নবীজির সাথে ঘনিষ্ঠতা
আলী (রা:) এবং ফাতিমার (রা:) পরিবারের সাথে রাসুলের (ﷺ) ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অনেক হাদিস আছে। এ প্রসঙ্গে আমার খুব প্রিয় একটি হাদিস উল্লেখ করতে চাই। আয়েশা (রা:) বলেন, “একদিন রাসুল (ﷺ) ঢিলেঢালা এক জোব্বা পরিধান করেছিলেন। ডোরাকাটা কালো জোব্বা। আল হাসান (রা:) দৌড়ে রাসুলের (ﷺ) কাছে আসলো। রাসুল (ﷺ) বসলেন এবং হাসানকে জোব্বার ভিতর জড়িয়ে নিলেন। এরপর হুসাইন (রা:) দৌড়ে আসলে, তিনি তাকেও জোব্বার ভেতর জড়িয়ে নিলেন, এবং তাদের সাথে খেলা করতে লাগলেন।
তখন ফাতিমা (রা:) – রাসুলের (ﷺ) কন্যা তথা বাচ্চাদের মা আসলেন। রাসুল (ﷺ) তাঁর ডান হাত সম্প্রসারিত করে ফাতিমাকেও (রা:) জোব্বায় আবৃত করলেন। এরপর আলী (রা:) আসলে, তিনি বাম হাত সম্প্রসারিত করে তাঁকেও জোব্বায় জড়িয়ে নিলেন। এভাবে চারজনকে তিনি তাঁর জোব্বায় আবৃত করলেন। ঐ মুহূর্তে এটা ছিল তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
সহি মুসলিম হাদিসে উল্লেখ আছে রাসুল (ﷺ) তখন তাদের সাথে বসলেন এবং তেলাওয়াত করলেন –
إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرً
হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ, আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে।
[৩৩:৩৩]
রাসুল (ﷺ) চারজনকে তাঁর জোব্বায় জড়িয়ে রেখে এই দোয়াটি করেছিলেন। দৃশ্যটি একবার কল্পনা করে দেখুন। বস্তুত এই চারজনকেই তিনি জন্মের পর থেকে জড়িয়ে ধরে আছেন।
রাসুল (ﷺ) তাদের বাসায় গিয়ে ফাতিমাকে (রা:) বলতেন, ادعوني ابنيه – আমার দুই সন্তানকে ডাকো, তাদেরকে আমি দেখতে চাই, হাসান ও হোসেনকে ডাকো। ফাতিমা (রা:) তাদেরকে সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত করে দিতেন। হাসান এবং হোসাইন দৌড়ে তাঁর কাছে আসতো। ভালোবাসা প্রকাশের জন্য তিনি আলিঙ্গন করে তাদের চুলের ঘ্রাণ নিতেন, প্রায় তাদের জন্য দু’আ করতেন। আল্লাহ যেন তাদের দুজনের প্রতি সন্তুষ্ট হন। এখানে আমরা রাসূলকে (ﷺ) দেখছি একজন নানার ভূমিকায়, জানছি বাচ্চাদের কাছে নানা হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন।
আলী (রা:) এবং ফাতিমার (রা:) কন্যা জয়নাবের জন্ম হয় হিজরীর পঞ্চম বছরে, এবং উম্মে কুলসুমের জন্ম হয় হিজরীর ষষ্ঠ বছরে। তাঁদের আরো একটি পুত্রসন্তান জন্মের সময় মারা যায়। রাসূল (ﷺ) তার নাম রেখেছিলেন আল মুহাসসিন – হাসান ও হুসাইনের ছোট সংস্করণ।
আলী (রা:) এবং ফাতিমার (রা:) সংসারে এখন চার সন্তান। ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, اهب الله لما يرزقكم نعمه – আল্লাহকে ভালোবাসুন তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতের জন্য, واحبني بحب الله – এবং আল্লাহকে ভালোবাসার কারণে আমাকে ভালোবাসুন। তারপর তিনি বলেন, واحب اهل بيتي لحبي – এবং আমাকে ভালবাসার কারনে আমার পরিবারকেও ভালোবাসুন, কারণ আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি।
সহি মুসলিম হাদিস এসেছে একবার হাসানকে (রা:) কোলে নিয়ে রাসূল (ﷺ) বলেছিলেন, اللهم أني أحبه – হে আল্লাহ! আপনি জানেন আমি তাকে ভালোবাসি, فاحبه – কাজেই আপনিও তাকে ভালোবাসুন, وأحبب من يحبه – এবং যারা তাকে ভালবাসে তাদেরও আপনি ভালোবাসুন।
আরো একটি খাঁটি হাদীসে বর্ণিত আছে রাসূল (ﷺ) বলেন,
من أحب الحسن و الحسين فقد أحبني ، و من أبغضهما فقد أبغضني
“যে হাসান ও হুসাইনকে ভালোবাসে সে আমাকেও ভালোবাসে, যে তাদের ঘৃণা করে সে আমাকেও ঘৃণা করে।”
আলী (রা:) এবং ফাতিমার (রা:) বাড়িটি ছিল হাসি খুশিতে ভরপুর একটি বাড়ি। রাসূল (ﷺ) তাঁদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাসির শব্দ শুনতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন তাঁরা কি কারনে হাসছে, যাতে তিনিও তাঁদের সাথে শামিল হতে পারেন।
আলী (রা:) এবং ফাতিমা (রা:) একে অন্যের সাথে রসিকতা করতেন। তাদের বৈবাহিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে অনেক বইতে এই গুনটির উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আলী (রা:) একবার বললেন, ফাতিমা (রা:) তাঁকে এই বলে জ্বালাতন করছিলেন যে তিনি তাঁর (আলীর) চেয়ে বয়সে বড়। বিয়ের সময় আলীর (রা:) বয়স কম ছিল। তাই ফাতিমা (রা:) প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতেন, “আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়।”
আলীও (রা:) জোর দিয়ে বলতেন তিনি ফাতিমার (রা:) চেয়ে বয়সে বড়। সেই সময় অধিকাংশ মানুষ জানতো না কে কোন বছর, কোন মাসে জন্মগ্রহণ করেছে। এই সুযোগে ফাতিমা (রা:) আলীর (রা:) সাথে দুষ্টুমি করে বলতেন, “আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়।” এ নিয়ে যখন তাঁরা হাসাহাসি করছিলেন, রাসূল (ﷺ) পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের হাসির কারণ জানতে চেয়ে তাঁদের আনন্দে শামিল হতে চেয়েছিলেন।
আলী (রা:) ফাতিমাকে (রা:) নিয়ে মজার মজার কবিতা লিখতেন, আর তা শুনে ফাতিমা হাসতেন। এভাবে হাসি আনন্দে অবগাহন করে দুজনের মধ্যে সহজ সুন্দর ভালোবাসার সম্পর্ক বিরাজমান ছিল।
আলী (রা:) ও ফাতিমার (রা:) সুখের সংসার
পর্ব : ৭
মূল: ড. ওমর সুলাইমান