ফিরে যাচ্ছি জাহেলি যুগের এমন এক বালিয়াড়ি পথের সূর্যাস্তে, যেখানে এক নির্ভয়া, সাহসিকা মু’মিনার জীবনের দৃশ্যপট স্পষ্ট হয়ে উঠছে; সোনালি রোদ্দুরে উদ্দীপিত ঝলমলে অক্ষরে লিপিবদ্ধ তাঁর নাম, উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান (রাঃ)।
তাঁর প্রথম সংসার জীবনের সূচনা ঘটেছিল মালিক বিন নাজরের সঙ্গে, স্বামীর অনিচ্ছা-অনীহা সত্ত্বেও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি ছিলেন আনসারীদের মধ্যে প্রথম সারির মুসলিম, যাঁরা কিনা প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলামকে জড়িয়েছিলেন হৃদয়ে। তাঁর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ সফর অবস্থায় মালিক বিন নাজরের নিকট পৌছায়, সে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে বাড়ি ফিরে আসে।
ফিরবার মাত্র স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ধর্মত্যাগী হয়ে গেছো!“
উম্মে সুলাইমের চোখে তখন ছিল সাবলীল উচ্ছ্বাস, যেন পৃথিবীর কোনো আতঙ্ক তাঁকে ছুঁতে পারবে না। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, “আমি মুরতাদ হইনি; বরং আমি অবশ্যই ইসলাম গ্রহণ করে একজন মু’মিনা হয়েছি।” তাঁর সাহসিক ঈমানের পরিচয় দীপ্তিময় প্রদীপ রূপে আবির্ভূত হয় জাহেলিপনায় সংকুচিত মরুর জমিনে।
আনাস বিন মালিকের (রাঃ) মতো বরেণ্য রাসূলপ্রেমী সাহাবীর মাতা ছিলেন, মুশরিক স্বামী যখন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতো যে, সন্তানকে দ্বীনী ইলমে উৎসাহী করে তোলাটা সন্তানকে বিপথে পরিচালনা করার সামি।
তখন তিনি বিনা ক্লেদে উত্তর দিতেন, “আমি আমার সন্তানকে জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছি, মোটেও তাকে বিপথে পরিচালিত করছি না; বরং তার জীবনকে আসমানী পন্থায় আলোকিত করে তুলছি।”
শামে কোনো এক কাজে মালিক বিন নাজর সফরে গিয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানে কোনো এক শত্রু তাকে হত্যা করে। এ সংবাদ উম্মে সুলাইম (রাঃ) পর্যন্ত এলে, তাঁর অভিব্যক্তি ছিল স্বাভাবিক; “কোনো সমস্যা নেই আমি আমার প্রিয় সন্তানকে বুকের দুধ ততদিন পর্যন্ত দিয়ে যাব যতদিন সে নিজেই দুধ পান না ছাড়বে। বড় না হওয়া পর্যন্ত আমি দ্বিতীয় কোনো বিয়ে করব না।” এ উক্তির আদলে উপলব্ধি করতে পারা যায়, তিনি সংকটে বিচলিত না হয়ে পরিস্থিতি বিবেচনায় সঠিক পদক্ষেপ নিতে জানতেন।
এরপর থেকে সন্তানকে নিয়ে একার সংসার একাই সামলেছেন এবং কালেমায়ে শাহাদাতের বুনিয়াদে গর্ভজাত সন্তানকে বড় করেছেন, শুধু তাই নয় মহিয়ান নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উৎসর্গ করেছিলেন আনাস বিন মালিককে (রাঃ)।
মায়ের প্রতি তাই আনাস বিন মালিকের (রাঃ) প্রকাশ এমন ছিল,
“আল্লাহ তায়ালা আমার মাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। নিশ্চয় তিনি আমাকে উত্তমরূপে লালন-পালন করেছেন।”
আনাসকে(রাঃ) বালেগ হবার পূর্বে, উম্মে সুলাইম (রাঃ) তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটে নিয়ে গিয়ে খেদমতের তাগিদে পেশ করেন, মদীনায় নবীর(সাঃ) পদধূলি পড়বার সৌজন্যে মদীনাবাসী নানাবিধ উপহারের ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু উম্মে সুলাইম তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে পেশ করেন উপহারস্বরূপ এবং অভিপ্রায় প্রকাশ করেন,
“হে আল্লাহর রাসূল। এ আনাস, আমার প্রিয় বৎস, আপনার সেবায় থাকবে। আমি তাকে আপনার সেবার জন্যে উৎসর্গ করছি। আপনি তার জন্য দু’আ করে দিন।”
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনাসের (রাঃ) জন্যে দু’আ করেন; “হে আল্লাহ! তাকে অধিক সম্পদ এবং অনেক সন্তান দান করুন। আর যা তাকে দান করেছেন তাতে বরকত দিন।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ দু’আ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কবুল করেছিলেন, এবং আনাসকে (রাঃ) রহমতের চাদর স্বরূপ একশোর অধিক সন্তান দান করেন; এমন একটি বাগানের মালিক বানিয়ে ছিলেন যেখানে বছরে দু’বার ফল জন্মাতো। সেখানে এক সুবাস মোহিত বৃক্ষও ছিল যা মিসক-আম্বরের চেয়েও অধিক সুগন্ধি ছড়াতো।
তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার কাহিনী ঈমানের উজ্জ্বল শশীর অমায়িক উদাহরণ, মোহরানা হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন দ্বীন ইসলামকে, রক্তিম শেষ বেলার আকাশ বোধ করি এমন মোহরানায় সন্ধি লগ্নের খবর রটিয়েছিল আসমান থেকে আসমানে।
প্রথম স্বামীর পরলোক গমনের পর যখন ইদ্দত পূর্ণ হয়েছিল তখন আবু তালহা (রাঃ), যিনি ছিলেন খাযরাজ গোত্রের স্বনামধন্য ব্যক্তি। যদিও তখন ইসলাম গ্রহণ করেননি তিনি; কিন্তু উম্মে সুলাইমকে (রাঃ) বিয়ের প্রস্তাব দেন।
তখন উম্মে সুলাইম বলেছিলেন,
“হে আবু তালহা, তুমি কি দেখো না যে, তোমাদের উপাস্য মাটির থেকে জন্মানো উদ্ভিদ?”
আবু তালহা (রাঃ) উত্তরে বলেছিলেন: “হ্যাঁ।”
তারপর উম্মে সুলাইম বিরূপ ভাবাপন্ন ভঙ্গিতে বলেছিলেন,
“তোমার লজ্জা হয় না! কোনো একি বৃক্ষের সামনে মাথা নত করতে। আর হ্যাঁ! যদি তুমি ইসলাম কবুল করো তবে তাই হবে আমার জন্য দেনমোহর।”