Writing

নবীর কন্যা রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মদ এর জীবনী

রুকাইয়া (রাঃ)-এর পরিচয়

রুকাইয়া (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বিতীয়া কন্যা। নবুওয়াত লাভের ৭ বৎসর পূর্বে খাদীজাতুল কুবরার (রাঃ) গর্ভে রুকাইয়া (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়স তখন ৩৩ বৎসর।

রুকাইয়া (রাঃ)-এর শৈশব কাল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। শুধু এইটুকু জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নবুওয়াত লাভের পূর্বেই রুকাইয়া এবং তাঁর ছোট বোন উন্মু কুলসুমের শুভ বিবাহ তাঁর অন্যতম চাচা আবু লাহাবের দুই পুত্র যথাক্রমে উৎবা ও উতাইবার সাথে সম্পন্ন করেন। বয়সে খুব ছোট ছিলেন বলে তাদের স্বামীগৃহে প্রেরণ করা হয়নি।

ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত লাভ করলেন। আল্লাহর নির্দেশ মত তিনি প্রথমে গোপনে এবং তিন বৎসর পরে প্রকাশ্যে ইসলামের প্রতি স্বজনবর্গ ও লোকদিগকে আহ্বান জানাতে থাকলেন। তাঁর এই আহ্বান ও প্রচার কার্যের ফলে দু’একজন করে পিতৃধর্ম প্রতিমা পূজা ছেড়ে আল্লাহর সিরাতে মুস্তাকীম- সোজা সরল পথ অবলম্বন করলেন। সর্বপ্রথম বিবি খাদীজা (রাঃ) এবং তার পর পরই তাঁর কন্যাগণও ইসলাম কবুল করে ধন্য হলেন।

এতে মক্কার কাফিরগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রাণের শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং নবদীক্ষিত মুসলমানগণকে নানাভাবে লাঞ্ছনা গঞ্জনা এবং অমানুষিক কষ্ট দিতে লাগল। এই দুশমনদের মধ্যে তাঁর চাচা আবু লাহাব এবং চাচী উন্মু জামীলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর আবু লাহাবের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দৈহিক যাতনা এবং রূঢ় ব্যবহারে মনঃকষ্ট প্রদানের বহু বিবরণ বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। এখানে তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। তবে উল্লেখযোগ্য কথা হচ্ছে যে, এ ব্যাপারে তার স্ত্রী উন্মু জামীলা ছিল তার সহকর্মিণী বরং এক ধাপ অগ্রবর্তিণী। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কষ্ট দেওয়ার মানসেই বনে জঙ্গলে গিয়ে কাঁটাধারী বৃক্ষ থেকে কাঁটাওয়ালা শাখা কেটে আনত এবং রাত্রির আঁধারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যাতায়াত পথে সেই কাঁটা বিছিয়ে রাখত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রত্যুষে সেই পথ দিয়ে হাঁটতেন তখন কাঁটার আঘাতে তার পা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যেত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ইসলামের চিরশত্রু এই দম্পতি-যুগলের দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার-নির্যাতন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন আল্লাহ তা’আলা সূরা লাহাব নাযিল করলেন- যাতে বলা হয়েছে:
“বিনষ্ট হোক আবু লাহাবের বাহু যুগল এবং বিনষ্ট হোক সে নিজেও। তার ধন-দৌলত এবং তার কামাই রোজগার কোনই উপকারে আসল না তার। অনতিবিলম্বে সে প্রবেশ করবে দাউ দাউ করা প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে এবং তার সাথে তাঁর (চুগলখোর) স্ত্রীও, যে বন থেকে কাষ্ঠ বহন করে আনত। তার গ্রীবাদেশে আঁকড়ে থাকবে খেজুর (গাছের) দৃঢ় রজ্জু।”

এই সূরা নাযিল হওয়ার সংবাদ পেয়ে আবু লাহাব এবং তার হিংসুটে বিবি উম্মু জামীলা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। আবু লাহাব দাঁত কড়মড় করতে করতে তার দুই পুত্রকে ডেকে বললোঃ
“এই মুহূর্তে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাড়ীতে গিয়ে তোরা দু’জন তার দুই কন্যাকে তালাক দিয়ে আয়, আমি আমার বাড়ীতে দুশমনের মেয়েদের। বরদাশত করতে পারব না।”

উসমান (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ

আল্লাহ তো আগে থেকেই তাদের জন্য পর পর সর্বোত্তম এক বর ঠিক করে রেখেছিলেন আর তিনি ছিলেন পরবর্তীকালে ইসলামের তৃতীয় খলীফা, সহিষ্ণুতা ও অমায়িক ব্যবহার, সংযম ও ধৈর্যশীলতা, দানশীলতা ও বদান্যতা, ক্ষমাশীলতা ও ধার্মিকতা প্রভৃতি অতুল্য চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী উসমান ইবনু আফ্ফান (রাঃ)।

উসমান (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ এবং রুকাইয়া (রাঃ)-এর সাথে তাঁর শুভ বিবাহের চমকপ্রদ ঘটনাবলী বিভিন্ন সীরাত, আসমাউর রিজাল ও ইতিহাস গ্রন্থে বিবৃত রয়েছে। সেই সব বিবৃতির সার সংক্ষেপ নিম্নে আলোচনা করা হলো:

সম্ভ্রান্ত কুরাইশ যুবকদের মধ্যে আকর্ষণীয় সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন উসমান ইবনু আফফান (রাঃ)। তিনি ছিলেন কুরাইশ গোত্রের হাকামী বংশোদ্ভূত। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন হাশিমী বংশের অন্তর্ভুক্ত। অভিজাত কুরাইশদের মধ্যে হাশিমীদের পরেই ছিল হাকামীদের বংশ কৌলিন্যের মর্যাদা। সমগ্র কুরাইশ গোত্রের পুরুষদের মধ্যে উসমান (রাঃ) ছিলেন যেমন সৌন্দর্যে অনুপম, তেমনই চরিত্র গুণে অতুলনীয়। তাঁর ধন-দৌলত ছিল যেমন অগাধ, তেমনই তাঁর হৃদয়টিও ছিল উদার ও প্রশস্ত। অপর দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বিতীয়া কন্যা রুকাইয়াও ছিলেন অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যের অধিকারিণী। শুধু দৈহিক সৌন্দর্যই নয়, জ্ঞানে ও গুণেও তিনি ছিলেন পরম আকর্ষণীয়া।

উসমান (রাঃ)-ও রুকাইয়া (রাঃ)-কে বিয়ে

উসমান (রাঃ) তাঁর প্রতি মনে মনে আকর্ষণ বোধ করলেও অবস্থা পরস্পরায় মনের আকাঙ্খা মনেই গোপন রেখেছিলেন। উসমান (রাঃ) নিজেই বলেছেন:
একদিন আমি খানায়ে কা’বায় বন্ধু বান্ধবদের সাথে বসে আছি- এমন সময় কোন এক ব্যক্তি এসে খবর দিল যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যা রুকাইয়ার (রাঃ) বিবাহ সম্পন্ন করলেন আবু লাহাবের পুত্র উৎবার সাথে। রুকাইয়ার অনুপম রূপে গুণে তাঁর প্রতি আমার হৃদয়ের একটা অনুরাগ এবং প্রছন্ন প্রবণতা ছিল। হঠাৎ এ সংবাদে আমার চিত্ত-চাঞ্চল্য দেখা দিল। আমি উক্ত সংবাদ শুনে সেখানে আর স্থির থাকতে পারলাম না। সোজা নিজ গৃহে ফিরে আসলাম। ঘটনা চক্রে আমাদের বাড়ীতে আমার খালা আম্মা সা’দা উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলেন কবি এবং কাহিনীকার। আমাকে দেখেই তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কবিতার ছন্দে বলে চললেন:

ওগো উসমান। তোমার জন্য শুভ সংবাদ:
তোমার উপর শান্তি (সালাম) বর্ষিত হোক তিন বার, আবার তিন বার, পুনরায় তিন বার এবং তারও পরে আর একবার। এই ভাবে দশ দফা সালাম পূর্ণ হোক। তুমি পেয়ে গেছ এক উত্তম জিনিস আর বেঁচে গেছ এক খারাপ বস্তু থেকে। আল্লাহর কসম! তুমি বিয়ে করেছ এক সম্ভ্রান্ত সচ্চরিত্র সুন্দরী মেয়েকে, তুমি নিজে একজন নিষ্কলঙ্ক কুমার, পেয়ে গেছ এক পূত-চরিত্রা কুমারীকে- যে কুমারী এক বিরাট মর্যাদা সম্পন্ন মহৎ ব্যক্তির কন্যা।

বিশ্বয় বিস্তৃত নেত্রে খালাআমাকে লক্ষ্য করে উসমান (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন: খালাআম্মা!
আপনি এ কি কথা বলছেন? এ কী করে সম্ভব?
উসমান (রাঃ) খালা সা’দা তখন বললেন:
“উসমান! হে উসমান। ওগো উসমান! তুমি নিজে সুন্দর সুপুরুষ এবং বিপুল শান শওকতের অধিকারী আর আমাদের এ নাবী যে বন্ধু নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তা হচ্ছে সুস্পষ্ট প্রমাণ-সিদ্ধ, তিনি হচ্ছেন সমস্ত নবী ও রাসূলদের সরদার। তাঁকে পাঠিয়েছেন মহান আল্লাহ। তার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে পবিত্র কুরআন, তুমি তাঁর প্রতি ঈমান এনে তাঁকে অনুসরণ করে চল। তুমি প্রতিমা পূজার ধোঁকায় আর পড়ে থেকো না।”

উসমান (রাযিঃ) বলেছেন, আমার মনের বিস্ময় এবং দ্বিধা দ্বন্দ তখনও কেটে উঠল না, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। খালাআম্মার খিদমাতে নিবেদন করলাম, আমি আপনার কথার মর্ম উদ্ধার করতে পারলাম না। কথাগুলো আরও একটু ব্যাখ্যা করে বলুন। তখন তিনি বলতে লাগলেন:
“শুন! মুহাম্মাদ ইবনু ‘আব্দুল্লাহ হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল। তিনি আল্লাহর নিকট থেকে নিয়ে এসেছেন আল-কুরআন। সে কুরআনের মাধ্যমে তিনি লোকদেরকে আল্লাহর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি নিয়ে এসেছেন আলোক-বর্তিকা। আর সেটা সত্যিকারের আলোক-বর্তিকা। তার দ্বীন হচ্ছে মুক্তি ও সাফল্য অর্জনের একমাত্র উপায়…..

এসব কথা শুনে ‘উসমান (রাযিঃ)-এর চিত্ত-চাঞ্চল্য বেড়ে চলল। মনের গভীরে যাকে তিনি সযতনে স্থান দিয়ে রেখেছিলেন তার বিয়ের সম্বন্ধ তো অন্যত্র পাকা হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তার খালাআম্মার কথার অর্থ কি হতে পারে? এসব ভাবনায় তাঁর মন ভীষণভাবে আন্দোলিত। তারপর রুকাইয়া (রাযিঃ)-এর পিতা মুহাম্মাদ এর যে নুতন দ্বীন প্রচার করছেন তার সত্যতা, স্পষ্ট প্রমাণিকতা এবং মহান আল্লাহর তরফ থেকে তার প্রেরণের কথা যেরূপ নিশ্চিত প্রত্যয়ের সাথে তাঁর খালাআম্মা ঘোষণা করলেন তাতে তাঁর হৃদয়ে আর এক দিক দিয়ে প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি হল।

ব্যক্তি জীবনে নৈরাশ্য ও আশার দ্বন্দু, আর সমাজ জীবনে মহা বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এক প্রদীপ্ত সূর্যের আবির্ভাব। তাঁর হৃদয়ে অঙ্কিত হল গভীর রেখাপাত, দেখা দিল ভীষণ চিন্তা ভাবনা।

মনের এই বিক্ষুব্ধ এবং কৌতূহল-পীড়িত অবস্থা নিয়ে উসমান (রাঃ) গিয়ে উপস্থিত হলেন তাঁর সুখ দুঃখের বিশ্বস্ততম বন্ধু আবু বকর (রাঃ) সমীপে।

মাঝে মাঝেই তিনি তাঁর কাছে যেতেন। তাঁর সাথে কথা বলে ও আলাপ আলোচনায় সময় কাটিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন, উপকৃতও হতেন। প্রবল আশা নিয়েই সেই দিন তিনি তাঁর সম্মুখে গিয়ে হাজির হলেন। তাঁর চেহারায় তখন গভীর চিন্তার ছাপ। মনস্তত্ব সম্পর্কে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন আবু বকর (রাঃ) তাঁকে দেখেই তাঁর মনের অবস্থা আঁচ করতে সক্ষম হলেন।

কথা প্রসঙ্গে সুযোগ বুঝে আবু বকর (রাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বললেন-
“ভাই উসমান (রাঃ)। তুমি একজন সুবিবেচক এবং বুদ্ধি-দীপ্ত মানুষ। আজও যদি তুমি হক ও বাতিলের পার্থক্য বুঝতে এবং সত্যকে চিনে উঠতে না পেরে থাকো তবে তার চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আর কি হতে পারে?
এই যে পাথরের মূর্তিগুলোকে নিজ হাতে বানিয়ে তারই পূজা ওরা করে চলেছে, তুমিই বলো, এরা কি কিছু শুনতে পায়? না কারো কোন উপকার কিংবা কোন ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা এদের আছে।”

আবু বকর (রাঃ)-এর সহজ ভাবে বলা এই সোজা সরল কথাগুলো উসমানের (রাঃ) কানের ভিতর দিয়ে হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল। তার বিক্ষুব্ধ হৃদয়ে প্রচণ্ড ঝড় দেখা দিল। এই ঝড়ের তীব্র আঘাতে তাঁর ভিতরের মানুষটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তিনি বলে উঠলেন:
“আপনি যা বলছেন, সবই ঠিক। পাথরের তৈরী প্রতিমাগুলোর এতটুকুও ক্ষমতা নেই। এদের পূজা করা সম্পূর্ণ নিরর্থক।” আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ “ঠিক বলেছ ভাই। চলো আর দেরী নয়, এখনই আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে যাই, তিনি কি বলেন মনোযোগ দিয়ে শুনো।

উসমান (রাঃ) তার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজী হলেন এবং অনতিবিলম্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে গিয়ে হাজির হলেন। অন্য বিবরণে- ঘটনাক্রমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং সেখানে এসে হাজির হলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেনঃ
“হে উসমান (রাঃ)! আল্লাহ তোমাকে সুখসমৃদ্ধ চিরন্তন জীবনের পথে আহ্বান জানাচ্ছেন, তুমি সে আহ্বানে সাড়া দাও। বিশ্বাস কর, আমি আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবী, তোমাদের প্রতি এবং সমগ্র মানবমণ্ডলীর প্রতি সত্য জীবন বিধান সহকারে প্রেরিত।”

উসমান (রাঃ) স্বয়ং বলছেন, একমাত্র আল্লাহই জানেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্ত কথাগুলো আমার হৃদয়ে কী এক আশ্চর্য্য প্রভাব বিস্তার করে ফেললো, আমার মনের বিস্ময় এবং দ্বিধা দ্বন্দ্ব এক নিমিষে দূর হয়ে গেল। মুহূর্তেই সত্যের জ্যোতি আমার হৃদয়ফে প্রদীপ্ত করে তুললো, স্বতঃস্ফূর্ত আমি ঘোষণা করলামঃ

اشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمدا رسول الله
আশহাদু আল্-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনই উপাস্য নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।

কিছুদিনের মধ্যেই উসমান (রাঃ)-এর খালাআম্মা সা’দার আশার বাণী কার্যে পরিণত হওয়ার সুযোগ এসে গেল। আবু লাহাব এবং উন্মু জামীলার পুত্র উৎবা রুকাইয়ার সাথে তার বিবাহের সম্পর্ক চুকিয়ে দিল, বিবাহ ভেঙ্গে গেল, অথচ রুকাইয়ার কুমারিত্ব বজায় রইল। অনুপম সৌন্দর্য, নিষ্কলঙ্ক চরিত্র এবং বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী উসমান (রাঃ)-এর সাথে রুকাইয়ার (রাঃ) শাদী মুবারাক যথা নিয়মে সুসম্পন্ন হয়ে গেল।

দৈহিক সৌন্দর্য

সমগ্র আরবের মধ্যে কুরাইশরা ছিল সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত। স্বভাবতঃই দৈহিক সৌন্দর্যেও তারা ছিল সকলের ঊর্ধ্বে। তাদের মেয়েরাও হত প্রায়শঃ সুন্দরী। সে সময়ে সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে যারা ছিল সুন্দরতম, রুকাইয়া (রাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম। তাঁর দৈহিক গঠন ও রূপের খ্যাতি সমগ্র মক্কায় ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর জীবনসাথী রূপে যাঁকে জুটিয়ে দেন সেই উসমান (রাঃ) ও ছিলেন তেমনি আকর্ষণীয় সৌন্দর্যের অধিকারী। সমসাময়িক কুরাইশ যুবকদের মধ্যে সৌন্দর্যে কেউ তাঁর মতো ছিল না বললেই চলে।

যেমন স্বামী তেমনি স্ত্রী। উভয়কে একত্রে দেখলে মনে হত কী চমৎকার মানিয়েছে তাদের মিলন। এমন মিলন খুব কমই ঘটে থাকে।

এই প্রসঙ্গে এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাদিম ছিলেন বালক উসামা ইবনু যায়িদ। একবার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পাঠালেন উসমানের (রাঃ) গৃহে। উসামা (রাঃ) নিজেই বলেন:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কিছু ভুনা গোশত দিয়ে বললেনঃ যাও, উসমান (রাঃ)-এর ঘরে দিয়ে এস। আমি সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখলাম উসমান (রাঃ) এবং রুকাইয়া (রাঃ) একই চাটাইয়ে বসে আছেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই এত সুন্দর দেখাচ্ছিল যে, আমি একবার তাকাই রুকাইয়া (রাঃ)-এর দিকে, আর একবার তাকাই উসমান (রাঃ)-এর দিকে। ফিরে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একথা উল্লেখ করলাম। তিনি খুশী হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: বল দেখি, তুমি কি এদের চাইতে সুন্দরতর আর কোন মিঞা-বিবি দেখেছ? আমি বললাম, জী না, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

রুকাইয়া (রাঃ)-এর তালাক

উম্মু জামীলা রাগে অন্ধ হয়ে উৎবা এবং উতায়বাকে লক্ষ্য করে বলল-
“দেখ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোদের পিতা-মাতা সম্বন্ধে কী ভয়ানক কথা উচ্চারণ করেছে। এর পরও কি তারই দুই মেয়েকে আমাদের পুত্রবধু রূপে ঘরে আনা চলে?
তোরা এক্ষুণি গিয়ে তাদের তালাক দিয়ে আয়। যদি না দিস, তোদের সাথে আমাদের সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন। তোদের সাথে আমাদের কথা বলা, উঠা-বসা, একত্রে বাস করা হারাম

উৎবা এবং উতাইবা পিতা-মাতার আদেশ শিরোধার্য করে নিল। পর পর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হল। পিতা-মাতার মুখের উপর প্রথমে উৎবা দম্ভের সাথে উচ্চারণ করল:
“আমি রুকাইয়া (রাঃ)-কে তালাক দিলাম।”
উতাইবাও পরক্ষণে বলে গেল:
“আমি উম্মু কুলসূম (রাঃ)-কে তালাক দিলাম।”

স্বভাবতই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খাদীজা (রাঃ) জামাতাদের এই নিষ্ঠুর আচরণে ব্যথিত হলেন। স্বাভাবিক অনুমানেই বলা চলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়ত এই অবস্থাকে আল্লাহর মঙ্গল ইচ্ছার বাস্তবায়নরূপে গ্রহণ করেছিলেন। নিজে ধৈর্য ধরে খাদীজা (রাঃ)-কেও বৃহত্তর কল্যাণের আভাস দিয়ে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খাদীজা (রাঃ) সাময়িক ভাবে ব্যথিত হলেও ইসলামের ঘোরতর শত্রু আবু লাহাবের ঘরে যে তাদের প্রাণপ্রিয় কন্যাদ্বয়কে পুত্রবধূ রূপে যেতে হয়নি- এ জন্য মনে হয় তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলেছিলেন এবং রাহমানুর রাহীম আল্লাহর নিকট নিশ্চয় এদের জন্য উপযোগী, সুবিবেচক, জ্ঞান, বুদ্ধিসম্পন্ন ও ধর্মপরায়ণ মুসলিম সুপাত্রের আকাঙ্খায় প্রার্থনা করেছিলেন।

চারিত্রিক গুণাবলী

শুধু দৈহিক সৌন্দর্যেই নয়, রুকাইয়ার চারিত্রিক গুণাবলীও ছিল অতুলনীয়। খাদীজাতুল কুবরার (রাঃ) ক্রোড়ে প্রতিপালিত আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সাক্ষাৎভাবে সুশিক্ষা-প্রাপ্ত রুকাইয়ার (রাঃ) মধ্যে উভয়ের নৈতিক, চারিত্রিক এবং আধ্যাত্মিক গুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি ছিলেন প্রকৃতিগত ভাবে লাজুক, কথার ও আচরণে শালীন, চরিত্রে নিষ্কলঙ্ক ও নিষ্পাপ। পরম ধৈর্যশীল, অল্পতেই তুষ্ট, বিপদে আপদে অচঞ্চল ও সুদৃঢ়। কষ্ট বরণে তিনি পুরুষদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন- কাফিরদের নির্মম আচরণ ও নিষ্করুণ নিপীড়ন তিনি নীরবে বরদাশত করেছেন, মুখে আহ্ শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি।

পিতামাতার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা, মহব্বত ও খিদমাত এবং স্বামীর প্রতি অটল ভালবাসা আর সুখে দুঃখে তাঁর সার্বক্ষণিক সাহচর্যে অবস্থানের যে অতুল্য দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করে গেছেন তা কিয়ামত অবধি মুসলিম কন্যা, ভগ্নি ও স্ত্রীদের অনুসরণের জন্য চিরন্তন প্রেরণার উৎসরূপে বিরাজ করবে।

উসমান (রাঃ) – এর উপর নিষ্ঠুর অবিচার

বাপ-দাদার ধর্ম- প্রতিমা পূজার মোহ ও অন্ধ কুসংস্কার ছেড়ে যারা রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এক “লা-শারীক আল্লাহ” কে একমাত্র উপাস্যরূপে এবং মুহাম্মাদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -কে তাঁর রাসূলরূপে মেনে নিত তাদের উপর মক্কার কাফিরদের অত্যাচার ও নিপীড়ন নিষ্করুণভাবে নেমে আসত। সে নিষ্ঠুর ও লোমহর্ষক জুলুম নির্যাতন, অত্যাচার-অনাচারের করুণ বিবরণ লিপিবদ্ধ করার স্থান এখানে নয়।

রুকাইয়ার স্বামী অগাধ ধন-দৌলত, বিপুল মান-মর্যাদা এবং বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী ‘উসমান (রাযিঃ)-এর প্রতি তাঁর আপনজন ও কাফিরগণ অত্যাচারের যে নিষ্ঠুর লীলা চালিয়েছিল তারই কিঞ্চিৎ বিবরণ নিম্নে পেশ করছি।

‘উসমান (রাযিঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের সংবাদে তাঁর পরিবার-পরিজন এবং খান্দানের লোক সকল তাঁর প্রতি বিরক্ত এবং নারাজ হয়ে পড়ল। যখন তারা এবং কাফিরদের দল শুনতে পেল যে, তিনি রাসূল তনয়া রুকাইয়া (রাযিঃ)-কে স্বীয় সহধর্মিনীরূপে বরণ করে মুহাম্মাদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে সম্পর্কিত হয়ে গেলেন তখন তাদের ক্রোধ, ঘৃণা ও বিদ্বেষের সীমা-পরিসীমা রইল না।

তাবাকাত ইবনু সা’দের বরাতে প্রমাণিত হয়:

‘উসমান (রাযিঃ)-এর হাকাম ইবনুল ‘আস নামে এক চাচা ছিল। সে ছিল এক দয়া-মায়াহীন নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক। সে ‘উসমান (রাযিঃ)-এর প্রতি একের পর এক নির্মম ও নিষ্করুণ নিপীড়ন চালিয়ে যেতে লাগল। সে তাঁকে দড়ি দিয়ে বুকে-পিটে শক্ত করে বেধে চাবুকের পর চাবুকের কষাঘাত মেরে চলত। তাঁকে সে রশি দিয়ে বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখত, চাটাই দিয়ে তাঁকে মুড়িয়ে নীচে থেকে ধোঁয়া দিয়ে তাঁর শ্বাস রুদ্ধ করে তুলত। কিন্তু এত কঠোর শাস্তি দিয়েও তাঁর বিদ্বেষাগ্নি নির্বাপিত হত না।

এক দিনের ঘটনা।
আরবের প্রখর রৌদ্র-তাপে উত্তপ্ত বালুকাময় ময়দানে সে ‘উসমান (রাযিঃ)-কে লৌহবর্ম পরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখলেন। উপর থেকে মধ্যাহ্নের সূর্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করে চলেছে। ফলে নিম্নের জমি উত্তপ্ত বায়ু প্রবাহে প্রায় আগুন হয়ে উঠেছে। আর সে উত্তাপে লৌহবর্ম লালচে হয়ে উঠেছে তখন ঐশ্বর্যের ক্রোড়ে লালিত, সুখ প্রাচুর্যে পালিত ‘উসমান (রাযিঃ)-এর কোমলকান্ত দেহখানা সে দুঃসহ তাপে ভাজা মাছের মত ধড়ফড় করতে লাগল। চাচা হাকাম এ অবস্থা দেখে ভাবল, এবার বাছাধনের উপযুক্ত শিক্ষা হয়েছে। এবার আচ্ছা রকম শিক্ষাপ্রাপ্ত ভাতিজার দ্বীনে মুহাম্মাদীর মোহ কেটে যাবে- এবার বাপ-দাদার ধর্মে ফিরে আসবে।

কিন্তু চাচার সে আশার গুড়ে বালি। ভাতিজা সম্পূর্ণ নীরব ও নির্বিকার। মাজলুম ভাতিজার এ নিষ্ক্রিয় ও নির্বিকার অবস্থা দেখে জালিম চাচার ক্রোধাগ্নি দ্বিগুণ প্রজ্জ্বলিত হতে লাগল। ক্রোধ ও আক্রোশে সে হুঙ্কার দিয়ে বললো:

“বল, ‘উসমান তোর পূর্ব-পুরুষদের ধর্মই ভাল, না মুহাম্মাদ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর ধর্ম?”

এবার ‘উসমান (রাযিঃ) আর নীরব ও নিরুত্তর থাকতে পারলেন না। স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে তিনি জবাব দিলেন। আপনাদের ধর্ম কল্পিত ও সম্পূর্ণ মনগড়া, আর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم -এর দ্বীন স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট। তাই দ্বীনে মুহাম্মাদীই সত্য এবং উত্তম। চাচাজান, সে একক সত্তার কসম যার হাতে ‘উসমানের জীবন- আপনি যদি ‘উসমানকে হত্যাও করে ফেলেন, তবু সে “লা-শারীক আল্লাহ’র সত্য দ্বীন থেকে এতটুকু বিচ্যুত হবে না।

শুধু তাঁর চাচা হাকাম ইবনুল ‘আসই নয়, অন্যেরাও ‘উসমানের উপর অনুরূপ জুলুমের স্টিম রোলার চালাতে কুণ্ঠাবোধ করত না।
ইমাম সুয়ূতী (রাযিঃ) বলেন:
‘উসমান (রাযিঃ)-এর উপর অত্যাচার উৎপীড়ন চালাতে চালাতে জালিমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ত। কিন্তু ‘উসমান (রাযিঃ) সমস্ত জুলুম নির্যাতন নীরবে বরদাশত করতেন, ধৈর্যচ্যুত হতেন না।

রুকাইয়া ও উসমান (রাযিঃ)-এর হিজরাত

কিন্তু প্রত্যেক বস্তুরই একটা সীমা আছে- ধৈর্যও তার ব্যতিক্রম নয়। ‘উসমান (রাযিঃ) নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম জুলুম সহ্য করলেন, অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে চললেন। কিন্তু তাঁর ধৈর্যের পাত্র পূর্ণ হয়ে গেল তখন যখন কাফিররা তাকে তাঁর নিজের ঘরে নিবিষ্ট মনে আল্লাহর ‘ইবাদাতে বাঁধা দিতে শুরু করল। এ ছাড়া কাফিরদের স্পর্ধা এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে, আশঙ্কা হল তারা রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর কলিজার টুকরা রুকাইয়া (রাযিঃ)-এর উপর কোন অবাঞ্ছিত আচরণ করে না বসে।

অবস্থার এ প্রেক্ষিতে তিনি রাসূলের খিদমাতে হাযির হয়ে নিবেদন করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ! কাফিরদের সবরকম নির্মম অত্যাচার আমি নীরবে সহ্য করে এসেছি। কিন্তু এখন যে জালিমরা আমাকে আমার নিজ গৃহের নিভৃত প্রকোষ্ঠেও আল্লাহর ‘ইবাদাত করতে দিচ্ছে না। এখন এ অবস্থায় আমাকে যদি হিজরাতের অনুমতি দিতেন তা হলে বোধ হয় ভাল হত।

ওদিকে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন ‘উসমানের মনের কথাগুলো ব্যক্ত করার পূর্বেই জেনে গিয়েছিলেন, কারণ তিনি হচ্ছেন আলিমুল গাইব এবং অন্তর রাজ্যের গোপন খবর সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। ‘উসমান (রাযিঃ)-এর আরজী পেশের পূর্বেই রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-কে প্রত্যাদেশ নাযিল করেছেন: আপনি ‘উসমান এবং তার স্ত্রী রুকাইয়া (রাযিঃ)-কে হিজরাত করার আদেশ প্রদান করুন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান (রাঃ)-এর নিবেদন পেশ করার সাথে সাথেই আল্লাহর হুকুম মুতাবিক- আবিসিনিয়ায়- রুকাইয়া (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে হিযরত করার অনুমতি প্রদান করলেন।

উসমান (রাঃ) নবী দুলালী রুকাইয়া (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে যে কাফিলার সাথে আবিসিনিয়ার উদেশ্যে রওয়ানা হলেন তাতে মোট মুহাজিরের সংখ্যা ছিল ষোল। তন্মধ্যে পুরুষ ছিলেন বার জন এবং নারী মাত্র চার জন।

তারা অত্যন্ত গোপনে- চুপিসারে মক্কা ত্যাগ করে সমুদ্র তীরে পৌঁছে যান। সৌভাগ্য ক্রমে সেখানে পৌঁছেই দুটো বাণিজ্য জাহাজ পেয়ে যান। জাহাজের কর্মকর্তাগণ দয়া করে তাদেরকে জাহাজে তুলে নেন এবং নিরাপদে আবিসিনিয়ায় পৌঁছে দেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ ক্রমে আয়িশা (রাঃ)-এর বড় ভগ্নি আসমা বিনতু আবু বকর (রাঃ) সফরের সমস্ত প্রয়োজনীয় আসবাব-পত্র গুছিয়ে দিয়ে সমুদ্র তীর পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে আসেন। তাদের বিদায় দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে হাযির হয়ে তিনি নিবেদন করেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। উসমান (রাঃ) তাঁর স্ত্রী রুকাইয়াকে (রাঃ) সাথে নিয়ে আবিসিনিয়ার পথে রওয়ানা হয়ে গেছেন।

এদিকে কুরাইশগণ সংবাদ পেয়ে তাদের ধরার জন্য দ্রুতবেগে সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু তারা তীরে পৌঁছার পূর্বেই মুহাজির কাফিলা জাহাজে উঠে পড়েছেন এবং মাঝি-মাল্লারা জাহাজের নোঙ্গর তুলে ফেলেছে। কাজেই ব্যর্থ মনোরথ হয়ে তারা ফিরে আসল মক্কায়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সংবাদ শুনে আশ্বস্ত হলেন। তিনি আবূ বকর (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বললেনঃ
ইবরাহীম (আঃ) এবং লুত (আঃ)-এর পর ওসমানই সর্ব প্রথম ব্যক্তি যিনি সস্ত্রীক কাফিরদের অত্যাচার উৎপীড়নের দরুণ আল্লাহর পথে হিজরত করেন।

হিজরতের পর বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। কন্যা ও জামাতার সংবাদ জানার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতৃ হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত কোন খবরা খবর পাওয়া গেল না। উদ্বেগ ও অস্থিরতায় তিনি মাঝে মাঝে মক্কা থেকে বের হয়ে পড়তেন। যখন কোন পথিককে আবিসিনিয়া থেকে মক্কার দিকে আসতে দেখতেন তখন তার কাছে গিয়ে রুকাইয়ার (রাঃ) ও উসমান (রাঃ)-এর সংবাদ নেয়ার চেষ্টা করতেন। একদা হঠাৎ এক বৃদ্ধার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে গেল। সে আবিসিনিয়া থেকে আসছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কি হাবশ রাজ্যে আমার কন্য রুকাইয়া (রাঃ) এবং জামাতা উসমানকে (রাঃ) দেখতে পেয়েছ?
বৃদ্ধা জওয়াবে বললেন, হাঁ তাদের আমি দেখে এসেছি। তারা ভাল আছেন, আপনি আশ্বস্ত হউন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সংবাদ শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি উদ্বেগমুক্ত হলেন এবং তাঁদের জন্য দু’আ করলেন।

অবশেষে মদীনায় হিজরত

উসমান (রাঃ)-এর আবিসিনিয়ায় অবস্থানকালে এই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, মক্কার কাফিররা ইসলামের প্রতি বৈরী ভাব পরিত্যাগ করেছে এবং মুসলমানদের প্রতি কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা কমে এসেছে। এ সংবাদ শুনে উসমান (রাঃ) তদীয় সহধর্মিণী রুকাইয়া (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে আশায় বুক বেঁধে স্বদেশে ফিরে আসলেন। কিন্তু এখানে ফিরে এসেই জানতে পারলেন, উক্ত সংবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যে ও ভিত্তিহীন। বরং তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ করলেন যে, অত্যাচারের মাত্রা পূর্বাপেক্ষা আরও বেড়েছে। এখানে অবস্থান করলে তাদেরকে আবারও দুর্ভোগ পোহাতে হবে। সুতরাং উসমান (রাঃ) তার স্ত্রীকে নিয়ে আবার আবিসিনিয়ায় ফিরে যেতে বাধ্য হলেন।

মুসলমানদের মধ্যে যারা মক্কায় অবস্থান করছিলেন তারা কাফিরদের অত্যাচার উৎপীড়নের যাঁতাকলে অবিরাম পিষ্ট হচ্ছিলেন। রাসূল নিজেও কাফিরদের জুলম-নির্যাতন এবং ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। সীমাহীন অত্যাচারে তাওহীদের ঝাণ্ডাবাহী সহায়-সম্বলহীন আল্লাহর বান্দাদের ধৈর্যের বাঁধ একেবারে ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হল- এমন সময় আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় বান ডেকে উঠল। তিনি মুসলমানদিগকে দলবদ্ধভাবে ব্যাপক আকারে মাদীনায় হিজরাত করার অনুমতি প্রদান করলেন। তারা যাত্রা শুরু করলেন।

যথাসময়ে আবিসিনিয়ায় এ খবর পৌছুল। ‘উসমান (রাযিঃ) এ সংবাদ পেয়ে পুনরায় রুকাইয়া (রাযিঃ)-কে সাথে নিয়ে মক্কায় ফিরে এলেন। এসে রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর দরবারে হাযির হলেন। অতঃপর রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এ অনুমতি নিয়ে এঁরাও মাদীনায় হিজরাত করলেন।

আবিসিনিয়া এবং মাদীনাহ্ এ দু’স্থানে হিজরাত করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন- ‘উসমান (রাযিঃ) এবং তাঁর জীবন-সঙ্গিনী রুকাইয়া (রাযিঃ)।

মাদীনার আনসারগণ মক্কার মুহাজিরগণকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে একেক পরিবারকে একেক বাড়ীতে আশ্রয় প্রদান করেন। শুধু আশ্রয় প্রদানই নয়, ওঁরা মুহাজিরদেরকে আপন ভাইরূপে বরণ করে নেন। ‘উসমান (রাযিঃ)-কে ভ্রাতৃরূপে বরণ করে নিলেন হাসান (রাযিঃ)-এর ভাই উয়াইস ইবনু সাবিত (রাযিঃ)

মাদীনায় উসমান (রাযিঃ) তদীয় জীবন-সঙ্গিনীকে নিয়ে সুখের ঘর পাতলের এবং ইসলামের আদর্শে সন্তোষধন্য দাম্পত্য জীবন গড়ে তুললেন। দৈহিক সৌন্দর্য, পারস্পরিক ভালবাসায় আর একের প্রতি অপরের সুমধুর আচরণে এ সুখী দম্পতি ছিল তুলনাহীন

রুকাইয়া (রাযিঃ)-এর ইন্তিকাল

আল্লাহর ইচ্ছা ও মরযী অনুধাবন করা মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। মাদীনায় তাঁদের মধুর দাম্পত্য জীবন বেশি দিন স্থায়ী হল না। হিজরাতের দ্বিতীয় বর্ষেই রুকাইয়া (রাযিঃ) হঠাৎ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলেন। আর ঠিক এ সময়টিতে বদর প্রান্তরে অনুষ্ঠিত হয় মক্কার কাফিরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম জিহাদ এবং জাতি হিসেবে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার জীবন মরণ সংগ্রাম। ঠিক এ সময়েই দূরারোগ্য ও কঠিন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলেন নাবী-নন্দিনী রুকাইয়া (রাযিঃ)। মুসলমানদের ইমাম ও নেতারূপে রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর পক্ষে- মুসলিম জাতির এ জীবন মরণ সংগ্রামে কন্যার কঠিন পীড়ার মত পারিবারিক কারণে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকার প্রশ্নই উঠে না। সুতরাং প্রিয় কন্যাকে আল্লাহর হিফাযাতে রেখে তিনি সাহাবীদের নিয়ে যুদ্ধ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন।

কিন্তু সমস্যায় নিপতিত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন রুকাইয়া (রাযিঃ)-এর স্বামী ‘উসমান (রাযিঃ)। একদিকে সারা জীবনের সুখ দুখের চির-সঙ্গিনী রোগ শয্যায় শায়িতা এবং মারাত্মক রোগ যন্ত্রনায় ছটফট করে চলেছেন, অপরদিকে ইসলামের প্রতি কর্তব্যবোধ- যে ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করার জন্য কাফিররা বিপুল অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত হয়ে এসেছে। একদিকে স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা এবং দায়িত্ব- অপরদিকে ইসলামের এ মহা সঙ্কটকালে জিহাদে অংশ গ্রহণের কর্তব্যবোধ- কোনটির প্রতি তিনি অধিক গুরুত্ব দিবেন?

এ দু’ পরস্পর বিরোধী মানসিক দ্বন্দ্বে ইসলামের প্রতি তাঁর অটল মহব্বতই জয়ী হল। তিনিও স্ত্রীকে আল্লাহর হস্তে সোপর্দ করে জিহাদে যোগদান করতে মনস্থ করলেন এবং এজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন

‘উসমান (রাযিঃ)-এর এ সংকল্পের কথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে তিনি বুঝিয়ে বললেনঃ তোমাকে এবার যুদ্ধযাত্রা স্থগিত রাখতে হবে, তুমি যুদ্ধে গেলে রুকাইয়া (রাবিঃ)-এর দেখাশুনা এবং সেবা শুশ্রূষা করবে কে?”
‘উসমান আরয করলেন, তবে কি জিহাদে যোগদানের সাওয়াব থেকে আমি বঞ্চিত হবো? রাসূলুল্লাহ ইরশাদ ফরমালেন, তোমার সহধর্মিণী রুকাইয়া (রাযিঃ)-এর সেবা শুশ্রূষা করে তুমি জিহাদে যোগদানের সমান সাওয়াব পাবে, এছাড়া গাণীমাতের মালের অংশও তুমি ঠিক ঠিক মত পেয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর ইচ্ছা এবং নির্দেশ মুতাবিক ‘উসমান (রাযিঃ) মাদীনায় থেকে গেলেন এবং স্ত্রীর সেবা শুশ্রূষা করে চললেন। কিন্তু প্রাণপণ সেবা করেও তিনি তাঁর প্রিয়তমাকে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেন না। হিজরী দ্বিতীয় সালে মাত্র ২৩ বৎসর বয়সে স্নেহশীল মহান পিতার অনুপস্থিতিতে এবং প্রেমময় স্বামীর চোখের সামনে ধৈর্য সহিষ্ণুতা, প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক নবী-নন্দিনী রুকাইয়া (রাযিঃ) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)

রুকাইয়া (রাযিঃ)-এর ইন্তিকালে তদীয় স্বামী ‘উসমান (রাযিঃ) হৃদয়ে এক চরম আঘাত পেলেন। নাবী-নন্দিনী রুকাইয়া (রাযিঃ)-কে জীবন-সঙ্গিনী, সহধর্মিণী ও সহমর্মিণীরূপে লাভ করে তিনি যে অপার আনন্দ এবং পরম সন্তোষ লাভ করেছিলেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। বিবাহের পর থেকে সুখে-দুঃখে তিনি তাঁর স্বামীর সাথে ছায়ার মতো অবস্থান করেছেন। কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ‘উসমান (রাযিঃ) যখন নিজের প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে আবিসিনিয়ায় হিজরাত করতে বাধ্য হন, তখনও তিনি তাঁকে একা ছেড়ে দেননি। ইচ্ছে করলে অন্যান্যের মতো তিনিও জন্মভূমি মক্কায় থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না, স্বামীর সাথে স্বেচ্ছায় নির্বাসন দণ্ড বেছে নিলেন। তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র, উষর মরুভূমি এবং বিপদ সঙ্কুল ও বন্ধুর পার্বত্য পথ অতিক্রম করার কষ্ট তিনি হৃষ্টমনে বরদাশত করেন। প্রেমময় মহান পিতার স্নেহচ্ছায়া, দরদী ভগ্নিত্রয়ের প্রীতির আকর্ষণ এবং অন্যান্য আপন জনের মায়া মমতার বাঁধন সাময়িকভাবে পরিত্যাগ করে প্রতিকূল পরিবেশের কষ্টকর প্রবাস-জীবন তিনি বরণ করে নেন।

আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ছাড়াও স্বীয় স্বামীকে তাঁর সাহচর্য দ্বারা খুশি রাখার এবং নিজে তাঁর সাহচর্যের দ্বারা খুশী থাকার বাসনা এ কষ্ট বরণের পশ্চাতে নিশ্চয় সক্রিয় ছিল। পারস্পরিক গভীর প্রেম এবং আকর্ষণে তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল মাধুর্যমণ্ডিত। যেন এক বৃন্তের দুটি সুষমামণ্ডিত ও সুবিকশিত ফুল। এ যুগল দম্পতি সম্পর্কে যথার্থই বলা হয়েছে-

“আহথআনুষ যাওজাইনে রা’আহুমাল ইনসানু- রুকাইয়া ওয়া যাউজুহা ‘উস্মান।”
“সুন্দরতম দম্পতি যা মানুষ দেখতে পেয়েছে তা হচ্ছে রুকাইয়া (রাযিঃ) এবং তাঁর স্বামী ‘উসমান (রাযিঃ)।”

সে আদর্শ দম্পতির অর্ধাঙ্গিনী যখন চোখ বুঝল- বৃন্তচ্যুত হয়ে যখন কোমলতর ফুলটি ঝরে পড়ল তখন অপর অর্ধেক তথা বৃন্তচ্যুত পুষ্পটির মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

আদর্শা সহধর্মিণীর চির বিদায়ের ফলে ‘উসমান (রাযিঃ)-এর হৃদয়ে বিরহের অগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। কিন্তু ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অটল মূর্তি এবং আল্লাহর ইচ্ছার সম্মুখে অবনত মস্তক ‘উসমান (রাযিঃ) মনের দুঃখ মনেই চেপে রেখে বুকে পাথর বেঁধে স্ত্রীর কাফন-দাফনের আশু কর্তব্য সুসম্পন্ন করলেন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ রুকাইয়া (রাযিঃ)-এর ইন্তিকালের সংবাদে মর্মাহত

সময়টি ছিল পবিত্র রামাযান মাস। হিজরাতের পর এক বৎসর ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। দাফন কার্য এ মাত্র সম্পন্ন হয়েছে, কবরে তখনও মাটি দেয়া চলছে- এমন সময় যায়িদ ইবনু হারিসা (রাযিঃ) বদর যুদ্ধে মুসলমানদের মহা বিজয়ের খোশখবর নিয়ে মাদীনায় প্রবেশ করলেন।

জয়-উল্লাসে উচ্চারিত ‘আল্লাহু আকবার‘ ‘আল্লাহু আকবার‘ এর গগণ-বিদারী আওয়াজে মাদীনার পাহাড় পর্বত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত এবং তার অলী-গলী মুখরিত হয়ে উঠল। জানা গেল, মিথ্যা ও সত্যের দ্বন্দে সত্যের নিকট অসত্য পরাভূত হয়েছে, আলোর মাঝ থেকে অন্ধকার বিদূরিত হয়েছে। আরও জানা গেল, বিজয়ী আনসার ও মুহাজির মুজাহিদ দল সমভিব্যাহারে রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ এর মাদীনার দ্বার প্রান্তে উপনীত।

বিজয়ের জয়মাল্য পরে নাবী কারীম صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ মাদীনায় প্রবেশ করলেন। বস্তিতে ঢুকেই তিনি তাঁর প্রিয়তমা কন্যার ইন্তিকাল সংবাদ শুনে মর্মাহত হলেন। স্বভাবতঃই তাঁর পিতৃ-হৃদয় আকুলভাবে কেঁদে উঠল। শোকাকুল হৃদয়েই তিনি সোজা চলে গেলেন মাদীনার বাকী নামক কবরস্থানে- যেখানে তাঁর কন্যা রুকাইয়া (রাযিঃ) চিরশয্যা রচিত হয়েছিল।

কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে দু’আ করার পর রাসূলায় শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন :
“উসমান ইবনু মাযউন (রাযিঃ) আগে চলে গিয়েছে, এখন তুমি গিয়ে তার সাথে মিলিত হও।”

‘উসমান ইবনু মাসযউন (রাযিঃ) ছিলেন এক জন বিশিষ্ট সাহাবী, তাঁকে রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ অত্যন্ত ভালবাসতেন। ইনি মুহাজিরদের মধ্যে সে ব্যক্তি যিনি মাদীনায় এসে প্রথম ইন্তিকাল করেন। নাবী صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর শোকাকুল অবস্থা ও নীরব ক্রন্দন এবং উক্ত মন্তব্য শুনে আনসার ও মুহাজিরদের মহিলারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। মাদীনায় শোকার্ত মেয়ে মহলের এ করুণ কান্নায় এক বিষাদঘন অবস্থার সৃষ্টি হল। এ সময়ে কঠোর প্রকৃতি ও উগ্র মেজাজী ‘উমার (রাযিঃ)-এর আবির্ভাব ঘটল। তিনি এ অবস্থা দেখে মেয়েদের শাসাতে শুরু করলেন।
তখন রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ তাঁকে বাঁধা দিয়ে বলেনঃ ওমর তাদের কাঁদতে দাও, কেননা কান্নার সম্পর্ক যখন হৃদয় ও চোখের সাথে তখন আল্লাহর রহমত থেকে তা উৎসারিত। কিন্তু তাতে যদি মুখ এবং হাতের সংযোগ ঘটে (অর্থাৎ- যখন তারা উচ্চ স্বরে চিৎকার করে কাঁদে এবং হাত-পা ছুঁড়ে বুক চাপড়িয়ে ও চুল ছিঁড়ে শোকের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়) তখন বুঝবে যে তথায় শয়তানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে রাসূল একথাও বললেন:
“আলহামদু লিল্লা, কন্যাদের দাফন করা একটা সম্মানজনক কাজ।”

এক বর্ণনায় পাওয়া যায় মরহুমা রুকাইয়া (রাযিঃ)-এর সর্বকনিষ্ঠা বোন ফাতিমাতুয যাহরা প্রিয়তমা ভগ্নির মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন হন। তিনি শোকের আতিশয্যে স্বীয় পিতা রাসুল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -এর কাছে বসে আহাজারী করে কেঁদে চলেছিলেন। রাসূল صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ স্বীয় চাদরের আঁচল দিয়ে তাঁর অশ্রু মুছে দিচ্ছিলেন আর ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিয়ে চলেছিলেন। এ ছিল আদর্শ নবীর আদর্শ কাজ। মানবিক সহৃদয়তার স্বাভাবিক প্রকাশ এবং নবুওয়াতী দায়িত্ব পালনের সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

পিতা-কন্যার সম্পর্ক

বিবাহের পূর্বে তো বটেই, বিবাহের পরও রুকাইয়া (রাঃ) তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় আব্বাজানের সেবা যত্নে-ছিলেন বিশেষ অগ্রণী। পরম আগ্রহ সহকারে তিনি তাঁর নাসীহাত শুনতেন এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালনে সচেষ্ট হতেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁর ঘরে প্রবেশ করতেন তখন তিনি নিজ হাতে তাঁর মাথায় তৈল দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোখে সুরমা লাগান খুব পছন্দ করতেন বলে তিনি পিতার চোখে নিজ হস্তে সুরমাও লাগিয়ে দিতেন।

একবার এমনি যত্নের সাথে রুকাইয়া (রাঃ) তাঁর আব্বা জানের সেবা করছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৌতূহল বশতঃ কন্যাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, বেটী। তোমার প্রতি উসমানের (রাঃ) ব্যবহার কেমন? উত্তরে রুকাইয়া (রাঃ) বললেন: অত্যন্ত ভাল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই জওয়াবে অত্যন্ত খুশী হলেন। তারপর উপদেশ দিয়ে বলেন, উসমান (রাঃ) একজন সম্মানী ব্যক্তি তাঁর সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। আমাদের সাথে তাঁর অভ্যাস ও চাল চলনে অনেক মিল রয়েছে।

রুকাইয়া ও উসমান (রাযিঃ)- এর সম্পর্ক

রুকাইয়া (রাঃ) আর উসমান (রাঃ)-এর মধ্যে কী গভীর প্রেম ও অটুট পারস্পরিক আকর্ষণ ছিল- তা আমরা তাঁদের মিলিত জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে দেখতে পেয়েছি। আবাসে হউক অথবা প্রবাসে- যেখানেই তারা বসবাস করেছেন সেখানেই তাদের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি প্রগাঢ় প্রণয়প্রীতির স্বতঃস্ফূর্ত ঝলক। একের প্রতি অপরের সমঝোতা, সহযোগিতা ও সহৃদয়তা মূলক আচরণ। আমরা তাঁদের মধ্যে দেখতে পাই অকপট আন্তরিকতা- যার নযীর একান্তই বিরল। এজন্য লোকের মুখে প্রবচনের মত হয়ে দাঁড়ায় এই কথা:

“পৃথিবীর মানুষ যত সুন্দর ও সুখসমৃদ্ধ দম্পতি দেখেছে তার মধ্যে সুন্দরতম হচ্ছে রুকাইয়া (রাঃ) এবং তার স্বামী উসমান (রাঃ)।”

সন্তান

উসমান (রাঃ) এবং রুকাইয়া (রাঃ)-এর মিলনজাত একটি মাত্র সন্তান ছিল, নাম আবদুল্লাহ। তার থেকেই উসমানের (রাঃ) উপনাম ছিল আবূ আবদিল্লাহ- আব্দুল্লাহর পিতা। আবিসিনিয়ায় তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। সুন্দর চেহারা ও লাজুক প্রকৃতির এই সন্তানটি পিতামাতার প্রতি ছিলেন বিশেষ অনুরাগী। তার নানাজান মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মনে হয় রুকাইয়ার (রাঃ) মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল চার বৎসর। দুই বৎসর পর ৪র্থ হিজরীতে তিনি ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুর কারণটি মর্মান্তিক। একটি মোরগ হঠাৎ তাঁর চোখে ঠোকর দেয়ায় সেই চোখে ক্ষত সৃষ্টি হয়। ক্রমেই ক্ষতের যন্ত্রণা বেড়ে চলে এবং পরিণামে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোকাহত হৃদয়ে স্নেহময় নাতীর জানাযার নামায পড়ান এবং উসমান (রাঃ) তাঁর একমাত্র পুত্র-সন্তানের মৃতদেহ কবরে রাখেন।

সংগ্রহীত
লেখকঃ- হুসাইন বিন সোহরাব
বইঃ- প্রিয় নবীর কন্যাগণ

নবীর কন্যা যায়নাব বিনতে মুহাম্মদ এর জীবনী

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture