মৃতের লাশ ময়নাতদন্ত করার বিধান

মৃতের লাশ পোস্ট মর্টেম বা ময়নাতদন্ত করার ব্যাপারে সংক্ষেপে কথা হল:

আমাদের জানা জরুরি যে, মুসলিম ব্যক্তির দেহ সম্মানের পাত্র জীবদ্দশায় হোক অথবা মৃত্যুর পরে হোক। তাই তো ইসলামে অতি যত্নের সাথে মৃতের গোসল, কাফন-দাফন প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে সসম্মানে তার লাশ কবর দেওয়ার নির্দেশ এসেছে। আর মৃত ব্যক্তিকে অপদস্থ করা বা শরীরে আঘাত করা বা তার হাড়-হাড্ডি ভাঙ্গার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞায় হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:

عَنْ عَائِشَةَ: أَنَّ رَسُولَ اللّهِ ﷺ قَالَ: كَسْرُ عَظْمِ الْمَيِّتِ كَكَسْرِه حَيًّا
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“মৃত ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গা, জীবিতকালে তার হাড় ভাঙারই মতো।”
[আবু দাউদ, হা/৩২০৭, ইবনে মাজাহ হা/ ১৬১৬, সহীহ আত্ তারগীব, হা/ ৩৫৬৭-সনদ সহিহ]

ব্যাখ্যা: এ হাদিসে মৃত ব্যক্তিকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করতে নিষেধ করা হয়েছে।

আলোচ্য হাদিসের বর্ণনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আল্লামা সুয়তি রাহ.আবু দাউদের হাশিয়ার মধ্যে উল্লেখ করেছেন, জাবির রা. বলেন, একবার আমরা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে এক জানাজায় গেলাম। সেখানে গিয়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কবরের কাছে বসলেন এবং তার সাথে সাহাবিরাও বসলেন। এমন সময় একজন গর্ত খননকারী বেশ কিছু হাড় বের করে আনল এবং সে এগুলো ভাঙ্গার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এগুলো ভাঙ্গিও না। কেননা َكَسْرُ عَظْمِ الْمَيِّتِ كَكَسْرِه حَيًّا “মৃত অবস্থায় হাড় ভাঙ্গা জীবদ্দশায় হাড় ভাঙ্গার অনুরূপ।”

আল্লামা তীবী রাহ. বলেন,
“এ হাদিস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, জীবিত ব্যক্তিকে যেমন অপমান-অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করা যায় না ঠিক তেমনিভাবে মৃত ব্যক্তিকে অনুরূপ অবজ্ঞা ও অবহেলা করা যাবে না।”

ইবনে আব্দুল বার রাহ. বলেন, এ হাদিস থেকে এ ফায়দা গ্রহণ করা যায় যে, জীবিত ব্যক্তি যে সব কারণে কষ্ট ও ব্যথা অনুভব করে মৃত ব্যক্তিও সেসব কারণে ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করে। (হাদিস বিডি ডট কম থেকে সংগৃহীত)

এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ. বলেন,

المقصود أن هذا الحديث الصَّحيح يدل على تحريم كسر عظم الميت، وأن كسره ميتًا ككسره حيًّا، يعني: إيذاء الميت وتقطيعه وتكسير عظامه كالحي، فلا يجوز، فالمسلم محترم حيًّا وميتًا، فالواجب عدم التَّعرض له بما يُؤذيه ويُشوه خلقتَه.

ويُستنبط من هذا تحريم التَّمثيل به لمصلحة الأحياء: كأن يُؤخذ قلبه أو رئته أو كليته أو غير ذلك؛ لأنَّ هذا أبلغ من كسر عظم الميت؛ لأنَّ هذا كله أذى وتمثيل بالميت وانتهاك لحرمته.

وقد شاع بين الناس الآن التَّبرع بالأعضاء وشراؤها من بلادٍ بعيدةٍ، وقد اختلف العلماءُ في هذا: فمنهم مَن أجاز ذلك وقالوا: إنَّ مصلحة الحي مُقدَّمة على مصلحة الميت، وأن الناس يحتاجون إلى الأخذ من الأموات؛ لكثرة مرضى الكلى وغيرها، وهذا فيه نظر.

والأظهر عندي أنَّ ذلك لا يجوز، وأنه من جنس كسر عظم الميت، ومعناه: التلاعب بالميت، هذا يأخذ كليته، وهذا يأخذ قلبه، وهذا يأخذ كذا، وهذا يأخذ كذا، فصار لا قيمةَ له، والورثة قد يطمعون في المال ولا يُبالون، والورثة لهم ماله، وليس جسمه، فلا يرثون جسمه، أمَّا التلاعب بجسمه وبيعه إلى الناس فهذا خلاف ما شرعه الله من احترام الميت، واحترام أعضائه، وأن الواجب تغسيله وتكفينه وتطيبه ودفنه على حاله في قبره.

“এই সহিহ হাদিসটির উদ্দেশ্য হলো, মৃত ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গ হারাম। হাদিসটি নির্দেশ করে যে, মৃত অবস্থায় হাড় ভাঙ্গা জীবিত অবস্থায় হাড় ভাঙ্গার সমতুল্য। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গা, শরীর কাটাছেঁড়া বা তার ক্ষতি করা জীবিত ব্যক্তিকে কষ্ট দেওয়ার মতোই গুরুতর। তাই এটি নিষিদ্ধ।

মুসলিম ব্যক্তি জীবিত এবং মৃত উভয় অবস্থাতেই সম্মানিত। তাই তাকে এমন কোনো কিছু দ্বারা কষ্ট দেওয়া বা তার আকার বিকৃত করা বৈধ নয় যা তার জন্য অপমানজনক।

এখান থেকে বোঝা যায় যে, জীবিতদের উপকারের জন্য মৃত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ। যেমন: তার হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি বা অন্য কোনো অঙ্গ নেওয়া। কারণ এটি মৃত ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। এটি মৃত ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুরতা, তার মর্যাদার লঙ্ঘন এবং তাকে অপমান করা।

বর্তমানে অঙ্গদানের প্রথা এবং দূরবর্তী দেশ থেকে অঙ্গ কেনার প্রচলন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এই বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ এটিকে বৈধ বলেছেন এবং বলেছেন যে, জীবিত ব্যক্তির উপকার মৃত ব্যক্তির চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। তারা যুক্তি দিয়েছেন যে, কিডনি রোগীসহ বিভিন্ন অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য মৃত ব্যক্তিদের অঙ্গ নেওয়া প্রয়োজন। তবে এই মতামতের বিষয়ে পর্যালোচনা প্রয়োজন।

আমার মতে, এটি বৈধ নয়। এটি মৃত ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গার মতোই এবং এর অর্থ মৃত ব্যক্তির দেহ নিয়ে খেলা করা। কেউ তার কিডনি নেবে, কেউ তার হৃদপিণ্ড, আবার কেউ অন্য কোনো অঙ্গ। এতে মৃত ব্যক্তির কোনো মূল্য থাকে না। উত্তরাধিকারীরা অর্থের লোভে এমন কিছু করতে পারেন যা শালীনতার পরিপন্থী। উত্তরাধিকারীরা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির মালিক হতে পারেন কিন্তু তার দেহের নয়। মৃত ব্যক্তির দেহ নিয়ে এমনভাবে খেলা করা বা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধানের পরিপন্থী। মৃত ব্যক্তিকে সম্মান দিয়ে গোসল করানো, কাফনে জড়ানো, সুগন্ধি দেওয়া এবং তাকে যথাযথভাবে কবর দেওয়া আল্লাহর বিধান।” [ শাইখের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট binbaz.org]

তবে বর্তমানে মানুষ হত্যা ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে তদন্তের স্বার্থে অথবা বিশেষ কোন সংক্রামক রোগের কারণ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে মৃতের দেহের অংশ বিশেষ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। এ কাজটি বৃহত্তর স্বার্থে জায়েজ বলে নির্ভরযোগ্য আলেমগণ ফতোয়া প্রদান করেছেন এবং এটি Islamic Fiqh Academy এর সিদ্ধান্ত।

মিশরীয় ফতোয়া বোর্ডকে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের উদ্দেশ্যে কবর থেকে মৃতদেহ উত্তোলন এবং তদন্ত করার বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা নিশ্চিত করেছে যে, এতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই।

ফতোয়ায় বলা হয়েছে যে, কিছু পরিস্থিতিতে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ধারণের জন্য মৃতদেহ উত্তোলন করা প্রয়োজন হতে পারে।
যেমন: যদি পরিবারের সন্দেহ হয় যে, ব্যক্তির মৃত্যু হত্যার কারণে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মৃতদেহ উত্তোলন করে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ এটি হকদারকে তার হক ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়।
[আল ওয়াতান নিউজ]

ময়নাদন্ত বিষয়ে হানাফি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হলো, “পোস্টমর্টেমের মাধ্যমে ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেক সময় শরিয়া প্রয়োজন ছাড়াই করা হয়। যদি শরয়ি প্রয়োজন ছাড়া করা হয় তাহলে তা নাজায়েজ। বিশেষ কোনো শরয়ি প্রয়োজনে যদি করতেই হয় তাহলে তা শরিয়তের নির্দেশনার ভিত্তিতে করতে হবে।

যেমন: সতরের ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং মৃতের সম্মানের প্রতি সজাগ থাকা অপরিহার্য। অনেক সময় অপরাধ নির্ণয়, অপরাধের ধরন এবং অপরাধী চিহ্নিত করার জন্য ময়নাতদন্তের প্রয়োজন হয়। এমতাবস্থায় প্রয়োজন অনুযায়ী ময়নাতদন্তের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু যেখানে মৃত্যুর কারণ সুস্পষ্ট বা অপরাধী নিজ অপরাধ স্বীকার করে অথবা মৃতের অভিভাবক ময়নাতদন্ত করাতে অস্বীকার করে এবং তারা হত্যা বিষয়ে সন্দেহকারী না হয়, তবে ময়নাতদন্ত করা যাবে না।” (কেফায়াতুল মুফতি ২/২০০; কিতাবুল ফাতাওয়া ৩/২৫০} [source: somoynews]

আল্লাহু আলাম।

Exit mobile version