Writing

সিরিজ: নবীদের জীবন কাহিনী – ইউসুফ (আঃ)

ইউসুফ (আ:) ছিলেন নবী ইয়াকুবের (আ:) প্রিয় পুত্র। ইয়াকুবের (আ:) আরও ১১জন পুত্র ছিল। ইয়াকূবের (আ:) দ্বিতীয়া স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন ইউসুফ ও বেনিয়ামীন, এবং বাকি বড় ভাইরা ছিল তাঁর সৎ ভাই। তাঁরা সবাই কেন‘আন বা ফিলিস্তীনের হেবরন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।

অল্প বয়সে ইউসুফ (আ:) একদিন সকালে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেন। উত্তেজিত হয়ে তিনি তাঁর বাবাকে বললেন –

يَٰٓأَبَتِ إِنِّى رَأَيۡتُ أَحَدَ عَشَرَ كَوۡكَبًا وَٱلشَّمۡسَ وَٱلۡقَمَرَ رَأَيۡتُهُمۡ لِى سَٰجِدِينَ
হে আমার পিতা, আমি দেখেছি এগারটি নক্ষত্র, সূর্য ও চাঁদকে, আমি দেখেছি তাদেরকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায়’।1

প্রিয় পুত্রকে নবুওয়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা সত্যিই মনোনীত করেছেন ভেবে ইয়াকুব (আ:) আনন্দিত হলেন। যাই হোক, ইয়াকুব (আ:) এই ব্যাপারে তাঁর বড় ছেলেদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি জানতেন ইউসুফের (আ:) সৎ ভাইরা তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল। তাই তিনি ইউসুফকে (আ:) তাঁর ভাইদের কাছে স্বপ্নের কথা বলার ব্যাপারে সতর্ক করলেন,পাছে তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এই ভয়ে।

সময়ের সাথে সাথে ইউসুফের (আ:) ভাইদের মনে বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। নিজেদের তুলনায় তারা ইউসুফকে (আ:) অসাধারণ মনে করত। তাই হিংসার বশবর্তী হয়ে তারা তাঁকে কূপে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।

একদিন তারা তাদের বাবার কাছে এসে বলল তারা ইউসুফকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চায়। ছেলেদের এই প্রস্তাবে ইয়াকুব (আ:) অনিচ্ছা প্রকাশ করে বললেন –

قَالَ إِنِّى لَيَحۡزُنُنِىٓ أَن تَذۡهَبُواْ بِهِۦ وَأَخَافُ أَن يَأۡكُلَهُ ٱلذِّئۡبُ وَأَنتُمۡ عَنۡهُ غَٰفِلُونَ
সে বলল, ‘নিশ্চয় এটা আমাকে কষ্ট দেবে যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশঙ্কা করি, নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলবে, যখন তোমরা তার ব্যাপারে গাফিল থাকবে’।2

পরদিন ইউসুফ (আ:) তাঁর ভাইদের সাথে রওনা হলেন। তাঁর ভাইরা তাকে নিক্ষেপ করার জন্য যথেষ্ট গভীর কূপের সন্ধানে অনেক দূর ভ্রমণ করল। অবশেষে যখন তারা কূপের কাছে পৌঁছল, পানি খাওয়ার অজুহাতে তারা ইউসুফকে সেখানে নিয়ে যায়, এবং জোর করে তাঁর গায়ের জামা খুলে ফেলে। ইউসুফ (আ:) তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। ভাইরা শেষ পর্যন্ত ইউসুফকে কূপের নিচে ফেলে দেয় এবং বাড়ি ফিরে যায়।

ভেড়ার রক্তে মাখা ইউসুফের জামা নিয়ে ভাইয়েরা তাদের বাবার কাছে ছুটে গেল। তারা কেঁদে কেঁদে বলল –

قَالُواْ يَٰٓأَبَانَآ إِنَّا ذَهَبۡنَا نَسۡتَبِقُ وَتَرَكۡنَا يُوسُفَ عِندَ مَتَٰعِنَا فَأَكَلَهُ ٱلذِّئۡبُۖ وَمَآ أَنتَ بِمُؤۡمِنٍ لَّنَا وَلَوۡ كُنَّا صَٰدِقِينَ
তারা বলল, ‘হে আমাদের পিতা, আমরা প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম আর ইউসুফকে রেখে গিয়েছিলাম আমাদের মালপত্রের নিকট, অতঃপর নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলেছে। আর আপনি আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী হই’।’3

ইয়াকুব (আ:) তাদের গল্প সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন, তিনি মনে মনে বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁর ছেলে এখনও বেঁচে আছে এবং ভাইরা সম্ভবত শয়তানের কুমন্ত্রণালয় এই জঘন্য কাজের জন্য প্রলুব্ধ হয়েছে। তিনি মন্তব্য করলেন যে নেকড়েটি এতই দয়ালু যে জামা না ছিঁড়েই তাঁর ছেলেকে খেয়ে ফেলেছে! তিনি সবরের সাথে শোক সহ্য করলেন এবং তাঁর পুত্রের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন।

وَجَآءُو عَلَىٰ قَمِيصِهِۦ بِدَمٍ كَذِبٍۚ قَالَ بَلۡ سَوَّلَتۡ لَكُمۡ أَنفُسُكُمۡ أَمۡرًاۖ فَصَبۡرٌ جَمِيلٌۖ وَٱللَّهُ ٱلۡمُسۡتَعَانُ عَلَىٰ مَا تَصِفُو
আর তারা তার জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে নিয়ে এসেছিল। সে বলল, ‘বরং তোমাদের নফস তোমাদের জন্য একটি গল্প সাজিয়েছে। সুতরাং (আমার করণীয় হচ্ছে) সুন্দর ধৈর্য। আর তোমরা যা বর্ণনা করছ সে বিষয়ে আল্লাহই সাহায্যস্থল’।4

আমরা জেনেছি ইউসুফের (আ:) সৎ ভাইরা বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে তাঁকে গভীর কুয়ায় ফেলে আসে। এদিকে, ইউসুফ (আ:) একটি পাথরের কিনারা আঁকড়ে ধরতে সক্ষম হন, তিনি তাঁর মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেন।

শীঘ্রই মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী একদল কাফেলা এই কূপে পানি তোলার জন্য থামে। পানির বালতিটি তুলতে গিয়ে দড়িতে আঁকড়ে থাকা সুদর্শন ছেলেটিকে দেখে তারা হতবাক হয়ে যায়। কাফেলার লোকেরা সাথে সাথে ইউসুফকে শিকলে বেঁধে মিশরে নিয়ে যায়।

তারা ইউসুফকে (আ:) নিলামে তুলে এবং সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে। আব্দুল আজিজ নামের একজন কোষাধক্ষ্য বালক ইউসুফকে কিনে নেয়। ইউসুফের এই নতুন মনিবের কোন সন্তান ছিল না। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন ভালোভাবে ইউসুফের যত্ন নিতে এবং চাইলে তারা ইউসুফকে ক্রীতদাস হিসেবে অথবা পুত্র হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।

ইউসুফ (আ:) শুধুমাত্র একজন সুদর্শন যুবক হিসেবেই বেড়ে ওঠেননি বরং আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়েও আশীর্বাদ করেন। তাঁর সততা আল-আজিজের মন জয় করে, তাই তিনি ইউসুফকে তার পরিবারের দায়িত্বভার দেন। এই সময় ইউসুফ (আ:) তাঁর জীবনে দ্বিতীয় পরীক্ষার মুখোমুখি হন। জুলাইকা, আল-আজিজের স্ত্রী, যিনি দিনের পর দিন ইউসুফের দেখাশোনা করেছেন, তাঁর প্রতি আবেগপ্রবণ হন। জুলাইকা এতটাই মহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন যে তিনি তার কামনা চরিদার্থ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।

একদিন, যখন স্বামী আব্দুল আজিজ বাড়ি থেকে দূরে অবস্থান করছিলেন, জুলাইকা দরজা বন্ধ করে ইউসুফকে তার কাছে আমন্ত্রণ জানায়। ইউসুফ (আ:) আল্লার ভয়ে ভীত হয়ে বললেন –

....وَقَالَتۡ هَيۡتَ لَكَۚ قَالَ مَعَاذَ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ رَبِّىٓ أَحۡسَنَ مَثۡوَاىَۖ إِنَّهُۥ لَا يُفۡلِحُ ٱلظَّٰلِمُونَ
সে বলল, আল্লাহর আশ্রয় (চাই)। নিশ্চয় তিনি আমার মনিব, তিনি আমার থাকার সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন। নিশ্চয় যালিমগণ সফল হয় না।5

ইউসুফ (আ:) জুলাইকার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পালানোর জন্য বন্ধ দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন। জুলাইকা মরিয়া হয়ে তাঁর পিছনে ধাওয়া করে এবং তাঁর জামা পেছন থেকে টেনে ধরে, ফলে তা ছিড়ে যায়। দরজা খুলে আল-আজিজ প্রবেশ করলেন। বিব্রত হয়ে সে তার স্বামীর কাছে দৌড়ে গেল এবং কাঁদতে লাগল।

قَالَتۡ مَا جَزَآءُ مَنۡ أَرَادَ بِأَهۡلِكَ سُوٓءًا إِلَّآ أَن يُسۡجَنَ أَوۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ
সে (মহিলা) বলল, ‘যে লোক তোমার পরিবারের সাথে মন্দকর্ম করতে চেয়েছে, তাকে কারাবন্দি করা বা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি দেয়া ছাড়া তার আর কী দন্ড হতে পারে’?6

আব্দুল আজিজ ছিলেন একজন ন্যায়পরায় লোক। তিনি বুঝতে পারছিলেন না ঠিক কাকে বিশ্বাস করবেন। তাই তিনি তার স্ত্রীর এক কাজিনের সাথে পরামর্শ করলেন।

وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِّنۡ أَهۡلِهَآ إِن كَانَ قَمِيصُهُۥ قُدَّ مِن قُبُلٍ فَصَدَقَتۡ وَهُوَ مِنَ ٱلۡكَٰذِبِينَ
আর মহিলার পরিবার থেকে এক সাক্ষ্যদাতা সাক্ষ্য প্রদান করল, ‘যদি তার জামা সামনের দিক থেকে ছেঁড়া হয় তাহলে সে (মহিলা) সত্য বলেছে এবং সে (পুরুষ) মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত’।7

এইভাবে ইউসুফ (আ:) নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। আব্দুল আজিজ তার স্ত্রীর অশালীনতার জন্য ইউসুফের (আ:) কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং বিষয়টি গোপন রাখতে বললেন।

ইউসুফ (আ:) নির্দোষ প্রমাণিত হলে আব্দুল আজিজ তার স্ত্রীর অশালীনতার জন্য ইউসুফের (আ:) কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং বিষয়টি গোপন রাখতে বললেন। তারপরও ইউসুফের (আ:) প্রতি জুলেখার আসক্তির গল্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

শহরের মহিলারা জুলাইকার চরিত্রকে উপহাস করতে শুরু করে। ব্যথিত, জুলাইকা তাদের কাছে ইউসুফের অসাধারণ সৌন্দর্যের প্রতি তার অসহায় প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করার পরিকল্পনা করল। তাই সে একদিন শহরের মহিলাদেরকে তার বাসভবনে ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে সে তাদের ফল পরিবেশন করে ছুরি সহ।

মহিলারা যখন ফল কাটতে কাটতে আনন্দে আড্ডা দিচ্ছিল, জুলাইকা ইউসুফকে (আ:) ডেকে পাঠাল। মহিলারা তাঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্যে বিস্মিত হয়ে তারা কখন যে নিজেদের হাত কেটে ফেলেছে তা বুঝতেই পারলো না। আর সেই মুহূর্তটিকে কাজে লাগিয়ে জুলাইকা ঘোষনার দিল এই সেই যুবক যার জন্য সে অভিযুক্ত হয়েছে।

তারপর জুলাইকা ইউসুফকে (আ:) হুমকি দিয়ে বলে যে যে ইউসুফ (আ:) যদি তাকে আবার অস্বীকার করেন তবে তাকে কারারুদ্ধ করা হবে, যার উত্তরে ইউসুফ (আ:) বলেন –

قَالَ رَبِّ ٱلسِّجۡنُ أَحَبُّ إِلَىَّ مِمَّا يَدۡعُونَنِىٓ إِلَيۡهِۖ وَإِلَّا تَصۡرِفۡ عَنِّى كَيۡدَهُنَّ أَصۡبُ إِلَيۡهِنَّ وَأَكُن مِّنَ ٱلۡجَٰهِلِينَ
সে (ইউসুফ) বলল, ‘হে আমার রব, তারা আমাকে যে কাজের প্রতি আহবান করছে তা থেকে কারাগারই আমার নিকট অধিক প্রিয়। আর যদি আপনি আমার থেকে তাদের চক্রান্ত প্রতিহত না করেন তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হব’।8

সেই রাতে জুলাইকা তার স্বামীকে বোঝাল যে তার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করার একমাত্র উপায় হল ইউসুফকে কারাবন্দী করা। এভাবে ইউসুফকে (আ:) কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।

ইউসুফের (আ:) কারাগারে থাকাকালীন সময়ে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। ইউসুফের (আ:) দুই কারাসঙ্গী, তাঁর ধার্মিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে অনুরোধ করেছিলেন। একজন স্বপ্নে দেখলেন যে তিনি আংগুর নিংড়িয়ে রস বের করছেন এবং অন্যজন স্বপ্নে দেখলেন তিনি তার মাথায় রুটি বহন করছেন যা দুটি পাখি খাচ্ছে। ইউসুফ (আ:) প্রথমে তাদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকলেন, তারপর ব্যাখ্যা করলেন-

يَٰصَىٰحِبَىِ ٱلسِّجۡنِ أَمَّآ أَحَدُكُمَا فَيَسۡقِى رَبَّهُۥ خَمۡرًاۖ وَأَمَّا ٱلۡأٓخَرُ فَيُصۡلَبُ فَتَأۡكُلُ ٱلطَّيۡرُ مِن رَّأۡسِهِۦۚ قُضِىَ ٱلۡأَمۡرُ ٱلَّذِى فِيهِ تَسۡتَفۡتِيَانِ
হে আমার কারা সঙ্গীদ্বয়, তোমাদের একজন স্বীয় মনিবকে মদপান করাবে। আর অন্যজনকে শূলে চড়ানো হবে, অতঃপর পাখি তার মাথা থেকে আহার করবে। যে বিষয়ে তোমরা জানতে চাচ্ছ তার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে।9

আর যাকে ইউসুফ (আ:) মুক্তি পাবে বলে ধারণা করেছিলেন তাকে বললেন, “তোমার প্রভুর কাছে আমার কথা উল্লেখ কর।” কিন্তু শয়তান তাকে এ কথা ভুলিয়ে দেয় এবং ইউসুফ (আ:) কয়েক বছর জেলে থাকেন।

একদিন মিসরের রাজা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। তিনি তার লোকদের ডেকে বললেন –

وَقَالَ ٱلۡمَلِكُ إِنِّىٓ أَرَىٰ سَبۡعَ بَقَرَٰتٍ سِمَانٍ يَأۡكُلُهُنَّ سَبۡعٌ عِجَافٌ وَسَبۡعَ سُنۢبُلَٰتٍ خُضۡرٍ وَأُخَرَ يَابِسَٰتٍۖ يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡمَلَأُ أَفۡتُونِى فِى رُءۡيَٰىَ إِن كُنتُمۡ لِلرُّءۡيَا تَعۡبُرُونَ
আর বাদশাহ বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখছি, সাতটি মোটা তাজা গাভী, তাদের খেয়ে ফেলছে সাতটি ক্ষীণকায় গাভী এবং সাতটি সবুজ শীষ ও অপর সাতটি শুষ্ক। হে পারিষদবর্গ, তোমরা আমাকে আমার স্বপ্ন সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দাও যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে থাক’।10

কারাগারের দুই ব্যক্তির মধ্যে যিনি মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি অবিলম্বে ইউসুফের (আ:) কথা স্মরণ করলেন এবং রাজাকে তাঁর স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার অনবদ্য ক্ষমতার কথা জানালেন। রাজা তার নিজের অদ্ভুত স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, তাই তিনি ইউসুফের (আ:) সাথে দেখা করতে চাইলেন।

ইউসুফ তাঁর সঙ্গীকে দেখে আনন্দিত হলেন এবং তিনি জানতেন যে এটি আসলেই আল্লাহর পরিকল্পনা। তিনি বর্ণনা করলেন –

قَالَ تَزۡرَعُونَ سَبۡعَ سِنِينَ دَأَبًا فَمَا حَصَدتُّمۡ فَذَرُوهُ فِى سُنۢبُلِهِۦٓ إِلَّا قَلِيلًا مِّمَّا تَأۡكُلُونَ
সে বলল, ‘তোমরা সাত বছর একাধারে চাষাবাদ করবে অতঃপর যে শস্য কেটে ঘরে তুলবে তার মধ্য থেকে যে সামান্য পরিমাণ খাবে সেগুলো ছাড়া সব শীষের মধ্যে রেখে দেবে’।11
ثُمَّ يَأۡتِى مِنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ سَبۡعٌ شِدَادٌ يَأۡكُلۡنَ مَا قَدَّمۡتُمۡ لَهُنَّ إِلَّا قَلِيلًا مِّمَّا تُحۡصِنُونَ
তারপর আসবে সাতটি কঠিন বছর। এর জন্য তোমরা পূর্বে যা সঞ্চয় করে রেখে দেবে এরা (ঐ সময়ের লোকেরা) সেগুলো খেয়ে ফেলবে, সামান্য কিছু ছাড়া যা তোমরা সংরক্ষণ করে রাখবে’।12
ثُمَّ يَأۡتِى مِنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ عَامٌ فِيهِ يُغَاثُ ٱلنَّاسُ وَفِيهِ يَعۡصِرُونَ
এরপর আসবে এমন এক বছর যাতে মানুষ বৃষ্টি সিক্ত হবে এবং যাতে তারা (ফলের ও যয়তুনের) রস নিংড়াবে’।13

স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে বিস্মিত হয়ে রাজা ইউসুফকে (আ:) তার সামনে হাজির করার নির্দেশ দিলেন। ইউসুফ (আ:) অবশ্য নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কারাগার ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। এইভাবে রাজা ইউসুফের (আ:) ঘটনার সাথে সম্পর্কিত মহিলাদের ডেকে পাঠালেন। যেসব মহিলা তাদের হাত কেটেছিল, তারা রাজার সামনে ইউসুফের (আ:) নির্দোষতার কথা তুলে ধরে।

قَالَ مَا خَطۡبُكُنَّ إِذۡ رَٰوَدتُّنَّ يُوسُفَ عَن نَّفۡسِهِۦۚ قُلۡنَ حَٰشَ لِلَّهِ مَا عَلِمۡنَا عَلَيۡهِ مِن سُوٓءٍۚ
বাদশাহ বলল, ‘তোমরা যখন ইউসুফকে কুপ্ররোচনা দিয়েছিলে তখন তোমাদের কী হয়েছিল’? তারা বলল, ‘মহিমা আল্লাহর! আমরা তার ব্যাপারে খারাপ কিছু জানি না’।14

আযীয পত্নীও উপায়ান্তর না দেখে নিজের দোষ স্বীকার করে-

قَالَتِ ٱمۡرَأَتُ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡئَٰنَ حَصۡحَصَ ٱلۡحَقُّ أَنَا۠ رَٰوَدتُّهُۥ عَن نَّفۡسِهِۦ وَإِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلصَّٰدِقِينَ
‘এখন সত্য প্রকাশ পেয়েছে, আমিই তাকে কুপ্ররোচনা দিয়েছি। আর নিশ্চয় সে সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত’।15

এভাবে ইউসুফ (আ:) নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে রাজার সামনে উপস্থিত হলেন, এবং তার উদারতার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানালেন। রাজা ইউসুফের (আ:) সৎ আচরণ এবং মনোরম ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগরের দায়িত্ব দিলেন।

ইউসুফ (আ:) কোষাধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে প্রথম সাত বছর মিসরে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয়। এ সময় তিনি আসন্ন দুর্ভিক্ষ সমস্যা দূর করার জন্য আগে থেকেই সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন যার পরামর্শ তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলার পর বাদশাহকে দিয়েছিলেন। এরপর শুরু হয় দুর্ভিক্ষের বছরগুলো, যা কেনানের ইয়াকুবের (আ:) পরিবারেও পৌঁছেছিল। ইয়াকুব (আ:) বিনয়ামিন ছাড়া তাঁর সব ছেলেকে মিশরে পাঠান খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য।

সৎ ভাইরা ইউসুফকে (আ:) চিনল না; কিন্তু ইউসুফ (আ:) তাদেরকে ঠিকই চিনে ফেললেন। এরপর ইউসুফ (আ:) বুদ্ধিমত্তার সাথে ভাইদের কাছ থেকে তাঁর বাবা এবং ছোট ভাইয়ের খবর জেনে নিলেন। তিনি তাদেরকে রাজকীয় মেহমানের মর্যাদায় রাখার এবং যথারীতি খাদ্যশস্য প্রদান করার আদেশ দিলেন। বন্টনের ব্যাপারে ইউসুফের (আ:) রীতি ছিল একবারে কোন এক ব্যক্তিকে এক উটের বোঝার চাইতে বেশী খাদ্যশস্য দেওয়া যাবে না। হিসাব অনুযায়ী যখন তা শেষ হয়ে যেত, তখন আবার দেওয়া হতো।

ইউসুফ (আ:) তাঁর সৎ ভাইদের বললেন, পরেরবার আসার সময় যেন তারা তাদের ছোট ভাইকে নিয়ে আসে, এবং তাদেরকে এ কথা বলে সতর্ক করলেন যে ছোট ভাইকে না আনলে তারা আর খাদ্যশস্য পাবে না। এছাড়া গোপনে তিনি খাদ্যশস্যের মূল্য বাবদ ভাইরা যে অর্থকরি এবং অলংকার জমা দিয়েছিল, সেগুলো গোপনে তাদের আসবাবপত্রের মধ্যে রেখে দেয়ার জন্য কর্মচারীদেরকে আদেশ দিলেন, যাতে বাড়ী পৌছে যখন তারা আসবাবপত্র খুলবে এবং নগদ অর্থ ও অলংকার পাবে, তখন যেন পুনর্বার খাদ্যশস্য নেয়ার জন্য আসতে পারে।

ইউসুফের (আ:) ভাইরা মিসর থেকে খাদ্যশস্য নিয়ে ঘরে ফিরে আসলো। তারা তাদের বাবার কাছে মিসরের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে একথাও জানালো যে সেখানকার কোষাধ্যক্ষ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যশস্য দেয়ার ব্যাপারে একটি শর্ত আরোপ করেছেন, এবং তা হল পরেরবার ছোটভাইকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। তাই তারা তাদের বাবার কাছে অনুরোধ করলো ভবিষ্যতে বিনইয়ামীনকেও তাদের সাথে প্রেরণ করতে- যাতে ভবিষ্যতেও তারা খাদ্যশস্য পায়, এবং তারা প্রতিশ্রুতি দিল যে তারা তাদের ছোট ভাইয়ের হেফাজত করবে। কিন্তু তাদের বাবা এবার আর তাদেরকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।

قَالَ هَلۡ اٰمَنُکُمۡ عَلَیۡهِ اِلَّا کَمَاۤ اَمِنۡتُکُمۡ عَلٰۤی اَخِیۡهِ مِنۡ قَبۡلُ ؕ فَاللّٰهُ خَیۡرٌ حٰفِظًا ۪ وَّ هُوَ اَرۡحَمُ الرّٰحِمِیۡنَ
সে বলল, ‘তোমাদেরকে কি আমি তার ব্যাপারে নিরাপদ মনে করব, যেমন নিরাপদ মনে করেছিলাম ইতঃপূর্বে তার ভাইয়ের ব্যাপারে? তবে আল্লাহ উত্তম হেফাযতকারী এবং তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু’।16

প্রথমে ইয়াকুব (আ:) রাজি না হলেও, ছেলেদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বিনিয়ামিনকে খাদ্যশস্য আনার জন্য ভাইদের সাথে মিশরে পাঠালেন। তিনি বিনিয়ামিনকে রক্ষা করার জন্য তাদের কাছ থেকে দৃঢ় শপথ নেন। যখন তারা মিশরে পৌঁছল, ইউসুফ (আ:) বিনয়ামিনকে একপাশে টেনে নিয়ে তার কানে ফিসফিস করে বলল –

...قَالَ إِنِّىٓ أَنَا۠ أَخُوكَ فَلَا تَبۡتَئِسۡ بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ
‘...আমি তোমার ভাই, কাজেই ইতঃপূর্বে তারা যা করত, তাতে তুমি দুঃখ পেয়ো না’।17

পরের দিন ইউসুফ (আ:) তার ভাইদের থলে শস্যে ভরে দিলেন। তারপর তিনি গোপনে রাজার সোনার বাটিটি বিনিইয়ামিনের থলিতে ভরে দিলেন।

যাওয়ার সময়, রাজার সৈন্যরা তাদের থামালো, কারণ তারা রাজার হারিয়ে যাওয়া পাত্রটি খুঁজছিল। ভাইদের থলে তল্লাশি করা হয় এবং সবচেয়ে ছোট ভাই বিনয়ামিনের থলে থেকে হারিয়ে যাওয়া কাপটি উদ্ধার করা হয়। সৈন্যরা চিৎকার করে ওঠে –

....أَيَّتُهَا ٱلۡعِيرُ إِنَّكُمۡ لَسَٰرِقُونَ
ওহে কাফেলার লোকজন, নিশ্চয় তোমরা চোর।18

ভাইরা হতভম্ব হয়ে গেল! তারা অবিলম্বে স্মরণ করলো বাড়িতে তাদের অসুস্থ বাবার কথা, এবং বিনয়ামিনকে যে কোনও মূল্যে রক্ষা করার জন্য তাদের শপথের কথা। তারা সৈন্যদের কাছে অনুরোধ করল তাদের ছোট ভাইকে ছেড়ে দিতে এবং এবং তার বদলে তাদের একজনকে রেখে দিতে, কিন্তু সৈন্যরা অস্বীকার করল। ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বড়জন বললেন –

....فَلَنۡ أَبۡرَحَ ٱلۡأَرۡضَ حَتَّىٰ يَأۡذَنَ لِىٓ أَبِىٓ أَوۡ يَحۡكُمَ ٱللَّهُ لِىۖ وَهُوَ خَيۡرُ ٱلۡحَٰكِمِينَ
সুতরাং যতক্ষণ না আমার পিতা আমাকে অনুমতি দেবেন অথবা আল্লাহ আমার ব্যাপারে ফয়সালা করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এদেশ ছেড়ে যাব না এবং তিনি সর্বোত্তম ফয়সালাকারী’।19

তাই বাকি ভাইয়েরা বড় ভাইকে দেখে মিশর ত্যাগ করল।

ইয়াকুব (আ:) যখন তার কনিষ্ঠ পুত্রের দুর্দশার কথা জানতে পারলেন, তিনি ইউসুফ (আ:) এবং বিনিয়ে আমিনের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেলেন। তিনি সান্ত্বনার জন্য প্রার্থনার আশ্রয় নিলেন কারণ তিনি জানতেন যে একমাত্র আল্লাহই তার ব্যথা প্রশমিত করতে পারেন।

قَالَ إِنَّمَآ أَشۡكُواْ بَثِّى وَحُزۡنِىٓ إِلَى ٱللَّهِ وَأَعۡلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ
সে বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’।20

শীঘ্রই, তিনি তার ছেলেদের রাজার দেশে ফিরে যেতে এবং তাদের ভাই সম্পর্কে খোঁজখবর করার নির্দেশ দেন।

يَٰبَنِىَّ ٱذۡهَبُواْ فَتَحَسَّسُواْ مِن يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلَا تَاْيۡئَسُواْ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ لَا يَاْيۡئَسُ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡكَٰفِرُو
‘হে আমার ছেলেরা, তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের খোঁজ খবর নাও। আর তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, কেননা কাফির কওম ছাড়া কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না’।21

বাবার কথা মত ছেলেরা আবার মিশরে ফিরে যায়। তারা ইউসুফের (আ:) সাথে দেখা করে এবং বলে যে তারা অভাব-অনটন এবং দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত। তখন ইউসুফ (আ:) তাদের বললেন-

قَالَ هَلۡ عَلِمۡتُم مَّا فَعَلۡتُم بِيُوسُفَ وَأَخِيهِ إِذۡ أَنتُمۡ جَٰهِلُونَ
সে বলল, ‘তোমাদের জানা আছে কি, ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ করেছিলে, যখন তোমরা অজ্ঞ ছিলে’?22

ভাইদের বুঝতে সময় লাগেনি যে এটি আসলেই তাদের দীর্ঘ দিনের হারিয়ে যাওয়া ভাই ইউসুফ, তারা ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। কিন্তু ইউসুফ (আ:) তাদের এই বলে সান্ত্বনা দিলেন –

قَالَ لَا تَثۡرِيبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡيَوۡمَۖ يَغۡفِرُ ٱللَّهُ لَكُمۡۖ وَهُوَ أَرۡحَمُ ٱلرَّٰحِمِينَ
সে বলল, ‘আজ তোমাদের উপর কোন ভৎর্সনা নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। আর তিনি সবচেয়ে বেশি দয়ালু।’23

এরপর ইউসুফ (আ:) বললেন –

ٱذۡهَبُواْ بِقَمِيصِى هَٰذَا فَأَلۡقُوهُ عَلَىٰ وَجۡهِ أَبِى يَأۡتِ بَصِيرًا وَأۡتُونِى بِأَهۡلِكُمۡ أَجۡمَعِينَ
তোমরা আমার এ জামাটি নিয়ে যাও, অতঃপর সেটি আমার পিতার চেহারায় ফেল। এতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আর তোমরা তোমাদের পরিবারের সকলকে নিয়ে আমার কাছে চলে আস’।24

নির্দেশ অনুসারে, ভাইয়েরা তাদের পিতার মুখের উপর ইউসুফের জামাটি নিক্ষেপ করে এবং আল্লাহ অলৌকিকভাবে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন! তারা তাদের পিতাকে অনুরোধ করে তিনি যেন আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ক্ষমা চান।

একসাথে, তারা সবাই মিশরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন এবং সেখানে ইউসুফ (আ:) তাদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানালেন।

فَلَمَّا دَخَلُواْ عَلَىٰ يُوسُفَ ءَاوَىٰٓ إِلَيۡهِ أَبَوَيۡهِ وَقَالَ ٱدۡخُلُواْ مِصۡرَ إِن شَآءَ ٱللَّهُ ءَامِنِينَ
অতঃপর যখন তারা ইউসুফের নিকট প্রবেশ করল, তখন সে তার পিতামাতাকে নিজের কাছে স্থান করে দিল এবং বলল, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় আপনারা নিরাপদে মিসরে প্রবেশ করুন’।25

ইউসুফ (আ:) তাঁর পিতা-মাতাকে সিংহাসনে বসিয়ে বললেন –

وَرَفَعَ أَبَوَيۡهِ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ وَخَرُّواْ لَهُۥ سُجَّدًاۖ وَقَالَ يَٰٓأَبَتِ هَٰذَا تَأۡوِيلُ رُءۡيَٰىَ مِن قَبۡلُ قَدۡ جَعَلَهَا رَبِّى حَقًّاۖ وَقَدۡ أَحۡسَنَ بِىٓ إِذۡ أَخۡرَجَنِى مِنَ ٱلسِّجۡنِ وَجَآءَ بِكُم مِّنَ ٱلۡبَدۡوِ مِنۢ بَعۡدِ أَن نَّزَغَ ٱلشَّيۡطَٰنُ بَيۡنِى وَبَيۡنَ إِخۡوَتِىٓۚ إِنَّ رَبِّى لَطِيفٌ لِّمَا يَشَآءُۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ
আর সে তার পিতামাতাকে রাজাসনে উঠাল এবং তারা সকলে তার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল এবং সে বলল, ‘হে আমার পিতা, এই হল আমার ইতঃপূর্বের স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আমার রব তা বাস্তবে পরিণত করেছেন আর তিনি আমার উপর এহসান করেছেন, যখন আমাকে জেলখানা থেকে বের করেছেন এবং তোমাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করার পর। নিশ্চয় আমার রব যা ইচ্ছা করেন, তা বাস্তবায়নে তিনি সূক্ষ্মদর্শী। নিশ্চয় তিনি সম্যক জ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’।26

সুবহানাল্লাহ, এভাবেই আল্লাহ পুনরায় পিতা পুত্রের মিলন ঘটালেন।

কুরআনে খুবই আকর্ষণীয় এক কাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে ইউসুফের (আ:) জীবনের দুঃখ-কষ্ট, পরীক্ষা এবং আনন্দের বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা দেখেছি ইউসুফের (আ:) বিরুদ্ধে কীভাবে হিংসা, ঘৃণা, প্রতারণা এবং সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছিল। তবুও তিনি ধৈর্য, ​​সাহসিকতা, সততা এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে জয়লাভ করেছিলেন।

ইউসুফের (আ:) জীবন থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো:

স্বপ্ন দেখা ভালো, তবে স্বপ্নগুলোকে নিজের মধ্যে রাখতে হয়।

قَالَ يُوسُفُ لِأَبِيهِ يَٰٓأَبَتِ إِنِّى رَأَيۡتُ أَحَدَ عَشَرَ كَوۡكَبًا وَٱلشَّمۡسَ وَٱلۡقَمَرَ رَأَيۡتُهُمۡ لِى سَٰجِدِينَ
যখন ইউসুফ তার পিতাকে বলল, ‘হে আমার পিতা, আমি দেখেছি এগারটি নক্ষত্র, সূর্য ও চাঁদকে, আমি দেখেছি তাদেরকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায়’।27
قَالَ يَٰبُنَىَّ لَا تَقۡصُصۡ رُءۡيَاكَ عَلَىٰٓ إِخۡوَتِكَ فَيَكِيدُواْ لَكَ كَيۡدًاۖ إِنَّ ٱلشَّيۡطَٰنَ لِلۡإِنسَٰنِ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
সে বলল, ‘হে আমার পুত্র, তুমি তোমার ভাইদের নিকট তোমার স্বপ্নের বর্ণনা দিও না, তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন’।28

আমাদের সকলেরই জীবনে স্বপ্ন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সবাই আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী নাও হতে পারে, কারণ তারা হয়তো আপনার মত সৌভাগ্যবান বা আশীর্বাদপ্রাপ্ত নয়। তাই আপনি যখন আপনার প্রাপ্তি এবং অর্জনের কথা সোশ্যাল মিডিয়াতে ফলাও ভাবে প্রচার করেন, তা অন্যের মনোকষ্টের কারণ হতে পারে। আর এর থেকে জন্ম হয় হিংসা এবং খারাপ নজরের। কাজেই নিজের স্বপ্ন এবং প্রত্যাশাকে নিজের এবং নিজের প্রভুর মধ্যেই রাখুন।

আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সম্মান এবং আশীর্বাদ দেন

وَكَذَٰلِكَ يَجۡتَبِيكَ رَبُّكَ وَيُعَلِّمُكَ مِن تَأۡوِيلِ ٱلۡأَحَادِيثِ وَيُتِمُّ نِعۡمَتَهُۥ عَلَيۡكَ وَعَلَىٰٓ ءَالِ يَعۡقُوبَ كَمَآ أَتَمَّهَا عَلَىٰٓ أَبَوَيۡكَ مِن قَبۡلُ إِبۡرَٰهِيمَ وَإِسۡحَٰقَۚ إِنَّ رَبَّكَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
আর এভাবে তোমার রব তোমাকে মনোনীত করবেন এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবেন। আর তোমার উপর ও ইয়াকূবের পরিবারের উপর তাঁর নিআমত পূর্ণ করবেন যেভাবে তিনি তা পূর্বে পূর্ণ করেছিলেন তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের উপর, নিশ্চয় তোমার রব সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়29

আল্লাহ তাঁর সর্বোচ্চ জ্ঞানে আপনার জন্য সর্বোত্তম পরিকল্পনা করে রেখেছেন। সুতরাং আল্লাহ যদি আপনার ভাইকে আশীর্বাদ করেন তবে ঈর্ষান্বিত হবেন না এবং আপনার ভাইয়ের প্রতি ক্ষিপ্ত হবেন না। আপনার যদি সেই আশীর্বাদ বা অনুগ্রহ না থাকে তার মানে এই নয় যে আপনি অবহেলিত। বিশ্বাস রাখুন এবং অবিচল থাকুন। অন্যদের আনন্দে আনন্দিত হন, সুখ হয়তো একসময় আপনার কাছেও এসে ধরা দিবে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, কখনই অন্যের পাতনের জন্য কাজ করবেন না এর চিন্তাও করবেন না।

হাল ছাড়বেন না, ধৈর্য ধারণ করুন

শত প্রতিকূলতার মাঝেও রয়েছে প্রত্যাশার হাতছানি। আপনাকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে রাতের অন্ধকার দূরীভূত হয়ে এক সময় ভোরের আলো দেখা দিবেই।

وَجَآءُو عَلَىٰ قَمِيصِهِۦ بِدَمٍ كَذِبٍۚ قَالَ بَلۡ سَوَّلَتۡ لَكُمۡ أَنفُسُكُمۡ أَمۡرًاۖ فَصَبۡرٌ جَمِيلٌۖ وَٱللَّهُ ٱلۡمُسۡتَعَانُ عَلَىٰ مَا تَصِفُونَ
আর তারা তার জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে নিয়ে এসেছিল। সে বলল, ‘বরং তোমাদের নফস তোমাদের জন্য একটি গল্প সাজিয়েছে। সুতরাং (আমার করণীয় হচ্ছে) সুন্দর ধৈর্য। আর তোমরা যা বর্ণনা করছ সে বিষয়ে আল্লাহই সাহায্যস্থল’।30

জীবনে বিভিন্ন সময়ে আমরা বিভিন্ন উত্থান-পতন এবং পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাই। আমরা সাধারণ মানুষরা অনেক সময় আল্লাহর পরিকল্পনার উপর আশা ও আস্থা হারিয়ে ফেলি। ধৈর্য ও প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার এটাই মোক্ষম সময়। ইয়াকুব (আ:) তার পুত্রের মৃত্যুর বানোয়াট সংবাদে ধৈর্য ধারণ করেছিলেন এবং আল্লাহ তাকে দীর্ঘমেয়াদে সম্মানিত করেছিলেন। তাই আপনার জীবনে আল্লাহর পরিকল্পনার উপর আস্থা রাখুন এবং আপনিও একসময় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন।

ভালো এবং মন্দ দুটোর প্রতিউত্তরই হোক ভালো

وَرَٰوَدَتۡهُ ٱلَّتِى هُوَ فِى بَيۡتِهَا عَن نَّفۡسِهِۦ وَغَلَّقَتِ ٱلۡأَبۡوَٰبَ وَقَالَتۡ هَيۡتَ لَكَۚ قَالَ مَعَاذَ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ رَبِّىٓ أَحۡسَنَ مَثۡوَاىَۖ إِنَّهُۥ لَا يُفۡلِحُ ٱلظَّٰلِمُونَ
আর যে মহিলার ঘরে সে ছিল, সে তাকে কুপ্ররোচনা দিল এবং দরজাগুলো বন্ধ করে দিল আর বলল, ‘এসো’। সে বলল, আল্লাহর আশ্রয় (চাই)। নিশ্চয় তিনি আমার মনিব, তিনি আমার থাকার সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন। নিশ্চয় যালিমগণ সফল হয় না।’।31

কখনো কখনো আল্লাহ আমাদেরকে আশীর্বাদ করেন, কিন্তু আমরা সঠিকভাবে তাঁর নিয়ামতকে কাজে লাগাতে পারিনা। মানুষ যখন আপনার প্রতি সদয়, আপনিও তাদের প্রতি সদয় হন। এমনকি লোকেরা যখন আপনার ক্ষতি করতে চায়, তখনও তাদের মন্দকে ভাল দিয়ে ফিরিয়ে দিন যাতে আপনি আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পেতে পারেন।

অনন্ত শাস্তির চেয়ে পার্থিব যন্ত্রণাই উত্তম

قَالَ رَبِّ ٱلسِّجۡنُ أَحَبُّ إِلَىَّ مِمَّا يَدۡعُونَنِىٓ إِلَيۡهِۖ وَإِلَّا تَصۡرِفۡ عَنِّى كَيۡدَهُنَّ أَصۡبُ إِلَيۡهِنَّ وَأَكُن مِّنَ ٱلۡجَٰهِلِينَ
সে (ইউসুফ) বলল, ‘হে আমার রব, তারা আমাকে যে কাজের প্রতি আহবান করছে তা থেকে কারাগারই আমার নিকট অধিক প্রিয়। আর যদি আপনি আমার থেকে তাদের চক্রান্ত প্রতিহত না করেন তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হব’।32

প্রলোভনের মাঝে নিজের বিশ্বাসকে কখনো পরীক্ষিত করবেন না। আখেরাতের অনন্ত শাস্তির চেয়ে পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী দুঃখ কষ্টকে মেনে নেওয়াই ভালো। ফিতনা থেকে যতটা কারণ দূরে থাকুন। এমনকি একজন নবীও একজন মহিলার দ্বারা প্রলব্ধ হয়েছিলেন। একমাত্র আল্লাহর সাহায্য তাকে পাতন থেকে রক্ষা করেছিল। সেখানে আপনার বা আমার পরীক্ষিত হওয়ার ব্যাপারে দুঃসাহস দেখানোর প্রশ্নই উঠে না।

  1. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৪ ↩︎
  2. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-১৩ ↩︎
  3. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-১৭ ↩︎
  4. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-১৮ ↩︎
  5. সূরা ইউসুফ-১২:আয়াত -২৩ ↩︎
  6. সূরা ইউসুফ-১২:আয়াত -২৫ ↩︎
  7. সূরা ইউসুফ-১২:আয়াত -২৬ ↩︎
  8. সুরা ইউসুফ-১২:আয়াত-৩৩ ↩︎
  9. সুরা ইউসুফ-১২:আয়াত-৩৬ ↩︎
  10. সুরা ইউসুফ-১২:আয়াত-৪৩ ↩︎
  11. সুরা ইউসুফ-১২:আয়াত-৪৭ ↩︎
  12. সুরা ইউসুফ-১২:আয়াত-৪৮ ↩︎
  13. সুরা ইউসুফ-১২:আয়াত-৪৯ ↩︎
  14. সুরা ইউসুফ-১২:আয়াত-৫১ ↩︎
  15. সুরা ইউসুফ-১২:আয়াত-৫১ ↩︎
  16. সূরা ইউসুফ-১২:আয়াত-৬৪ ↩︎
  17. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৬৯ ↩︎
  18. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৭০ ↩︎
  19. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৮০ ↩︎
  20. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৮৬ ↩︎
  21. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৮৭ ↩︎
  22. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৮৯ ↩︎
  23. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৯২ ↩︎
  24. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৯৩ ↩︎
  25. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৯৯ ↩︎
  26. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-১০০ ↩︎
  27. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৪ ↩︎
  28. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৫ ↩︎
  29. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৬ ↩︎
  30. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-১৮ ↩︎
  31. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-২৩ ↩︎
  32. সূরা ইউসুফ-১২: আয়াত-৩৩ ↩︎

লিখেছেন

Picture of ফাহমিনা হাসানাত

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture