Writing

নবীর কন্যা উম্মু কুলসূম বিনতে মুহাম্মদ (রাঃ) এর জীবনী

উন্মু কুলসুম (রাঃ)-এর জন্ম ও পরিচয়

উন্মু কুলসুম (রাঃ) খাদীজাতুল কুবরার (রাঃ) গর্ভজাত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তৃতীয়া কন্যা। তাঁর আসল নাম ছিল উমাইয়া আর কুনিয়াত বা উপনাম ছিল উন্মু কুলসুম। উপনামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন।

উন্মু কুলসুমের (রাঃ) জন্ম তারিখ, ইতিহাস এবং জীবনী গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায় না। তবে যেহেতু রুকাইয়ার (রাঃ) জন্ম হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াত লাভের ৭ বৎসর পূর্বে এবং ফাতিমার (রাঃ) জন্ম হয় ৫ বৎসর পূর্বে এবং যেহেতু এটা স্বীকৃত সত্য যে, রুকাইয়া (রাঃ) ছিলেন উম্মু কুলসূমের (রাঃ) বড় এবং ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন ছোট, কাজেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, উন্মু কুলসুমের (রাঃ) জন্ম হয় নবুওয়াতের ৬ বৎসর পূর্বে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ৩৪ বৎসর বয়সে।

কোন কোন মতে নবুওয়াতের দুই বৎসর পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ৩৮ বৎসর বয়সে উম্মু কুলসুমের (রাঃ) জন্ম হয়। এটা মেনে নিলে উম্মু কুলসূম (রাঃ)-কে ফাতিমার (রাঃ) তিন বৎসরের ছোট বলে মেনে নিতে হয় যা হবে স্বীকৃত সত্যের বিপরীত আর রুকাইয়া (রাঃ) এবং উম্মু কুলসূমের (রাঃ) একই সাথে আবু লাহাবের দুই পুত্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যহীন।

উম্মু কুলসুমের (রাঃ) জীবনী সম্পর্কে বেশী তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর শৈশবের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে আবু লাহাবের দ্বিতীয় পুত্র উতাইবার সাথে তাঁর বিয়ের কথা এবং “তাব্বাত ইয়াদা আবী লাহাবিউ” আয়াতটি নাজিল হওয়ার পর উক্ত বিবাহ বন্ধনের বিচ্ছেদ হওয়ার ঘটনা।

উন্মু কুলসুম (রাঃ)-এর বিয়ে ও তালাক

আবু লাহাবের প্রথম পুত্র উৎবা যে অবস্থায় রুকাইয়া (রাঃ)-কে তালাক দিয়ে বিবাহের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলে যা রুকাইয়ার (রাঃ) জীবন-কাহিনীতে বিবৃত হয়েছে, ঐ একই উপায়ে উতাইবাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তৃতীয়া কন্যা উন্মু কুলসূম (রাঃ)-কে রুখসতী অর্থাৎ স্বামী গৃহে গমনের পূর্বেই তালাক দিয়ে দেয়। কিন্তু তালাক দিয়েই সে ক্ষান্ত হয় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সে বেয়াদবীর চূড়ান্ত পরিচয় দিতে থাকে। অত্যন্ত আপত্তিকর ও অসম্মানসূচক বাক্যাবলী সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে উচ্চারণ করে চলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কানে এ সব কথা আসতে থাকে। তিনি ব্যথিত এবং মর্মাহত হন। একদিন উতাইবার এমনি এক মর্মবিদারী বাক্যবাণে বিদ্ধ হওয়ার ফলে তাঁর আহত হৃদয় থেকে স্বতঃ উৎসারিত হয়ে এই কথা তাঁর পবিত্র মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে: পরওয়ারদিগার। তোমার দুই সৃষ্ট জীবের (বাঘ ও সিংহ) মধ্য থেকে একটিকে এই বদবখতের পিছনে লাগিয়ে দাও।

উতাইবা যেভাবে ধ্বংস হলো

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাৎকারী রূপে অবতীর্ণ না হলেও তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে আসা- উক্ত বদ-দু’আ ব্যর্থ হতে পারে না। আল্লাহর দরবারে তা গৃহীত হয় এবং উতাইবা অপমৃত্যুর শিকারে পরিণত হয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বদ-দু’আ শুনার পর মুহূর্ত থেকে উতাইবার মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়। তার পিতা আবু লাহাবের মনেও আতঙ্ক দেখা দেয় এবং উভয়ের চেহারায় ত্রাস ও আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠে।

কিছুদিন পর উতাইবা এবং আবু লাহাব উভয়ে বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়া যাত্রা করে। পথিমধ্যে এক স্থানে হঠাৎ উতাইবার মনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বদ-দু’আর কথা উদিত হয়, সাথে সাথে আশঙ্কা ও আতঙ্ক তার হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলে। ভয় হয় কখন কোন মুহূর্তে অতর্কিতে বাঘের আক্রমণ ঘটে যায়। তার সঙ্গী সাথীরা তাকে নানা কথায় নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবু আতঙ্ক দূর না হওয়ায় অবশেষে কাফিলার বাণিজ্য সম্ভার দিয়ে চারিদিকে প্রাচীরের মত এক রক্ষাব্যূহ তৈরী করে উতাইবাকে তার মধ্যস্থলে রেখে সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু মারে আল্লাহ রাখে কে?

রাত্রি গভীর হয়ে চলল। মধ্যরাত্রি পার হওয়ার পর কোথা থেকে কোন দিক দিয়ে সহসা এক হিংস্র জন্তুর আবির্ভাব ঘটল। সে জন্তু এক লাফে মালপত্রের প্রাচীর টপকে একেবারে উতাইবার ঘাড়ে গিয়ে পড়ল এবং এক পলকের মধ্যে তার ঘাড় মটকিয়ে তাকে পীঠে তুলে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। যারা উতাইবার পাহারায় নিয়োজিত ছিল তারা ভীত চকিত নয়নে এই অচিন্তপূর্ব ভয়াবহ দৃশ্য শুধু দেখতে পেল কিন্তু কিছুই করতে পারল না। কাঠের পুতুলের ন্যায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর হতভম্ব হয়ে গেল।

উসমান (রাঃ)-এর সাথে উন্মু কুলসুমের শুভ বিবাহ

একথা আমরা পূর্বেই অবগত হয়েছি যে, উসমান (রাঃ) তদীয় প্রথমা স্ত্রী রুকাইয়া (রাঃ)-কে অত্যধিক ভালবাসতেন। এই ভালবাসা রুকাইয়ার (রাঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত অব্যাহত এবং অবিচল ছিল। তাঁর ইন্তিকালে উসমান (রাঃ) শোকে মুহ্যমান হলেন। তিনি সব সময় চিন্তাযুক্ত থাকতেন। তাঁর চিন্তা এবং উদ্বেগের ছাপ তাঁর চেহারায় ধরা পড়ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা তাঁকে এরূপ বিমর্ষ অবস্থায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবূ আবদিল্লাহ! (উসমান (রাঃ)-এর উপনাম) তোমাকে সর্বদাই বিমর্ষ ও চিন্তাযুক্ত দেখতে পাই, এর কারন কি?

উসমান (রাঃ) জওয়াবে বললেন:
রুকাইয়ার (রাঃ) মৃত্যুতে আমার কোমর ভেঙ্গে গেছে। আমার উপর এমন মুসীবত নাযিল হয়েছে যা আর কারও উপর নাযিল হয়নি। তাঁর মৃত্যুশোকে আমার হৃদয় ভেঙ্গে খান-খান হয়ে গেছে। বিশেষ করে তাঁর মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আমার যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল তা ছিন্ন হয়েছে, ফলে যে নৈকট্য অর্জিত হয়েছিল তাও ব্যাহত হয়ে গেছে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে তখন আশ্বস্ত করে বললেনঃ
“তুমি চিন্তিত হয়ো না, উদ্বিগ্ন হয়ো না। সাধারণ লোকের মধ্যে বৈবাহিক কারণে অর্জিত সম্পর্ক স্ত্রীর মৃত্যু দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলেও তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা এমন নয় যে, আমার কন্যা রুকাইয়া (রাঃ)-এর মৃত্যুতে তা ছিন্ন হয়ে যাবে।” একথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাবছিলেন কি করে উসমানের (রাঃ) শোক দূরীভূত এবং দুঃখ কষ্টকে আনন্দ উল্লাসে পরিণত করা যায়। এমন সময় জিব্রীল (আঃ) ঐশী বাণী নিয়ে হাজির হলেন। বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আপনার নিকট তাঁর পয়গাম পাঠিয়েছেন, “আপনার চোখের জ্যোতিঃ উম্মু কুলসূমকে রুকাইয়ার মোহরেই উসমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দিন। আর তাকে একথা বলে দিন: সে যেন উম্মু কুলসুম (রাঃ)-কে ঠিক রুকাইয়া (রাঃ)-এর মত ভালবাসে এবং তেমনি আদর যত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথেই তাঁকে উক্ত | খোশখবর শুনালেন। উসমান (রাঃ)-এর তখন সমস্ত দুঃখ বেদনা আনন্দে রূপান্তরিত হল। সেই আনন্দের কোন সীমা পরিসীমা রইল না।

হিজরী তৃতীয় বর্ষের ববিউল আউয়াল মাসে রুকাইয়ার(রাঃ) মোহরেই উসমান (রাঃ)-এর সাথে উম্মু কুলসুম (রাঃ)-এর শুভ বিবাহ যথারীতি সুসম্পন্ন হল।

যুন্ নূরাইন

উসমান (রাযিঃ) এ বিবাহের ফলশ্রুতিতে একটি বিশেষ খিতাবে (উপাধিতে) ভূষিত হলেন আর তা হল যুন্-নূরাইন- অর্থাৎ দুই নূরের অধিকারী। এ দুই নূর হচ্ছে রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-এর দুই কন্যা। ‘উসমান (রাযিঃ) পর পর রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর দুই কন্যাকে বিয়ে করার দুর্লভসৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তিনি ছাড়া কোন ব্যক্তির নাবীর দু’কন্যার স্বামী হওয়ার সৌভাগ্য কারো ভাগ্যে ঘটেনি। এ ব্যাপারে তিনি একক এবং অন্যান্য বহু দিকের ন্যায় এ দিক দিয়েও তিনি বিশেষ ফাযীলাত এবং শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।

স্বামীর মর্যাদা সম্পর্কে স্ত্রীর গৌরবানুভূতি

আদর্শ স্ত্রীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা তাদের স্বামীদের উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন দেখতে এবং তাদের গুণগান শুনতে অভিলাষী হন এবং তাদের গৌরব বোধ করে থাকেন। রাসূল-কন্যা উম্মু কুলসূম (রাযিঃ) মধ্যেও আদর্শ নারী চরিত্রের এ বৈশিষ্ট্য পূর্ণ মাত্রায় বিরাজমান ছিল।

এক দিনের কথা। উম্মু কুলসূম (রাযিঃ)-এর মনে এ কৌতূহল জাগ্রত হল আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর নিকট তাঁর স্বামীর আসন কোথায়-বিশেষ করে তাঁর ছোট বোন ফাতিমা (রাযিঃ)-এর স্বামী ‘আলী (রাযিঃ)-এর মুকাবিলায়।

যেমন মনে হওয়া তেমনি তিনি তাঁর সম্মানিত পিতা রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-এর দরবারে গিয়ে হাজির হয়ে আরয করলেন: আব্বাজান! অনুমতি পেলে আমি আপনার খিদমাতে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। স্নেহপ্রবণ পিতা মুচকি হেসে বললেন: হ্যাঁ বেটি, নিশ্চয়, বল- তোমার প্রশ্নটা কি?

লজ্জাবনত বদনে, বিনয়-নম্র বচনে উন্মু কুলসূম (রাযিঃ) আরয করলেন, আমার মনে কৌতূহল জেগেছে এই কথা জানতে যে, আমার স্বামী উসমান (রাঃ) এবং ফাতিমার (রাঃ) স্বামী আলী (রাঃ) এর দু’জনের মধ্যে কার মর্তবা শ্রেষ্ঠতর কার মর্যাদা উচ্চতর?

প্রশ্নটা ছিল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সূক্ষ্মতাত্বিক। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেয়া সাধারণতঃ সুকঠিন। বিশেষ করে যখন এর সাথে কন্যার ভাবাবেগ, স্বামীর প্রতি অনুরাগ-ভক্তি এবং গৌরববোধ জড়িত। কিন্তু সমগ্র বিশ্বের পথ প্রদর্শক ও শিক্ষক রূপে যার আগমন ঘটেছিল এবং মানব প্রকৃতি সম্পর্কে যার জ্ঞান ছিল অত্যন্ত প্রখর তাঁর পক্ষে এর সন্তোষজনক উত্তরদান কঠিন ছিল না। তিনি ক্ষণিকের জন্য খামোশ থেকে পরক্ষণেই উত্তর দিলেন:

প্রিয় কন্যা! তোমার এই কথা শুনে খুশী হওয়া উচিত যে, তোমার স্বামী উসমান (রাঃ) ঐ সব ভাগ্যবান ব্যক্তিদের অন্যতম যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অন্তর দিয়ে ভালবাসে এবং আল্লাহ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে অনুরূপ ভালবাসেন।

তারপর তিনি বললেন:
আমি যখন বেহেশতে ভ্রমণরত ছিলাম তখন দেখতে পেলাম তোমার স্বামীর বালাখানা সব চেয়ে প্রশস্ত, সব চেয়ে উচ্চ- আমার অন্য কোন সাহাবীর জন্য এর চাইতে প্রশস্ততর ও উচ্চতর বালাখানা আর একটাও দেখতে পেলাম না। তাঁর এই বিশেষ মর্যাদা এজন্যই দেয়া হবে যে, কিছু লোক তাঁকে হত্যা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠবে আর সেদিন উসমান (রাঃ) সবর এবং শুকরিয়ার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

উন্মু কুলসুম (রাঃ)-এর গুণাবলী ও চরিত্র-বৈশিষ্ট্য

সৎ-স্বভাব, অমায়িক ব্যবহার এবং মিষ্টি ভাষা ছিল উম্মু কুলসুমের (রাঃ) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

তিনি তাঁর স্বামীর খিদমত করতেন তাঁর দরদ মাখা অন্তর দিয়ে। উভয়ের দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল মাধুর্যমণ্ডিত। মাত্র ছয় বৎসরের কিছু অধিককাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল তাদের মিলিত জীবন। এই সময়ে তাঁদের প্রেম ও প্রীতিতে পরিপূর্ণ সম্পর্কটি নিরন্তর এমন মধুময় ছিল যে, একদিনের জন্যও তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়নি, কারো বিরুদ্ধে কারো কোন দুঃখ অভিযোগ ছিল না। এক ঐতিহাসিক লিখেছেন, উম্মু কুলসূম (রাঃ) স্বীয় সম্মানিত পিতার নির্দেশ-ক্রমে সর্বদা স্বামীর কথামত চলতেন এবং তাঁর খিদমত করতে ব্যস্ত থাকতেন। অপর পক্ষে তিনি পিতার সেবার কোন সুযোগ যখন পেতেন তখন তার সদ্ব্যবহার করতেও উন্মুখ থাকতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁর গৃহে প্রবেশ করতেন তখন তিনি মনে-প্রাণে তাঁর খিদমত করতেন।

উন্মু কুলসুম (রাঃ)-এর ইন্তিকাল

উম্মু কুলসূম (রাঃ) নবম হিজরীর শাবান মাসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সম্ভাব্য সব রকম চিকিৎসা সত্ত্বেও আল্লাহর ডাকে তাঁকে সাড়া দিতে হল। প্রিয় স্বামী এবং সম্মানিত পিতাকে শোকাকুল করে তিনি এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মায়া ছেড়ে অপরিণত বয়সে চিরস্থায়ী ঠিকানায় প্রস্থান করলেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নয়নমণি ও কলিজার টুকরাকে গোসল দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। উম্মু আতিয়াহ, আসমা বিনতে উমায়স, সাফিয়া বিনতু আবদুল মুত্তালিব এবং লাইলা বিনতু কায়িফ (রাঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ মত তাঁর গোসল দিলেন। গোসল শেষে যখন তিনি লাইলা বিনতু কায়িফের নিকট একটির পর একটি কাফনের কাপড় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র চক্ষু যুগল থেকে টপ টপ করে অশ্রু ধারা ঝরে পড়ছিল।

বলাবাহুল্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তার জানাযার নামায পড়ালেন।

তাঁকে মাদীনার ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে দাফন করা হল। অনুমতি ক্রমে আবূ তালহা, আলী, ফযল ইবনু আব্বাস এবং উসামা ইবনু যায়িদ (রাঃ) একের পর এক কবরে অবতরণ করেন। উসামা ইবনু যায়িদ (রাঃ) দেহ কবরে শায়িত করলেন।

আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন: যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ তালহাকে কবরে নামার অনুমতি দিলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের পাশে অবস্থান করছিলেন। দেখা গেল তখন তাঁর পবিত্র চক্ষুদ্বয় থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু বয়ে চলেছে।

দাফনের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন:
বিয়ে দেয়ার মত আমার আর কোন কন্যা নেই- যাকে উসমানের (রাঃ) সাথে বিয়ে দিতে পারি, থাকলে তৃতীয় দফায় আমি তাকেও উসমানের (রাঃ) হাতে সঁপে দিতাম।

আলী (রাঃ) বলেন: নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
যদি আল্লাহ আমাকে চল্লিশ জন কন্যা দিতেন তা হলে প্রয়োজনে আমি একের পর এক প্রত্যেককে উসমানের (রাঃ) নিকট বিয়ে দিতাম-আমার শেষ মেয়েটি পর্যন্ত।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যদি আমার একশতটি মেয়ে থাকত এবং একের পর একটি মারা যেতো- তবু আমি তাদের প্রত্যেকের বিবাহ উসমানের (রাঃ) সাথে দিতে থাকতাম।

সংগ্রহীত
লেখকঃ- হুসাইন বিন সোহরাব
বইঃ- প্রিয় নবীর কন্যাগণ

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture