেকে কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।’’5
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল (রা.)-কে আদেশ দেন, তিনি যেন বলেন,
‘‘কোনো মুসলিম ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’’6
ভালো কাজ করার মাধ্যমে আখিরাতে উপকৃত হওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ঈমানের ‘শর্ত’ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘‘ঈমানদার অবস্থায় যে ভালো কাজ করবে—সে পুরুষ হোক বা নারী—তাকে আমি পবিত্র জীবন দান করবো এবং তারা (দুনিয়াতে নেক আমল) যা করতো, তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে (আখিরাতে) উত্তম প্রতিদান দেবো।’’7
তবে, যদি কোনো অমুসলিম দুনিয়ায় থাকতে ইসলাম সম্পর্কে না জানতে পারে এবং কেউ তাকে ইসলামের দাওয়াত না পৌঁছায়, তাহলে তার বিষয়টি পেন্ডিং থাকবে। আল্লাহ তাকে হাশরের দিন পরীক্ষা করবেন। আল্লাহ কাউকে বিনা কারণে শাস্তি দেবেন না। [শায়খ মুনাজ্জিদ এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছেন তাঁর islamqa(.)info-তে]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘‘(ঐশীবাণীর) বার্তাবাহক না পাঠিয়ে আমি কখনই কাউকে শাস্তি দিই না।’’8
সুতরাং, প্রিয় ভাই-বোনেরা! নিজের ঈমানকে পরিশুদ্ধ করুন। এই ঈমানের মূল্য দুনিয়ার কোনো কিছুর সমান হবে না। আল্লাহর দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো ঈমান। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন, ঈমানের কদর করুন।
আমরা কোনো অমুসলিমের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা রাখবো না (এ ব্যাপারে আলাদা একটি পর্ব আসবে, ইনশাআল্লাহ)। তবে, আমরা তাদের ভালো কাজের প্রশংসা করবো, তাদের সাথে সদাচরণ করবো, তাদের সাথে স্বাভাবিক লেনদেনও করবো; কিন্তু কখনই তাদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করবো না, তারা মারা গেলে তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করবো না, RIP (Rest in peace) লিখে শোক জানাবো না।
একদিন সম্রাট আকবরকে এক জ্যোতিষী বলেছিলো, সম্রাট আর মাত্র ৩ বছর বাঁচবে। এতে সম্রাট ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো এবং বিষণ্ন মনে পায়চারি করতে লাগলো।
এটি দেখে আকবরের অন্যতম প্রাজ্ঞ সভাসদ বীরবল জ্যোতিষীকে বললো,
‘আপনার নিজের আয়ু কতো, হিসেব করুন তো!’ অনেকক্ষণ হিসাব-নিকাশ করে জ্যোতিষী বললো,
‘আরো ২৫ বছর।’ বীরবল তখনি তরবারি দিয়ে এক কোপে জ্যোতিষীর মাথা ফেলে দিলো! এরপর আকবরকে বললো, ‘দেখলেন তো জাঁহাপনা, জ্যোতিষীর গণনা কতটা ভুল?’ [ঘটনাটির বিশ্বস্ততা যাচাই করার সুযোগ হয়নি]
ভালো করে জেনে রাখুন—রাশিফল ব্যাখ্যাদাতা, গণক এবং জ্যোতিষীর কথা (হোক সেটি মানুষ, টিয়াপাখি বা অন্য কিছু) বিশ্বাস করা দ্বারা একজন ব্যক্তি সরাসরি ঈমানহারা হয়ে যায়।
নবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“যে ব্যক্তি কোনো গণক বা জ্যোতিষীর কাছে যায় এবং তার কথা সত্য বলে বিশ্বাস করে, সে ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যা অবতীর্ণ (কুরআন) তা অবিশ্বাস করে।’’9
কীভাবে সে কুরআনকে অস্বীকার করে?
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘‘বলুন, আল্লাহ ব্যতীত আসমান ও জমিনে কেউ অদৃশ্যের খবর জানে না।’’10
সুতরাং, কেউ যদি জ্যোতিষীর কাছে যায় এবং জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য ও সঠিক বলে বিশ্বাস করে, তবে আল্লাহর বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে অন্যের সাথে মেলানোর মাধ্যমে শির্ক করার কারণে এবং কুরআনের কথাকে অবিশ্বাস করার কারণে সে মুশরিক ও কাফির হয়ে যাবে।
তবে, কেউ যদি শুধু অভিজ্ঞতার জন্য যায় এবং জ্যোতিষীর কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস না করে, তাহলে সে ঈমানহারা হবে না, কিন্তু ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামাজ কবুল হবে না।
নবি সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“যে ব্যক্তি কোনো জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করবে, তার ৪০ রাতের নামাজ কবুল হবে না।”11
এর কারণ হলো, সে জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে নিজের ঈমানকে অবমূল্যায়ন করেছে, আল্লাহর কথার সাথে খামখেয়ালিপনা করেছে। সে এমন একটি জঘন্য শির্কের ব্যাপারে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো দূরের কথা, ঘৃণাও দেখাতে পারেনি।
তবে, কেউ জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে থাকলে, অবশ্যই তাকে নামাজ পড়ে যেতে হবে। কারণ নামাজ কবুল হওয়া এক বিষয় আর নামাজের আবশ্যকতা সম্পন্ন করা আরেক বিষয়। নামাজ বাদ দিলে ফরজ ত্যাগের গুনাহ হবে, যেটি আরো ভয়ানক।
সুতরাং সে নামাজ পড়বে এবং তাওবাহ্ করবে। তার ৪০ দিনের নামাজ কবুল না হলেও নামাজত্যাগের গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। আর, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহর মেহেরবানি হলে তার ভুল মাফ করে দিতে পারেন এবং নামাজও কবুল করতে পারেন।
যারা জ্যোতিষী, গণক ও রাশিফল বর্ণনাকারীদের কথা বিশ্বাস করে, তারা বড় ধরনের বোকা। যে জ্যোতিষী নিজেই ফুটপাতে থেকে কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে, সে যদি নিজের ভবিষ্যতের ব্যাপারেও জানতো, তবে তো তার এই অবস্থা থাকার কথা না। এদের নিজেদের জীবনেই হতাশার শেষ নেই। এরা মিথ্যুক, ভণ্ড ও প্রতারক।
খোদ নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত গায়েব (অদৃশ্যের খবর) এবং ভবিষ্যতের বিষয়াবলী জানতেন না। তবে, যেটুকু তাঁকে জানানো হতো, সেটি ভিন্ন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘‘(হে নবি) আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান (তা ব্যতীত)। আর আমি যদি গায়েবের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে কল্যাণের প্রাচুর্য পেয়ে যেতাম এবং কোনো অনিষ্ট আমাকে স্পর্শ করতো না।’’12
প্রশ্ন আসতে পারে: কোনো কোনো সময় তো ওদের কথার বাস্তবতাও দেখা যায়, তাহলে?
এ ব্যাপারে স্বয়ং নবিজিকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। তিনি উত্তরে বলেছিলেন,
‘‘ফেরেশতাগণ মেঘের মাঝে এমন সব বিষয় নিয়ে কথা-বার্তা বলেন, যা পৃথিবীতে ভবিষ্যতে ঘটবে। তখন জিন-শয়তানেরা কিছু কথা শুনে ফেলে এবং তা জ্যোতিষীদের কানে এমনভাবে ঢেলে দেয়, যেমন বোতলে পানি ঢালা হয়। তখন তারা (জ্যোতিষীরা) এগুলোর সাথে আরও শত মিথ্যা বাড়িয়ে বলে।’’13
- ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৪০৬ ↩︎
- শারহু মুসলিম: ৩/৮২ ↩︎
- ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৬৯৮৩ ↩︎
- আল্লামা কাশ্মিরি, ফায়দ্বুল বারি: ১/১৩৬, ইমাম নববি, শারহু মুসলিম: ৩/৮৭ ↩︎
- সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫ ↩︎
- ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৩০৬২ ↩︎
- সুরা নাহল, আয়াত: ৯৭ ↩︎
- সুরা ইসরা, আয়াত: ১৫ ↩︎
- ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ৩৯০৪; হাদিসটি সহিহ ↩︎
- সুরা আন নামল, আয়াত: ৬৫ ↩︎
- ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৫৭১৪ ↩︎
- সুরা আল আ’রাফ, আয়াত: ১৮৮ ↩︎
- ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৩২৮৮ ও ৭৫৬১ ↩︎