সর্বশেষ যে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে, সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে। কারণ ইতোমধ্যে সে আগুনে পুড়তে পুড়তে প্রায় কয়লা হয়ে যাবে। আল্লাহ তাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেবেন। সে ভাববে, তার চেয়ে বেশি নিয়ামত জান্নাতে আর কাউকে দেওয়া হয়নি। কারণ, যখন তাকে বলা হবে, পুরো দুনিয়ার সমান বিশাল জান্নাত তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, তখন সে আল্লাহকে বলবে, ‘আপনি মালিক হয়ে আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?’
এই ব্যক্তির এই কথাটি বলার সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিগণ হাসতেন। সর্বশেষ ওই ব্যক্তির জন্য এই দুনিয়া এবং আরো দশগুণ (দশটি দুনিয়ার সমান) দেওয়া হবে।1
এটি হলো সর্বশেষ জান্নাতি ব্যক্তির ঘটনা। ঈমান এমনই মূল্যবান সম্পদ—যদি এটি কারও কাছে থাকে, তবে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করে হলেও একদিন অনাবিল সুখের স্থান জান্নাতে যাবে। তবে, এই ঈমান বা বিশ্বাসটা হতে হবে নিখাদ—এতে কোনো ভেজাল থাকবে না; শির্ক থাকবে না; কুফর থাকবে না।
ঈমান তথা সঠিক ইসলামি আকিদা-বিশ্বাস মুমিন জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কারণ এই ঈমানের চেতনা দিয়েই তার পুরো জীবন পরিচালিত হয় এবং এই ঈমান দিয়েই তার জান্নাত নির্ধারিত হয়। সুতরাং শির্কমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান সম্পর্কে জানা প্রত্যেকের উপর ফরজ। আমরা ধারাবাহিকভাবে আমাদের নতুন এই ‘ঈমান সিরিজ’ কন্টিনিউ করবো ইনশাআল্লাহ।
বিষয়টি খুব বেশি চটকদার নয়, তাই অনেকে আগ্রহবোধ করেন না। অথচ এই ঈমানের বিশুদ্ধতা না থাকলে দুনিয়া এবং আখিরাত বরবাদ হয়ে যাবে। তাই, সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনারা আমাদের ঈমান সিরিজের প্রতিটি লেখা শেয়ার করবেন অথবা কপি করবেন। অসংখ্য মানুষ নামে মাত্র মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করছে, অথচ তাদের ঈমান-আকিদা বিশুদ্ধ নয়। আপনার একটি শেয়ার বা কপির মাধ্যমে একজন মানুষও যদি সঠিক পথের দিশা পায়, তবে আপনি মহাসৌভাগ্যের অধিকারী হয়ে যাবেন।
আল্লাহ চাইলে সকল গুনাহ ক্ষমা করবেন, কিন্তু শির্কের গুনাহ্ ক্ষমা করবেন না। শিরক হলো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে ইবাদতের যোগ্য মনে করা, অন্য কাউকে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালনকারী মনে করা, অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা।
শির্কের আরও অনেক ধরণ আছে, যা আমরা জানি না। কারণ শির্কের বিষয়গুলো খুবই সূক্ষ্ম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“এই উম্মতের শির্ক পিঁপড়ার পদচারণার চেয়েও সূক্ষ্ম বা গুপ্ত।”2
সুতরাং, শির্ক সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে, যদি আমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চাই এবং জান্নাতে যেতে চাই। পাশাপাশি তাওহিদ তথা আল্লাহর বিশুদ্ধ একত্ববাদ সম্পর্কেও জানতে হবে। কারণ তাওহিদে বিশ্বাসী প্রতিটি ব্যক্তি জান্নাতে যাবে। সর্বশেষ জান্নাতি ব্যক্তি তাওহিদের কারণেই জান্নাতের অধিকারী হবে। তাই, এ বিষয়েও জানা জরুরি।
একবার রাসুলুল্লাহ ﷺ এক আনসারি সাহাবির বাগানে প্রবেশ করলেন, তখন সেখানে দুটি উট লড়াই করছিলো এবং কাঁপছিলো। যখন রাসুলুল্লাহ ﷺ এদের নিকটে গেলেন, তখন উট দুটি তাদের ঘাড় জমিনে ঝুঁকিয়ে দিলো। সাথে থাকা লোকটি বলে উঠলেন,
‘উট আপনাকে সিজদা করেছে।’
তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ (তার কথাকে নাকচ করে) বললেন,
‘‘কোনো ব্যক্তির উচিত নয় অন্য কাউকে সিজদা করা।’’3
মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট দুটো অঙ্গ হলো: নাক এবং কপাল। এই দুটো সিজদার প্রধান অঙ্গ। সিজদা পাওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার।
অতএব, কোনো পিরের পায়ে বা মাজারে সিজদা দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম এবং শির্ক। যদি কেউ কোনো পির, কোনো প্রাণী বা অন্য কোনো কিছুকে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা দেয়, তবে সে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমতে মুশরিক (কাফির) হয়ে যাবে। তবে, যদি কেউ শুধু ‘সম্মান প্রদর্শনার্থে’ কোনো মাজারে বা কাউকে সিজদা করে (তার কাছে কিছু না চায় বা তার ইবাদত না করে), তবে সে অনেক আলিমের মতে কাফির হবে না, কিন্তু নিঃসন্দেহে কবিরা গুনাহগার হবে। কারণ, এভাবে সিজদা দেওয়াও হারাম।
রাসুল ﷺ মৃত্যুর পূর্বে পাঁচটি বিষয় বলেছিলেন। এর মাঝে একটি ছিলো:
‘‘তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মত তাদের নবি ও নেককারদের কবরকে সিজদার স্থান বানিয়েছিলো। সাবধান! তোমরা কবরগুলোকে সিজদার স্থান বানিও না। আমি সেটি থেকে তোমাদের নিষেধ করছি।’’4
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর আগে বলেছিলেন,
‘‘ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ; তারা তাদের নবিদের কবরকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে।’’
আয়িশা (রা.) বলেন, একই আশঙ্কা না থাকলে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরকে উন্মুক্ত রাখা হতো। কিন্তু আমি আশঙ্কা করি যে, (উন্মুক্ত রাখা হলে) একে সিজদার স্থানে পরিণত করা হবে।’5
এই হাদিস থেকে বুঝতে পারছি, বুজুর্গদের কবর তথা মাজারকে সিজদার স্থান বানানো যাবে না। মাজারে সিজদা দেওয়া যাবে না।
মু‘আয (রা.) সিরিয়া থেকে ফিরে এসে নবিজিকে সিজদা করেন। তখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘হে মু‘আয! এ কী?’’ তিনি উত্তর দিলেন,
‘আমি সিরিয়ায় গিয়ে দেখতে পেলাম, সেখানকার লোকেরা তাদের ধর্মীয় নেতা ও শাসকদের সিজদা করে। তাই আমি মনে মনে আশা পোষণ করলাম যে, আমি আপনার সামনে তাই করবো।’
তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন,
‘‘তোমরা তা করো না।’’6
যেখানে স্বয়ং রাসুলকে সিজদা দেওয়ার অনুমতি নেই, সেখানে কোনো পির, দরবেশ বা অন্য কোনো কিছুকে সিজদা দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।
কিছু লোক বলে, ‘ফেরেশতারা আদমকে সিজদা দিয়েছিলো, ইউসুফ (আ.)-কে তার ভাইয়েরা সিজদা দিয়েছিলো। তাই, আমাদের জন্যও এ ধরনের সম্মানসূচক সিজদা বৈধ।’ তাদের এই কথা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর ও ভুল।
কারণ আদম (আ.) ও ইউসুফ (আ.)-এর শরিয়ত (জীবনবিধান) আমাদের জন্য কেবল ততটুকু অনুসরণীয়, যতটুকু মুহাম্মাদি শরিয়তের সাথে মিলবে। এককথায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসার পর পূর্ববর্তী সকল নবির শরিয়ত রহিত হয়ে গেছে। যেমন: দাউদ (আ.)-এর উম্মতের জন্য শনিবারে মাছ শিকার করা অবৈধ ছিলো। অথচ, আমাদের জন্য এরকম কোনো বিধি-নিষেধ নেই। সুতরাং, পূর্ববর্তী নবিদের উদাহরণ টানা যাবে না।
সর্বশেষ দুটো কথা:
কোনো ব্যক্তিকে যদি দেখেন, মাজারে বা কারও পায়ে সিজদা দিচ্ছে, তবে সাথে সাথেই তাকে ‘মুশরিক’ বলবেন না। কারণ এদেশের প্রচুর মানুষ দ্বীনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ মূর্খ।
এরা এই সিজদার ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে না। অজ্ঞতার কারণে আলিমগণ এই শ্রেণির লোকদের সরাসরি ‘মুশরিক’ বা ‘কাফির’ বলেন না; শুধু কবিরা গুনাহগার বলেন। কিন্তু কেউ যদি এটা জানে যে, পিরের পায়ে বা মাজারে কিংবা অন্য কোনো কিছুতে সিজদা দেওয়া শির্ক, তবুও সে ইবাদত বা প্রার্থনার উদ্দেশ্যে সিজদা করে, তবে সে মুশরিক (কাফির) হয়ে যাবে। সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে। তাকে নতুন করে কালিমা পড়ে মুসলিম হতে হবে।
- ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৬৫৭১ ↩︎
- ইমাম বুখারি, আল-আদাবুল মুফরাদ: ৭১৬; শায়খ আলবানি, সহিহুল জামি’: ৩৭৩১; হাদিসটি সহিহ ↩︎
- ইমাম ইবনু হিব্বান, আস-সহিহ: ৪১৬২; হাদিসটি হাসান ↩︎
- ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ১০৭৫ ↩︎
- ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ১৩৩০ ↩︎
- ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১৮৫৩; হাদিসটি হাসান সহিহ ↩︎