উম্মে সুলাইম (রাঃ) বলেছিলেন-
“আমি এ মহাপুরুষের (মুহাম্মাদ সাঃ) উপর বিশ্বাস (ঈমান) স্থাপন করেছি, এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। যদি তুমি আমার অনুসরণ করে ইসলাম গ্রহণ করো তবে আমি তোমাকে বিয়ে করব। “
প্রত্যুত্তরে আবু তালহা সম্মত সুরে বলছিলেন- “ঠিক আছে, আমাকে একটু ভাবতে দাও। এরপর যথারীতি তিনি ইসলাম গ্রহণ রাজি হন এবং বলেন,
“আমি সেই ধর্ম গ্রহণ করেছি যার উপর তুমি আছ।”
উম্মে সুলাইম বিনতে মালহান এমন এক মুসলিম নারী ছিলেন যার জীবনাদর্শে নির্হিত আছে সমগ্র মুসলিম নারীসমাজের জন্য অনুধাবনযোগ্য মূল্যবান সংস্কার, তিনি বিচক্ষণতার চিহ্ন রেখে গেছেন জীবনের প্রতিটি বিদীর্ণ বিরাগ সময়ে। আবু তালহার সঙ্গে তাঁর বরকতময় সাংসারিক জীবনে নেমে এলো আর-রহিমের পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ সন্তান বিয়োগের মুহূর্ত।
আবু তালহার (রাঃ) সঙ্গে দ্বিতীয় দাম্পত্যের পরিণতিতে, আল্লাহ্ তায়ালা উম্মে সুলাইমকে (রাঃ) আবারও মাতৃত্বের আলিঙ্গন পাবার খোশ নাসীব দান করেন। তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের নাম ছিল আবু উমাইর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের বাড়িতে এলে আবু উমাইরের সাথে রসিকতা করতেন, তাকে স্নেহ করতেন।
আবু উমাইরের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাটানো সময়ের মধ্যে, কৌতুকপ্রবণ একটা ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
একদিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন, আবু উমাইর গোমড়া মুখে এককোণে বসে আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু উমাইরের নিষ্পাপ মুখে মন খারাপের ছায়া দেখে বললেন,
“এমন করে বসে আছ কেন?”
উম্মে সুলাইম বললেন, “তার খেলার সাথী নুগাইর পাখিটি মারা গেছে।”
তখন থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে দেখলেই কাব্য করে বলেন; “ইয়া আবা উমাইর- মা ফা’য়ালান নুগাইর- ওহে আবু উমাইর, তোমার নুগাইরটি কি করল?” ‘নুগাইর’ লাল ঠোঁট বিশিষ্ট চড়ুই সদৃশ এক প্রকার ছোট্ট পাখী।
এই ছোট আবু উমাইর-ই আর রাজ্জাকের ফয়সালার দরুন আসমানে ফিরে গিয়েছিল।
পরে আনাস বিন মালিক স্মৃতিচারণ করেন- আবু তালহা সেদিন বাড়ির বাইরে ছিলেন। বিষণ্ণতা ঘিরে ধরেছিল উম্মে সুলাইমের ঘর জুড়ে, কিন্তু শান্তচিত্তে তিনি বাড়ির অন্যান্যদের বলে দিলেন, আবু তালহা বাড়ি ফিরলে তাঁকে যেন সন্তানের মৃত্যু সংবাদ দেয়া না হয়।
যখন আবু তালহা বাড়ি ফিরলেন তখন জিজ্ঞেস করলেন, আবু উমাইর কেমন আছে; উম্মে সুলাইম বেদনাতুর সুর কন্ঠে উহ্য রেখে সহজ সুরে জবাব দিলেন, সে আগের থেকে অনেক ভালো আছে। আবু তালহা চেহারায় নিশ্চিন্তের ছাপ ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ পর উম্মে সুলাইম রাতের খাবার পরিবেশন করলেন, আবু তালহা খাবার আহার করলেন তৃপ্তভরে। তারপর পরিপাটি বেশে স্বামীর সম্মুখে দাঁড়ালেন উম্মে সুলাইম (রাঃ) হক্ব আদায়ের মাকসাদ পূরণে।
নির্বিঘ্নে স্বামীর প্রশান্ত নয়ন অবলোকনের পর তিনি বললেন,
“আপনি বলুন, যদি কোনো লোক কোনো বাড়িওয়ালাকে প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস ধার হিসেবে দেয়, এরপর সেই জিনিস ফেরত চায়, তবে তা বাড়িওয়ালার নিষেধ করার অধিকার আছে?”
আবু তালহা বললেন, “কখনো নয়।”
উম্মে সুলাইম বললেন, “তাহলে আপনি আপনার সন্তানের ব্যাপারে তাই মনে করুন।”
এ কথা শুনে আবু তালহার (রাঃ) অন্তর কেঁপে উঠল, নির্জীব হয়ে আসতে চাইলো দৃষ্টি; “তুমি আমাকে আমার অপবিত্র হওয়ার পূর্বে এ খবর কেন দাওনি?”
পুত্র বিয়োগ আবু তালহার (রাঃ) হৃদয়কে এক নিমিষে বিষণ্ণ মরুভূমি করে তুলেছিল, তিনি ছুটে যান তখনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটে। বিরহের ডুব দেয়া স্বরে তিনি পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করেন,
“তোমরা কি গত রাতে মিলন করেছো?”
আবু তালহা (রাঃ) বলেন, “হ্যাঁ।”
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দু’আ করেন;
“হে আল্লাহ! তাদের গত রাতের মিলনে বরকত দাও।”
সম্মানিত মুহাদ্দিসগণ থেকে উল্লেখ পাওয়া যায়, উম্মে সুলাইম এর সাথে রাসুলুল্লাহ-এর এমন কোনো আত্মীয়তা ছিল যার জন্য তিনি রাসূলুল্লাহ-এর সামনে পর্দা করতেন না। নানার পক্ষের আত্মীয়া ছিলেন; তিনি খালা অথবা দুধ মাতা ছিলেন, এমন উল্লেখ লক্ষ করা যায়। নবীপ্রীতি ছিল উম্মে সুলাইমের (রাঃ) জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাঝে মাঝে উম্মে সুলাইমের (রাঃ) ঘরে আসতেন। উম্মে সুলাইম (রাঃ) খাদ্য পানীয় প্রস্তুত করে রাখতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সযত্নে পরিবেশন করতেন।
যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্লান্ত হয়ে পড়লে শুয়ে কিছুটি বিশ্রাম নিতেন; তখন তাঁর শরীর থেকে বের হওয়া ঘাম বোতলে ভরে নিতেন উম্মে সুলাইম (রাঃ) এবং তা সুগন্ধির সাথে ব্যবহার করতেন।
উম্মে সুলাইম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এবং পিপাসার্ত মুজাহিদদের, আহতদের পানি পান করিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের পর হুনাইন যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। এ দিনগুলোতে তিনি গর্ভবতী ছিলেন, আল্লাহ্ তায়ালার তাঁকে আবদুল্লাহ নামক সন্তানের মাধ্যমে আবারও রিজ্বিকে বরকত দান করেছিলেন।
হুনাইনের যুদ্ধে একদিন তিনি তাঁর কোমরে একটি খঞ্জর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। আবু তালহা (রাঃ) তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলার পর, রাসূলুল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন,
“এ খঞ্জর দিয়ে কি করবে?”
উম্মে সুলাইম উত্তর দেন:
“আমি খঞ্জর এজন্যে রেখেছি যে, কোনো মুশরিক আমার কাছে আসলে এর দ্বারা পেট ফেঁড়ে দিব।”
একথা শুনে রাসূলুল্লাহ মুচকি হেসেছিলেন। উম্মে সুলাইমের (রাঃ) দ্বীনের খাতিরে ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা, বিচার-বিবেচনায় দ্বীনী ছাপ এবং দৃঢ় ঈমানের জন্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ দেন।
উম্মে সুলাইমের দ্বীনী আলোয় সমৃদ্ধ আদর্শ, আমাদের মু’মিনা নারীদের জন্য আত্মিক পরিশুদ্ধির অমূল্য উপাদান; তাঁর দ্বীনদারি ঈমান বহুল জীবনপাঠের ভ্রমণে যেন প্রাচীন অথচ নবীন তাকওয়া হৃদয়ে অগোচরে স্থান করে নেয়।
সহীহ মুসলিমের এক হাদিস রয়েছে। যেখানে আনাস বিন মালিক বর্ণনা করেছেন- নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
“আমি জান্নাত ভ্রমণে ছিলাম, সে সময় একজনের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাই; আমি জিজ্ঞেস করলাম সে কে?
তারা (ফেরেশতারা) প্রতুত্তরে বললেন, এ হলো গোমাইছা বিনতে মালহান। আনাস বিন মালিকের মাতা।”