মৃত্যুর সময় যে আফসোস রয়ে যাবে

মৃত্যুর সময় মানুষের যে আমল নিয়ে আফসোস হবে এবং আল্লাহর কাছে একজন মৃত্যু পথযাত্রী যে আমল করার জন্য সুযোগ চাইবে সেটি কোন আমল, জানেন?
সেটি আর কিছু নয় দানের আমল। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, আর আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে তোমাদের কারও মৃত্যু আসার আগে আগেই। (অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে,) হে আমার রব! আমাকে আরো কিছু সময়ের জন্য সুযোগ দিলে আমি দান সাদাকাহ করতাম এবং নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম! বান্দার এই আক্ষেপের প্রেক্ষিতে আল্লাহ বলছেন,
যখন কারো নির্ধারিত সময় উপস্থিত হয়ে যাবে, তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা আমল করো আল্লাহ সে সম্বন্ধে ভালোভাবে অবহিত রয়েছেন।1
وَأَنفِقُوا مِن مَّا رَزَقْنَاكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَىٰ أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ الصَّالِحِينَ
আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবেঃ হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।
وَلَن يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا ۚ وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন।
দান করা কত গুরুত্বপূর্ণ আমল হলে একজন মানুষ তার মৃত্যুর সময় মালাকুল মউতের উপস্থিতিতে আফসোস করবে, ভাবা যায়!
কাজেই আমাদের উচিত এখন থেকে দানের আমল বেশি বেশি করা এবং অন্যদেরকেও তা করতে উদ্বুদ্ধ করা। এই আমল খুবই পাওয়ারফুল একটি আমল যা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। যেখানে একবার বললেই হত সেখানে আল্লাহ কুরআনের পাতায় পাতায় দানের কথা বলেছেন। কত গুরুত্বপূর্ণ আমল হলে এতবার বলা যায় তা একটু চিন্তা করে দেখুন। এজন্য আমাদের একটি দিনও যেন এমন না যায় যেদিন কোনো দানই করা হয় নি। প্রতিদিন অন্তত একটা টাকা হলেও যেন দান করা হয়।
রামাদানের মতো দামি, মর্যাদাপূর্ণ সর্বোপরি কুরআনের মাসের খাতির পারলে প্রতি ওয়াক্তে মাসজিদের দান বাক্সে বা অসহায় কাউকে দান করতে পারলে আরও অনেক ভালো হবে। কারণ মৃত্যু চলে আসলে এ সুযোগ তো আর পরের বছর পাবো না।আমরা যদি এটা চিন্তা করি যে,হয়ত এটাই আমার জীবনের শেষ সুযোগ তখন আমল করার প্রতি আরও টান বেড়ে যাবে।
প্রতিদিন অন্তত পাঁচ টাকা করে দান করলেও সারা বছরে অর্থাৎ ৩৬৫ দিনে মাত্র ১৮২৫ টাকা হয়। অথচ আমাদের এমনও অনেক দিন আছে যেদিন এর চেয়েও অনেক বেশি টাকা এদিক সেদিক খরচ হয়ে যায়, অপচয় হয়ে যায়। আর সেই জায়গায় এই পরিমাণ টাকা সারা বছর মিলে কেন দান করতে পারবো না?
এটা তো বেশি কিছু নয়। তাছাড়া, এটা তো বিফলে যাবে না।
এটা আখিরাতের ইনভেস্টমেন্ট, আখিরাতের সঞ্চয়। এটা আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে তা-ও বহুগুণে ফিরে আসবে। আসলে যখন ইবাদাতের নিয়ত থাকে, যখন আখিরাতের ইনভেস্টমেন্ট কিংবা সঞ্চয় মনে করা হয় তখন অভাবী হলেও দান করা সহজ হয়ে যায়, কৃপণতা আসে না। মনে হয় এগুলো তো একসময় আরও উত্তমভাবে ফিরে পাচ্ছিই। তখন এ আমল করতে অনেক মজাও লাগে।
আপনি বিপদে আছেন? দান করুন।
ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন? দান করুন।
উপার্জন নিয়ে চিন্তা করছেন? দান করুন।
অসুস্থতায় ভুগছেন? দান করুন।
বিয়ে হচ্ছে না? নেককার জীবনসঙ্গী খুঁজছেন? দান করুন।
সন্তান নিয়ে চিন্তা হচ্ছে? দান করুন।
দাম্পত্য জীবন অসুখে কাটছে? দান করুন।
আর্থিক সমস্যায় আছেন? তবুও দান করুন।
পরীক্ষার টেনশন হচ্ছে? দান করুন।
নানা কারণে অন্তরটা পেরেশান? দান করুন।
সুস্থতার নিয়ামতে আছেন? দান করুন।
এই আমলটাকে প্রতিদিনের খাবার খাওয়ার মতোই অভ্যাসে পরিণত করে ফেলুন। মনে রাখবেন, এ আমল বড়ো দামি একটি আমল।
দানের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বলে রাখি। প্রথম বিষয় হচ্ছে, ছোটো ছোটো বাচ্চাদেরকে দিয়ে দান করাবেন। মাসজিদে গেলে অনেক বাচ্চাদের পাবেন যাদেরকে দিয়ে দান করালে অনেক খুশি হবে এবং আপনার সাথে সম্পর্ক মজবুত হবে।আর তাদের প্রতি আপনার অ্যাকসেস সহজ হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এতে তারা দানের আমল প্র্যাকটিক্যালি শিখে নিবে এবং এ আমলের প্রতি অভ্যস্ত হবে। এতে তারা জীবনে যতবার এই আমল করবে আপনিও ততবার সওয়াব পেতে থাকবেন। কারণ আপনিই তাদেরকে এই আমল শিখিয়ে দিয়েছেন। সুবহানআল্লাহ।
কত সুন্দর না বিষয়টা! একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মুমিন সবসময় নিজে তো সওয়াবের কাজ করবেই। এর পাশাপাশি কীভাবে অন্যের আমলে নিজের সওয়াবের ভাগ রাখা যায় সে চিন্তা থেকে অন্যকেও সবসময় আমলমুখী করার চেষ্টা করবে।বলা যায়,এটা তার এক প্রকার আমলী দূরদর্শিতা।
দানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, দান করার সময় এই নিয়তে দান করতে পারেন যে,
হে আমার রব, একমাত্র আপনারই সন্তুষ্টির জন্য আমার এই সামান্য দান আমার পক্ষ থেকে, আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, সন্তান সন্তনী, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচি, ফুফু-ফুফা, খালা-খালু আত্নীয় স্বজন, প্রতিবেশী, সকল মাজলুম সর্বোপরি সকল মুসলিম উম্মাহের পক্ষ থেকে দান করলাম। এতে আপনার দানের আমলটা ব্যাপক হয়ে যাবে। ফলে সওয়াবও বেশি হবে।
মাঝে মাঝে সারপ্রাইজিং কিছু দান করা যেতে পারে। কীভাবে?
এই ধরুন, আপনি রাস্তায় বের হয়ে কোনো অসহায়কে পেয়ে কিংবা কোনো বৃদ্ধ চাচার রিকশা থেকে নেমে আপনার কষ্টার্জিত টাকার মায়া ভুলে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম বিনিময় পাওয়ার আশায় হঠাৎ করে তাঁকে পাঁচশ টাকার মতো বড়ো চকচকে একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে হাসিমুখে সেখান থেকে চলে আসলেন। আহ, সে কী যে আনন্দ তা না করলে কখনোই বুঝতে পারবেন না।
এছাড়া, তাঁদের দৃষ্টিতে অপ্রত্যাশিত এই বিশাল পরিমাণ টাকা পেয়ে তাঁরা যে কত্ত বেশি খুশি হবে তা যদি তারা আপনাকে দেখাতে পারত তবে এই আমল আপনার সবসময় করতেই মন চাইত। মানুষকে এরকম সারপ্রাইজ দিয়ে খুশি করলে আল্লাহও একদিন আপনাকে তার চেয়েও উত্তম উপায়ে খুশি করবেন। কারণ আল্লাহ উত্তম বিনিময়দাতা।
দানের ক্ষেত্রে আরেকটি আইডিয়া বলি। সেটা হচ্ছে, আপনি আপনার মা বাবাকে কিছু টাকার, হতে পারে পাঁচশ টাকার মধ্যে পাঁচ টাকা কিংবা দশ টাকার ভাংতি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতে পারেন যে, তারা যেন ঐ নিয়তে অর্থাৎ তাদের মা-বাবা, ভাই- বোন, সন্তান সন্তনী, দাদা-দাদি, নানা-নানি প্রমুখের পক্ষ থেকে দান করেন। এটা তাদের জন্য এক প্রকার সারপ্রাইজ হবে। তাদেরকে এমন সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য তারা যেমন অনেক খুশি হবেন তেমনি আল্লাহও খুশি হবেন। আর এটাই হতে পারে আপনার ক্ষমা পাওয়ার উসিলা, হতে পারে নাজাতের উসিলা।
দেখুন, আমাদের অনেকের জীবনে হতে পারে এই রামাদানই শেষ রামাদান। আর শেষ রামাদান মনে করে আমাদের এই রামাদান এমনভাবে কাটানো উচিত যেন এই রামাদান ফ্রুটফুল একটি রামাদান হয়, যেন এই রামাদান আল্লাহর কাছে আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম রামাদান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তাই কোনোভাবেই যেন উপরে আলোচিত আমলগুলো আমাদের নিকট উপেক্ষিত না থাকে। আমরা যেন সিরিয়াসনেসের সাথে একমাত্র আল্লাহরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে আমলগুলো করতে থাকি। একইসাথে, অন্যদের তা করা নিয়ে উৎসাহিত করতে না ভুলি।
- সূরা মুনাফিকুন, আয়াত নং : ১০-১১ ↩︎