পথভ্রষ্ট শহর
লূত (আঃ) ছিলেন ইবরাহীমের (আঃ) ভাতিজা। চাচার সাথে তিনিও জন্মভূমি ‘বাবেল’ শহর থেকে হিজরত করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অদূরে কেন‘আনে চলে আসেন। লুত (আ:) ইব্রাহিমের (আ:) বার্তাকে ভালবাসতেন, সম্মান করতেন এবং বিশ্বাস করতেন, এমনকি যখন সবাই তাকে উপহাস করেছিল তখনও। ইব্রাহিম (আঃ) লুতকে (আঃ) সাথে নিয়ে প্রায়শই স্থল ও সমুদ্র পথে বহুদূর ভ্রমণ করে মানুষকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন।
নবী ইব্রাহিম (আঃ ) এবং লুত (আঃ) যখন ফিলিস্তিনে হিজরত করছিলেন, তখন তারা আল্লাহর ওহী পেলেন। ওহির মাধ্যমে জানানো হলো যে লুতকে (আঃ) সাদূমবাসীদের জন্য একজন নবী ও রসূল হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। আল্লাহ নতুন নবীকে নির্দেশ দিলেন জর্ডান ও ফিলিস্তিনের সীমান্তে অবস্থিত সাদূম শহরে ভ্রমণ করার জন্য এবং ওই শহরের সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে আল্লাহর ইবাদতে ফিরিয়ে আনার জন্য।
সাদূম ছিল একটি সমৃদ্ধশালী শহর এবং বাণিজ্য কেন্দ্র। বহু পর্যটক, বণিক, এবং ব্যবসায়ীরা সেই সময় এই শহর পরিদর্শন করত। কিন্তু একই সাথে এটি ছিল অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত একটি শহর, এবং এর অধিবাসীরা অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। এই শহরের উপর দিয়ে অতিক্রমকারী যাত্রীদের প্রায়শই আক্রমণ করা হতো, সর্বস্ব লুট করা হতো, এমনকি তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যাও করা হতো। কিন্তু, এই দুর্নীতিগ্রস্ত জাতির দ্বারা সংঘটিত সবচেয়ে জঘন্য কাজটি ছিল সমকামিতা।
লুতের (আ:) কাওম এই পৃথিবীতে প্রথম সমকামিতা প্রবর্তন করে। ইতিহাসে সাদূমবাসীদের আগে কেউ সমকামিতার অনুশীলন করেনি। এই জাতির মধ্যে এই লজ্জাজনক প্রথা প্রচলিত ছিল, এবং সবাই এতে নিয়োজিত ছিল। তারা তাদের আচরণের জন্য অত্যন্ত গর্বিত ছিল এবং প্রকাশ্যে এই নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতো। তারা প্রকাশ্যে এই অনৈতিক আচরণে জড়িত ছিল।
নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে লুত (আ:) শীঘ্রই সাদূমে বসতি স্থাপন করেন এবং এর লোকদেরকে ইসলামের ছায়াতলে আনার চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি ভাল ভাবেই অবগত ছিলেন যে এই জাতি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি। কিন্তু তিনি তার প্রভুর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছিলেন, ভালো প্রত্যাশা করেছিলেন, এবং একান্তভাবে প্রার্থনা করেছিলেন যেন তারা শীঘ্রই তাদের নিজেদের ত্রুটি উপলব্ধি করে আল্লাহর পথে প্রবেশ করে। তিনি এসে পূর্বেকার নবীগণের ন্যায় প্রথমে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে বললেন,
إِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ أَمِيْنٌ، فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيْعُوْنِ، وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلاَّ عَلَى رَبِّ الْعَالَمِيْنَ،
‘আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি এর জন্য তোমাদের নিকটে কোনরূপ প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো বিশ্বপ্রভু আল্লাহ দিবেন’।
[সূরা আশ-শু'য়ারা: ১৬২-১৬৪]
শীঘ্রই হযরত লুত (আঃ) সাদূম জনপদের লোকদেরকে তাদের প্রভুর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন: “তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না এবং তাঁর আনুগত্য করবে না?”
আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর।
[সূরা আশ-শু’আরা: ১৬২-১৬৩]
সাদূমের পথভ্রষ্ট লোকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলো: “এই লোকটা আমাদের জনপদে ঢুকেছে, আর আমরা যা করছি তা আমাদেরকে ছেড়ে দিতে বলছে? স্পষ্টতই, তার কোন উদ্দেশ্য আছে এবং এর থেকে সে কিছু ফায়দা হাসিল করতে চায়! লুত (আঃ) উত্তর দিলেন –
আমি এর জন্য তোমাদের নিকটে কোনরূপ প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো বিশ্বপ্রভু আল্লাহ দিবেন’।
[সূরা আশ-শু’আরা: ১৬৪]
তখন লুত (আঃ) সমকামিতার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং তাদের জানান যে এটি আসলেই একটি অনৈতিক প্রথা। তিনি বললেন:
أَتَأۡتُونَ ٱلذُّكۡرَانَ مِنَ ٱلۡعَٰلَمِينَ
‘সৃষ্টিকুলের মধ্যে তোমরা কি কেবল পুরুষদের সাথে উপগত হও’?
[সূরা আশ-শু’আরা: ১৬৫]
وَتَذَرُونَ مَا خَلَقَ لَكُمۡ رَبُّكُم مِّنۡ أَزۡوَٰجِكُمۚ بَلۡ أَنتُمۡ قَوۡمٌ عَادُونَ
‘আর তোমাদের রব তোমাদের জন্য যে স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন তাদেরকে তোমরা ত্যাগ কর, বরং তোমরা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়’।
[সূরা আশ-শু’আরা: ১৬৬]
তখন লুত (আঃ) তাঁর জাতিকে অবহিত করেন যে তিনি কখনই এই জাতীয় গর্হিত কাজের অনুশীলন এবং অনুমোদন করবেন না, এবং তিনি তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তির বিষয়েও সতর্ক করেলেন –
قَالَ إِنِّى لِعَمَلِكُم مِّنَ ٱلۡقَالِينَ
লূত বলল, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের কাজকে ঘৃণা করি’।
[সূরা আশ-শু’আরা: ১৬৮]
সদূমের পুরুষ ও মহিলারা লুতের (আ:) কথায় প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে; তারা একে অপরের সাথে আলোচনা শুরু করে, এবং লুতকে (আঃ) তাদের জনপদ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। তারা লুতকে (আঃ) সতর্ক করে বলে –
قَالُواْ لَئِن لَّمۡ تَنتَهِ يَٰلُوطُ لَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡمُخۡرَجِينَ
তারা বলল, ‘হে লূত, তুমি যদি বিরত না হও, তাহলে তুমি অবশ্যই বহিস্কৃতদের অন্তর্ভুক্ত হবে’।
[সূরা আশ-শু’আরা:১৬৯]
লুত (আঃ) ব্যথিত হলেন। বছরের পর বছর মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার পরও সাদূমের একজনও ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করেনি। সাদূমের একমাত্র মুসলিম পরিবার ছিল লুতের (আ:) পরিবার এবং তাঁর পরিবারের সকল সদস্যও মুসলিম ছিল না। লুত এবং তাঁর কন্যারা তাদের ধর্মে অবিচল ছিলেন, কিন্তু তাঁর স্ত্রী অবিশ্বাসীদের মধ্যেই ছিল। তাই হযরত লুত (আঃ) আকাশের দিকে হাত তুলে দোয়া করলেন:
رَبِّ نَجِّنِى وَأَهۡلِى مِمَّا يَعۡمَلُونَ
হে আমার রব, তারা যা করছে, তা থেকে আমাকে ও আমার পরিবার-পরিজনকে তুমি রক্ষা কর’।
[সূরা আশ-শু’আরা:১৬৭]
আমরা জেনেছি লূতের (আ:) আহবানে সাদূম জনপদের কেউ ইসলামের ছায়াতলে আসেনি। লূত (আ:) মরিয়া হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তিনি যেন তাঁর পরিবার এবং পরিজনকে এই অশালীন কাজ থেকে রক্ষা করেন।
এদিকে আল্লাহ তা’য়ালা জিবরীল (আ:) সহ তিনজন ফেরেশতাকে পুরুষের ছদ্মবেশে ইব্রাহিমের (আ:) বাড়িতে অতিথি হিসেবে পাঠালেন। ইব্রাহিম (আ:) ফেরেশতাদের চিনতে ব্যর্থ হন, এবং তিনি তাঁর অতিথিদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু অতিথিরা তাঁর দেওয়া খাবার প্রত্যাখ্যান করেন। এতে ইব্রাহিম (আ:) ভীত হয়ে তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। ফেরেশতারা ইব্রাহিমের (আ:) কাছে নিজেদের পরিচয় দিলেন, এবং তাঁকে এক পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলেন।
وَلَقَدۡ جَآءَتۡ رُسُلُنَآ إِبۡرَٰهِيمَ بِٱلۡبُشۡرَىٰ قَالُواْ سَلَٰمًاۖ قَالَ سَلَٰمٌۖ فَمَا لَبِثَ أَن جَآءَ بِعِجۡلٍ حَنِيذٍ
আর অবশ্যই আমার ফেরেশতারা সুসংবাদ নিয়ে ইবরাহীমের কাছে আসল, তারা বলল, ‘সালাম’। সেও বলল, ‘সালাম’। বিলম্ব না করে সে একটি ভুনা গো বাছুর নিয়ে আসল।’
[সূরা হুদ:৬৯]
فَلَمَّا رَءَآ أَيۡدِيَهُمۡ لَا تَصِلُ إِلَيۡهِ نَكِرَهُمۡ وَأَوۡجَسَ مِنۡهُمۡ خِيفَةًۚ قَالُواْ لَا تَخَفۡ إِنَّآ أُرۡسِلۡنَآ إِلَىٰ قَوۡمِ لُوطٍ
অতঃপর যখন সে দেখতে পেল, তাদের হাত এর প্রতি পৌঁছছে না, তখন তাদেরকে অস্বাভাবিক মনে করল এবং সে তাদের থেকে ভীতি অনুভব করল। তারা বলল, ‘ভয় করো না, নিশ্চয় আমরা লূতের কওমের কাছে প্রেরিত হয়েছি’।
[সূরা হুদ: ৭০]
ইব্রাহীম (আ:) জানতেন যে সদূমবাসীদের জন্য আল্লাহর শাস্তি নিকটবর্তী। তিনি অবিলম্বে তাঁর ভাতিজা লুত (আ:) এর জন্য শঙ্কিত বোধ করলেন।
فَلَمَّا ذَهَبَ عَنۡ إِبۡرَٰهِيمَ ٱلرَّوۡعُ وَجَآءَتۡهُ ٱلۡبُشۡرَىٰ يُجَٰدِلُنَا فِى قَوۡمِ لُوطٍ
অতঃপর যখন ইবরাহীম থেকে ভয় দূর হল এবং তার কাছে সুসংবাদ এল, তখন সে লূতের কওম সম্পর্কে আমার সাথে বাদানুবাদ করতে লাগল।
[সূরা হুদ: ৭৪]
আজাবের কথা শুনে ইব্রাহিম (আ:) ফেরেশতাদের বললেন এই জাতির মধ্যে তো আমার ভাতিজা লূতও (আ:) আছে। ফেরেশতারা তখন উত্তর দিলেন: “এর মধ্যে কে আছে সেই ব্যাপারে আমরা অধিক অবগত।” তারা ইব্রাহিমকে (আ:) আশ্বস্ত করেছিল যে লুতকে (আ:) রক্ষা করা হবে।
তারপর ফেরেশতারা সুদর্শন যুবকের ছদ্মবেশে সাদূমের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। লুতের (আ:) কন্যা, যিনি ছিলেন একজন বিশ্বাসী, সুদর্শন পুরুষদের শহরে প্রবেশ করতে দেখে দৌড়ে তার বাবার কাছে গেলেন এবং এই তিনজন যুবকের কথা জানালেন। লুত (আ:) যুবকদের কাছে এগিয়ে এসে তাদের স্বাগত জানালেন।
সাদূমের লোকদের হাতে যুবকদের কি পরিণতি ঘটবে তা তিনি খুব ভাল করেই জানতেন; তাই যুবকদের নিরাপত্তার জন্য তিনি চাচ্ছিলেন তারা যেন এই শহর ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু নবী লুত (আ:) অতিথিদের চলে যেতে বলতে খুব বিব্রত বোধ করছিলেন, তাই তিনি তাদেরকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান যাতে কেউ এই সুদর্শন যুবকদের না দেখে।
সাদূমবাসীরা যখন জানতে পারে লূতের (আ:) বাড়িতে কয়েকজন সুদর্শন যুবক এসেছে, তারা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর বাড়ির দিকে ছুটে আসে।
وَجَآءَهُۥ قَوۡمُهُۥ يُهۡرَعُونَ إِلَيۡهِ وَمِن قَبۡلُ كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٱلسَّيِّئَاتِۚ
আর তার কওম তার কাছে ছুটে আসল এবং ইতঃপূর্বে তারা মন্দ কাজ করত…
[সূরা হুদ: ৭৮]
সাদূমবাসীদের এই অবস্থা দেখে লূত (আ:) তাঁর নিজের মেয়েদের কথা উল্লেখ করেন, এবং বলেন যে তারা তোমাদের জন্য পবিত্র এবং হালাল।
قَالَ يَٰقَوۡمِ هَٰٓؤُلَآءِ بَنَاتِى هُنَّ أَطۡهَرُ لَكُمۡۖ
সে বলল, ‘হে আমার কওম, এরা আমার মেয়ে, তারা তোমাদের জন্য পবিত্র…
[সূরা হুদ: ৭৮]
তিনি আরো বলেন –
فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُخۡزُونِ فِى ضَيۡفِىٓۖ أَلَيۡسَ مِنكُمۡ رَجُلٌ رَّشِيدٌ
সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার মেহমানদের ব্যাপারে তোমরা আমাকে অপমানিত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কোন সুবোধ ব্যক্তি নেই’?
[সূরা হুদ: ৭৮]
কিন্তু তারা কোন কথাই শুনলো না, বরং লূতের (আ:) ঘরের দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করল। লূত (আ:) খুব বিব্রত বোধ করতে লাগলেন।
وَلَمَّا جَآءَتۡ رُسُلُنَا لُوطًا سِىٓءَ بِهِمۡ وَضَاقَ بِهِمۡ ذَرۡعًا وَقَالَ هَٰذَا يَوۡمٌ عَصِيبٌ
আর যখন লূতের কাছে আমার ফেরেশতা আসল, তখন তাদের (আগমনের) কারণে তার অস্বস্তিবোধ হল এবং তার অন্তর খুব সঙ্কুচিত হয়ে গেল। আর সে বলল, ‘এ তো কঠিন দিন’।
[সূরা হুদ:৭৭]
মেহমানদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে লূত বলে উঠলেন –
قَالَ لَوۡ أَنَّ لِى بِكُمۡ قُوَّةً أَوۡ ءَاوِىٓ إِلَىٰ رُكۡنٍ شَدِيدٍ
সে বলল, ‘তোমাদের প্রতিরোধে যদি আমার কোন শক্তি থাকত অথবা আমি কোন সুদৃঢ় স্তম্ভের (শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী) আশ্রয় নিতে পারতাম!
[সূরা হুদ:৮০]
এই পর্যায়ে লূতের (আ:) কাছে ফেরেশতারা নিজেদের পরিচয় দিলেন।
قَالُواْ يَٰلُوطُ إِنَّا رُسُلُ رَبِّكَ لَن يَصِلُوٓاْ إِلَيۡكَۖ
তারা বলল, ‘হে লূত, আমরা তোমার রবের প্রেরিত ফেরেশতা, তারা কখনো তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না।
[সূরা হুদ:৮১]
ফেরেশতা জিব্রাইল (আ:) তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর পাখার ঝাপটায় সাদূমের সব পুরুষদের অন্ধ করে দিলেন।
وَلَقَدۡ رَٰوَدُوهُ عَن ضَيۡفِهِۦ فَطَمَسۡنَآ أَعۡيُنَهُمۡ فَذُوقُواْ عَذَابِى وَنُذُ
আর তারা তার কাছে তার মেহমানদেরকে (অসদুদ্দেশ্যে) দাবী করল। তখন আমি তাদের চোখগুলোকে অন্ধ করে দিলাম। (আর বললাম) আমার আযাব ও সাবধানবাণীর পরিণাম আস্বাদন কর।
[সূরা আল-কামার:৩৭]
হতবাক এবং ক্ষুব্ধ পুরুষেরা চিৎকার করে বলে উঠলো, নিশ্চয়ই এর পেছনে লূতের (আ:) ষড়যন্ত্র রয়েছে। তারা লূতকে (আ:) দেখে নেবে বলে হুমকি দিল।
এ পর্যায়ে লূতের (আ:) কাছে আল্লাহর নির্দেশ আসলো –
قَالُواْ يَٰلُوطُ إِنَّا رُسُلُ رَبِّكَ لَن يَصِلُوٓاْ إِلَيۡكَۖ فَأَسۡرِ بِأَهۡلِكَ بِقِطۡعٍ مِّنَ ٱلَّيۡلِ وَلَا يَلۡتَفِتۡ مِنكُمۡ أَحَدٌ إِلَّا ٱمۡرَأَتَكَۖ إِنَّهُۥ مُصِيبُهَا مَآ أَصَابَهُمۡۚ إِنَّ مَوۡعِدَهُمُ ٱلصُّبۡحُۚ أَلَيۡسَ ٱلصُّبۡحُ بِقَرِيبٍ
সুতরাং তুমি তোমার পরিবার নিয়ে রাতের কোন এক অংশে রওয়ানা হও, আর তোমাদের কেউ পিছে তাকাবে না। তবে তোমার স্ত্রী (রওয়ানা হবে না), কেননা তাকে তা-ই আক্রান্ত করবে যা তাদেরকে আক্রান্ত করবে। নিশ্চয় তাদের (আযাবের) নির্ধারিত সময় হচ্ছে সকাল। সকাল কি নিকটে নয়’?
[সূরা হুদ:৮১]
নির্দেশ অনুসারে, লুত (আঃ) তাঁর কন্যাদের সাথে রাতের বেলা বেলা সদূম ত্যাগ করলেন।
قَالُواْ يَٰلُوطُ إِنَّا رُسُلُ رَبِّكَ لَن يَصِلُوٓاْ إِلَيۡكَۖ فَأَسۡرِ بِأَهۡلِكَ بِقِطۡعٍ مِّنَ ٱلَّيۡلِ وَلَا يَلۡتَفِتۡ مِنكُمۡ أَحَدٌ إِلَّا ٱمۡرَأَتَكَۖ إِنَّهُۥ مُصِيبُهَا مَآ أَصَابَهُمۡۚ إِنَّ مَوۡعِدَهُمُ ٱلصُّبۡحُۚ أَلَيۡسَ ٱلصُّبۡحُ بِقَرِيبٍ
তারা বলল, ‘হে লূত, আমরা তোমার রবের প্রেরিত ফেরেশতা, তারা কখনো তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং তুমি তোমার পরিবার নিয়ে রাতের কোন এক অংশে রওয়ানা হও, আর তোমাদের কেউ পিছে তাকাবে না। তবে তোমার স্ত্রী (রওয়ানা হবে না), কেননা তাকে তা-ই আক্রান্ত করবে যা তাদেরকে আক্রান্ত করবে। নিশ্চয় তাদের (আযাবের) নির্ধারিত সময় হচ্ছে সকাল। সকাল কি নিকটে নয়’?
[সূরা হূদ:৮১]
ভোর হওয়ার সাথে সাথে একটি বিকট চিৎকার সাদূম জনপদকে প্রকম্পিত করে এবং এর অধিবাসীদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। জিব্রাইল (আ:) তার ডানার প্রান্ত দিয়ে সাদূম জনপদকে উপরে উঠিয়ে উপর করে ফেলে দেন এবং সাথে সাথে প্রবল বেগে ঘুর্ণিবায়ুর সাথে প্রস্তর বর্ষণ শুরু হয়। প্রতিটি পাথরে খোদাই করা ছিল একেকজন সীমালংঘনকারীর নাম। যেমন আল্লাহ বলেন –
فَلَمَّا جَاء أَمْرُنَا جَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهَا حِجَارَةً مِّن سِجِّيلٍ مَّنضُودٍ، مُّسَوَّمَةً عِندَ رَبِّكَ وَمَا هِيَ مِنَ الظَّالِمِيْنَ بِبَعِيدٍ
‘অবশেষে যখন আমাদের হুকুম এসে পৌঁছল, তখন আমরা উক্ত জনপদের উপরকে নীচে করে দিলাম এবং তার উপরে ক্রমাগত ধারায় মাটির প্রস্তর বর্ষণ করলাম’। ‘যার প্রতিটি তোমার প্রভুর নিকটে চিহ্নিত ছিল। আর ঐ ধ্বংসস্থলটি (বর্তমান আরবীয়) যালেমদের থেকে বেশী দূরে নয়’
[সূরা হূদ:৮২-৮৩]।
লুত (আ:) তাঁর কন্যাদের সাথে সদূম ত্যাগ করেছিলেন। সাদূমবাসীদের শাস্তি তাঁর স্ত্রীও ভোগ করেছিল কারণ সে তাদের জঘন্য অপরাধকে সমর্থন করেছিল। লুত (আ:) ফিরে আসেন তাঁর চাচা ইব্রাহিমের (আ:) কাছে, এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইব্রাহিমের সাথে আল্লাহর বাণী প্রচার করতে থাকেন।
কলুষিত সাদূম নগরীর ধ্বংসাবশেষ এর অধিবাসীদের উপর আল্লাহর ক্রোধের একটি শক্তিশালী নিদর্শন। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন –
إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٍ لِّلۡمُتَوَسِّمِينَ
وَإِنَّهَا لَبِسَبِيلٍ مُّقِيمٍ
নিশ্চয় এতে পর্যবেক্ষণকারীদের জন্য রয়েছে নিদর্শনমালা। আর নিশ্চয়ই তা পথের পাশেই বিদ্যমান ।
[সূরা আল-হিজর:৭৫-৭৬]
লূতের (আ:) কাহিনী থেকে আমরা যে শিক্ষাগুলো পাই
সমকামিতা এক জঘন্য অপরাধ যা ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। পুরুষ এবং নারীর জন্য আল্লাহ বিয়ের মত পবিত্র সম্পর্ককে হালাল করেছেন। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশ অমান্য করার জন্য লূতের (আ:) কাওমের উপর আল্লাহর কঠিন আযাব আপতিত হয়েছিল।আজকের বিশ্বে দুর্ভাগ্যক্রমে সমকামিতা ব্যাপক একটি সমস্যা, আর এদের জন্য লূতের কাহিনীতে রয়েছে একটি বিরাট শিক্ষা।
যারা নিজেরা অন্যায় না করলেও অন্যায় কাজকে সমর্থন করে আল্লাহর শাস্তি তাদের উপরও আপতিত হয়। লূতের (আ:) স্ত্রী সমকামিতার মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত না থাকলেও, সে সাদূমবাসীদের এই জঘন্য অপরাধকে সমর্থন করেছিল, এজন্য আল্লাহর শাস্তি তাকেও ভোগ করতে হয়েছে।
গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসালে চলবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক অন্যায় করলে আপনাকেও যে তা করতে হবে, তা কিন্তু নয়। লূতের (আ:) সম্প্রদায় তাই করেছিল, কিন্তু তার পরিবারের কিছু সদস্য কাওমের লোকদের সাথে তাল না মিলিয়ে, আল্লাহর নির্দেশ মতো লূতের (আ:) সাথে এসেছিল।
লুতের (আঃ) জাতি যে সমস্ত অপরাধ ও পাপ কাজে লিপ্ত ছিল তা আজকের সমাজেও দেখা যায়। তাই এখন সময় এসেছে সমকামিতা, শিশু পর্নোগ্রাফি, মানব পাচার, ব্যভিচার, ডাকাতি ও খুনের মতো জঘন্য কাজের নিন্দা করা অন্যথায়, আল্লাহর আযাব নিকটবর্তী এবং অবিশ্বাসীদের সতর্ক হওয়া উচিত।
নবী নূহের (আ:) মত লুতের (আঃ) স্ত্রীও কাফেরদের সাথে হাত মিলিয়েছিল, এবং তাদেরকেও আল্লাহর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। লুতের (আঃ) স্ত্রী ছিল একজন মুনাফিক, সেই সাদুমবাসীকে আল্লাহর প্রেরিত সুদর্শন ফেরেশতাদের সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। কাজেই মুনাফিকদের ব্যাপারে আমাদের সব সময় সচেতন থাকতে হবে।
একজন ধর্ম প্রচারককে অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে এবং নম্র ভাষায় অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে যদি আপনি কঠোর বা অহংকারী হন, তাহলে মানুষ আপনার থেকে দূরে সরে যাবে এবং এবং অবিশ্বাসীদের আপনি বিভ্রান্ত করবেন।
এই উদ্ধৃতিতে দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন “প্রত্যেক প্রাণই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।” সদূমের লোকেরা কখনই ধর্মীয় শিক্ষা এবং আল্লাহর শক্তিতে বিশ্বাস করেনি। লূতের (আ:) আহ্বানে এবং তাঁর সতর্কীকরণে তারা হাসি তামাশা করত, এবং আল্লাহর নিদর্শন উপেক্ষা করত। কাজেই পূর্ববর্তী জাতিদের থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, কুরআনে বর্ণিত বিধি-নিষেধ, হালাল-হারাম মেনে চলতে হবে, এবং আখেরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে।