ইতিহাস জুড়ে আমরা দেখতে পাই আল্লাহ মানবজাতিকে সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করার জন্য হাজার হাজার নবী রাসুলকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। একই সাথে, স্পষ্ট সতর্কবানী পাওয়া সত্ত্বেও যেসব জাতি তাঁর উপাসনা করতে অস্বীকার করেছে তিনি তাদের দায়বদ্ধ রেখেছেন। আলোচনা করতে যাচ্ছি নূহের (আ:) উত্তরসূরি প্রাচীন আরব গোত্রগুলোর মধ্যে একটি আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত নবী হুদের (আ:) জীবনী।
সুরা আল-আহকাফে উল্লিখিত আদ জাতি আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাংশের বালুকাময় পাহাড়ে বাস করত, যা আধুনিক ইয়েমেন ও ওমানের মধ্যবর্তী একটি অঞ্চল।
أَلَمۡ تَرَ كَيۡفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ
তুমি কি দেখনি তোমার রব কিরূপ আচরণ করেছেন ‘আদ জাতির সাথে?
إِرَمَ ذَاتِ ٱلۡعِمَادِ
ইরাম গোত্রের সাথে, যারা ছিল সুউচ্চ স্তম্ভের অধিকারী?
ٱلَّتِى لَمۡ يُخۡلَقۡ مِثۡلُهَا فِى ٱلۡبِلَٰدِ
যার সমতুল্য কোন দেশে সৃষ্টি করা হয়নি।1
হুদ (আ:) ছিলেন এদেরই বংশধর। আদ ও সামূদ জাতি ছিল নূহের (আ:) পুত্র সামের বংশধর। ইরামপুত্র ‘আদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ঊলা’ বা প্রথম ‘আদ এবং অপর পুত্রের সন্তান সামূদ-এর বংশধরগণ ‘আদ সানী বা দ্বিতীয় ‘আদ বলে খ্যাত।2 ‘আদ ও সামূদ উভয় গোত্রই ইরাম-এর দু’টি শাখা। সেকারণ ‘ইরাম’ কথাটি ‘আদ ও সামূদ উভয় গোত্রের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এজন্য কুরআনে কোথাও ‘আদ ঊলা’ (নাজম ৫০) এবং কোথাও ‘ইরামা যাতিল ‘ইমাদ’ (ফজর ৭) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আদ জাতির সামনে দুনিয়ার যাবতীয় নেয়ামতের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। আদ জাতির লোকেরা তাদের বিশাল উচ্চতা এবং সুঠাম দেহের জন্য সুপরিচিত ছিল। তাদের শক্তি এবং সামর্থ্য ছিল অতুলনীয়। নির্মাণ কাজে ছিল তাদের বিশেষ দক্ষতা। তাদের নির্মিত উঁচু উঁচু স্তম্ভের উপর বিশাল ইমারত আশেপাশের সব জাতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এতে করে অহংকার এবং অজ্ঞতা তাদের পেয়ে বসে। এছাড়া এ গোত্রের শাসকরাও ছিল অন্যায়ে লিপ্ত। অনিয়ন্ত্রিত এবং প্রশ্নাতীত ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য তারা সুপরিচিত ছিল।
আদ জাতি কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ ছিল না। তারা আল্লাহর উপাসনা করতো ঠিকই, কিন্তু সাথে অন্যান্য দেব-দেবীদেরও পূজা করত। এইসব দেব-দেবীদের প্রতিনিধিত্বকারী মূর্তিও তারা তৈরি করেছিল। তাই তাদেরকে একত্ববাদের দিকে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ তাদের কাছে একজন নবী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
নবী হুদকে (আ:) আল্লাহ এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন –
وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمۡ هُودًاۗ قَالَ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥٓۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ
আর (প্রেরণ করলাম) আদ জাতির নিকট তাদের ভাই হূদকে। সে বলল, ‘হে আমার কওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না’?3
হুদ (আ:) তার জাতির লোকদেরকে একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করার জন্য বলেছিলেন এবং অন্যান্য সকল প্রকার উপাসনা ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন তাদের নিজের হাতের তৈরি দেবতাদের উপাসনার যৌক্তিকতা নিয়ে। হুদ (আ:) তাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে আল্লাহ তা’আলাই তাদেরকে জীবন ও মৃত্যু দিয়েছেন, এবং আল্লাহই তাদেরকে সুঠাম দেহ ও দক্ষতা দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন, কাজেই একমাত্র তিনিই আন্তরিক উপাসনার যোগ্য।
وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمۡ هُودًاۚ قَالَ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥٓۖ إِنۡ أَنتُمۡ إِلَّا مُفۡتَرُونَ
আর আদ জাতির কাছে (প্রেরণ করেছিলাম) তাদের ভাই হূদকে। সে বলেছিল, ‘হে আমার কওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের জন্য কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তোমরা তো কেবল মিথ্যা রটনাকারী’।
يَٰقَوۡمِ لَآ أَسۡئَلُكُمۡ عَلَيۡهِ أَجۡرًاۖ إِنۡ أَجۡرِىَ إِلَّا عَلَى ٱلَّذِى فَطَرَنِىٓۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ
‘হে আমার কওম, আমি তোমাদের কাছে এর বিনিময়ে কোন প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো কেবল তাঁরই কাছে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। এরপরও কি তোমরা বুঝবে না’?4
গোত্রীয় প্রধানরা হুদকে (আ:) বিশ্বাস তো করলোই না, বরং তাকে উপহাস করলো এবং বোকা ও মিথ্যেবাদী আখ্যা দিল।
قَالَ ٱلۡمَلَأُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِن قَوۡمِهِۦٓ إِنَّا لَنَرَىٰكَ فِى سَفَاهَةٍ وَإِنَّا لَنَظُنُّكَ مِنَ ٱلۡكَٰذِبِينَ
তার কওমের কাফির নেতৃবৃন্দ বলল, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাকে নির্বুদ্ধিতায় দেখতে পাচ্ছি এবং আমরা অবশ্যই তোমাকে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করি’।5
হুদ (আ:) উত্তর দিয়েছিলেন –
قَالَ يَٰقَوۡمِ لَيۡسَ بِى سَفَاهَةٌ وَلَٰكِنِّى رَسُولٌ مِّن رَّبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ
সে বলল, ‘হে আমার কওম, আমার মধ্যে কোন নির্বুদ্ধিতা নেই; কিন্তু আমি সকল সৃষ্টির রবের পক্ষ থেকে রাসূল’
أُبَلِّغُكُمۡ رِسَٰلَٰتِ رَبِّى وَأَنَا۠ لَكُمۡ نَاصِحٌ أَمِينٌ
আমি তোমাদের নিকট আমার রবের রিসালাতসমূহ পৌঁছাচ্ছি, আর আমি তোমাদের জন্য কল্যাণকামী বিশ্বস্ত’।6
أَوَعَجِبۡتُمۡ أَن جَآءَكُمۡ ذِكۡرٌ مِّن رَّبِّكُمۡ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنكُمۡ لِيُنذِرَكُمۡۚ وَٱذۡكُرُوٓاْ إِذۡ جَعَلَكُمۡ خُلَفَآءَ مِنۢ بَعۡدِ قَوۡمِ نُوحٍ وَزَادَكُمۡ فِى ٱلۡخَلۡقِ بَصۜۡطَةًۖ فَٱذۡكُرُوٓاْ ءَالَآءَ ٱللَّهِ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ
তোমরা কি আশ্চর্য হচ্ছো যে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির নিকট উপদেশ এসেছে, যাতে সে তোমাদেরকে সতর্ক করে? আর তোমরা স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদেরকে নূহের কওমের পর স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন এবং সৃষ্টিতে তোমাদেরকে দৈহিক গঠন ও শক্তিতে সমৃদ্ধ করেছেন। সুতরাং তোমরা স্মরণ কর আল্লাহর নিআমতসমূহকে, যাতে তোমরা সফলকাম হও’।7
তার বাণীর প্রতি মানুষের বিরোধিতা সত্ত্বেও, হুদ (আ:) ধৈর্যশীল এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি তার জাতির লোকেদেরকে তাদের ভুলগুলো বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকেন, এবং তাদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহর উপাসনায় নিয়োজিত থাকতে উৎসাহিত করেন। তিনি তাদের হিসাব দিবস সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন, যখন আল্লাহ তা’আলা প্রতিটি আত্মাকে পুনরুত্থিত করবেন এবং পৃথিবীতে তাদের কর্ম ও বিশ্বাসের জন্য তাদের জবাবদিহি করবেন।
হুদ (আ:) তার গোত্রের লোকদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন, এবং তাদেরকে হিসাব দিবস সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন। কিন্তু মুশরিকরা তার কথা শুনলো না, কারণ পার্থীব লোভ-লালসা এবং অজ্ঞতা তাদেরকে অন্ধ করে রেখেছিল।
তারা ঠাট্টা করে বলতো:
“হে হুদ! তুমি কি বলছো যে আমরা মরে পচে মাটিতে পরিণত হওয়ার পর আবার পুনরুত্থিত হব?”
হুদ (আ:) উত্তরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই তোমরা বিচার দিবসে পুনরুত্থিত দিতে হবে, এবং তোমাদের প্রত্যেককে তাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।”
তারা বিদ্রুপের সাথে কানাকানি করে ও বলে, ” হুদের দাবিগুলো কতই না অদ্ভুত!”
তারা হুদকে (আ:) বিচার দিবস সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করল, তিনি ধৈর্য সহকারে তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন, এবং তাদেরকে বুঝিয়ে বললেন যে বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিচার দিবসে সবাইকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে তবে তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে আল্লাহ তা’আলা পরম ক্ষমাশীল, যারা আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করবে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিবেন।
আদ জাতি হুদের (আ:) কথা শুনল, কিন্তু তারা সত্যকে অস্বীকার করল। তারা তাদের বিশ্বাসে অটল ছিল যে মৃত্যুর পরে কোন জীবন নেই, এবং মৃত্যুর পরে মানুষের দেহাবশেষ মাটির সাথে মিশে যাবে।
وَقَالَ ٱلۡمَلَأُ مِن قَوۡمِهِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَكَذَّبُواْ بِلِقَآءِ ٱلۡأٓخِرَةِ وَأَتۡرَفۡنَٰهُمۡ فِى ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا مَا هَٰذَآ إِلَّا بَشَرٌ مِّثۡلُكُمۡ يَأۡكُلُ مِمَّا تَأۡكُلُونَ مِنۡهُ وَيَشۡرَبُ مِمَّا تَشۡرَبُونَ
আর তার সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ যারা কুফরী করেছে, আখেরাতের সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে এবং আমি দুনিয়ার জীবনে যাদের ভোগ বিলাসিতা দিয়েছিলাম, তারা বলল, ‘সে কেবল তোমাদের মত একজন মানুষ, সে তাই খায় যা থেকে তোমরা খাও এবং সে তাই পান করে যা থেকে তোমরা পান কর’।
وَلَئِنۡ أَطَعۡتُم بَشَرًا مِّثۡلَكُمۡ إِنَّكُمۡ إِذًا لَّخَٰسِرُونَ
‘আর যদি তোমরা তোমাদের মতই একজন মানুষের আনুগত্য কর, তবে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।
أَيَعِدُكُمۡ أَنَّكُمۡ إِذَا مِتُّمۡ وَكُنتُمۡ تُرَابًا وَعِظَٰمًا أَنَّكُم مُّخۡرَجُونَ
সে কি তোমাদের ওয়াদা দেয় যে, তোমরা যখন মারা যাবে এবং তোমরা মাটি ও হাড়ে পরিণত হয়ে যাবে। তোমাদেরকে অবশ্যই বের করা হবে?’
هَيۡهَاتَ هَيۡهَاتَ لِمَا تُوعَدُونَ
অনেক দূর, তোমাদের যে ওয়াদা দেয়া হয়েছে তা অনেক দূর।
إِنۡ هِىَ إِلَّا حَيَاتُنَا ٱلدُّنۡيَا نَمُوتُ وَنَحۡيَا وَمَا نَحۡنُ بِمَبۡعُوثِينَ
‘এ শুধু আমাদের দুনিয়ার জীবন। আমরা মরে যাই এবং বেঁচে থাকি। আর আমরা পুনরুত্থিত হবার নই’।
إِنۡ هُوَ إِلَّا رَجُلٌ ٱفۡتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا وَمَا نَحۡنُ لَهُۥ بِمُؤۡمِنِينَ
‘সে শুধু এক ব্যক্তি যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করেছে; আর আমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারী নই’।8
এত করে বোঝানোর পরও যখন আদ জাতি তাদের অবিশ্বাসে অটল রইল, হুদ (আ:) তাদের কাছে তার প্রচার বন্ধ করলেন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন।
قَالَ رَبِّ ٱنصُرۡنِى بِمَا كَذَّبُونِ
সে বলল, ‘হে আমার রব, আমাকে সাহায্য করুন, কারণ তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছে’।
قَالَ عَمَّا قَلِيلٍ لَّيُصۡبِحُنَّ نَٰدِمِينَ
আল্লাহ বললেন, ‘কিছু সময়ের মধ্যেই তারা নিশ্চিতরূপে অনুতপ্ত হবে’।9
হুদ (আ:) তার জাতিকে আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। আসন্ন দুর্যোগ এবং দুর্দশার ব্যাপারে আদ জাতি ছিল নিরুদ্বিগ্ন এবং গাফেল। তারা হুদকে (আ:) আত্মবিশ্বাসের সাথে চ্যালেঞ্জ করে বলল, তাদের সুউচ্চ অট্টালিকাগুলো তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করবে।
সতর্কতা বাণী সত্য হলো, এক বিধ্বংসী খরা সারা দেশে বয়ে গেল। মেঘহীন আকাশে সূর্যের প্রখর তেজ মরুভূমি এবং এর মধ্যে থাকা সব কিছুকে ঝলসে দিল।
হুদ (আ:) তার জাতিকে সম্বোধন করে আরও একবার বললেন –
وَيَٰقَوۡمِ ٱسۡتَغۡفِرُواْ رَبَّكُمۡ ثُمَّ تُوبُوٓاْ إِلَيۡهِ يُرۡسِلِ ٱلسَّمَآءَ عَلَيۡكُم مِّدۡرَارًا وَيَزِدۡكُمۡ قُوَّةً إِلَىٰ قُوَّتِكُمۡ وَلَا تَتَوَلَّوۡاْ مُجۡرِمِينَ
‘হে আমার কওম, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও অতঃপর তার কাছে তাওবা কর, তাহলে তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি পাঠাবেন এবং তোমাদের শক্তির সাথে আরো শক্তি বৃদ্ধি করবেন। আর তোমরা অপরাধী হয়ে বিমুখ হয়ো না’।10
আদ জাতি তখন তর্ক করে বলল –
قَالُواْ يَٰهُودُ مَا جِئۡتَنَا بِبَيِّنَةٍ وَمَا نَحۡنُ بِتَارِكِىٓ ءَالِهَتِنَا عَن قَوۡلِكَ وَمَا نَحۡنُ لَكَ بِمُؤۡمِنِينَ
তারা বলল, ‘হে হূদ, তুমি আমাদের কাছে কোন স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আসনি, আর তোমার কথায় আমরা আমাদের উপাস্যদের ত্যাগ করব না এবং আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাসীও নই’।
إِن نَّقُولُ إِلَّا ٱعۡتَرَىٰكَ بَعۡضُ ءَالِهَتِنَا بِسُوٓءٍۗ قَالَ إِنِّىٓ أُشۡهِدُ ٱللَّهَ وَٱشۡهَدُوٓاْ أَنِّى بَرِىٓءٌ مِّمَّا تُشۡرِكُونَ
আমরা তো কেবল বলছি যে, ‘আমাদের কোন কোন উপাস্য তোমাকে অমঙ্গল দ্বারা আক্রান্ত করেছে’।11
উত্তরে হুদ (আ:) বলেছিলেন –
সে বলল, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি আর তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমি অবশ্যই তা থেকে মুক্ত যাকে তোমরা শরীক কর।12
مِن دُونِهِۦۖ فَكِيدُونِى جَمِيعًا ثُمَّ لَا تُنظِرُونِ
আল্লাহ ছাড়া। সুতরাং তোমরা সকলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কর তারপর আমাকে অবকাশ দিও না’।
إِنِّى تَوَكَّلۡتُ عَلَى ٱللَّهِ رَبِّى وَرَبِّكُمۚ مَّا مِن دَآبَّةٍ إِلَّا هُوَ ءَاخِذٌۢ بِنَاصِيَتِهَآۚ إِنَّ رَبِّى عَلَىٰ صِرَٰطٍ مُّسۡتَقِيمٍ
আমি অবশ্যই তাওয়াক্কুল করেছি আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর উপর, প্রতিটি বিচরণশীল প্রাণীরই তিনি নিয়ন্ত্রণকারী। নিশ্চয় আমার রব সরল পথে আছেন’।
فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَقَدۡ أَبۡلَغۡتُكُم مَّآ أُرۡسِلۡتُ بِهِۦٓ إِلَيۡكُمۡۚ وَيَسۡتَخۡلِفُ رَبِّى قَوۡمًا غَيۡرَكُمۡ وَلَا تَضُرُّونَهُۥ شَيۡئًاۚ إِنَّ رَبِّى عَلَىٰ كُلِّ شَىۡءٍ حَفِيظٌ
অতঃপর তোমরা যদি বিমুখ হও, তবে যা নিয়ে আমি তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি তা তো তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। আর আমার রব তোমাদেরকে ছাড়া অন্য এক জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করবেন। আর তোমরা তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয় আমার রব সব কিছুর হেফাযতকারী’।13
এতেও তাদের হৃদয় দ্রবীভূত হলো না, বরং অহংকার করে তারা বলল –
قَالُوٓاْ أَجِئۡتَنَا لِتَأۡفِكَنَا عَنۡ ءَالِهَتِنَا فَأۡتِنَا بِمَا تَعِدُنَآ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّٰدِقِينَ
তারা বলল, ‘তুমি কি আমাদেরকে আমাদের উপাস্যদের থেকে নিবৃত্ত করতে আমাদের নিকট এসেছ? তুমি যদি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও, তাহলে আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে এসো’।14
হুদ (আ:) তখন বললেন –
قَالَ إِنَّمَا ٱلۡعِلۡمُ عِندَ ٱللَّهِ وَأُبَلِّغُكُم مَّآ أُرۡسِلۡتُ بِهِۦ وَلَٰكِنِّىٓ أَرَىٰكُمۡ قَوۡمًا تَجۡهَلُونَ
সে বলল, ‘এ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে। আর যা দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে, আমি তোমাদের কাছে তা-ই প্রচার করি, কিন্তু আমি দেখছি, তোমরা এক মূর্খ সম্প্রদায়’।15
আগেই সূর্যর প্রখর তাপে গাছপালা শুকিয়ে হলুদ হয়ে গিয়েছিল। কাজেই ঘন মেঘ উপত্যকার কাছাকাছি আসলে আদ জাতি আনন্দিত হল।
فَلَمَّا رَأَوۡهُ عَارِضًا مُّسۡتَقۡبِلَ أَوۡدِيَتِهِمۡ قَالُواْ هَٰذَا عَارِضٌ مُّمۡطِرُنَاۚ بَلۡ هُوَ مَا ٱسۡتَعۡجَلۡتُم بِهِۦۖ رِيحٌ فِيهَا عَذَابٌ أَلِيمٌ
অতঃপর যখন তারা তাদের উপত্যকার দিকে মেঘমালা দেখল তখন তারা বলল, ‘এ মেঘমালা আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে’। (হূদ বলল,) বরং এটি তা-ই যা তোমরা ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে। এ এক ঝড়, যাতে যন্ত্রণাদায়ক আযাব রয়েছে’।16
প্রচন্ড খরতাপ থেকে আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়ে দমকা হাওয়া এবং ঝড়ের রূপ নিল। এই ঝড় গাছপালা, ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে সবকিছু উপড়ে ফেলল। তাদের উচ্চ স্থাপনাগুলো, যা নিয়ে তাদের গর্বের শেষ ছিল না, হিংস্র ঝড়ের সামনে শক্তিহীন হয়ে পড়ে রইলো। এই ঝড় সাত দিন, আট রাত ধরে চলল, এবং আদ জাতিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিল।
শুধুমাত্র হুদ (আ:) ও তাঁর অনুসারীরা এই অগ্নিপরীক্ষা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তারা হাদরামাউতে হিজরত করেন, এবং সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে থাকেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন –
سَخَّرَهَا عَلَيۡهِمۡ سَبۡعَ لَيَالٍ وَثَمَٰنِيَةَ أَيَّامٍ حُسُومًا فَتَرَى ٱلۡقَوۡمَ فِيهَا صَرۡعَىٰ كَأَنَّهُمۡ أَعۡجَازُ نَخۡلٍ خَاوِيَةٍ
আর ‘আদ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল প্রচন্ড ঠান্ডা ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা।
سَخَّرَهَا عَلَيۡهِمۡ سَبۡعَ لَيَالٍ وَثَمَٰنِيَةَ أَيَّامٍ حُسُومًا فَتَرَى ٱلۡقَوۡمَ فِيهَا صَرۡعَىٰ كَأَنَّهُمۡ أَعۡجَازُ نَخۡلٍ خَاوِيَةٍ
তিনি তাদের উপর তা সাত রাত ও আট দিন বিরামহীনভাবে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তুমি উক্ত সম্প্রদায়কে সেখানে লুটিয়ে পড়া অবস্থায় দেখতে পেতে যেন তারা সারশূন্য খেজুর গাছের মত।17
সূরা আল আহকাফেও আল্লাহ তা’য়ালা আদ জাতির ধ্বংসের কথা বর্ণনা করেছেন –
تُدَمِّرُ كُلَّ شَىۡءٍۢ بِأَمۡرِ رَبِّهَا فَأَصۡبَحُواْ لَا يُرَىٰٓ إِلَّا مَسَٰكِنُهُمۡۚ كَذَٰلِكَ نَجۡزِى ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡمُجۡرِمِينَ
এটা তার রবের নির্দেশে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে’। ফলে তারা এমন (ধ্বংস) হয়ে গেল যে, তাদের আবাসস্থল ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এভাবেই আমি অপরাধী কওমকে প্রতিফল দিয়ে থাকি।
وَلَقَدۡ مَكَّنَّٰهُمۡ فِيمَآ إِن مَّكَّنَّٰكُمۡ فِيهِ وَجَعَلۡنَا لَهُمۡ سَمۡعًا وَأَبۡصَٰرًا وَأَفۡئِدَةً فَمَآ أَغۡنَىٰ عَنۡهُمۡ سَمۡعُهُمۡ وَلَآ أَبۡصَٰرُهُمۡ وَلَآ أَفۡئِدَتُهُم مِّن شَىۡءٍ إِذۡ كَانُواْ يَجۡحَدُونَ بِئَايَٰتِ ٱللَّهِ وَحَاقَ بِهِم مَّا كَانُواْ بِهِۦ يَسۡتَهۡزِءُونَ
আর আমি অবশ্যই তাদেরকে যাতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম, তোমাদেরকে তাতে প্রতিষ্ঠিত করিনি। আর আমি তাদেরকে কান, চোখ ও হৃদয় দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা যখন আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করত, তখন তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের হৃদয়সমূহ তাদের কোন উপকারে আসেনি। আর তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত তা-ই তাদেরকে পরিবেষ্টন করল।
وَلَقَدۡ أَهۡلَكۡنَا مَا حَوۡلَكُم مِّنَ ٱلۡقُرَىٰ وَصَرَّفۡنَا ٱلۡأٓيَٰتِ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ
আর অবশ্যই আমি তোমাদের পার্শ্ববর্তী জনপদসমূহ ধ্বংস করেছিলাম। আর আমি বিভিন্নভাবে আয়াতসমূহকে বর্ণনা করেছিলাম যাতে তারা ফিরে আসে।
فَلَوۡلَا نَصَرَهُمُ ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ قُرۡبَانًا ءَالِهَةًۢۖ بَلۡ ضَلُّواْ عَنۡهُمۡۚ وَذَٰلِكَ إِفۡكُهُمۡ وَمَا كَانُواْ يَفۡتَرُونَ
অতঃপর তারা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল, তারা কেন তাদেরকে সাহায্য করল না? বরং তারা তাদের থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, আর এটা তাদের মিথ্যাচার এবং তাদের মনগড়া উদ্ভাবন।18
হুদ (আ:) এবং আদ জাতির শিক্ষা
হুদ (আ:) ও আদ জাতির কাহিনী থেকে যে শিক্ষাগুলো আমরা নিতে পারি তা হলো –
ওহীর বিধানকে অস্বীকার করা এবং অন্যায়ের উপর জিদ ও অহংকার প্রদর্শন করাই হ’ল পৃথিবীতে আল্লাহর গযব নাযিলের প্রধান কারণ। আদ জাতি তাদের কাছে প্রেরিত নবী হুদের (আ:) একত্ববাদ আহ্বানে সাড়া দেয়নি। ফলস্বরূপ, আল্লাহ তাদেরকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন।
আল্লাহ যখন আমাদেরকে কোন ক্ষমতা বা শক্তি দেন, তখন যেন আমরা অহংকারী না হয়ে উঠি। আদ জাতি তাদের বিশাল ও মজবুত শারীরিক কাঠামো, এবং নির্মাণ কাজে তাদের দক্ষতার ব্যাপারে খুব বেশি আস্থাশীল এবং অহংকারী হয়ে উঠেছিল। এজন্যই আল্লাহর গজব তাদের উপর নাযিল হয়েছিল।
আমাদেরকে সবসময় মনে রাখতে হবে, আমাদের যে কোন শক্তি বা ক্ষমতা আল্লাহর দান, এবং তিনি যখন চান তখনই তা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেন। নবী রাসূলদের কাহিনী এবং অতীতের জাতিগুলোর মাধ্যমে এরকম অনেক রিমাইন্ডার আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন, আর আমরা যদি তা উপেক্ষা করি তাহলে আমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি। অহংকার এবং জিদের পরিণাম হলো এই দুনিয়াতে এবং আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তি।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে এই দুনিয়ায় সম্পদ, স্বাস্থ্য, এবং অন্যান্য নিয়ামত আমাদের জন্য পরীক্ষা। সবকিছু পেয়ে গেলে আমরা কি রকম প্রতিক্রিয়া দেখাই, এবং কিভাবে পরিবর্তিত হই তা পরীক্ষার জন্য।
মৃত্যু যখন আমাদের গ্রাস করবে তখন আমাদের স্বাস্থ্য সম্পদ কোন কিছুই কোন কাজে আসবে না, বরং যা কাজে আসবে তা হল এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্য।
আমরা কি অতীতের শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী জাতি, যারা তাদের নবীদের অমান্য করেছে এবং আল্লাহর বাণীকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের কোন অবশিষ্টাংশ বা চিহ্ন দেখতে পাই? এখনও কি সময় আসেনি যে আমরা পূর্ববর্তী জাতিগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি যাতে আমরা আল্লাহর ক্রোধের পাত্র না হই? আল্লাহ যেন আমাদের রক্ষা করেন এবং হেদায়েত করেন। আল্লাহুম্মা আমীন!
- সূরা আল-ফজর: ৬-৮ ↩︎
- ইবনে কাসীর, সূরা আ‘রাফ ৬৫, ৭৩ ↩︎
- সূরা আল-আরাফ: ৬৫ ↩︎
- সূরা হুদ: ৫০-৫১ ↩︎
- সূরা আল-আরাফ: ৬৬ ↩︎
- সূরা আল-আরাফ: ৬৭-৬৮ ↩︎
- সূরা আল-আরাফ-: ৬৯ ↩︎
- সূরা আল-মু’মিনুন: ৩৩-৩৮ ↩︎
- সূরা আল-মু’মিনুন: ৩৯-৪০ ↩︎
- সূরা হুদ-১১:আয়াত-৫২ ↩︎
- সূরা হুদ-১১:আয়াত-৫৩-৫৪ ↩︎
- সূরা হুদ-১১:আয়াত-৫৪ ↩︎
- সূরা হুদঃ৫৫-৫৭ ↩︎
- সূরা আল-আহকাফ-৪৬: আয়াত-২২ ↩︎
- সূরা আল-আহকাফ-৪৬: আয়াত-২৩ ↩︎
- সূরা আল-আহকাফ-৪৬: আয়াত-২৪ ↩︎
- সূরা আল-হাক্কাহ: ৬-৭ ↩︎
- সূরা আল-আহকাফ: ২৫-২৮ ↩︎